মন_গহীনের_গল্প পর্ব-৩৩ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৩৩
রূবাইবা_মেহউইশ
💞

সন্ধ্যার ব্যস্তময় ঢাকা শহরে গাড়ির হেডলাইটের আলোগুলো জোনাকির আলোর মত মনে হচ্ছে। গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলো মেহউইশ। সারাটাদিন তার রিশাদদের বাড়িতে কেটেছে নির্জনকে নিয়ে। একটু আগেই রিশাদ ফোন করে তাকে ধমকেছে খুব৷ কেন সে ওই বাড়িতে গেল সেই অপরাধে তাকে এই মুহূর্তে হাসপাতালে পৌঁছানোর হুকুম দিয়েছে রিশাদ। নির্জনটা ঘুমিয়ে পড়েছে বলে রাইমার কাছে রেখে এসেছে তাকে। হাতে কিছু টাকা থাকায় রিশাদদের বাড়ির সামনে থেকে ক্যাবে উঠেছে। অসুস্থ মানুষ অর্ধেক দিন নিথর পড়ে থেকেও এখন কি তেজী স্বরে ধমকালো তাকে। ম্যানেজারের কারণে দ্রুতই প্লেনে করে ঢাকায় এসেছে তারা। তারপরই জেবুন্নেসা রিশাদকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ইমারজেন্সি সকল টেস্ট করিয়ে নিয়েছে। আধঘন্টার মত হলো রিশাদকে কেবিনে দিয়েছে। আর তাতেই লোকটা দুনিয়া উল্টেপাল্টে ফেলার চেষ্টা করছে।

গাড়ি এসে হাসপাতালে থামলে মেহউইশ ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লো। হাতে থাকা পার্সটাতে তার ফোন কিন্তু কাকে ফোন করবে বুঝে আসছে না। হাসপাতালে রিশাদের সাথে বড় মামা আর জেবুন্নেসা আছে এমনটাই বলেছে রেহনুমা৷ জেবুন্নেসার ফোন নম্বরও দিয়েছে কিন্তু কল করবে কি করবে না ভেবে রিশাদকেই ফোন দিলো। ওপাশ থেকে গলা শোনা গেল, ‘ এখনও এলে না কেন? ‘

-এসেছি। কোন ফ্লোরে আছেন?

– ‘তিন তলার প্রথম কেবিন।’ বলেই কল কেটে দিলো রিশাদ। মেজাজ খারাপ হলো মেহউইশের । যেখানে কল সে কাটবে সেখানে লোকটা নিজেই কেটে দিলো। যাচ্ছেতাই সব স্বভাব এই লোকের এমনটাই মনে হলো মেহউইশের । সে লিফটে ঢুকে তিন তলায় যাওয়ার জন্য সুইচ টিপতেই চোখে পড়লো ইভান দাঁড়িয়ে আছে সামনে। নাহ, সে লিফটের ভেতরে নয় বাইরে দাঁড়ানো। বুকের ভেতর কিছু একটা ছ্যাৎ করে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের পলকহীন চাহনি তারপরই লিফট থেকে বেরিয়ে আসার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। দ্রুত লিফট অফ করতে গিয়ে পঞ্চম তলার সুইচে চাপ লাগলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে মেহউইশের, দুনিয়া উলটপালট হয়ে যাচ্ছে কয়েক সেকেন্ডেই। একি হলো! ইভান এখানে কি করছে৷কান্না পাচ্ছে তার দরজাটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে৷ লিফট পঞ্চম তলায় থামতেই মেহউইশ বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে আবার নিচ তলায় যাচ্ছে। উপর, নিচ করে করে প্রায় আধঘন্টা যাবৎ সে পাঁচ তলা বিল্ডিংটাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। ইভানের ছায়াটারও দেখা পায়নি সে আর। কান্নার দমক এতক্ষণ যাবৎ গলায় কাঁটার মত আটকে ছিলো। তা হঠাৎ করেই জেবুন্নেসার ডাক শুনে ছিটকে বেরিয়ে এলো। প্রথম তলায় সিঁড়ির গোড়ায় পা ছড়িয়ে বসে কান্না করতে লাগলো সে। প্রিয় মানুষ, হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষটাকে আজ কতদিন পর আজ চোখের সামনে দেখতে পেল অথচ তাকে ছুঁয়ে দেখার ক্ষমতা হলো না। তার গলার স্বর, তার চোখে চোখ রাখা সবই দুঃস্বপ্নের মত হয়ে গেল।

-‘কি হয়েছে তোমার, এভাবে কাঁদছো কেন?’ জেবুন্নেসা পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো কিন্তু মেহউইশের কান্না থামলো না। জেবুন্নেসা কি করবে ভেবে না পেয়ে একটু কুঁজো হয়ে বাহু ধরলো মেহউইশের।

-‘কি হয়েছে তোমার? তুমি নাকি অনেকক্ষণ আগে এসেছো রিশাদ বলল।’ জেবুন্নেসার বলা কথা শুনতেই যেন মেহউইশের হুঁশ এলো। সে বসা থেকে উঠে সোজা দাঁড়ালো। ওড়না টেনেটুনে জামাটাকে ঝেড়ে ঠিক করে দাঁড়ালো। বা হাতে দু গালের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফোঁপানো তখনও পুরোপুরি তার বন্ধ হয়নি। মেহউইশের আচরণে আশ্চর্য হলো জেবুন্নেসা। মেয়েটা এমন করছে কেন আচানক তার বোধগম্য হচ্ছে না। এদিকে মেহউইশের মস্তিষ্ক বলছে তার ফোন কি এতক্ষণ বাজছিলো! সত্যিই বেজেছিলো ফোনটা তার। জেবুন্নেসা সামনে আসার আগেও সে পার্থিব সবকিছু ভুলে যেন অন্য জগতে চলে গিয়েছিলো। কি হয়েছে একটু আগে মনে নেই শুধু মনে পড়ছে রিশাদ তাকে যেতে বলেছে উপরে। কোন ফ্লোর যেন বলেছিলো!

-‘আন্টি উনি কোন ফ্লোরে?’

জেবুন্নেসা তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে মেহউইশকে। মেয়েটার কি মাথায় গন্ডগোল আছে কোন প্রকার! পাগল টাগল নয়তো আবার? কে জানে রিশাদ একেই কেন ধরে এনেছিলো! বিয়ের জন্য দুনিয়ায় মেয়ের এতোই কি অভাব ছিলো নাকি? তবুও যদি মেয়েটার অন্য কোথাও এ্যাফেয়ার না থাকতো, এসব ভাবতেই লাগলো জেবুন্নেসা ।

-‘ আন্টি!’ মেহউইশ আবার ডাকলো।

‘তিন তলায়।’ জেবুন্নেসা আরও কিছু বলবে তার আগেই মেহউইশ সিঁড়ি বেয়ে যেতে লাগল।

-‘হাফ সাইকো মেয়ে একটা!’ বিড়বিড় করতে করতে জেবুন্নেসাও চলে গেল।

কেবিনের দরজায় মুখটা কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে মেহউইশ।আবারও ধমক খেয়েছে সে রিশাদের কাছে উপরে আসতেই। আধঘন্টা আগে ফোন করে ফ্লোর জেনেও লাপাত্তা তাতেই রিশাদ চিন্তিত হয়েছিলো। লাগাতার ফোন করেও যখন মেহউইশের হদিশ পেলো না তখনই সে জেবুন্নেসা বলেছিলো, ‘ মেবিশ ফোন করেছিলো অনেক আগে। কত নম্বর ফ্লোরে আছি তা জেনেও এখনও সে পৌঁছায়নি। আপনি কি একটু দেখবেন সে হাসপাতালেই আছে কিনা?’ জেবুন্নেসা অবাক হয়েছিলো তখন রিশাদের কথা শুনে কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে মেয়েটা পাগল তা রিশাদ জানে। তাই ওরকম চিন্তিত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলেছিলো।

-‘নির্জনকে নিয়ে আসোনি কেন?’ রিশাদ প্রশ্ন করলো মেহউইশকে।

-‘আহ্ রিশু, কি শুরু করেছো? মেয়েটা এই ভর সন্ধ্যায় এসেছে আবার বলছো বাচ্চাটাকেও আনার কথা? এই চেন্জিং ওয়েদারে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।’ রিশাদের মামা কথাটা বলে তাকালেন জেবুন্নেসার দিকে৷ তিনি এসেছেন রিশাদকে হাসপাতালে আনার পরপরই। সেই থেকে এক পাও নড়েননি সাথে জেবুন্নেসাও। কিন্তু এবার মামা সিঙ্গেল সোফাটা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।

‘রিশাদের বউ তুমি তো রাতে এখানেই থাকবে। খেয়াল রেখো তার আর কোন প্রয়োজন পড়লেই তৎক্ষনাৎ আমাকে অথবা জেবুকে ফোন দিবে।’ মেহউইশের উদ্দেশ্যে কথা বলেই মামা জেবুন্নেসাকে বললেন, ‘চল আমরা বাসায় যাই এখন।’

-‘আমি এখানেই থাকবো ভাইয়া।’ বাচ্চাদের মত জেদি কন্ঠে বলল জেবুন্নেসা। রিশাদ আর তার মামা দুজনেই বিষ্মিত হলেন। রিশাদ বোঝে তার খালা মুখে যতোই কটুবাক্য বলুক না কেন মনে মনে সে রিশাদের ব্যপারে খুবই পজেসিভ। কিন্তু রাতে এখানে মেহউইশ ছাড়া অন্যকারো থাকাটা অপ্রত্যাশিত। মামা অবুঝ নন তিনি জোর করেই জেবুন্নেসাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন। রিশাদের মামা,খালা যেতেই মেহউইশের অস্বস্তি বেড়ে গেল৷ এতদিন একঘরে, একসাথে থেকেও এতোটা অপ্রস্তুত সে কখনো হয়নি। রিশাদের হাতে ক্যানোলা, ড্রিপ লাগানো। একজন নার্স এসে রিপোর্টস হাতে দিয়ে গেল মেহউইশের । রিশাদকে যে ডক্টর দেখেছেন তিনি আপাতত হাসপাতালে নেই। কাল সকালে আসবেন তিনি তাই রিশাদ বলল আজ আর রিপোর্টও দেখাবে অন্য কোন ডাক্তার। মেহউইশের অত সাহস কই সে কিছু বলবে তাই চুপই রইলো। মাইমুনা ফোন করেছিলেন মেয়ের সাথে কথা বলতে তখনি জানতে পারেন মেহউইশরা ঢাকায়। তিনি আর ধৈর্য্য রাখতে পারেননি মেয়েকে না দেখে থাকার। মিহাদকে নিয়ে হাজির হন হাসপাতালে। অনেকটা সময় মা, মেয়ে কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলে যখন কেবিনে ফিরলো তখন রিশাদ প্রথমেই বলল, ‘ গোপন কথা এখনও কিছু বাকি থাকলে শেষ করে এসো। এখানে কোন কাজ নেই তোমাদের। ‘

মেহউইশ কিছু বলবে তার আগেই মাইমুনা বলল, ‘ গোপন কথা না বাবা।তুমি অসুস্থ তাই তোমার যেন ডিস্টার্ব না হয় সেজন্য বাইরে,,,’

-হয়েছে থাক, আর বলতে হবে না। আরো কথা থাকলে বলো আসেন আমার সমস্যা নেই। আর তোমাকে বলছি, কাল সকালেই নির্জনকে দিয়ে গেলে তোমার বাড়িতে যাবে। খান বাড়ির ত্রিসীমানয়ও যেন ছায়া না পড়ে তোমার কিংবা আমার ছেলের।

রিশাদের কথায় মা,মেয়ে দুজনেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে।মিহাদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো কেবিনেই। রিশাদের কথা শেষ হতেই মাকে বলল, ‘যাওয়া যাক।’ মেহউইশ তার ভাইকে ধরেও টুকটাক কথা বলল । তারা চলে যেতেই রিশাদ ডাকলো, ‘এদিকে এসো।’

-জ্বী!

-বাংলা বোঝো না?

-জ্বী।

-ডোর লক করে এদিকে এসো।

মেহউইশ ভেবে পায় না একজন অসুস্থ মানুষ এভাবে কেন ডাকবে! ডাকার ধরণ এত ভিন্ন কেন? ভয়ে ভয়ে সত্যিই সে দরজাটা লক করে রিশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ক্যানোলা লাগানো হাতটা দিয়েই মেহউইশের একটা হাত চেপে ধরলো রিশাদ। রাগে তার চোখ মুখের রঙ বদলে গেছে। অসুস্থ, দূর্বল মানুষের গায়ের জোর এত বেশি হয় কি করে! মেহউইশের মনে হলো তার হাতের হাড়টা ভেতর থেকে ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে ।

-‘আমাকে নিয়ে এত ভাবার সাহস হয় কি করে? আমার বাবাকে ফোন করার তুই কে! আমি বলেছি আমার বাবাকে খবর দে? আমার চৌদ্দগুষ্টিকে ডেকে আমার চিকিৎসা করা? কোন ভয়ে সবাইকে জানিয়েছিস! আমি অসুস্থ হয়ে মরে গেলেইবা কি তোর বিয়ের দেনমোহর আমি আগেই পরিশোধ করে দিয়েছি৷ আমি মরলেও তুই শুধু দেনমোহর না আমার ভাগের সম্পত্তি যা আছে তা থেকেও ভাগ পাবি। আর কোনদিনও আমার অসুস্থতা কিংবা অসহায়ত্ব দেখে খান বাড়ির কোন কাকপক্ষীকেও খবর দিবি না অন্যথা তোর ঘাড়ে বিপদ ছাড়া আর কিছুই জুটবে না।’ কথা শেষ করে তবেই রিশাদ হাত ছাড়লো মেহউইশের৷ চমকপ্রদ জীবনটা আরো এক চমক দেখালো মেহউইশকে৷ কারো উপকার করতে গেলেও যে এমন ব্যথা পেতে হয়, অপমানিত হতে হয় তা শুধু রিশাদের কাছে জানলো সে৷ লোকটার কি কোনরকম মানসিক সমস্যা আছে কিনা তা জানতে ইচ্ছে করছে না। হাতটা চেপে ধরায় যতোটা ব্যথা লেগেছে তার চেয়ে দ্বিগুণ সে মনে মনে কষ্ট পেয়েছে। সন্ধ্যায় ইভানকে দেখে মনে ভেতর যে ক্ষত তাজা হয়েছিলো সেই ক্ষতের ব্যথাও এখন অনুভব হচ্ছে না তার।

তিশমা মন খারাপ করে বসে আছে হোটেলের তিন তলায়। বিলিয়ার্ড খেলার বোর্ডের পাশেই একটা চেয়ার এনে বসেছে৷ এখানে আজকে খেলছে না কেউই তাই জায়গাটা নীরব৷ মন খারাপের সময় নীরবতার চেয়ে ভালো কোন ঔষধ আর নেই৷ সমুদ্র তীরে হাটলে সমুদ্রের হাওয়া আর লাল কাঁকড়ার পালিয়ে বেড়ানো দেখলেও মনটা ভালো হয় কিন্তু এখন তার হাঁটার ইচ্ছেটাই নেই৷ রিশাদকে সে বন্ধুর মত ভালোবাসে। রিশাদের অসুস্থতা সত্যিই তাকে কষ্ট দিচ্ছে খুব। কিন্তু এ কথা মুখে বলে প্রকাশ করার মত নয়। ম্যানেজার সাহেব এখনও ফেরেনি ঢাকা থেকে তাই রিশাদের খোঁজটাও সে ঠিকঠাক নিতে পারছে না। রিশাদকে ফোন করবে করবে করেও মনে হলো করা উচিত হবে না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here