মনের মানুষ❤️পর্ব-১৮

0
661

#মনের_মানুষ ❤️
#অষ্টাদশ_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি 🌸

একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় প্রান্তিক এর বাইক।আহেলি নামতেই ওকে প্রান্তিক সামনে এগিয়ে যাওয়ার ইশারা করে…..প্রান্তিকের সাথে হাঁটতে শুরু করে আহেলি।সদর দরজায় এসে প্রান্তিক দরজায় করাঘাত করে,বেশ খানিকক্ষন পর দরজা খুলতেই ওরা একজন মহিলার মুখোমুখি হয়……আহেলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মহিলাটির দিকে।একদম প্রান্তিকের মুখটা বসানো…..বয়স বাড়লেও কি অপূর্ব দেখতে।মহিলাটি প্রান্তিককে দেখে হাসলেও আহেলির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুচকায়,পরক্ষনে দরজা থেকে সরে গিয়ে ওদেরকে ভেতরে যেতে বলে।

আহেলি জড়তার সাথে প্রান্তিকের সাথে ঢোকে…..ছোট্ট বসার ঘরের একটা সোফায় প্রান্তিক আর আহেলি বসতে উনিও একটা টুল নিয়ে বসেন।প্রান্তিক আহেলির দিকে ফিরে বলে,,,,

“মা…..এ হলো আহেলি।আর আহেলি এতক্ষন আমি যার কথা বললাম আপনাকে ইনিই আমার মা।”

আহেলি উঠে গিয়ে মহিলার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই উনি আহেলির মাথায় হাত রেখে বললেন,,,

“তুমিই তাহলে আহেলি?যেমন মিষ্টি নাম আর তেমন মিষ্টি তুমি।প্রান্তিকের সব বর্ননা তো মিলে যাচ্ছে।”

প্রান্তিকের মায়ের কথায় আহেলি অবাক হয়ে তাকাতেই প্রান্তিক স্মিত হেসে বললো,,,,

“শান্তিনিকেতনে বেড়ানোর কথা মায়ের কাছে বলেছিলাম তখনই তোমার কথা বলেছি।”

“তুই এসময় হটাৎ করে আসবি তো জানতাম না।একটু আগেই আমি খেয়েছি আর সুব্রতও বেরিয়ে গেলো।”

“আমি জানতাম সুব্রত আঙ্কেল বেরিয়ে যাবেন….যাক অন্যদিন কথা হবে।যে জন্য এলাম….আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে গো মা।আমি হসপিটাল থেকে ফিরছি আর আহেলি এক্সাম দিয়ে….প্লিস খেতে দাও।”

প্রান্তিক এর কথায় আহেলি লজ্জ্বায় পরলো।এই ছেলেটা নিজের মায়ের সামনে আহেলি কে হ্যাংলা দেখাতে চায় নাকি?

“সত্যিই প্রান্ত তুই পারিস…..আচ্ছা তোরা দুজনই হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে আয়।আমি ততক্ষন ভাত বাড়ি।”

“হ্যাঁ সেই ভালো….আহেলি আসুন।”

বেসিনে হাত ধুয়ে আহেলি প্রান্তিকের কাছে সরে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,,,,,

“আপনি কেমন মানুষ হ্যাঁ?এভাবে কেউ বলে?আপনার মায়ের সামনে আমার কি ইমেজ তৈরি হলো?”

“খিদে পেলে সেটা চেপে রাখতে নেই….আর মা তো মা’ই হয়।এখানে আবার লজ্জ্বা কিসের?”

আহেলি আর প্রান্তিক দুজনই খেতে বসে…..প্রান্তিকের মা স্টিলের থালায় ভাত আর বাটিতে করে মাছের ঝোল এগিয়ে দিতে দিতে বলেন,,,,

“এরকম হুট করে এলে হয়?ভাগ্যিস আজ অবেলার কথা ভেবে রান্না করেছিলাম…..যদি আগে বলতিস তাহলে অন্তত কিছু বানানো যেতো।”

“না আন্টি এটাই ঠিক আছে……আবার অন্যকিছুর কি দরকার?”

“তা বললে কি হয়?তুমি আমার বাড়িতে প্রথম এলে…..এইই ছেলেটা তো আগে থেকে কিছু বলবেও না।”

“আরে ওর সাথে দেখা হবে কি জানতাম নাকি?আমি তো সোজা হসপিটাল যেতাম।”

“তা এসে ভালোই করেছিস…..কদিন ধরেই তোকে ডাকবো ভাবছিলাম।”

“তুমি ভাবলে আর আমি চলে এলাম।একেই তো নাড়ির টান বলে মা।”

প্রান্তিকের কথায় সকলের মুখেই হাসি ফুটে ওঠে।আহেলি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্রান্তিকের মায়ের দিকে…..লক্ষী প্রতিমার মতো মুখটা আর তেমনই ব্যবহার।

খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রান্তিক আর আহেলি ফিরে যাওয়ার কথা বললে প্রথমে প্রান্তিকের মা রাজি হয় না….অন্তত প্রান্তিকের সুব্রত আঙ্কেল আসা অবধি ওয়েট করতে বলেন কিন্তু প্রান্তিক বলে ওকে যেতেই হবে।ঠিক বেরোনোর সময় বছর আটেকের একটা ছেলে এসে ঢোকে দরজা দিয়ে….কাঁধে ব্যাগ পরনে স্কুলড্রেস।প্রান্তিককে দেখেই এগিয়ে এসে বলে,,,,

“দাদাভাই তুমি?তুমি কখন এলে?ভাগ্যিস আজ তাড়াতাড়ি স্কুল শেষ হয়ে গেছিলো….আর এই দিদিটা কে?”

ভাই ধীরে!তুই তো একেবারে প্রশ্ন-বিচিত্রা হয়ে উঠছিস।আমি খেতে এসেছিলাম…আর এই দিদিটা….

প্রান্তিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই ছেলেটা বলে,,

“এটা কি বৌদিভাই নাকি গো দাদাভাই?”

“আহঃ সৌর….কি হচ্ছেটা কি?স্কুল থেকে ফিরেই শুরু হলো?যাও ড্রেস চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে নাও…..”

প্রান্তিকের মায়ের কথায় ছেলেটা মুখটা ছোটো করে নিতে আহেলি হালকা হেসে বললো,,,,

“আমি তোমার দাদাভাই এর বন্ধু হই….তোমার নাম কি?”

“আমি সৌরিক…..ক্লাস থ্রি তে পড়ি।”

“বাহঃ।আমি আহেলি…..আর তোমার দাদাভাই ভীষণ পচা।তোমার কথা আমায় একবারের জন্য বলেনি….তাহলে তোমার জন্য তো কিছু আনতাম।”

“ওর জন্য আর কিছু আনার দরকার নেই আহেলি….ওকে আমি প্রতি সপ্তাহে চকলেট দিয়ে যাই।এবার কিন্তু বেরোতে হবে আমায় নাহলে ডিউটি জয়েন করতে লেট হয়ে যাবে।”

ওনাদের সকলকে বিদায় জানিয়ে আহেলি আর প্রান্তিক যখন ফেরার পথ ধরলো তখন বিকেল হয়ে গেছে।প্রান্তিকের পেছনে বসে আহেলি একদৃষ্টে প্রান্তিককে দেখতে থাকে……এই ছেলেটা সকলের চেয়ে আলাদা।ওদের বাইকটা একটা গঙ্গার ঘাটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই আহেলি বলে ওঠে,,,,

“একবার ঘাটে যাবেন?জাস্ট কয়েকটা মিনিটের জন্য যদি যাই তাহলে কি খুব দেরি হবে আপনার?”

আহেলি কে কোনো উত্তর না দিয়ে প্রান্তিক আবারো ঘাটের কাছে ফিরে যায়।দুজনে একটা ঘাটের ওপর এসে বসে……আহেলি গঙ্গার ওপরের ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে,প্রান্তিক কয়েকপলক আহেলির দিকে তাকিয়ে থাকার পর নিজে থেকেই বলে,,,,

“আমার মাকে দেখে খুব অবাক হয়েছেন তাই না?ভাবছেন আসলে কি ঘটনা?”

“ঠিক তা নয় প্রান্তিক…..আমি খুব অবাক হয়েছি আপনাকে দেখে।আজকালকার দিনে এও সম্ভব?কেউ পারে এতো সহজে সবটা মানতে?”

“এখানে মানা না মানার কি কোনো ব্যাপার আছে আহেলি?প্রত্যেকের অধিকার আছে তার নিজের জীবনটা সাজিয়ে নেওয়ার….এই যে আমি,আজ হার্ট সার্জেন্ট সেটা কিন্তু আমি নিজের ইচ্ছায় হয়েছি আর সবসময় পাশে মাকে পেয়েছি।”

“আপনি মায়ের সাথে একসাথে থাকেন না কেনো প্রান্তিক?”

“আগেই তো বললাম আমার যখন পাঁচবছর বয়স তখনই বাবা মা আলাদা হয়ে যায়…..বাবা একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছিলেন,সেটা বাবা মাকে জানায় আর ডিভোর্স চায়।আমার মা খুব সাধারণ জানেন তো আহেলি….সামান্য গৃহবধূ ছিলেন।স্বাভাবিক ভাবে মা প্রথমে ব্যাপারটা মানতে পারেননি তারপর মায়ের মনেহয় এতদিন সংসার করার পরে যদি বাবা অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তাহলে তাকে কি আর ফেরানো যায়?তাই মা বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে ওবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে…..মামাবাড়ি তেও মাকে সহজে কেউ মানছিলো না।সকলেই বিয়ে ভাঙার জন্য মাকে দোষ দিতো।আমি তখন ছোটো….সবটা দেখতাম।রোজ কিভাবে খাওয়ার সময় চোখের জল ফেলতো….মাকে দিয়ে মামীরা সবকাজ করিয়ে নিতো।তখনই মায়ের একজন বন্ধু মাকে বলে একটা কাজ শুরু করতে…..মা মাধ্যমিক পাস,তারপর আর পড়া হয়নি মায়ের তবে সেলাই খুব ভালো জানতেন।মায়ের ওই বান্ধবী মাকে একটা বুটিকে কাজ জোগাড় করে দেন…..তারপর মা আমায় নিয়ে একটা ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে থাকতে শুরু করেন।এভাবেই কাটছিলো আমাদের জীবন…..এরমাঝে আলাপ হয় সুব্রত আঙ্কেলের সাথে।সুব্রত আঙ্কেলের একটা বই আর জেরক্সের দোকান….ভাইদের মানুষ করতে গিয়ে আর ওনার বিয়ে করা হয়নি।মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ায় মা কিছুতেই রাজি হয়নি…..আমার কথা ভেবে পিছিয়ে এসেছিলো কারণ আমি তখন উচ্চ-মাধ্যমিক দিয়েছি।ওই বয়সে আবার কেউ বিয়ে করে?মা সবসময় আমায় সবকিছু বলতো তাই ওই কথাটাও বলে ফেলে।আমি জানতাম আমার মায়ের মনেও একটা সংসার করার সুপ্ত বাসনা ছিলো যা কোনোদিন পূরণ হয়নি….ডাক্তারি পড়ার জন্য আমি দিল্লি চলে যেতাম আর মাকে একাই থাকতে হতো এখানে।তাই আমি ঠিক করলাম এবার মায়ের জীবনটা গুছিয়ে দিতে হবে…..একদিন আমি নিজেই যোগাযোগ করলাম সুব্রত আঙ্কেলের সাথে….কথা বললাম,বুঝলাম মানুষটা খুব ভালো হয়তো প্রাচুর্য নেই কিন্তু সুন্দর একটা মন আছে।বাড়ি ফিরে যখন মাকে আমি কথাগুলো বললাম মা কিছুতেই রাজি হয়নি…..সমাজের কথা ভেবে।অনেক বোঝানোর পর শেষঅব্দি রাজি হলো মা….দিল্লি যাওয়ার আগেই রেজিস্ট্রি হয় সুব্রত আঙ্কেল আর মায়ের।ওটা সুব্রত আঙ্কেলের বাড়ি….আমি যখন ছুটিতে ফিরলাম তখন মায়ের মুখটা খুব উজ্জ্বল লাগছিলো জানেন।এতদিন হাসলেও সেই হাসিতে খুশির পরিমান খুব কম থাকতো…..সেদিন আমিও খুব খুশি হয়েছিলাম।যখন সৌরিক হয় তখন আমার বন্ধুরা আমায় নিয়ে খুব ঠাট্টা ইয়ার্কি করতো,আমি পাত্তা দিইনি।যে মা আমায় ছোট্ট থেকে কষ্ট করে বড়ো করে তুললো….ডাক্তার হওয়ার সুযোগ করে দিলো তাকে সুখী দেখার জন্য যদি হাসির খোরাক হতে হয় তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই আমার।আমি মাঝেমধ্যে ওদের সাথে থাকি আবার নিজের ফ্ল্যাটেও থাকি…..

কথা শেষ করে প্রান্তিক আহেলির অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,,,

“অবাক হচ্ছেন আহেলি?,ভাবছেন ছেলে হয়ে মায়ের বিয়ে তার সন্তান কিভাবে মেনে নিয়েছি?আচ্ছা মা যদি ছেলের জন্য নিজের জীবনের সমস্ত আনন্দ আহ্লাদ ভুলে যেতে পারে তাহলে ছেলে কেনো মায়ের খুশির জন্য এটুকু করতে পারবে না?হ্যাঁ এটা ঠিক যে আমার মা আর আমায় নিয়ে প্রচুর গসিপ হয়…..তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।পৃথিবীতে সকলের অধিকার আছে ভালোবেসে তার মনের মানুষের সাথে সংসার করার।আমার মা বা বাদ যাবে কেনো?”

প্রান্তিকের কথার উত্তর না দিয়ে আহেলি একদৃষ্টএ তাকিয়ে রইলো ওরদিকে…..একটা অতি সাধারণ ছেলে যার মধ্যে অনেক অসাধারন গুন রয়েছে।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here