মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৩৭

মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৩৭
#আনিশা_সাবিহা

–“আমি খুব ভালো করে জানি আয়াশ রায়হান এখনো তোমাকে সেভাবে ছুঁয়ে দেখেনি। মানে তুমি এখনো ভার্জিন। আর সেই হিসেবে ভার্জিন আর তোমার মতো সুন্দর গঠনের মেয়ের দাম বাজারে চড়া মানের হবে। আর তোমাকে যেহেতু বিদেশি লোকের দলের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেহেতু ওরা তোমাকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করবে।”

নীলাদ্রের প্রতিটা কথাতে ঘিনঘিন করে উঠল আমার শরীর। দাঁতে দাঁত পিষে রাগ আর দুঃখ নিয়ে কথাগুলো শুনলাম। তারপর কান্নামাখা গলা নিয়ে চিল্লিয়ে বললাম,
–“এসব বিশ্রী কথা বলতে বাঁধছে না তোমার? এতোটা খারাপ তুমি কবে থেকে ছিলে? শেষমেশ কিনা আমাকে বিক্রি করতে চাইছো? আমায় কি পেয়েছো তুমি? বাজারের পণ্য?”

–“মেয়েরা আমাদের কাছে পণ্যই। এমন পণ্য যা দিয়ে নিজের সকল তৃষ্ণা মেটে। তোমার মতো মেয়ে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। আর খারাপের কি দেখলে? তুমি যতটা জঘন্য ভাবছো তার থেকে দশগুন বেশি জঘন্য। এই মেয়ে মেয়ে খেলা তো গত দুইবছর ধরে করে আসছি। আজকের খেলাটা স্পেশাল। তবে হ্যাঁ আমার ওতো মেয়ের প্রতি লোভ নেই বাবা। আমার তো টাকা পেলেই হলো।”

শেষ কথাটা ঠাট্টা করেই বলল নীলাদ্র। ওর প্রতিটা কথা আমাকে বিস্মিত করেই চলেছে। আমি বুঝতেই পারছি না এটা সত্যি নীলাদ্র নাকি অন্য কেউ? এটা কি সেই নীলাদ্র যে আমাকে ভালোবেসে আমায় একবার দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠত? যে কিনা আমি অন্ধ হলেও তা নিয়ে বিন্দুমাত্র কথা শোনাতো না? বিস্মিয়ের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়ে আমি থেমে থেমে বললাম,
–“তু…তুমি না আমাকে ভালোবাসতে নী…নীলাদ্র?”

নীলাদ্র এমনভাবে হেঁসে দিল যেন আমি কোনো ঠাট্টার কথা বলেছি। আমি ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে রইলাম। আমার মন শুধু চাইছে আয়াশের কাছে যেতে। আর চোখজোড়া বিস্ময়ে থমকে গেছে। এতো ধাক্কা একসঙ্গে নিতে পারছি না আমি। নীলাদ্র হাসতে হাসতে বলল,

–“তুমি কি ভেবেছিলে আনিশা? আমি তোমায় ভালোবেসেছি? আমার মনে হয় না ভালোবাসা বলতে আদোও কিছু হয় বলে। টাকা-পয়সা মানেই আসল ভালোবাসা। আর তোমার সঙ্গে এই ভালোবাসা, ভালোবাসা খেলাও চালিয়ে গেছি শুধু টাকার জন্যই। নয়ত তোমার মতো একটা গরীব আর অন্ধ মেয়েকে একটা পাগল ছাড়া কে ভালোবাসতে পারে বলো তো? অবশ্য একটা পাগল আছে। কিন্তু আমি সেই পাগলের কাতারে পড়ি না। আমি টাকা চাই। আমি নিজের লাক্সারি চাই। তোমাকেও সেই কারণেই এখানে এনেছি। তোমাকে বিক্রি করতে এনেছি। ইউর টাইম ইজ ওভার।”

আমার মাঝে কোনো হেলদোল নেই। রোবটের মতো বসে রয়েছি। শুধু ভাবছি কতটা নিচু মস্তিষ্কের মানুষের সঙ্গে একসময় ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি। যদিও সেটা কিশোরী মনের আবেগ ছিল। কিন্তু ভাবতেও নিজের প্রতি একটা চাপা রাগ আসছে আমার। চোখের পলকও পড়ছে না চমকে। এতো বড় চমক কোনোদিনই খাইনি আমি। নীলাদ্র আবার বেশ মনোযোগ দিয়ে বলতে শুরু করে,

–“তুমি বলতেই পারো যে তাহলে আগে কেন তোমায় পাচার করিনি। এর কারণ হচ্ছে তোমার বয়স আর তোমার বুদ্ধি! তুমি ওই বয়সে পালিয়ে যেতে না। সেই সঙ্গে তোমার বয়সটাও ম্যাটার করে। ১৭-১৮ বছরের মেয়েরা এই লাইনের জন্য পারফেক্ট হয়। সেখানে তোমার বয়স ভীষণ কম ছিল। যখন তোমায় নিয়ে প্লান করি কোথা থেকে উটকো আয়াশ রায়হান এসে তোমার প্রতি পাগল হয়ে একপ্রকার জোর করে বিয়ে করে। বাট তোমায় এবার পাচারের প্লান কিন্তু আমি করিনি। আমার বস করেছে। বসের সঙ্গে পুরোনো শত্রুতা আছে তোমার পাগল স্বামী আয়াশের। আর যখনই বস জানতে পারে তার দুর্বলতা তোমার জন্য একজন কমবয়সী মেয়ে তখনই উনি এক ঢিলে দুই পাখি মারার প্লানটা করেই ফেলেন।”

আমি আর একটা কথাও বলছি না। ওর দিকে চেয়েই আছি। এই পরিচিত মুখের পেছনে এতো অপরিচিত মুখ লুকিয়ে থাকবে সেটা সম্পূর্ণ অজানা ছিল। একপ্রকার পাথর হয়ে গেলাম আমি। কি করে পাব মুক্তি আর আয়াশের কি হবে? উনি বাঁচবেন তো?

দরজা খোলার শব্দ এলেও আমি চোখ তুলে তাকালাম না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে আমার। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। নিচদিকে তাকিয়ে থাকায় একজোড়া পা আমার নজরে পড়ল। তৎক্ষনাৎ নীলাদ্র লোকটিকে বস বলে সম্মোধন করতে শুরু করল।

–“বস? আমি আপনার কাজ করে দিয়েছি। আয়াশও ওদিকে প্রায় মরেই গিয়েছে ধরে নিন। আমাকে একদিন আধমরা করে আনিশাকে নিয়ে চলে গেছিল। আজকে সব ফিরিয়ে দিয়েছি।”

আয়াশের মারা যাবার কথা শুনতেই নড়েচড়ে উঠে ভয়ে ভয়ে তাকালাম আমি। চোখটা ভরে উঠল পানিতে। রশির বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছটফট করতে করতে বললাম,
–“বিশ্বাসঘাতকের ক্ষমা হয় না নীলাদ্র। আমাকে ছেড়ে দাও নয়ত…”

চোখ রাঙিয়ে বললাম কথাগুলো। তখনই আমার গাল খুব জোরে নিজের হাত দিয়ে টিপে ধরল সেই অপরিচিত ব্যক্তিটি। ব্যাথায় কাতরে উঠলাম আমি।সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করলাম লোকটাকে। মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ। চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

–“ওহ তাহলে এটাই আয়াশের দুর্বলতা। আমি তো জেল থেকে ছাড়া পাবার পর ভেবেছিলাম ওর কোনো দুর্বলতা নেই। কারণ ও তো পরোয়া করেই না। কিন্তু ওর বাড়িতে যে এতো সুন্দর জিনিস লুকিয়ে রেখেছি জানতেই পারিনি। এনিওয়ে, এই মেয়ে আমরা ছেড়ে দিলে কি করবি তুই? কিছুই করতে পারবি না।”

রাগে ও ঘৃণায় গা রি রি করছে আমার। তাই এক দলা থুথু এনে নিক্ষেপ করি সরাসরি এই নিচু মানসিকতার লোকটাকে। সঙ্গে সঙ্গে গাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দূরে সরে যায় লোকটা। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকি আমি। লোকটা চোখমুখ জড়িয়ে ফেলে। পকেট থেকে রুমাল বের করে থুথু মুছে নিয়ে আচমকা সজোরে আমার বাম গালে থাপ্পড় মারে। এতো জোরে থাপ্পড় লাগাতে ছিটকে পড়তে গিয়েও পড়লাম না বাঁধা থাকার কারণে। ঠোঁটের কোনা দিয়ে টুপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলাম এবার। অস্পষ্ট গলায় বললাম,

–“কে আপনি? কেন এমন করছেন আমাদের সাথে? ছেড়ে দিন। আয়াশ বাঁচবেন না অপারেশন না হলে। দোহাই লাগে ছেড়ে দিন এবার।”

–“আমি রক্তিম বাহাদুর। যাকে এক বছর আগে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল আয়াশ। প্রথমে আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে পরে দলটাই পাল্টে ফেলল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আগে আগে জেল থেকে বেরিয়েছি। আমার ব্যবসা সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে আয়াশ রায়হান তো পার পেতে পারে না। একবছর তোকে ছাড় দিয়েছি। সেদিন একবছর আগে নীলাদ্র তোকে তুলে নিয়ে আসতে গেছিল। কিন্তু আমি ওকে বলেছিলাম যে আমি না বের হওয়ার পর্যন্ত এসব যেন না করে। তাহলে ধরা পড়ে যেতে পারে। ও সেদিন আমার এসএমএস পেয়েই চলে আসে।”

–“তাই বলে এভাবে প্রাণে মারবেন না আয়াশকে। আমায় যেতে দিন দয়া করে।”

আমার কথা যেন কানেই গেল না রক্তিম বাহাদুরের। বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করে করে বললেন,
–“ছেড়ে দিলেই তো আর বাংলা সিনেমার মতো তুই গেলেই আয়াশ সুস্থ হয়ে উঠে তোকে জড়িয়ে ধরবে না নিশ্চয়। টাকা লাগবে টাকা। টাকা কোথা থেকে পাবি?”

–“যাই হোক পেয়ে যাব। ছেড়ে তো দিন!”

–“আচ্ছা শোন। তোর সঙ্গে একা ডিল করা যাক। দারুণ একটা ডিল।”

সন্দিহান হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম এবার। ডিল? দেখে তো মনে হয় না মুখ থেকে ভালো কিছু বের হবে বলে। তবুও ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। লোকটা বলল,
–“তুই আমাদের কথামতো বিক্রি হয়ে যা। আজকে আমার বাংলোতে বিদেশি দল আসবে মেয়ে কিনতে। তাদের মন খুশি করে দে নাচগান করে। দ্যাটস ইট। ওরা তোকে টাকাই ভরিয়ে দেবে আর টাকা পেলে না হয় ওখানে জমা দিয়ে দিস। কিন্তু মনে রাখবি একবার বিক্রি হয়ে গেলে পেছন ফিরে তাকাতে পারবি না।”

এসব শুনে চক্ষু চরকগাছ আমার। ঘাম বেয়ে পড়ে গেল। চিৎকার করে ঘৃণার সঙ্গে বললাম,
–“খবরদার আমার সঙ্গে এমন কিছু করবার চেষ্টা করেছেন তো! আর এসব জঘন্য ডিল মুখেও আনলে আপনার জ্বিহ্বা ছিঁড়ে ফেলবে আয়াশ। উনার পাগলামির ছিটেফোঁটাও এখনো দেখেননি।”

আমার কথায় নীলাদ্র ও রক্তিম বাহাদুর দুজনেই তাকাতাকি করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। নীলাদ্র বিদ্রুপ করে বলেই দিল,
–“আয়াশকে কি ভাবো তুমি? ফিল্মের হিরো? জোরে জোরে ডাকবে আর সে আধমরা হওয়া থেকে বেঁচে উঠে এসে ফাইট করে তোমায় নিয়ে চলে যাবে? এই জগতে একবার যে আসে সে কখনো নিজের সুন্দর জগতটা দেখতে পায় না আনিশা। তুমিও পারবে না। তুমি চাও আর না চাও তোমায় নিজেকে বিক্রি করতে হবে।”

–“করব না। আই উইল কিল ইউ ব্লাডি বিচ! মেরে ফেলব তোকে।”

আমার কথার কর্ণপাত করল না কেউই। আমিও রাজি না এসব নোংরা কাজকর্মে। নিজের সম্মান খোয়াতে চাই না। এরচেয়ে মৃত্যু হয়ত শ্রেয় একটা নারীর কাছে। রক্তিম বাহাদুর দুটো মেয়েকে ডেকে পাঠালেন।

–“এই মেয়েকে রেডি করিয়ে দাও। সন্ধ্যার আয়োজনে এই মেয়েই থাকবে প্রধাণ আর্কষণ!”

–“রেডি মানে? আমি রেডি হবো না। আমাকে মেরে ফেললেও আমি কারো সামনে যাব না। আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছেন তো খুন করে ফেলব।”

কথাটা বলতে না বলতেই আরো একটা থাপ্পড় পড়ল আমার অন্য গালে। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলাম আমি।
–“মেয়েদের হাতে তৈরি হয়ে নিলে ভালো। নয়ত নীলাদ্র আসবে তোকে তৈরি করাতে। ব্যাপারটা তোর ভালো লাগবে না হয়ত। দশ মিনিটে তৈরি হয়ে নে। আর নীলাদ্র! ঘড়ির কাটা গুনতে থাকো। দশ মিনিট হতেই ঘরে প্রবেশ করবে। তৈরি হলে ভালো নয়ত তুমি তৈরি করিয়ে দেবে। এর মাঝে ওর সুযোগও নিতে পারো। নো প্রবলেম।”

হিসহিসিয়ে কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল রক্তিম বাহাদুর। নীলাদ্রও নিজের হাতে থাকা ঘড়ি ইশারা করে বেরিয়ে গেল। এখন যদি তৈরি না হয় আমার সঙ্গে ঠিক কি কি হতে পারে সেটা ভেবেই মাথা নিচু হয়ে গেল। চারিপাশটা ঘোলাটে হয়ে আসছে। চিৎকার করে আয়াশকে ডাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ডাকলেই কি মানুষটা আসবে? সেই অবস্থায় কি উনি আছেন?

সোনালি রঙের একটা লেহেঙ্গা পরে আয়নার সামনে বসে আছি আমি। বাইরে কড়া পাহারা। ভেতরে দুজন মেয়ে নিঃশব্দে আমাকে রেডি করিয়ে যাচ্ছে। হাত ভর্তি চুড়ি, কানে ভারি দুল, মাথায় টায়রা, এমনকি নাকে নথ পড়িয়ে দিচ্ছে ওরা। চোখে গাঢ় কাজল লাগিয়ে দিল তাদের মধ্যে একজন। আমার চোখে পানি টলমল করছে। যার কারণে কাজল লেপ্টে গেল। তা দেখে ওদের মধ্যে একজন বলল,
–“কেঁদে লাভ নেই। নিজের ভাগ্য মেনে নাও। আমরাও একসময় এভাবেই কেঁদেছিলাম। এখন বুকে পাথর রেখে বেঁচে আছি।”

–“আমাকে আপনারা বাঁচান প্লিজ!”
মিনতির সুরে বললেও ওরা আমার কথা এড়িয়ে গেল। এসব নাকি ওদের সাধ্যের বাইরে। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আমায় রেডি করিয়ে দিল ওরা। অতঃপর বাইরে চলে গেল।

নিজেকে একপলক দেখলাম আয়নায়। নিজেকে বিশ্রী লাগছে। আমি সাজতে চাইনি অন্যের জন্য। আচ্ছা আয়াশ যদি এখানে থাকতেন তাহলে কি বলতেন? ভাবতে ভাবতে যেন কানে এলো একটা শীতল কন্ঠ! ‘তুমি অন্যকারো জন্য কেন সেজেছ নিশাপাখি? তুমি শুধু আমার সামনে সাজবে। কারণ তোমার এই সৌন্দর্য দেখার অধিকার শুধু আমার। এটা কতবার মনে করাতে হবে তোমাকে?’

চমকে আশেপাশে তাকালাম। কেউ তো নেই। হয়তবা আমি শুনতে ভুল করেছি। নিজের ইমাজিনেশনের এতোটাই গভীরে পৌঁছে গেছি যে আয়াশের কন্ঠ কানে বাজছে আমার। একসময় কান চেপে ধরে নিচে বসে পড়লাম। আর সহ্য হচ্ছে না!

বড় একটা ঘরে বিদেশি লোকজনের সমাহার। বিদেশি সবাইকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। নিচে করা হয়েছে তাদের বসার আসর। তাদের সামনের নাচছে নির্লজ্জভাবে বেশ কয়েকটা মেয়ে। আমি আড়াল থেকে দেখছি। রক্তিম বাহাদুর সকলের সঙ্গে হেঁসে কথা বলছে আর নাচগান করা মেয়েদের দাম নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। একসময় জোর করে আমায় নাচগান করা মেয়েদের মাঝখানে ছেড়ে দিতেই সকলে লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকাল। শকুনের মতো দৃষ্টি সকলের। তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে শুরু করল। এতোসব কুৎসিত ও বিকৃত দৃষ্টি যখন আমায় পর্যবেক্ষণ করতে থাকল তখন আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালাম। এর থেকে জঘন্য অনুভূতি আর হয়ত নেই।

মেয়েরা আমার হাত ধরে ঠেলে ঠেলে ও ধাক্কা দিয়ে নাচতে বলল। অনেকে হাত ধরে জোর করে নাচাতে থাকল। আমি সকলের ভীড়ে বড্ড একা হয়ে পড়েছি। এরই ফাঁকে একটা বড় মেইন গেটও নজর পড়ল আমার। সেদিকেই তাকালাম। এখান দিয়েই হয়ত বের হবার রাস্তা! কিন্তু বাইরেও নিশ্চয় লোকজন রয়েছে। আশেপাশে তাকালাম আমি। ফলমূল নিয়ে আসছে বেশ কয়েকজন মেয়ে। কাঁচের বাটিতে থাকা ফলমূলের মধ্যে একটা করে ছুরি রাখা।

সেদিকে এগোতে যাব তখনই আমার কোমড় চেপে ধরে কেউ। আমার প্রাণপাখি যায় যায় অবস্থা। পেছন ফিরে দেখি একটা বিদেশি লোক দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আমি কৌশলে তাকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে ফলমূলের বাটি থেকে ছুরি নিয়ে নিলাম। সকলে আমার দিকে বাঘের মতো এগিয়ে লাগলেও আমি সকলের দিকে ছুরি তাক করে নিজের ডান হাতের রগের ওপর ছুরি ধরে কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
–“দূরে থাকো সবাই আমার থেকে। নয়ত সকলকে মেরে ফেলব নয়ত শেষ করে দেব নিজেকে।”

–“এই মেয়ে এই? এই পাগলামি করবে না। ছুরি ফেলো।তুমি কিন্তু এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারবে না। ছুরি ফেলো বলছি।”

নীলাদ্র একটু এগিয়ে আসার চেষ্টা করে বলল আমায়। আমি তার দিকেই ছুরি ধরে পিছিয়ে গিয়ে মেইন দরকার কাছে এসে বললাম,
–“আমি মরব পালিয়ে যেতে না পারলে। তবুও বিক্রি হবো না। বুঝেছিস? সরে যা নয়ত দুই খন্ড করে দেব।”

নীলাদ্র এগিয়ে আসার সাহস পেল না। দরজা দিয়ে ছুটতে গেলেই আমায় ধরে ফেলে আবারও কোনো পুরুষালি হাত পেছন থেকে। কাটা মুরগীর মতো ছটফট করেও লাভ হয় না আমার। ছুরিটা উল্টো দিকে ধরে চোখমুখ খিঁচে লোকটার পায়ে আঘাত করে বসি। যন্ত্রণায় জোরে চিৎকার দিয়ে ছেড়ে দেয় লোকটা। আমি লেহেঙ্গা তুলে দৌড়াতে দৌড়াতে পেছন ফিরে তাকাই। হাতে এখনো রয়েছে ছুরি। একটা লোককে আঘাত করেছি সেটা ভাবতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! এতো সাহস কোথায় পেলাম জানি না। আমার পেছনে আসছে নীলাদ্র সহ বেশ কিছু লোক। কিছুদূর যেতেই বুঝলাম এটা তো সেই ঘন জঙ্গল! একবার আয়াশের সৎমা আমায় এখানে ছেড়ে দিয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে সব অস্পষ্ট। তবুও আমি ছুটছি।

একটা সময় ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে উঠলাম আমি। দাঁড়িয়ে পড়লাম। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলাম। কান্না গলায় দলা পাকাচ্ছে। এখন বুঝতে বাকি নেই এই দুনিয়া কত স্বার্থপর!

পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ পেয়ে আবারও পা চালাতে লাগলাম। মনে হচ্ছে সামনেই রাস্তা রয়েছে। সেদিকেই যেতে থাকলাম আমি। বেশ কিছুক্ষণ পর রাস্তার দেখা পেলাম। পিচঢালা রাস্তা! কিন্তু রাস্তায় নামতে না নামতেই কয়েকটা লোক কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘিরে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আমার কাছে থাকা ছুরি হাতে চাপতেই হাতের বেশ খানিকটা কেটে গেল আমার। রক্ত গড়িয়ে পড়ল পিচঢালা রাস্তায়! রাতের শুনশান রাস্তা এটা। তেমন গাড়ি নেই সেকারণে।

–“অনেক পালিয়েছিস। চল এখন যাবি।”

বলেই একজন এগিয়ে আসতে লাগল একজন। আমি তার দিকে ছুরি তাক করে বললাম,
–“এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছিস তো…”

–“তো কি? মারবি? নে মার।”
বলেই আরো এগিয়ে এলো লোকটি। আমার হাত কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল। সাহস যেন আর পাচ্ছি না। না পেরে নিজের ডান হাতের রগের ওপর ছুরি ধরে বললাম,
–“নিজেকেই মারব। তবুও ওই অন্ধকার পল্লীতে ফেরত যাচ্ছি না।”

সকলে হেসে উঠল। নীলাদ্রকে দেখতে পেলাম। গায়ে কাটা দিয়ে উঠল আমার। কি করব ভেবে পেলাম না। বাঁচার কি কোনো উপায় নেই তবে? ওরা যখন সকলে মিলে এগিয়ে আসতে লাগল আমি চিৎকার দিয়ে বললাম,
–“আই উইল কিল মাইসেল্ফ!”

থেমে আবার বললাম,
–“কাছে আসবে না কেউ। ছুরি দিয়ে নিজেকে মারব তবে।”
কারোর যেন আমার কথা বিশ্বাস এলো না। ওরা যত এগিয়ে আসতে লাগল ততই অস্থির হয়ে পরলাম আমি। কাঁপতে নিজের অজান্তেই আচমকা ছুরি চালিয়ে দিলাম নিজের হাতের রগে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেই চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ঘোলা চোখে ভেসে উঠল রক্তের ফিনকি!

হাত দিয়ে রক্ত গলগল করে পড়ে যাচ্ছে। সকলে দূরে সরে গেল। যতটুকু শক্তি ছিল তাও রক্ত দেখে কমে এলো। মাথা ঘুরে গেল এতো এতো রক্ত দেখে। তাও নিজের রক্ত। তাহলে কি আমার বাঁচা হবে না? হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লাম আমি। চোখ বুঁজে আসতে পড়েও গেলাম নিচে মুখ থুবড়ে। নিভু নিভু চোখে রক্তের ভয়াবহ দৃশ্য! তবে কি আর বাঁচা হবে না?

চলবে…

[বি.দ্র. গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তাই কেউ বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করবেন না আশা করি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here