মনের_মতো_তুই #পর্বঃ৫ #লেখিকাঃদিশা মনি

#মনের_মতো_তুই
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা মনি

আহসান ভাই আমাকে আব্বুকে বলেন তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমায় বিয়ে করতে চান।

আহসান ভাইয়ের মুখে এই কথাটা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।ছোটবেলা থেকে আহসান ভাইকে খুব ভয় পাই আমি।তার সাথে এক মিনিট থাকতেই ভয় লাগে আর সারাজীবন, কখনো না।

আমি কিছু বলতে যাব কিন্তু আহসান ভাইয়ের রাগী চোখ দেখে ভয়ে আর কিছু বলতে পারিনা।আব্বুর কিছু জরুরি কাজ ছিল তাই তিনি বাড়ি ফিরে যান।যাওয়ার আগে আমার হাত ধরে বলেন,
‘মেয়েদের নিয়ে বাবা-মায়ের যে কত চিন্তা তুই বুঝবি না।নিজে সন্তানের মা হও তারপর বুঝবি।আমি যা সিদ্ধান্ত নেব তোর ভালোর জন্যই নেব।আজ হয়তো আমার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তোর খারাপ লাগছে।তবে এমন একদিন ঠিকই আসবে যেদিন তুই নিজে এসে আমায় ধন্যবাদ বলবি।’

আমি আব্বুর কথার কোন জবাব দেইনা।কেন জানি সবাইকে আজ আমার খুব বিরক্ত লাগছে।কিন্তু না এভাবে ঝিমিয়ে থাকলে হবে না।আদিত্যর ব্যাপারে সবকিছু আমায় জানতে হবে।যদি আদিত্য ভালো ছেলে হয় তাহলে আমি ওর পরিবারের সাথে আবার ওকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

নিজের মনের মানুষটাকে নিজের রাজপুত্রকে নিজের করে না পেলেও অন্তত জীবনে তার একটা উপকার করতে চাই।

৯.
পরের দিন মন খারাপ নিয়েই ভার্সিটিতে চলে আসি।আমার মন খারাপ দেখে লিলি,তৃপ্তি ওরা খুবই বিচলিত হয়।

লিলিঃকি হয়েছে দোস্ত? এসেছি থেকে দেখছি তুই কিরকম চুপ করে আছিস।তুই তো চুপ থাকার মেয়ে না।তোর কি কোন প্রবলেম হয়েছে।

আমি আর নিজেকে আটকাতে পারিনা।লিলির গলা ধরে কাদতে থাকি।আমাকে এভাবে কাদতে দেখে তৃপ্তিও কেদে দেয়।

লিলিঃতোরা দুজন এভাবে মরার কাদছিস কেন?

তৃপ্তিঃহিয়া কাদছে জন্য আমি কাদছি।

লিলিঃহিয়া কেন কাদছে?

আমি ওদের কালকে কি কি হয়েছিল সব বলি।সাথে এও জানাই আমি বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে আদিত্যর ব্যাপারে সবকিছু জানতে চাই।

তৃপ্তিঃআদিত্যকে যখন ওর বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে তার মানে ও ভালো ছেলে নয়।আঙ্কেল ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে তুই আহসান স্যারকেই বিয়ে কর।

লিলিঃএই মুটকির কথা শুনবি না একদম।আহসান স্যার তোকে সবসময় কিরকম জোর জবরদস্তি করে।এরকম কাউকে বিয়ে করার দরকার নেই।তাছাড়া তুই তো আদিত্যকে পছন্দ করিস।আগে আদিত্যর ব্যাপারে সবকিছু জান।এমনও তো হতে পারে আদিত্য খারাপ ছেলে না।ওর বাবা অন্য কোন কারণেও তো বের করে দিতে পারে।

আমি বললাম,
‘আমারও তাই মনে হয় লিলি।তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমাকে তো আহসান ভাই এই কয়েকদিন চোখে চোখে রাখবে তাই তোরা দুজন একটু রুহান স্যারের বাড়ির আশেপাশে গিয়ে খোঁজখবর নে।তাহলে অনেক কিছু জানা যাবে।’

লিলিঃগুড আইডিয়া।তুই কিছু চিন্তা করিসনা দোস্ত।আমি আর মুটকি আজই গিয়ে সব খোঁজ নেব।

তৃপ্তিঃতোরা যাই বল।আমার কিন্তু আদিত্য ছেলেটাকে ভালো বলে মনে হচ্ছেনা।নাহলে ভেবে দেখ ছেলেটার সাথে হিয়ার বারবার কিভাবে দেখা হচ্ছিল? হিয়া যেখানে যেখানে যাচ্ছিল ছেলেটাও সেখানে সেখানে ছিল।আমার তো মনে হয় ছেলেটা হিয়াকে ফলো করছিল।

লিলিঃতোর কথায় লজিক আছে।বাট এখন আমাদের আগে সবকিছু ভালোভাবে জানতে হবে।তারপর নাহয় কোন ডিসিশন নেওয়া যাবে।

আমরা কথা বলতে বলতেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল।আজ আহসান ভাইয়ের কোন ক্লাস ছিল না।তাই আমি একটু নিশ্চিন্তে ছিলাম।

ক্লাস শেষ হওয়ার পর তৃপ্তি আর লিলি মিলে চলে যায় রুহান স্যারের বাড়ির আশেপাশে।আমি অধীর আগ্রহে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।আর ভার্সিটির মাঠের বটগাছের সামনে পায়চারি করতে থাকি।

কারো নরম স্পর্শে আমি পিছনে ফিরে তো কাই।আহসান ভাই! আমাকে দেখে আহসান ভাই দাঁত কেলিয়ে হাসেন।লোকটাকে আগে কখনো এভাবে হাসতে দেখিনি।আজ হঠাৎ কি হলো?

‘কিছু বলবেন আহসান ভাই?’

‘এটা তোমার জন্য।’

ওনার কথা শুনে আমি চমকে যাই।হঠাৎ করে ‘তুই’ থেকে তুমিতে চলে গেলেন।ব্যাপারটা ঠিক হজম হলোনা।হাত বাড়িয়ে ওনার দেওয়া উপহার খুলে দেখি একটা ঘড়ি।আমার খুবই বিরক্ত লাগল।ঘড়ি আবার কেউ উপহার দেয় নাকি।তবুও মুখে একটা মিথ্যে হাসি এনে ধন্যবাদ জানালাম।

আহসান ভাইঃআমি জানি এই উপহার তোমার পছন্দ হয়নি।তবে এটা তোমার জন্য খুবই জরুরি।এই ঘড়ি তোমার হাতে থাকলে তুমি বুঝতে পারবে আমাদের বিয়ের দিন কত ঘনিয়ে আসছে।

আমি চুপ করে থাকি।আহসান ভাইয়ের একটি কল আসলে উনি চলে যান।আমি হাফ ছেড়ে বাচি।

আহসান ভাই চলে যেতেই লিলি আর তৃপ্তি হাফাতে হাফাতে আমার সামনে আসে।আমি ওদের জিজ্ঞাসা করি,
‘আদিত্যর ব্যাপারে কি জানতে পারলি।’

লিলিঃএলাকার সবাই আদিত্যর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।এরকম ছেলে নাকি ঐ এলাকায় আর একটাও নেই।ধনী গরীব নির্বিশেষে সবাইকে সম্মান দেয়।সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে।কোনদিন কারো সাথে খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করেনি।

তৃপ্তিঃআমি তো এটাই বুঝতে পারছি না এত ভালো ছেলেকে কেউ কেন বাড়ি থেকে বের করে দেবে।কোন একটা কেস তো আছেই।

লিলিঃএই ব্যাপারে জানতে চাইলে আমাদের আদিত্যর পরিবারের কারো কাছ থেকে জানতে হবে।কারণ এলাকার কেউ এই ব্যাপারে কিছু জানে না।আচ্ছা হিয়া সেদিন রেস্টুরেন্টে একটা মেয়ে ছিলনা।

আমি বললাম,
‘হ্যা তৃষা ও তো আদিত্যর বোন হয়।’

লিলিঃওর কাছে তাহলে আমাদের জানতে হবে সবকিছু।তোর কাছে ওর নাম্বার আছে?

‘না নেই।’

তৃপ্তিঃকোন ব্যাপার না।ফেসবুকে তৃষা হোসেন লিখে সার্চ করলেই হলো।

আমার মনে পড়ে গেল আদিত্যর তো আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।আদিত্যর একাউন্টে গিয়ে তৃষা লিখে সার্চ করতেই ঐ মেয়েটার একাউন্ট চলে এলো।আমি মেয়েটাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম।এখন অপেক্ষা কখন ও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সসেপ্ট করবে।

১০.
রাতে ফোন হাতে নিতেই দেখি তৃষা আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সসেপ্ট করেছে।আমি ওকে ম্যাসেজ পাঠাই।

কিছুক্ষণ পর তৃষা রিপ্লাই দেয়।আমি তৃষাকে বলি, আমি হিয়া সেই মেয়েটি যার সাথে সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল।সাথে এও বলি আমি আদিত্যকে পছন্দ করি।তাই আদিত্যর ব্যাপারে জানতে চাই।

তৃষা কাল সকাল ৭ টায় আবার আমায় ঐ রেস্টুরেন্টেই দেখা করতে বলে।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে পড়ি রেস্টুরেন্টের উদ্দ্যেশ্যে।রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখি তৃষা বসে আছে।আমি তৃষার পাশে গিয়ে বসে কুশল বিনিময় করি।

তৃষাঃবলো আদিত্যর ব্যাপারে কি জানতে চাও?

আমি বলি,
‘আমি শুনেছি আদিত্যকে ওর বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।প্রথমে ভেবেছিলাম ও হয়তো খারাপ ছেলে তাই এমন হয়েছে।কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম আদিত্য অনেক ভালো ছেলে।তাহলে ওর বাবা এমন কেন করল?’

তৃষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘সব দোষ আমার।’

আমি বললাম, মানে?

তৃষা বলতে শুরু করে,
‘আমি আর আদিত্য চাচাতো ভাইবোন।চাচার খুব আদরের ছেলে ছিল আদিত্য।বাবা-ছেলের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল।কিন্তু একদিন সব বদলে গেল।আমি আমার বয়ফ্রেন্ড সুমনের সাথে পরিবারের সবার পরিচয় করিয়ে দেই।সবার সুমনকে অনেক পছন্দ হয়।তবে আদিত্য এই বিয়েতে আপত্তি জানায় কারণ তার সাথে সুমনের কিছু পূর্ব শত্রুতা ছিল।সুমন নাকি একবার মেয়েদের ইভটিজিং করতে গিয়ে আদিত্যর হাতে মা’র খেয়েছিল।তখন সবাই আদিত্যর কথা শুনে সুমনের সাথে আমার বিয়েতে আপত্তি জানায়।আমি সুমনকে খুব ভালোবাসতাম তাই সিদ্ধান্ত নেই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব।পালানোর সময় আদিত্য আমায় দেখে ফেলে এবং আমাকে ঘরে এনে বন্ধ করে রাখে।আমি অভিমানে স্লিপিং পিল খেয়ে সু*ইসাই**ড করার চেষ্টা করি।সেদিন আমি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলাম।সবাই আমার এই অবস্থার জন্য আদিত্যকে দোষ দেয়।জ্ঞান ফেরার পর আমি বলি সুমনকে না পেলে আমি বাঁচব না।তখন সবাই আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেয়।আদিত্য কোনভাবেই মেনে নেয়না।এই নিয়ে চাচার সাথে আদিত্যর অনেক ঝামেলা হয়।আমি যতদূর জানি আদিত্যই নিজের ইচ্ছায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে চাচা ওকে বের করে দেয়নি।এরপর থেকে আদিত্য ওর মায়ের কাছেই থাকে।’

আদিত্যর ব্যাপারে সবকথা শুনে অজান্তেই আমার চোখে জল চলে আসে।তৃষার উপর খুব রাগ হয় আমার।আমি আর দেরি না করে উঠে চলে আসি।বাইরে এসে দেখি আদিত্য দাড়িয়ে আছে।আমি ছুটে গিয়ে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরি।আদিত্যও নিজের বাহুর মধ্যে আমায় আগলে রাখে।তখনই সেখানে চলে আসে আহসান ভাই।তিনি চিৎকার করে বলেন,
‘হিয়া,,,,,চলে আয় বলছি।’

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here