মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৩২
রূবাইবা_মেহউইশ
💞
উষ্ণতা কপাল ছুঁয়ে মেহউইশের মন দুয়ারেও আছড়ে পড়েছে। রিশাদের ঠোঁটের রেখায় অবাধ্য উত্তেজনা আচমকাই মেহউইশের কপাল ছুঁয়ে দিয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের চোখ সওয়া অন্ধকারে চোখের পাতা কেঁপে কেঁপে উঠছে তার।ফেনিল ঢেউয়ের মত রিশাদের চুম্বন মেহউইশের অতৃপ্ত দেহে বিদ্যুতের ঝটকা খেয়ে গেল। সে রিশাদের পকেট থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে। কলটা প্রথমবার কেটে দ্বিতীয়বার আসতেই শরীর ঝিম মেরে গেল রিশাদের। সে নিজেই নির্জনকে এক হাতে ধরে অন্যহাত পকেটে ঢুকিয়ে ফোনটা বের করলো। অচেনা নাম্বার থেকে কল আসছে দেখে প্রথমে ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড নাম্বারটিকে মুখস্ত করার মত করে দু বার আওড়ালো।ফোনটা মেহউইশের দিকে এগিয়ে দিয়ে সে হোটেলের দিকে হাঁটতে লাগল। পেছন পেছন মেহউইশও চলে গেল তার। ফোনটা কানের কাছে ধরে হ্যালো,কে? কাকে চান! বলেই কল কেটে দিলো। বোঝা গেল রং নাম্বার।
হোটেলে ফিরে রিশাদ আজ কাপড় না পাল্টেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। নির্জনকে কম্বলে পেঁচিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। মেহউইশ আজকাল নিজের অভ্যাসে অনেক পরিবর্তন এনেছে। বলা যায় রিশাদকে অনুসরণ করেই এই পরিবর্তন। এই শীতের রাতগুলোতেও রিশাদ ঘরে ফিরে ঠান্ডা পানিতেই মুখহাত দোয়, ময়েশ্চারাইজার হাতে পায়ে লাগায় আবার চুলেরও খুব যত্ন নেয়। এগুলো দেখে মেহউইশের খুব হিংসে হতো। একটা ছেলে কেন এত যত্ন নিবে তার ত্বকের। এমনিতেই সে সুকুমার মুখবয়বের তার উপর শুভ্ররঙা ত্বক, কোমল পায়ের তালু। মেহউইশ কোন এক রাতে অনুভব করেছিলো রিশাদের পায়ের তালুর এই কোমলতা হঠাৎই তার মনে হলো তার হাতের তালুও এতোটা মসৃণ আর কোমল নয়। সেই থেকেই এই হিংসার উৎপত্তি। এতে তার অভ্যাসে বদল হয়েছে চমকপ্রদভাবে। কিন্তু আজ রিশাদের ঘরে এসে এমন নিস্পৃহতা তার ভালো লাগছে না। একটু আগেও রিশাদকে অন্যরকম লাগছিলো। হাতে পায়ে লোশন মেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু সময় নিজেকে দেখলো সে। বিয়ের পরের পরিবর্তন তার শরীরেও আছে একটুখানি৷ মোটা হয়েছে, চিবুকের নিচ ফুলে গেছে একটু তা খুব বেশি খেয়াল করলেই বোঝা যায়। মেদহীন পেটে কিছুটা চর্বির পরত পড়েছে। এমনটা সে অনেকদিন ধরেই বুঝতে পারছিলো কিন্তু এই পরিবর্তন সে একা নয় তার মাও ধরতে পেরেছিলো। কয়েকদিন আগেই ভিডিও কল করতেই বলেছিলো, ‘ তুই কি একটু মোটা হয়েছিস! ‘
আয়না থেকে সরতে গিয়েই আবার মনে হলো নাকফুল পরলে কেমন লাগবে!
ভোরের আলো ফুটতেই আজ বিতিকিচ্ছিরি ঘটে গেল রিশাদের ঘরে। নির্জন পায়খানা করে ডায়পার নষ্ট করে ফেলেছে। গন্ধ পেয়েই ঘুম ভেঙেছে রিশাদের৷ সে বিছানার চারপাশ চেক করতেই মনে হলো জেগে উঠা নির্জনের গা থেকে গন্ধ আসছে। সন্দেহ দূর করতেই সে নির্জনের ডায়াপার খোলে। প্রতিদিন ছেলেটা নিয়ম করে সকালে কিংবা দুপুরে পায়খানা করে। আজকের এই নিয়ম পরিবর্তনে কিছুটা বিরক্ত হলো যেন রিশাদ। আধবোজা চোখেই সে ডায়াপার পাল্টে নির্জনকে নিয়ে বাথরমে ঢুকলো৷ বিছানা থেকে কয়েক কদমের দূরত্ব তার বাথরুমের তবুও যেন এতটুকু পার হতে রিশাদের শরীরের সবটুকু শক্তি খরচ হয়ে গেল। সে নিঃসাড় শরীরে নির্জনকে ধরে পরিষ্কার করে আবার বিছানায় ফিরতে গিয়ে অনুভব করলো তা পা দুখানি চলছে না। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। চোখ দুটো অন্ধকার হয়ে আসছে বুঝতে পেরেই রিশাদ কুঁজো হয়ে নির্জনকে ফ্লোরে বসিয়ে দিতেই নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। ধপাস করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠলো মেহউইশ। ঘরে আলো জ্বলছে , বিছানায় রিশাদ,নির্জন নেই। বিছানা থেকে নামার আগেই নির্জনের কান্না শুনতে পেল সে। দ্রুত পায়ে বিছানা ছেড়ে সে নির্জনকে কোলে তুলে রিশাদকে দেখলো। হুঁশ নেই মনে হচ্ছে ।ভয় পেয়ে গেল মেহউইশ। নির্জনকে কোলে তোলে রিশাদের গালে হাত রাখতেই চমকে উঠলো। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার মেহউইশ তাকে ডাকালো; সাড়া নেই।
-‘এ্যাই শুনুন, উঠুন। আপনার তো অনেক জ্বর।’ রিশাদের সাড়া নেই অনেকবার ডাকার পরও আবার নির্জনেরও কান্না থামছে না। কি করবে কি করবে না ভেবে না পেয়ে আবারও রিশাদকে ডাকলো। নির্জনকে কোলে রেখে রিশাদকে টেনে তোলা তার পক্ষে অসম্ভব । ভোর হয়ে এসেছে রেহনুমা নিশ্চয়ই জেগে গেছে ভেবে আবার মেহউইশ দরজা খুলে রেহনুমাকে ডাকলো। রেহনুমা এলেও নির্জনকে থামাতে না পেরে মেহউইশ কান্নারত অবস্থাতেই তাকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। রেহনুমার সাহায্য নিয়ে রিশাদকে তুলে মেহউইশ বালতিতে করে পানি আনলো। শীত শীত আবহাওয়াতেও মেহউইশ ঘেমে গেল রিশাদকে বিছানার একপাশ থেকে অন্যপাশে সরিয়ে নিতে। সুঠামদেহী, লম্বা চওড়া, অচেতন রিশাদকে একটা মেয়ের পক্ষে একা নড়ানো সত্যিই খুব কষ্টদায়ক। তবুও মেহউইশ নিজ সাধ্যমত তাকে ঠিক করে মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। নির্জনের কান্না যখন বেড়ে দ্বিগুণ তখন মেহউইশ বাধ্য হয়েই রিশাদের ফোনে হাত দিলো। উপায় নেই আর বেহুঁশ রিশাদের আঙ্গুল ছুঁইয়ে ফোন আনলক করলো। কিছুটা ইতস্তত করেই সে ম্যানেজার সাহেবকে কল করে রুমে ডাকলো। ছেলেটা ডিউটি শেষ করে রাতেই নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়েছিলো। বাড়িতে তার মা,বাবা আছে। এত ভোরে কাউকে কিছু না বলে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসা দেখেই ঘাবড়ে গেলেন তারা।
সকাল আটটা নাগাদ রিশাদকে নিয়ে চট্টগ্রাম হাসপাতালে ছুটোছুটি করছে মেহউইশ। সে নিজেই ডাক্তারদের সাথে কথাবার্তা বলছে। ম্যানেজার সাহেব জোর করেই রেহনুমাকে হোটেলে রেখে এসেছে নির্জনকেও তার কাছেই রেখেছে। মেহউইশের কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট। ডাক্তার বলছে রিশাদের জ্বর হঠাৎ করে নয় আরো আগে থেকেই ছিলো। মেহউইশ ভাবছে কি করে সম্ভব! এতদিন ধরে তারা একই ঘরে একই বিছানায় থাকছে। কই তার তো কখনও মনে হয়নি রিশাদ একটিবারের জন্যও জ্বরে আর্তনাদ করছে কিংবা একটু দূর্বল হয়ে বিছানায় গা এলিয়েছে! তবে গত রাতে তার চুপচাপ শুয়ে পড়াটা চোখে লেগেছিল খুব৷ ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেল অনেকগুলো টেস্ট করাতে হবে হয়তো কিছুদিন হাসপাতালেও থাকতে হতে পারে।
অচেনা শহর,অচেনা পরিবেশ ; মোহউইশ অতিশিক্ষিত না হলেও কিছুটা পড়াশোনা জানা আবার হাসপাতালে কাজের সুবাদে ডাক্তারদের সাথে কথা বলাটাও সহজ। কিন্তু তবুও জড়তায় আছে সে প্রতিমুহূর্তে। রিশাদের অভিভাবকের জায়গাটাতে কে আছে! ভেবে পায় না সে এসময়ে রিশাদের পাশে কার থাকা উচিত। জেবুন্নেসাকে কি কল করবে? রিশাদের বাবা আছে সে না দেখলেও শুনেছিলো। বাবাকে ডাকবে? নাকি ফুপুই যথেষ্ট ! আবার মনে হলো সে নিজেই তো রিশাদের এই মুহূর্তে একমাত্র অভিভাবক , তার স্ত্রী । মন সায় দিলো না মেহউইশের। স্ত্রী বা স্বামী হলেই কেউ কারো অভিভাবক হওয়া যায় না।যেখানে সম্পর্কটাই আজ পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়নি সেখানে কেউ কারো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া অস্বাভাবিক। রিশাদের জ্ঞান ফিরলেও তার অবস্থা ভালো নয় এ অবস্থায় তার বাবা মাকে জানানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।অনেক ভেবে প্রথমে রেহনুমাকে আনতে ম্যানেজারকে পাঠানো হলো হোটেলে। রিশাদের আঙ্গুলের স্পর্শ নিয়ে ফোন পুনরায় আনলক করে প্রথমেই ফোন করলো রাইমার নাম্বারে। সব শুনে রাইমা বলল একটু অপেক্ষা করতে সে তার আব্বুকে জানাচ্ছে। মেহউইশের তবুও চিন্তা কমলো না সে আবার কল দিলো তার মাকে। মায়ের ফোন ব্যস্ত লাইনে পাওয়া সম্ভব হলো না।
মেহউইশের ভালোবাসার কুঠরিতে রিশাদের জায়গা নেই একটুও অথচ নির্দ্বিধায় ভাবনঘরে সে ছাড়া আর কেউ নেই৷ আশ্চর্যজনক ভাবে পরিস্থিতি মোড় বদলে দিচ্ছে জীবনের তা যেন চোখের সামনে স্পষ্ট মেহউইশের। সারাটা সকাল কাটলো হাসপাতালের এক বদ্ধ কেবিনে রিশাদের পাশে বসে। কখনও জানালায় তাকিয়ে যতদূর চোখ যায় সবুজ পাহাড়ে দৃষ্টি অথবা রিশাদের ঘুমন্ত ফ্যাকাশে মুখে। কাল রাতেও ওই মুখশ্রী ধারালো গাম্ভীর্যে পূর্ণ ছিলো। এক রাতেই যেন সকল গম্ভীরতা সমুদ্রের স্রোতের সাথে মিশে গেছে। মন ভার হয়ে আছে খুব৷ রেহনুমা নির্জনকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছেই আগে জানতে চাইলো রিশাদের অবস্থা । ইমিডিয়েট শুধু ডেঙ্গু টেস্টই করানো গেল। রিপোর্ট দুপুরে দেখবে ডাক্তার এরপরই হয়তো আবার বাকি টেস্টগুলোও করবে। মেহউইশ ভাবছে কিভাবে কি করবে রাইমা তো আর কল দিলো না। টাকা পয়সা বলতে রিশাদের দেওয়া হাজার আটেক টাকা ছিলো মোহউইশের কাছে। ম্যানেজার এসে সে বিপদ থেকেও উদ্ধার করলো। টাকার ব্যবস্থাও হয়ে গেল অথচ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত কারো খোঁজ পেল না৷ রেহনুমা বারবার কল দিচ্ছে তার ভাইকে। নো রেসপন্স।
সকাল সকাল আজ উকিলের সাথে এপোয়েনমেন্ট আছে জেবুন্নেসার। তার সাথে আছে রিহান। মা জানে ছেলে তার সাথে উকিলের কাছে যাবে কারণ মায়ের ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে তার আপত্তি নেই। কিন্তু কেন নেই তা জেবুন্নেসা জানতে পারেনি গত একমাসে অনেক চেষ্টা করে। শুধু জানে তার ছেলে তার সিদ্ধান্তে একটুও দুঃখী নয় এমনকি রিশাদের কাছে রিহান বলেছে সে বিদেশে চলে যেতে চায়। আর মা চাইলে মাকেও সাথে নিয়ে যাবে। এতেই যেন জেবুন্নেসার নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মা বলে মনে হয়েছে। তার ছোট্ট ছেলেটা তাকে সাথে নিতে চাইছে! রিহানের এই চাওয়া যে কতখানি দুঃখমাখা,কতোটা যে বেদনায় ভরপুর তা অজানা রিহানের মায়ের৷ মায়ের জীবনে অতীত জানার পরই সে মনে মনে চাইতো বাবা মরে যাক কিংবা তার জীবন থেকে হারিয়ে যাক দূরে কোথাও। এমন বাবা তার চাই না, প্রাচূর্যে ভর্তি জীবনটাতে সব আছে শুধু তার মায়ের মানসিক শান্তি নেই৷ অর্থ,অহংকার সব আছে কিন্তু তার মায়ের সম্ভ্রম নেই৷ ছেলে হয়ে মায়ের জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিকে নিজের মনে জমিয়ে রেখে বেঁচে থাকা বড় কষ্টকর। তার চেয়েও কষ্টকর হিংস্র পশুর ন্যায় বাবা নামক মানুষটার কাছে থাকা। তাই সে রিশাদের কাছে গিয়েছিলো৷ বারংবার রিশাদের পা ধরে বলেছিলো, ‘দাদাভাই আমাকে একটা সুযোগ করে দাও বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার। আমি বড় হয়ে তোমার সব ঋণ শোধ করে দেব। প্লিজ আমাকে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।’ রিশাদ নিজেও বাবার অর্থবিত্তের বলয় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে অনেক আগে তা জানে না তার ভাই বোন দুটো। সেদিন নিজের বুকে কষ্ট লুকিয়ে ভাইটাকে সে বলেছিলো ‘চেষ্টা করবো সাধ্যমত।’
জেবুন্নেসা উকিলের কাছে আসার আগেই রাইমার ফোন পেল। রিশাদের অবস্থা জানতেই সে রেগে গেল রিশাদকে কেন ঢাকায় আনছে না বলে। জেবুন্নেসার এই রাগের কথা মেহউইশ পর্যন্তও পৌঁছুলো। কিন্তু বাকি রইলো রিশাদের বাবার একটা ফোনকলের৷ রাইমা তার বাবাকে কি জানায়নি!
চলবে
( লেখায় মনযোগ একটু এদিক সেদিক হলেই শব্দ,বাক্য এমনকি পুরো পর্বটাই বাজে হয়ে যায় যা আমার হয়েছে। আশা করি ভুলগুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন)