মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্বঃ২২

0
1086

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ বাইশ

“তুমি ভীষণ সুন্দর। শহরে যারা থাকে, তারা বুঝি এমন পরীর মতন হয়?’

বকুলের প্রশ্নে হেসে দেয় বিষাদিনী। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। অবশেষে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে,
-‘তোমরাও তো ভীষণ সুন্দর। তোমরা তো শহরে থাকো না, তবে এত সুন্দর কেনো?’

বকুল লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
-‘সত্যি আমরা সুন্দর!’
-‘হ্যাঁ, অনেক সুন্দর। তোমাদের সৌন্দর্যের কাছে আমি কেবলই তুচ্ছ।’

বকুল এহেন প্রশংসায় লজ্জায় নুইয়ে গেলো। কঙ্কণা মিটিমিটি হেসে ঠাট্টার স্বরে বলে,
-‘আরে বকুল,এত লজ্জা পাচ্ছিস যে? বিষাদিনী কন্যা তোর সাথে মজা করছে।’

বকুলের লজ্জা মিশ্রিত মুখে ভর করলো অবাক। কঙ্কণা’র কথা সে রীতিমতো বিশ্বাস করে অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললো,
-‘তুমি আমার ছোট্ট হৃদয় টা খন্ড খন্ড করতে পারলা শহুরে দিদি! এটুকু মেয়ের এটুকু হৃদয়টা’র সাথে এমন মজা?’

বকুলের কথার ধরণে আবার হেসে দেয় বিষাদিনী। তার তো হুটহাট হাসা’র স্বভাব না। তবে আজ এই সপ্তদশীদের সাথে মিশে এত চঞ্চলতা ভর করলো যে? কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাস আবার ফিরে আসছে যে?

তাদের হাসি ঠাট্টার মাঝে একজন থম মেরে বসে আছে। যার আপাতত এই হাসিখুশি মুহূর্তে মনযোগ নেই। তার কেবল কিছুক্ষণ আগের ঘটনা নিয়ে ভীষণ ঝড় হচ্ছে হৃদয়ে। হুটহাট অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে। অশ্রুকণাদের আর্তনাদ নেই বলে তা গোপনে রয়।

বিষাদিনী’র হাসি’রা হঠাৎ থেমে যায়। ধ্যান ভাঙে। সুতো ছিঁড়ে ভাবনার। তার সামনে মেয়েটা এমন চুপচাপ বসে আছে,আর সে কিনা হেসে যাচ্ছে!

বিষাদিনী উঠে এলো। তিস্তার সাথে থাকা জায়গা টুকু দখল করে বসলো। প্রায় ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
-‘কী প্লাবন দা’র উচ্ছ্বসিত প্রেয়সী,মন খারাপ কেনো?’

তিস্তারও এবার ধ্যান ভাঙলো। বাঁধ ভাঙলো কান্নার। বিষাদিনী’কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-‘আপন মানুষ কেনো বদলে যায় বুবু? আজ দাদী’র জন্য সবাই আমার মুখে চুন কালি ছিটানোর সাহস পেলো। কিন্তু আগে এই দাদী’র সামনে আমায় কেউ কিছু বললে তার রক্ষে থাকতো না। মানুষ গুলো বদলে না গেলে খুব বড় ক্ষতি হতো বুঝি?’

বিষাদিনী থমকায়। আসলেই,মেয়েটার দাদী আজ যা করলো তা সত্যিই আঁচড় কাটার মতন। এটুকু মেয়েটাকে কত কিছুই না সহ্য করতে হলো! অবশেষে গ্রামের মানুষ সিদ্ধান্ত নিলো,মাস্টারমশাই’র কাছে কোনো ছেলেমেয়ে পড়বে না। কিন্তু কঙ্কণা আর বকুল সে সিদ্ধান্তের বিপরীতে গেলো। ওদের সমবয়সী আরও কয়েকটা মেয়েও তিস্তার পক্ষে ছিলো। কিন্তু অভিভাবকদের নির্দয়তা’র কারণে টিকতে পারে নি। বকুল’ই তো কত মার খেলো। তবুও সিদ্ধান্তে ঠাঁই অটল রইলো। অবশেষে ওর মা সারাজীবনের মতন মেয়ের মুখ দেখবেন না পণ করে বাড়ি ফিরে গেলো।

বিষাদিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। নাহ্, এখন তার দুঃখ বিলাস করার সময় না। এই ছোট্ট মেয়েটা’কে বুঝাতে হবে। হতাশার শ্বাস ফেলে নতুন উদ্যমে বিষাদিনী বললো,
-‘এর জন্য কান্না করা লাগে? যে তোমার চোখের জলের কারণ, সে কখনোই তোমার আপন না। আপন মানুষ কখনো ব্যাথা দিতে পারে? বলো?’

তিস্তা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-‘নাহ্।’
-‘তবে! এত কান্না কিসের? কথায় কথায় কান্না করলে মানুষ নরম ভেবে খামচে যাবে। কেনো মানুষকে সে সুযোগ দিবে?’

এবার তিস্তার কান্না থামলো। হ্যাঁ, সত্যিই তো। মানুষকে কেনো কাঁদানোর সুযোগ করে দিবে সে? নাহ্, আর না। সে আর কাঁদবে না।

চোখের জল তৎক্ষনাৎ মুছে ফেললো তিস্তা। ফোলা ফোলা চোখ গুলো নিয়ে বিষাদিনী’র দিকে তাকিয়ে করুণ হেসে বললো,
-‘তুমি এত ভালো কেনো? আমি আরও ভেবেছি তুমি অনেক গম্ভীর হবে। এত ভালো হবে যে ভাবি নি।’

বিষাদিনী হাসে। আগের চেয়ে কণ্ঠ আরেকটু খাঁদে নামিয়ে বলে,
-‘কেনো? আগে খারাপ ভেবেছিলে বুঝি? তোমার মাস্টারমশাই’কে বিয়ে করবো বলে খারাপ হয়ে গিয়েছিলাম নাকি?’

তিস্তা চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই নারী কী সর্বজান্তা? মনের কথা জানলো কীভাবে?

তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে মিটিমিটি হাসলো বিষাদিনী। তিস্তার বাহুতে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বললো,
-‘কী ভাবছো? কীভাবে জানলাম তাই তো? তুমি তীব্র ভাবে ভালোবাসতে জানলেও ভালোবাসা’র সবটুকু বিশ্লেষণ জানো না। কোনো রমনী তার প্রিয় মানুষটার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না। তা সে রমনী প্রাপ্তবয়স্ক হোক বা তোমার মতন সপ্তদশী হোক। নিজের ভালোবাসার ভাগ কেউ দিবে না।’

তিস্তা মুগ্ধ হয়ে শুনে বিষাদিনী’র কথা। মানুষটার মাঝে এত তৃপ্ততা!

পরক্ষণেই তিস্তা মুগ্ধ কণ্ঠে বললো,
-‘তুমি না অনেক ভালো।’
-‘মাস্টারমশাই’কে যদি আমি নিয়ে যাই,বিয়ে করি, তখনও এমন বলবে তো?’

বিষাদিনী’র কথায় ভড়কে যায় তিস্তা। ভয় জাগে হৃদয় কোণে।

কঙ্কণা আর বকুলও এবার এগিয়ে এলো। বকুল’কে দেখে তিস্তা’র এক ভাবনা কেটে আরেক ভাবনার উদয় হলো। সাথে সাথে সে প্রশ্ন করলো,
-‘বকুল,তুই এখন কোথায় থাকবি? জেঠিমা যে তোকে বাড়ি যেতে না করলো?’

-‘কেনো,আমার সাথে থাকবে। ওর মায়ের কাছে এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ওর যে সদ্য প্রতিবাদী মনোভাব টা জন্মেছে তা ভোঁতা হয়ে যাবে তাহলে। ও নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে অবশ্যই। মেয়ে বলেই কী পিছিয়ে যাবে নাকি?’

বিষাদিনী’র কথায় সবাই অবাকে হা হয়ে গেলো। বকুল বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-‘সত্যিই তোমায় সাথে আমাকে রাখবে!’

বিষাদিনী মুচকি হেসে বকুলের গাল টেনে বললো,
-‘একদম সত্যি। তোমার থাকতে সমস্যা হবে না তো?’

বকুল জলে টইটুম্বুর হওয়া চোখ নিয়ে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বললো,
-‘একদম সমস্যা হবে না। তুমি যে আমার মাথার ছাদ হয়ে দাঁড়িয়েছো সেটাই অনেক।’

বিষাদিনী হেসে এবার কঙ্কণা’র দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে বললো,
-‘কী কঙ্কণা? তুমি কোথায় থাকবে? তোমার মা বাড়িতে প্রবেশ করতে দিবে তো? না-হয় আমার সাথে থাকতে পারো।’

-‘আমার তো নিজের মা নেই। তবে,বাড়িতে বাবা’র দ্বিতীয় পক্ষের বউ আছে। তার অবশ্য আমার সম্পর্কে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মোড়লের মেয়ে বলে সবাই ভাবে কী রাজকীয় ভাবে আমি থাকি। কিন্তু যার মা নেই, তার তো দুনিয়া অন্ধকার। এটা কী সাধারণ মানুষ বুঝে?’

বিষাদিনী’র বুকের বা’পাশে ক্ষাণিক মোচড় দিলো৷ মেয়েটা’র মা নেই?

হঠাৎ করে বিষাদিনী’র রাজ্যের মায়া জন্মালো কঙ্কণা’র জন্য। মেয়েটাকে জাপ্টে ধরলো বক্ষ মাঝে। মেয়েটার কী দারুণ কষ্ট! বকুল আর তিস্তাও জড়িয়ে ধরলো ওদের। মানুষের উপর দেখে ভিতর বিচার করা সত্যিই সম্ভব না।

____

রাত নেমেছে ধরণীর বুকে। বকুল আর কঙ্কণা রয়ে গেছে বিষাদিনী’র সাথে। কঙ্কণা’র বাবা অবশ্য সন্ধ্যার দিকে লোক পাঠিয়ে ছিলো কিন্তু কঙ্কণা যায় নি। রয়ে গেছে বিষাদিনী’র সাথে। মোড়ল সাহেব অবশ্য কোনো হেলদোল দেখান নি। মেয়ে যেভাবে চলতে চায় সেভাবেই চলে। এতে বিশেষ বাঁধা তিনি দেন না। দিয়েই বা লাভ কী? সংসারে দারুণ ঝামেলা ছাড়া বিশেষ কিছুই হবে না।

তিস্তাকে প্লাবন দিয়ে এসেছিলো। মেয়েটাও হয়তো থাকতো যদি কলঙ্কিনী না হতো।

আজকে আকাশে বড় রূপোর থালার মতন একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় বিষাদিনী কলমে ফুটিয়ে তুলেছে বিষাদ। আবারও দু’লাইনের কবিতা জ্বলজ্বল করছে সাদা কাগজটাতে। কী বেদনা সেথায়। সাথে দু ফোঁটা চোখের জল। বিষাদিনী লাইন গুলো আবার পড়লো,

“মানুষ দেখলো বিশাল হাসি,দুঃখ তো অন্তরে চাপা,,
ভীষণ অশ্রু না ঝড়লে,কষ্ট নাকি যায় না মাপা!”

যথারীতি পৃষ্ঠা টা ছিঁড়ে গুটিয়ে ফেললো হাতের ভাজে। ছুঁড়ে ফেললো জানালার বাহিরে। বিষাদ কমানোর নতুন উপায় যেনো এটা।

‘এভাবে বুঝি দুঃখ কমানো যায়?’

হঠাৎ চমকে উঠলো বিষাদিনী। অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘কঙ্কণা! ঘুমাও নি?’

কঙ্কণা এবার বিষাদিনী’র পাশে এসে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বললো,
-‘ঘুম যে আসে না। তুমি যে আমার ঘুম কেড়েছো।’

বিষাদিনী অবাক হয়। অবাক কণ্ঠে বলে,
-‘আমি ঘুম কেড়েছি! কীভাবে?’

কঙ্কণা হঠাৎ যেনো ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। শক্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আমার মাস্টারমশাই’কে কেড়ে নিতে চেয়ে।’

বিষাদিনী অবাক হয়। কঙ্কণার হঠাৎ এহেন পরিবর্তন কেনো? হঠাৎ করে গভীর রাতে এত হিংস্রতা কেনো?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here