মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১২
রূবাইবা_মেহউইশ
_________________
পাখির পালকের মতোই পালকে তৈরি এক মোলায়েম কম্বলে পা হতে মাথা অব্ধি ঢাকা। উষ্ণতা দেহের প্রতিটি পশমের গোড়ায় গোড়ায় উপস্থিত। রাতটা ভীষণ ছোট কেটেছে কি আজ! নাকি মাত্রাতিরিক্ত আরামদায়ক বিছানা পেয়ে ঘুমের সময়টা কম মনে হচ্ছে? কে জানে! কাল রাতে পাহাড়ে এসে প্রথমেই যে ভয়টা কাজ করেছিলো তা হলো এখানকার নিস্তব্ধতা৷ যা ভোরের আলো ফুটতেই ক্রমশ বদলে গিয়ে হৈ হল্লা শোনা যাচ্ছে। ঘড়িতে সময় কয়টা দেখার উপায় নেই। রাতেই রিশাদ নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে মেহউইশকে দিয়েছিলো। মেহউইশ ছুঁয়েও দেখেনি সেটাকে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে৷ এই লোকের কাছ থেকে পালানোর পথ নেই তার চেয়ে ভালো তার বাচ্চার আয়া হয়েই না হয় জীবন কাটিয়ে দেবে। এর বিনিময়ে মা,ভাই দুজনেই যদি দারুণ একটা জীবন পায় তবে এই জীবনই কবুল শুধু রয়ে যাবে দিন শেষে প্রিয় আরেকটি মানুষের জন্য হাহাকার। থাক, কত মেয়েই তো এই হাহাকার বুকে চেপে বেঁচে আছে দীর্ঘকাল ধরে। আমিও না হয় তাদেরই একজন হবো।
ভাবনায় ঘুরে বেড়ানো আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মেহউইশের। কাল রাতেও দেয়ালে টাঙানো আয়নায় নিজেকে দেখে কত কি ভেবেছিলো। সেই ভাবনাকে চুটকি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রিশাদ চমৎকারভাবে তাকে নতুন বাড়িতে স্বাগতম জানিয়েছিলো। এক গুচ্ছ ফুল কোথা থেকে এনে ওই রাত্তিরেই বলেছিলো, ‘ওয়েলকাম টু ইউর নিউ হোম মিসেস. রিশাদ রায়হান। হোপ ইউ লাইক ইউর বিউটিফুল প্যালেস।’ ধরণটা এমন ছিলো বলার যেন সত্যিই কোন আলিশান মহলে নিয়ে এসেছে সে৷ আর আন্তরিকতার ছাপ এত গভীর যেন মেহউইশের সাথে তার সম্পর্ক জোরজবরদস্তির নয়। ঠিক যেন দীর্ঘজীবনের প্রেমমাখা কোন সম্পর্ক। মানুষ এতো অভিনয় করে কি করে ভেবে পায় না মেহউইশ৷ রাতের খাবারে দারুণ এক তরকারি ছিলো শুঁটকি দিয়ে যা এর আগে মেহউইশ খায়নি কখনো৷ অবাক করা বিষয় কালই খেয়াল করলো সে রিশাদ বাঙালি খাবার কত তৃপ্তি নিয়ে খায়। কোটিপতি বাবার ছেলেও যে কখন শুঁটকি আর গরম ভাতের স্বাদ চেটেপুটে নিতে পারে তা কালই প্রথম জানা হলো তার । আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়তেই খেয়াল হলো বিছানায় নির্জন নেই। নিজের অজান্তেই বুকের ভেতর ভয়ের অনুভূতি জেগে উঠেছে। বাচ্চাটা কোথায় আর রিশাদ কোথায়! খাটের কিনারায় ওড়না পেল সেটাকে গায়ে জড়িয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হলো। দরজা পেরিয়ে লম্বা প্যাসেজের মত জায়গাটাতে আসতেই কানে আওয়াজ এলো নির্জনের। সে মুখ বাঁকিয়ে একটু একটু আওয়াজ করে, খিদে পেলে নরম সুরে কান্না করে। নামের মতোই বাচ্চাটা নির্জনতা বজায় রেখেই তার উপস্থিতি,খিদে,মায়ের কমতি সবটাই জানান দেয় সবাইকে। মেহউইশ গত কয়েকদিনেই অনেকটা জেনে গেছে বাচ্চাটাকে। নির্জনের আওয়াজকে অনুসরণ করে প্যাসেজের ডান দিকে এগুতেই ভীষণরকম চমক পেল মেহউইশ। রাতে দেখা মহিলাটি যাকে সে রাতের বেলায় বৃদ্ধা ভেবেছিলো সে কেন বৃদ্ধা মহিলা নন৷ পায়ে হয়তো সমস্যা থাকায় লাঠিতে ভর করে চলেন। মহিলাটি বড়জোর পঁয়ত্রিশ, ছত্রিশ বছর বয়সী হবেন। দেখতেও সুশ্রী, শক্ত সামর্থ্য লাগছে। ধোঁকা! রাতের আঁধার কতোই না ধোঁকা দেয়। এই আঁধার শুধু তাকেই ধোঁকা দিতে দেয়নি বিয়ের রাতে। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে মেহউইশ মহিলার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ওকে এভাবে তেল দিচ্ছেন কেন? ওর বাবা যেই রাগী আপনাকে বকে দিবে দেখলেই।’
ফ্লোরে মাদুর পেতে তাতে পাতলা কাঁথা বিঁছিয়ে তাতে নির্জনকে শুইয়ে রেখেছেন ভদ্রমহিলা। হাতে তার তিলের তেল যা নির্জনকে খুব যত্নে মাখিয়ে দিচ্ছেন। মেহউইশের কথা শুনে মহিলা একটুখানি হেসে জবাব দিলেন, ‘ রিশাদ দেখে গেছে আমি তেল নিয়ে বসেছি। সে এও জানে এই তেল আমি তার ছেলেকে মাখবো।’
-সত্যি! চমকে যাওয়া গলায় বলল মেহউইশ। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এমন টিপটপ হয়ে সারাক্ষণ চলাফেরা করা লোক তার ছেলেকে তেল মালিশ করতে দিচ্ছে! সত্যিই আশ্চর্যজনক ঘটনা এটা। গত পাঁচ দিনে আজকেই এত উচ্ছল এক সকাল হলো বুঝি তার। এতোটা আনন্দ কিসে লাগলো? রিশাদের সন্তানকে তেল মালিশ করাটাই কি আনন্দকর ব্যাপার? মেহউইশ নিজেই জানে না সে কখন কি নিয়ে আনন্দ পাচ্ছে আর কখন বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করছে।
-এই মেয়ে তুমি মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছো তাই না!
জ্বী
‘যাও মুখ হাত ধুয়ে এসো। বেসিন তো দেখেছোই নিশ্চয়ই ওপাশে।’ মেহউইশ যে দিক থেকে এসেছিলো সে দিকে ইশারা করে বললেন।
-জ্বী
‘কথায় কথায় এমন জ্বী জ্বী করবে না। ফুপি বলে ডাকবে আমায়। আমি রাশেদ ভাইয়ের আপন চাচাতো বোন। বলতে গেলে বংশের একমাত্র মেয়েও ছিলাম। যাই হোক যাও রিশাদ আসার আগে মুখ হাত ধুয়ে এসো একসাথে খাবো সবাই ।’ শেষের দিকে কথাগুলো বলতে গিয়ে মহিলার গলাটা বোধহয় একটু কেঁপে উঠলো। মেহউইশের কেমন রহস্যময়ী মনে হলো মহিলাকে। এই বয়সে কেউ লাঠি ভর করে চলে না। এই মহিলার চলা দেখে জন্মগত বিকলাঙ্গও মনে হয় না। হয়তো কোন এক্সিডেন্টে এমন পঙ্গু হয়েছে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাদুরে শুয়ে থাকা নির্জনের গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে চলে গেল সে। মুখ হাত ধুয়ে ঘরে এসে খাটের কার্নিশে থাকা ফোনটা দেখে তা তুলে নিলো হাতে। কন্টাক্টস চেক করে দুটো নাম্বার পাওয়া গেল। একটা মা অন্যটা রিশাদ লিখে সেভ করা। তার মানে লোকটা নিজেই এ দুটো নাম্বার সেভ করে দিয়েছে। সিম নাম দেখে একাউন্ট চেক করতেই আবারও অবাক হলো। পাঁচশো টাকার ব্যালেন্স! এত টাকা দিয়ে কি করে মানুষ? সে তে পুরো মাসে একশো টাকাও খরচ করে না। প্রয়োজনে এক দু মিনিটের কথা বলতে মানুষ একশো, দেড়শো টাকাতেই মাস পার করতে পারে। আবারও মনে হলে এই লোক অপচয়কারী৷ আর অপচয়কারী মানেই তো শয়তানের ভাই। বাহ্ মেহউইশ দারুণ বলেছিস তো এই বেডা নিজে দানব আবার সম্পর্কে শয়তানের ভাই৷ নিজেই নিজেকে এপ্রিসিয়েট করতে লাগলো মেহউইশ। তারপর অভ্যস্ত হাতে ইভানের ফোন নাম্বারটা উঠিয়ে ডায়াল করলো। প্রথমবার নেটওয়ার্ক প্রবলেম এবং দ্বিতীয়বার সংযোগ বন্ধ শোনা গেল ওপাশ থেকে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা আর সেই ব্যথাটা চোখের মণিতে ছলছল করতে লাগলো। দু চোখের পাতা বুঁজে পানিটুকুকে লুকানোর চেষ্টা চালাতেই পেছন থেকে ডাক শোনা গেল, ‘নাস্তা দিয়েছে ফুপু। খিদে থাকলে আসা হোক।’ হাতের ফোন বিছানায় ফেলে পেছনে তাকিয়ে আবারও অবাক হতে হলো৷ এ কোন মানুষের কন্ঠ শুনলো সে? গত পাঁচ দিনে সে এমন কণ্ঠ একটিবারও শোনেনি এবং অমন কোমল চোখ মুখও এর আগে দেখেনি। রক্ত শীতল করা চাহনি; সে ভুল দেখছে নাতো!
ফুরফুরে পাহাড়ি হাওয়া আর ঝলমলে কাঁচরঙা রোদ্দুরের হালকা উষ্ণতা। মন প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া এই আবহাওয়ায় কোলা বারান্দায় বসে সকালের নাস্তা। আর কি চাই সুখী মানুষের জীবনে৷ সবুজ গাছপালা ঘেরা পাহাড়ের উপর এক টুকরো জমিতে ছোট্ট একটা বাড়ি। বাড়ির পেছন দিকে ভয়ংকর খাঁদ। সে বাড়ির সামনেটা টুকরো টুকরো ফুলের বাগান , পাথুরে রঙা খাঁজকাটা মোজাইক ঘরের দরজা থেকে সদর দরজা অব্ধি। কাঠের তৈরি দেয়াল বাড়ির চারপাশে৷ শিকলটানা কাঠের গেইট। কি চমৎকার শুভ্ররঙা বাড়ি এক বাড়ি ঠিক যেন স্বপ্নে দেখা প্রাসাদ। নাস্তার টেবিলে তিনজন মানুষ অথচ টু শব্দটি নেই কারো৷ বাড়ির ভেতর এই তিনজন ছাড়াও আরো দুজন লোক আছে দুজনই পাহাড়ী এখানকার স্থানীয়। আনতুং আর উকাচুং দু ভাই বোন। উকাচুং বাংলা বোঝে না তেমন কিন্তু কাজে পটু হওয়ায় বাঙালি দাড়োয়ান তাকে ঠিক করেছে। উকাচুং এর বয়স বিশ কি বাইশ হবে কিন্তু খুব কাজের ছেলে। বাজার করা থেকে সবরকম কাজই ও একা করতে পারে। এদিকে তার বড়বোন আনতুং নিজেও এ বাড়িতে আসা যাওয়া করে। প্রয়োজনীয় অনেক কাজই করে দেয় রিশাদের ফুপুর৷ আর রাতে এ বাড়িতেই থাকে। বাড়িটা ছোট বলতে এতোটাও ছোট নয়। সব মিলিয়ে তিনটা বেডরুম আছে আবার একটা স্টোররুম৷ একটা রান্নাঘর সাথে একটা বাথরুম।
সকালের নাস্তার পর রিশাদ ফুপুকে কিছু বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেই রিশাদের ফুপু এসে নির্জনকে দিয়ে গেছে মেহউইশের কোলে। বারবার বলছিলো বাচ্চাটা সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে ওকে একটু খাইয়ে সাথে নিয়ে শোও। খুব আরাম পাবে। এত ছোট বাচ্চাকে এখনই কেন বাজারজাত দুধ দিতে হয়! ছ’মাসের আগে এসব কি জরুরি নাকি? মেহউইশ বুঝতে পারছিলো না তার জবাব কি দেওয়া উচিত। রিশাদ কি বলেনি নির্জনের মা নীলিমা সে নয়৷ সে তো রিশাদের জোর করে বিয়ে করা নতুন বউ৷ কিন্তু নাহ, কোন জবাব সে দেয় নি চুপচাপ নির্জনকে কোলে নিয়ে ঘরের দরজা এঁটে দিয়েছে । ফ্লাক্সে রাখা গরম পানিতে এক কাপ পরিমাণ দুধ বানিয়ে নির্জনকে খাইয়ে তার কাপড় বদলাতে নিতেই হাতের কাছে ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রীণে ‘মা’ লেখা দেখে রিসিভ করলো।
-কেমন আছো মা?
-তুই কেমন আছিস?
-আমি আগে জিজ্ঞেস করেছি।
‘ভালো আছি আমরা। তুই কেমন আছিস?’ ধরে আসা গলায় প্রশ্নটা করলেন মাইমুনা।
-ইভান কেমন আছে, তার হাত ঠিক হয়েছে মা?
-কাল রাতে ইভানের বিয়ে ছিলো মেহউইশ।
-‘কিহ!’ বজ্রের ন্যায় আচমকা বাজ পড়ার মত শোনালো মেহউইশের কণ্ঠস্বর। হাতে থাকা মোবাইলটা কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই নিচে পরে ভেঙে গেল স্ক্রীণের কাঁচ।
চলবে
(আনতুং এবং উকাচুং নাম দুটো আমি শারমিন সেজ্যোতি আপুর ‘তুমি মাদক হও বিঁধু’ উপন্যাস থেকে কপি করছি। আসলে পাহাড়ি নাম একদমই বের করতে পারছিলাম না )