#মনের_মতো_তুই
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা মনি
আমি ছুটে গিয়ে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরি।আহসান ভাই চিৎকার করে বলেন,
‘হিয়া,,,,,চলে আয় বলছি।’
আমি আরো জোরে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরি।আহসান ভাই রেগে যান।তিনি দৌড়ে এসে আমাদের আলাদা করেন।আমার গালে ঠাস করে থাপ্পর মে’রে বলেন,
‘দিনে দুপুরে ছেলেদের সাথে রোম্যান্স করতে খুব ভালো লাগে তাইনা? তোর রোম্যান্স আমি বের করছি চল আমার সাথে।’
আদিত্য এগিয়ে এসে বলে,
‘তোমায় আমার কিছু বলার আছে হিয়া।’
আমার মন উশখুশ করতে থাকে ওনার কথা শোনার জন্য।কিন্তু আহসান ভাই একরোখা।তিনি কিছুতেই আমাকে এখানে থাকতে দেবেন না।বাধ্য হয়ে আহসান ভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে আমি আদিত্যর দিকে এগিয়ে আসি।
আদিত্য ধীর গলায় বলে,
‘আমি তোমায় প্রথম কখন দেখেছিলাম জানো?’
‘হ্যা জানি।যেদিন আপনি গাড়ি নিয়ে আমার গায়ে কাদা,,,,’
‘না সেদিন নয় আমি তোমাকে দেখেছি আরো অনেক আগে।তোমার মনে আছে কিনা জানি না গতবছর রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তুমি একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলে।সেখানে খুব সুন্দর একটা রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলে।সেদিন তোমার গান শুনেই আমি তোমার প্রেমে পড়ে যাই।তারপর থেকে তোমায় অনেক খুঁজে বেরিয়েছি।আর দেখ সেদিন না চাইতেই কিভাবে আমাদের দেখা হয়ে গেল।যদিও আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না কিন্তু ভালোবাসায় বিশ্বাস করি।আমরা বোধহয় একে অপরকে ভালোবাসার জন্যই জন্ম নিয়েছি।বিশ্বাস করো এই জীবনে আমি আগে কখনো কোন মেয়ের প্রেমে পড়িনি।কিন্তু তোমার প্রেমে পড়েছি।কারণ তুমি একদম আমার মনের মতো।আর তুমি যেটাকে ভাগ্য ভেবেছিলে বারবার আমাদের দেখা হওয়াকে সেটা আসলে ভাগ্য ছিলনা।তোমাকে ভালোবাসি জন্যই বারবার পরিকল্পনা করেই তোমার পিছু পিছু চলে যাচ্ছিলাম।’
১১.
চারিদিকে থমথমে পরিস্থিতি।সূর্যের তেজের সাথে সাথে আমার কষ্টও বেড়ে যাচ্ছে।যেই মানুষটাকে আমি ভালোবাসলাম সে অনেক আগে থেকেই আমায় মন দিয়ে বসে আছে।অথচ ভাগ্যের কাছে আজ আমি অসহায়।আব্বুর বিরোধিতা করার সাহস বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই।
আহসান ভাই আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলেন,
‘দেখলি তো এই ছেলেটা আসলে তোকে ফাঁদে ফেলেছে, প্রেমের ফাঁদে।যেই ছেলেকে তার বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয় সে কত ভালো বুঝতে পারছিস নিশ্চয়ই।এই ছেলেকে বিশ্বাস করে নিজের জীবন শেষ করিস না।চল আমার সাথে।’
আমি আহসান ভাইকে কোন জবাব না দিয়ে আদিত্যর দিকে এগিয়ে যাই।আদিত্যকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরি।চোখের জল আজ কোন বাধ মানতে রাজি নয়।নিজের মনের মানুষটাকে আজ চিরকালের মতো ত্যাগ করতে হবে।কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পরব ভাবতেই পারিনি।অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে আদিত্যকে বলি,
‘আমিও ভালোবাসি আপনাকে।আপনি আমার এই বিশ বছরের প্রেমহীন জীবনে প্রেমের কলি নিয়ে এসেছিলেন।আমার মনের বাগানে প্রথম ফুল ফুটিয়েছিলেন আপনি।কিন্তু সেই ফুলকে আগলে রাখার ক্ষমতা আমার নেই।ভালো থাকবেন নিজের যত্ন নেবেন।দেখবেন আল্লাহ আপনার জীবনে আমার থেকেও ভালো কাউকে পাঠাবে।তাকে পেয়ে আপনি আমাকে ভুলে যাবেন।’
আদিত্য অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার দিকে তাকায়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি।হারানোর তালিকাটা প্রাপ্তির তালিকার থেকে বড় ছিলনা কখনো।কিন্তু আজ হারানোর তালিকাটা এতটা বিশাল হয়ে গেল যে হাজার প্রাপ্তিও তাকে গ্লান করতে পারবে না।’
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি আদিত্যর দিকে।কিছু বলার মতো অবস্থা বা পরিস্থিতি কোনটাই আর নেই।আমি শেষবারের মতো নয়ন ভরে আমার রাজপুত্রকে দেখে নিলাম।এটাই হয়তো শেষ দেখা।
আর দাড়ালাম না সেখানে।আর কিছুক্ষণ থাকলেই আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাবো।তাই ছুটে এসে আহসান ভাইয়ের হাত ধরে বললাম,
‘চলো আহসান ভাই।আমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে চলো।এই শহরে আমার আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
আহসান ভাই আমার হাত ধরে চলতে থাকলেন।আমি একবারও পিছন ফিরে তাকালাম না।কারণ একবার পিছনে থাকালে আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলব।তবে আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি আদিত্য এখনো আমাকেই দেখে চলেছে।হয়তো চাইছে একবার যেন আমি ফিরে তাকাই।আমি মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিলাম ওর কাছে।কারণ এই ইচ্ছেটা পূরণ করার ক্ষমতা আমার নেই।
আহসান ভাইয়ের সাথে গাড়ি উঠে গেলাম।এরপর চললাম নিজের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে।ফোন হাতে নিয়ে তৃপ্তিকে একটা কল করলাম।
তৃপ্তি ফোন রিসিভ করতেই বলল,
‘কিরে তুই আজ ভার্সিটিতে এলি না কেন?’
আমি শান্ত গলায় বললাম,
‘লিলি আছে?’
‘হ্যা আমার পাশেই আছে।’
‘তোদের একটা কথা বলার ছিল।আমি আজ আমার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি।আর হয়তো কোনদিন ফেরা হবে না।খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে হতে চলেছে।তোদের কাছে বিয়ের কার্ড পৌঁছে দেব তোরা চলে আসবি।তোদের কিন্তু আমার বিয়েতে অবশ্যই আসতে হবে।’
আমার কথা শুনে বোধহয় ওরা খুব অবাক হলো।আমি আর অপেক্ষা না করে কল কে’টে দিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলাম।এক্ষুনি হয়তো ওরা আমার দিকে প্রশ্নের বান ছুড়ে দিত।আমার মনের অবস্থা এখন খুব খারাপ।এই মন নিয়ে ওদের এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না।
১২.
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে গেলাম।গাড়ি থেকে নামতেই আম্মু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।আম্মুর বুকে মাথা রেখেই কাদতে থাকি।ছোটবেলা থেকেই আব্বু যেমন আমায় শাসনে রেখেছে আম্মু ঠিক তার উলটো সবসময় আমায় ভালোবেসে গেছে।আম্মু সবসময় আমায় সাপোর্ট করেছে।আম্মুর মতো করে কেউ আর কখনো আমায় বুঝতে পারেনি।
আম্মু আমাকে ধরে ভিতরে নিয়ে গেল।আহসান ভাইকে বসতে বলে আম্মু আমায় রুমে নিয়ে গেলেন।তারপর বললেন,
‘হিয়া তুই সত্য করে বল তোর কি সমস্যা? তোর আব্বু বলল তুই নাকি কোন বখাটে ছেলের সাথে প্রেম করছিস।সেইজন্য তোর পড়াশোনা বন্ধ করে দিল আর আগামী সপ্তাহেই নাকি তোর বিয়ে।’
‘আগামী সপ্তাহেই?’
‘তাইতো বলল।আগামী সপ্তাহে কাবিননামা করে বিয়ে হবে।’
আম্মু কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।তারপর আম্মুকে আদিত্যর ব্যাপারে সব বললাম।সব শুনে আম্মু আমায় বলল,
‘তুই আদিত্যকে খুব ভালোবাসিস তাইনা?’
‘হুম খুব।’
‘তাহলে তোকে আহসানকে বিয়ে করতে হবে না।তুই পালিয়ে যা এখান থেকে।আদিত্যকেই বিয়ে কর।’
আম্মুর কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।আম্মু এরকম কিছু বলবে আশা করিনি।ছোটবেলা থেকে আমায় ভালোবাসলেও কখনো আব্বুর বিরোধিতা করেনি।আর আজ সেই আম্মুই আমায় এমন কথা বলল।
আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আম্মু মৃদু হেসে বলে,
‘তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস আমি মা হয়ে তোকে এমন কথা কিভাবে বলছি তাইনা? তাহলে শোন আমি নিজেও এটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারি ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার কষ্ট কি।তোর আব্বুর সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসতাম।ছেলেটা ছিল আমার আপন মামাতো ভাই।আমার আব্বু চাননি আত্মীয়ের সাথে আমার বিয়ে দিতে।তাছাড়া সে বেকার ছিল সেখানে তোর আব্বু সরকারি চাকুরিজীবী ছিল।তাই আমার আব্বু আমার অমতে তোর আব্বুর সাথে আমার বিয়ে দেয়।সেসময় আমি কি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম আমি তোকে বোঝাতে পারব না।তোর আব্বুকে প্রথম প্রথম মানতেই পারিনি।এরমধ্যে খবর পাই আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে না পাওয়ার দুঃখে আত্মহ,,,,।’
কথা সম্পূর্ণ না করেই আম্মু শাড়ির আচল দিয়ে মুখ চেপে কাদতে শুরু করে।আম্মুর জীবনের এই ঘটনাগুলো আমার জানা ছিলনা।আম্মুর কথা শুনে আদিত্যর কথা মনে পড়ে।আচ্ছা আদিত্যও কি আমাকে হারানোর ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে এমন কিছু করতে পারে? এসব ভাবতেই আমার মধ্যে অজানা ভয় কাজ করতে লাগল।আম্মু চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,
‘আমার মতো ভুল তুই করিসনা হিয়া।তোর আব্বুকে বিয়ে করলেও কখনো তাকে মন থেকে মানতে পারিনি।তারপর তুই এলি আমার কোল আলো করে, এরপর রিয়া এলো।তোদের দুজনকে ঘিরে আমার নতুন পৃথিবী গড়ে উঠল।তোর আব্বুকে স্বামী হিসেবে মানলেও একটা অদৃশ্য দেয়াল আজও আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে।এই কারণেই তোর আব্বু তোকে আর রিয়াকে সবসময় চোখে চোখে রাখত।যাতে তোরা কোন প্রেমের সম্পর্কে না জড়াতে পারিস।কারণ আমাকে দেখে তার মনে প্রেমের বিরুদ্ধে ঘৃণা জন্ম নেয়।সে ভাবে আমি অন্য একজনকে ভালোবেসেছিলাম বলেই কখনো মন থেকে তাকে মানতে পারিনি।কিন্তু মনকে আটকানোর ক্ষমতা কারো নেই।দেখ তুইও প্রেমে পড়ে গেলি।তাই বলছি আমার মতো ভুল করিস না।নাহলে আজীবন চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে যাবে।’
আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলি,
‘তুমি ঠিক বলেছ আম্মু।আমি কিছুতেই এই ভুল করব না।আমি আদিত্যর কাছে যেতে চাই।আদিত্যর সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই।’
হঠাৎ কোন কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে পিছনে পিছনে ফিরে তাকাই।এতক্ষণ ধরে আমরা যা বলছিলাম একজন দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে সব শুনে ফেলে।সে হলো,,,,,
চলবে?