#মনের_মতো_তুই
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা মনি
এতক্ষণ আম্মু আর আমার সব বলা কথা শুনে ফেলে রিয়া।আমার ছোট বোন।রিয়া দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।কাদতে কাদতে বলে,
‘আপু তুই এত কষ্ট কিভাবে সহ্য করছি? আর আমাকে দেখ আমি যে এসব আর সহ্য করতে পারছি না।নিজের মনের মানুষটা অন্য কারো হয়ে যাবে।আর আমাকে সেটা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখতে হবে।’
রিয়ার কথার কিছুই বুঝতে পারলাম না।কি বলছে ও? রিয়া কি কাউকে ভালোবাসে?
আম্মু ভ্রু কুচকে রিয়াকে জিজ্ঞেস করে,
‘সত্য করে বল রিয় তুই কাকে হারানোর ব্যাথা সহ্য করতে পারবি না।তুই কি কাউকে ভালোবাসিস?’
‘আমি আহসান ভাইয়াকে ভালোবাসি।’
রিয়ার কথা শুনে আমি আর আম্মু দুজনেই হা করে তাকিয়ে থাকি।রিয়া যে আহসান ভাইকে পছন্দ করতে পারে এটা আমরা কল্পনাও করতে পারি নি।ছোটবেলা থেকেই রিয়া বড্ড চুপচাপ,শান্ত স্বভাবের।সেই মেয়ে যে মনে মনে এতদূর এগিয়ে গেছে ভাবলেও হাসি পাচ্ছে।
আমি রিয়াকে রাগানোর জন্য বললাম,
‘খুব ভালো তো।আব্বুর কথা তো আমি ফেলতে পারব না।আর তুই তো সবসময় বলিস আমার কথা নাকি তোর খুব মনে পড়ে।আমার সাথে থাকতে ইচ্ছে করে।তাহলে এক কাজ করি আমার বিয়ের পর আহসানের সাথে তোরও বিয়ে করিয়ে দেব।তারপর দুই বোন সতীন হয়ে একসাথে সংসার করব।’
‘আপু!!!!’
আমি রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি,
‘তুই কোন চিন্তা করিস না বোন আমার।আহসান ভাই তোর একার হবে।তোর আপু তোকে কথা দিচ্ছে।’
১৩.
আহসান ভাই বাইরে বসে ছিল।আমি রিয়ার হাতে চা-বিস্কুট দিয়ে বললাম, ❝যা গিয়ে আহসান ভাইকে দিয়ে আয়❞
রিয়া আহসান ভাইয়ের কাছে যেতেই কাপতে থাকে।হয়তো হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।এই অনুভূতির সাথে আমি পরিচিত।আদিত্যকে কাছে দেখলে আমারও তো এমন অনুভূতি হতো।
রিয়াঃএই নিন আপনার চা।
আহসানঃআরে রিয়া মনি যে।কেমন আছিস?
রিয়াঃআছি।
আহসানঃআছি মানে? এটা আবার কেমন কথা?
রিয়া আর কোন কথা না বলে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসে।
আহসান ভাই আনমনে বলতে থাকে,
❝রিয়া এরকম করল কেন।আগে তো আমার সাথে সবসময় হেসে হেসে কথা বলত।❞
আমি আহসান ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলি,
‘ছাদে চলুন আপনার সাথে আমার কিছু দরকারি কথা আছে।’
আহসান ভাই অতি উৎসাহ নিয়ে আমার সাথে ছাদে চলে এলো।আমি আহসান ভাইকে বললাম,
‘আপনি আমায় কেন বিয়ে করতে চান?’
‘এসব কথা কেন বলছিস হিয়া?’
‘কারণ আমার জানা দরকার।আমি যেই মানুষটার সাথে সারাজীবন কাটাবো তার মনে আমার জন্য কিছু আছে কিনা সেটা তো আমায় জানতে হবে।’
‘দেখ হিয়া আমি ছোটবেলা থেকেই তোকে আগলে রাখার চেষ্টা করি।আমি চাই সারাজীবন তোকে আগলে রাখতে।’
‘এটাই শুনতে চেয়েছিলাম।’
‘মানে?’
‘মানে এটাই আহসান ভাই তুমি আমায় ভালোবাসো না।শুধু আমার কেয়ার করো।বোনের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করো।’
‘এসব কি বলছিস তুই?’
‘একদক ঠিকই বলেছি।তুমি নিজের অনুভূতিকে কখনো চিনতে পারোনি।হয়তোবা আমার প্রতি তোমার কিছুটা দূর্বলতা আছে কিন্তু একবার নিজেকে প্রশ্ন করো তুমি আসলে কি চাও।কাকে ভালোবাসো।’
‘আমি কাউকে ভালোবাসি না হিয়া।’
‘ভালোবাসো তুমি।আমার বোন রিয়াকে।’
‘কিসব বাজে কথা বলছিস তুই?’
‘বাজে কথা নয়।একবার ভালো করে ভেবে দেখ।ছোটবেলা থেকে তুমি আমায় শাসনে রাখার চেষ্টা করেছ।কিন্তু রিয়াকে কখনো কিছু বলোনি।আমার সাথে যখন কথা বলতে শুধু রাগ করতে।অথচ রিয়ার সাথে সবসময় হাসিমুখে কথা বলতে।তোমার মনে আছে কিনা জানিনা, একবার ছোটবেলায় আমি আর রিয়া পুকুরে ডুবে যাচ্ছিলাম।সেদিন তুমি আগে রিয়াকে বাঁচিয়েছিলে।তারপর আমায়।এসব কিছু তো এটাই প্রমাণ করে তোমার আসল ভালোবাসা রিয়া।এমনকি তুমি তো ছোটবেলায় সবসময় রিয়াকে নিজের বউ বলতে।এখন বড় হয়ে হয়তো সব ভুলে গেছ কিন্তু রিয়া ভোলেনি।মেয়েটা তোমায় খুব ভালোবাসে।যদি রিয়াকে বিয়ে করো তাহলে তুমি সুখী হতে পারবে।কিন্তু যদি আমায় বিয়ে করে তাহলে একসাথে ৪ টা জীবন নষ্ট হবে।তোমার,আমার,রিয়ার আর,,,,’
পুরো কথা শেষ না করে আমি দৌড়ে নিচে চলে আসি।সব সিদ্ধান্ত এখন আমি আহসান ভাইয়ের উপর ছেড়ে দিয়েছি।তিনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন তাই হবে।আমি আর কোন কিছু বলব না।
নিচে এসে আম্মুর কাছে শুনি আব্বু নাকি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন তার মেয়ের বিয়ের কথা।পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবার জানা হয়ে গেছে।আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।এমতাবস্থায় যদি বিয়েটা নাহয় তাহলে আব্বুর মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে।
তাহলে কি এখন আব্বুর সম্মামের কথা ভাবব আমি? নাকি ভাবব নিজের কথা,আমার ছোট বোনটার কথা।কিছুই ভাবতে পারছি না।চারিদিকে অন্ধকার দেখছি।আহসান ভাই বা কি সিদ্ধান্ত নেবেন।এখন আহসান ভাইয়ের উপর সবকিছু নির্ভর করছে।তিনি যদি কিছু বলেন তাহলেই পুরো পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।কিন্তু আদৌ কি তিনি কিছু বলবেন? নাকি সবকিছু যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলবে।
১৪.
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো।বিয়েটা আটকানো গেলো না।বিয়েটা হচ্ছে।আব্বুর সম্মানের কথা চিন্তা করে বিয়েটা ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সবকিছু ঠিকঠাক আছে।আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছে।আহসান ভাইয়ের বাড়ি থেকেও অনেক মানুষ এসেছে।সব ঠিক থাকলেও একটা জিনিস বদলে গেছে।সেটা হলো পাত্রী।আমার সাথে নয় রিয়ার সাথে আহসান ভাইয়ের বিয়ে আজ।
এরকম যে হতে পারে কল্পনাও করিনি।আহসান ভাই সেদিনই আব্বুকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আমাকে বিয়ে করতে পারবেন না।কারণ তিনি রিয়াকে পছন্দ করেন।হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত আহসান ভাই রিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
আব্বু তো প্রথমে খুব চিন্তিত ছিলেন কারণ সবাই তার মেয়ের বিয়ের কথা জেনে গিয়েছিল।তবে কোন মেয়ের বিয়ে সেটা কেউ জানত না।তাই আব্বু ঠিক করলেন আজকের দিনেই আহসান ভাইয়ের সাথে রিয়ার বিয়ে দেবেন।
আমি আজ খুব খুশি।দুটো ভালোবাসার মানুষকে মিলিয়ে দিতে পেরেছি।এর থেকে আনন্দের আর কি বা হতে পারে? এখন শুধু অপেক্ষায় আছি কখন এসব বিয়ে শাদির ঝামেলা মিটে যাবে আর আমি ফিরতে পারব আদিত্যর কাছে।
ভাবনার মধ্যেই পিছন থেকে কারো ডাকে ঘুরে তাকাই।লিলি,তৃপ্তি ওরা এসেছে।
তৃপ্তি এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদো কাদো গলায় বলে,
‘তোর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে হিয়া।যাকে ভালোবাসলি তাকে পেলিনা।আর দেখ শেষ পর্যন্ত আহসান ভাইয়ের সাথেই তোর বিয়ে হচ্ছে।’
লিলি পাশ থেকে বলে,
‘তুইও বা কেমন? কতদিন রাজপুত্র রাজপুত্র করে কত ঢং করলি আর এখন নাচতে নাচতে অন্য একজনকে বিয়ে করে নিচ্ছিস।তোর মতো মেয়েদের জন্যই ছেলেরা ছ্যাঁ/কা খায়।আর দোষ হয় সমস্ত নারী জাতীর।সবাই বলে, নারী তুমি ছলনাময়ী।’
ওদের কথা শুনে খুব হাসি পায়।তবে আমি নিজের হাসি লুকিয়ে কাদো কাদো ভাব নিয়ে অভিনয় করে বলি,
‘কি করব বল।আব্বুর কথা ফেলতে পারলাম না।তাই বাধ্য হয়ে,,,,’
লিলিঃআচ্ছা একটা কাজ কর পালিয়ে যা।
তৃপ্তিঃহ্যা ভালো আইডয়া।পালিয়ে যা তুই।
ওদের কথা শুনে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না।জোরে জোরে শব্দ করে হাসতে লাগলাম।আমাকে এভাবে হাসতে দেখে ওরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তৃপ্তি তো বলেই দিল,
‘আহারে বিয়ের শোকে বোধহয় মেয়েটা পাগল হয়ে গেল।’
আমি এবার একটু স্বাভাবিক হয়ে ওদের বলু,
‘তোরা কি বিয়ের কার্ডটা খুলে দেখিস নি?’
লিলিঃনা।কি আর দেখব? তুই তো ফোনেই জানিয়েছিলি তোর সাথে আহসান ভাইয়ের বিয়ে।তাই আর খুলে দেখার প্রয়োজন মনে করিনি।আজকের ডেট দেখে চলে এসেছি।
‘আরে পাগলী তোরা এক্ষুনি কার্ডটা খুলে দেখ।’
আমার কথা শুনে দু’জনে কার্ডটা খুলে দেখল।তারপর দুজনেই চেচিয়ে বলল,
‘হুররে! তার মানে তোর বিয়েটা হচ্ছেনা।’
আমি বললাম,❝আস্তে, কত মানুষ আছে বাড়িতে।❞
তারপর শোফায় বসিয়ে ওদের পুরো ঘটনা খুলে বলি।
সব শুনে ওরা দুজনেই খুব খুশি হয়।লিলি হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা এরমধ্যে কি আদিত্যর সাথে আর যোগাযোগ করেছিস।’
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, না।
লিলিঃতোর যোগাযোগ করা দরকার ছিল।না জানি ছেলেটা কতটা কষ্টের মধ্যে আছে।
‘জানাবো কি ভাবে? ও তো ফেসবুকে একটিভই নেই কতদিন থেকে।তৃষার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি।এবার একেবারে ঢাকায় ফিরে তারপর যোগাযোগ করব।বিয়েটা হয়ে যাক।’
আমি ওদেরকে নিয়ে রিয়ার রুমের দিকে চললাম।বউ সাজে আমার বোনটকে খুব সুন্দর লাগছিল।রুমে আমার ফুফু,খালারা সবাই ছিল।
বড় ফুফু হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে,
‘কিরে হিয়া।তোর ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর তোর কি খবর।’
❝দোয়া করিও ফুফু আমিও যাতে খুব তাড়াতাড়ি বউ হতে পারি❞
আমার কথা শুনে ঘরের সবাই হাসল।রিয়াকে নিচে নিয়ে যাওয়া হলো।
❝কবুল❞ বলার মাধ্যমে এক নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে গেল আহসান ভাই আর রিয়া।
রিয়ার বিদায়ের পালা চলে এলো।আম্মু আর আমাকে জড়িয়ে খুব কাদল মেয়েটা।আমিও কেদে দিলাম।পাশ থেকে আব্বুকে দেখছিলাম।বেশ শক্ত লাগছিল।কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম মানুষটা ভেতর থেকে একেবারে ভেঙে গেছে।আমাদের দুই বোনকে যে খুব ভালোবাসে।
রিয়ার বিদায়ের পর আব্বুর লুকিয়ে ফেলা চোখের জল আমার দৃষ্টিগোচর হলো।আব্বু কোন কথা না বলে ভেতরে চলে গেল।এখন হয়তো নিজের রুমে গিয়ে কাদবেন।আব্বুদের ভালোবাসা এমনই হয়।
এসব ভাবনার মধ্যেই লিলি ছুটতে ছুটতে আমার সামনে আসলো।খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল ওকে।লিলি আমায় বলল,
‘আদিত্য হাসপাতালে ভর্তি।এখনই খবর পেলাম।’
চলবে?