মন_গহীনের_গল্প পর্ব-৪৪ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৪৪
রূবাইবা_মেহউইশ
💞

প্রিয় রিশাদ,
আমার প্রথম এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ তুমি বাবা। আমার আর রেবুন্নেসা কলিজার টুকরো তুমি। আমি জানি বাবা হিসেবে আমি তোমার প্রাপ্তির খাতায় অর্থবিত্তের বাইরে কিছুই দিতে পারিনি এমনকি মা হারা তোমাকে ঠিকঠাক বাবার স্নেহটাও দেইনি৷ জীবনের অনেক বড় একটা সময় আমি মিথ্যে অহংকার আর দাম্ভিকতায় পার করতে গিয়ে সততা ভুলে গেছি। উত্তরাধিকার সূত্রে শুধু সম্পদই নয় রক্তের ভেতর ক্রোধ অহংকারের ধারাটাও পেয়েছি আমি এবং আমার ঔরসজাত হিসেবে তুমি আর রিহানও পেয়েছো। তবে আশাকরি আমার শেষটা যেমন হবে আমার সন্তানদের তা নয় কারণ তাদের দেহে শুধু আমারই না তাদের মায়ের রক্তও বিদ্যমান। জীবনে আমি অনেক পাপ করেছি আর সবচয়ে বড় পাপ বোধহয় আমি জেবুন্নেসাকে কষ্ট দিয়েই করেছি। তার মন থেকে আসা অভিশাপগুলো জীবনের এই শেষ মুহূর্তে সত্যি হয়ে গেল রে বাবা। দোষ দিচ্ছি না তাকে সেই ক্ষমতাও আমার নেই কিন্তু আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়ে যাচ্ছি দুনিয়ায় থেকে। শুনেছি তুই যাকে পরে বিয়ে করেছিস সেই মেয়েটি নাকি বিয়েতে রাজী ছিলো না, জোর করে বিয়ে করেছে আবার তার জীবনেও নাকি আগে থেকেই কেউ ছিলো। তোর জন্য লেখা চিঠিটা শুধুমাত্র তোমার এই জোর করে বিয়ে করার কারণেই লিখছি৷ আমি তো জানি তুমি যতোই রাগী যতোই দাম্ভিকতা দেখাস না কেন তোর ভেতরটা তোমার মায়ের মতোই কোমল৷ উপরের খোলস তোমাকে আমার প্রতিচ্ছবি প্রমাণ করলেও ভেতরটা রেবুরই মতন৷ আমার জীবনের অনেকগুলো পাপের পুনরাবৃত্তি তোর দ্বারা হয়েই গেছে জেনে প্রথমে এক পৈচাশিক আনন্দ পেয়েছিলাম। গর্ব করে বলেছিলাম জেবুন্নেসাকে, রক্ত কথা বলে। কিন্তু আজ এই অবস্থায় কোটি কোটি টাকায় তৈরি এই মহলে একলা থেকে বুঝতে পারছি সে গর্ব মিথ্যে । রাতের আঁধারে যখন এই বিশাল ঘরটিতে চোখ বুঁজে শুয়ে পড়ি তখন বুঝতে পারি আমার ঘুম নেই চোখের পাতায়। আমার পাশে আমার সন্তানেরা নেই, আমার স্ত্রী নেই৷ আমার যখন খুব ইচ্ছে করে দুটো কথা বলার তখন বাড়িভর্তি কাজের লোকের ভীড়ে আমার আপন একজন মানুষ নেই। কোটি কোটি টাকায় কেনা হাজারো কর্মচারী থাকে আমার অথচ দুন ভরসা করার মানুষ নেই। আমার করা অন্যায়ের শাস্তি তোমরা একজনও সামনে থেকে দাওনি কিন্তু সেই শাস্তি প্রকৃতি আমায় প্রতি সেকেন্ডে দিয়ে গেছে। বুকে আগলে রাখলাম না কেন তোদের , কেন বুঝলাম না আগে আমি যা করছি তা পাপ। আজ যে মুহূর্তে আমি উপলব্ধি করেছি সে মুহূর্তে আমার কোন সুযোগ নেই কারো কাছে মাফ চাওয়ার। জেবুন্নেসার সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। আমার বড় সন্তান আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আমার ছোট সন্তান আমার পরিচয়টাও মুছে দিয়েছে তার জীবন থেকে। সে তার মায়ের সন্তান হিসেবেই নাকি বড় হতে চায়, বেঁচে থাকতে চায় আর রাইমা আমাকে খুব ভালোবাসে কিন্তু কখনো আর বাবা বলে ডাকতে চায় না। ভয়ংকর একাকীত্ব আমি আর সইতে পারছিনা বাবা। যা যা করেছি সব ক্ষমার অযোগ্য আজ বুঝতে পারছি। আর তাই তোমাকে লিখছি তুমি যাকে বিয়ে করেছিস তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নে৷ তোমার শেষ পরিণতি যেন আমার মত না হয়। সময় থাকতে ভুল শুধরে নিও বাবা। আমি জানি তুমি রাইমা, রিহান,রেহনুমা কাউকেই অবহেলা করবে না তবুও শেষবারের মত তোমার কাছে অনুরোধ রইলো তাদেরকে আগলে রেখো।

ইতি
তোর কুলাঙ্গার বাবা

হাতের ফাঁক গলে পড়ে গেল চিঠিটা ফ্লোরে। খাটে হেলান দিয়ে তখনো বসে ছিলো রিশাদ। চিঠিটা পড়ে যেতে দেখে মেহউইশ এসে বসলো ফ্লোরে রিশাদেরই পাশে৷ চুপচাপ কাটলো কিছু সময় এরপর মেহউইশ জানতে চাইলো কি লেখা আছে চিঠিতে!

জমে থাকা বরফে যেন হঠাৎ কেউ আগুন ছুঁইয়ে গলিয়ে দিলো সবটা। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রিশাদ। সে কান্না হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় করা কান্না৷ সে কান্নায় ধারালো যন্ত্রণা মেশানো যা ক্ষত করে দিচ্ছিলো পাশে বসে থাকা মেহউইশের অন্তরও। কখনো কারে কান্না এতোটা তীক্ষ্ণও হতে পারে জানা ছিলো না মেহউইশের । তার চোখ ঘোলাটে হয়ে এলো অশ্রুতে সিক্ত হয়ে। মৃত্যুসংবাদ শোনার পরও যে চোখের পর্দা ভেদ করে জল নামেনি সে চোখে এখন পাহাড়ি ঝর্ণার অবাধ বয়ে চলা। আনমনেই মেহউইশ জড়িয়ে ধরলো রিশাদকে। সান্ত্বনা দিতে না জানা মেয়েটাও খুঁজতে লাগলো হাজারো সান্ত্বনাবাণী। হাজারো এমন শব্দ যা রিশাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই এ কান্না থেমে যাবে।

রাইমা,রিহান, রিশাদ তিনজনই চিঠি পড়েছে স্বনামীগুলো। রিশাদ ছাড়া বাকি দুজনের চিঠিতেই শুধু কয়েক অক্ষরে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে নিজের পাপাচারের জন্য; ওই দুজন সন্তানই বাবাকে ছেড়েছে শুধুমাত্র তাদের মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য ।খামে থাকা সকল লিগ্যাল কপি কাগজগুলো ছিলো রাশেদ খানের প্রতিটি সম্পদের বিবরণী। রিহান,রিশাদ,রাইমা, রেহনুমা সবার মধ্যেই সকল সম্পদের ওয়ারিশনামা আছে এমনকি ছোট্ট নির্জনও বাদ পড়েনি এর থেকে। কিন্তু এই অর্থ সম্পদ গ্রহণ করবে না কোন সন্তানই এমনটাই বলেছে তারা৷ জেবুন্নেসা কিছু বলতে চেয়েও রিশাদকে বলতে পারেনি৷ রেহনুমার অংশ রেহনুমা রেখেছে কিন্তু তা ভোগ করার সিদ্ধান্ত সে এখনও নেয় নি। মৃত্যু মানুষের জীবনে একটা ধাপ মাত্র; এখানেই শেষ নয়। ইহকালের ধাপ পেরিয়েই পরকালের জীবনে পা রাখা মাত্র। দুনিয়ার সকল কাজের হিসাব এবং তার ফলাফল ভোগের জীবনে প্রবেশ করতেই মৃত্যু একটা পথ। সময়ের স্রোতে বয়ে গেছে জীবনের গতি শ্লথ হয়ে তবুও থেমে যায়নি৷ রাশেদ খানের দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করারও কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। সবাই আপন কাজে আবারও লেগে পড়েছে ঠিকঠাক মতোই শুধু মাঝেমাঝে মৃত মানুষটার স্মৃতি হানা দেয় বুকের ভেতর। তেমনও স্মৃতি নেই রিশাদের জীবনে বাবাকে নিয়ে তবুও তো সে জন্মদাতা পিতা। তার বিয়োগে দুঃখ তো গ্রাস করবেই তাই করে৷ রিহানের মন নরম হয়ে গেছে গেছে কিন্তু তাতে আর লাভ কি! শেষ বেলায় তো বাবার মুখটাও সে দেখেনি। কাঁধে নেওয়ার ক্ষমতা থাকতেও বাবার লাশ কাঁধে তোলেনি৷ মায়ের সাথে যা হয়েছে তার শাস্তি বাবা দুনিয়া থেকেই পেয়ে গেছেন। বাবা যে অসহায়ত্বে পাগল হয়ে আত্মহত্যা করেছেন তারপরও আর বাকি থাকে কোথায় তার শাস্তি দেওয়ার! রাইমা কাঁদে এখনও প্রতিদিনই বাবার জন্য কিন্তু তার কি সাধ্য বাবাকে ফিরিয়ে আনার। তবে সে বাবার সন্তানের দায়িত্ব পালন করেছে ঠিক ঠিক। মৃত বাবার হয়ে সে তার মায়ের পায়ে পরেছে বাবার জন্য ক্ষমা চাইতে৷ জেবুন্নেসাও ভাবে মৃত মানুষের প্রতি আর ক্ষোভ কিসের!

বিষন্ন শীতের শেষে ত্বকে টান পড়া গরম আর বাতাসে বুনোফুলের নতুন করে আগমন। দিনের মধ্যাহ্নে নির্জনের ছুটোছুটিতে অতিষ্ঠ মেহউইশ একের পর এক ধমক দিচ্ছে। ছেলেটা আজকাল একদম কথা শুনতে চায় না। কে বলবে এই ছেলেটাই কিছুদিন আগেও কেমন নিঃশ্চুপ আর চুপ ছিলো। রেহনুমা রান্না শেষ করে মাত্রই গোসলে ঢুকেছে। নির্জনের খাওয়ার সময় হয়েছে বলে মেহউইশ ভাবছিলো সে পরে গোসল করবে আগে ছেলেটাকে খাওয়াবে। এখন মনে হচ্ছে সে আর আজকে সন্ধ্যের আগে সুযোগই পাবে না৷ এক লোকমা ভাত মুখে দিতেই নির্জন ঘর,বারান্দা,করিডোর সব দৌঁড়ে এখন এসেছে কর্টইয়ার্ডে। অনেক বলেও থামানো যাচ্ছে না তাকে। নির্জন দৌঁড়ে যখন গেইটের কাছে এলো তখনি দারোয়ান গেইট খুলল আর প্রায় সাথে সাথেই রিশাদের গাড়ি ঢুকল বাড়ির ভেতর। করিডোর থেকে নির্জনের সাথে চিল্লাতে থাকা মেহউইশ হাতের প্লেট ফেলে দৌঁড়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। ভয়ে তার আত্মাটাই যেন উড়ে যাচ্ছিলো দেহ থেকে৷ আরেকটু হলেই তো নির্জন গাড়ির চাকায় পিষ্ট হতো ভেবেই কান্না পেয়ে গেল তার। তাকে ওভাবে দৌড়ে আসতে দেখে রিশাদও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে এলো। কয়েক সময় নিয়ে রিশাদ বলল, ভেতরে এসো পানি খাও মেবিশ৷ ভয় পেয়ে ছিলে খুব!

রিশাদের এমন আদর করে কথা বলা শুনে রেগে গেল মেহউইশ। তার বুঝি কলিজাটাই ফেটে যাচ্ছিলো ভয়ে! রিশাদ বুঝতে পারলো মেহউইশের ভয় তাই নির্জনকে নিজের কোলে নিয়ে একহাতে মেহউইশকে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। ততক্ষণে রেহনুমাও বেরিয়ে এসেছিলো৷ মেহউইশের অমন চিৎকার শুনে সেও এসেছিলো বাইরে৷ রিশাদ ফুপিকে ইশারা করলো তেমন কিছু হয়নি। মেহউইশ একটু ভয় পেয়েছিলো।

‘কিছু হয়নি মানে কি? এখনই তো কিছু হতে পারতো।’ ঝাঁঝালো গলায় বলল মেহউইশ।

‘ আচ্ছা, রিল্যাক্স। আমি এমনিতেও গেইট দিয়ে স্লোলি ঢোকাই আর নির্জনকে আমি দেখেছি। তাকে দেখেই ব্রেক কষেছি তাই ওর জন্য কোন বিপদ হওয়ার ছিলো না’তো।’ রিশাদ খুব করে বোঝাতে চাইলো মেহউইশকে তার ভয় কাটানোর চেষ্টা করলো। এরপরই রেহনুমা প্রশ্ন করলো আজ সে এত তাড়াতাড়ি বাসায় কেন! প্রতিদিন তো লাঞ্চ সে হোটেলেই করে। কখনো সখনো খাবার নিয়ে যায় বাড়ি থেকে কিন্তু বাসায় এসে খায় না। রিশাদ বলল কাজ আছে একটু আর মেহউইশকে নিয়ে এক জায়গায় যেতে হবে। কিছু সময় বাদেই মেহউইশ যখন খাবার সাজাচ্ছিল টেবিলে তখনি রিশাদ গেল রেহনুমার ঘরে। রেহনুমা কিছু জিজ্ঞেস তার আগেই রিশাদ বলল, ‘ফুপি, আমি মেবিশের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে চাই। জীবন, মৃত্যু কিছুই তো আমাদের নিজের হাতে নেই। বাবার জীবনে যা ঘটেছে, তিনি নিজে যা করেছেন তার থেকে আমি একদমই ব্যতিক্রম নই। বাবার জীবনীর পুরোপুরি পুনরাবৃত্তি ঘটার আগেই আমি নিজেকে শুধরে নিতে চাই। যতোটা সম্ভব নিজের পথের কালোদিক সরিয়ে আলোয় চলতে চাই। আমার জীবনের ত্রিশটি বছরে কেউ আমার পথ নির্দেশক হয়নি,কেউ আমায় ঠিকঠাক ভালোমন্দ বুঝতে শেখায়নি। সময়ের সাথে এগিয়ে এসেছি আমি। কাজের লেকরা টাকার বিনিময়ে আমায় খুশি কিনে দিতো সেই খুশিতে তৃপ্তি কি জিনিস তা আমি কখনোই বুঝতে পারিনি। আজ আমি যা বুঝতে চাইছি তার জন্য আমার আব্বুর জীবনের প্রদীপ নিভেছে। আব্বুর মৃত্যু এবং তাঁর যন্ত্রণা আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে। যে পথ আমার আব্বু তৈরি করেছে, যে পথে হেঁটে এসেছি সে পথে আমি আমার সন্তানকে হাটাতে চাই না। আমার ভাইটাকেও আমি সে পথে চলতে দিতে চাই না। আর এসবের জন্য আমায় আগে নিজের সকল ভুলের ক্ষমাই জরুরি৷ মেবিশ ছাড়া আমি আর কাউকে মানসিক আঘাত দেইনি। খালাকে যেটুকু দিয়েছে তার জন্য বহুবার ক্ষমা চেয়েছি এবং পেয়েছিও। এবার আমার স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার বাকি৷’ বলতে বলতে থেমে গেল রিশাদ। রেহনুমা অপলক চেয়ে রইলো রিশাদের মুখের দিকে। কতেটা বদলে গেছে এই ছেলে! ঠিক কতোটা সে নিজেকে বদলে নিতে চাইছে? সে কি সত্যি চাইছে জীবনটাকে নতুন করে সঠিকভাবে শুরু করতে! চাইলে করুক শুরু । মেহউইশের সত্যি পাওনা আছে রিশাদের থেকে এমন কিছু।জীবনটা ক’দিনের কে জানে! সময় থাকতেই শুধরে নেওয়া উচিত সবার। এতে করে শেষটা সবার প্রাপ্তির না হলেও অন্তত তার মত বিচ্ছেদের হবে না। এমন বিচ্ছেদ, যে বিচ্ছিদে সে দোষ না করেও দোষী। ভুল না করেও অপবাদের চিহ্ন গায়ে থাকবে না। চোখের পাতা জলে টইটম্বুর হয়ে গেছে তবুও তা বাঁধ ভাঙেনি। নিজের একটি হাত উঁচিয়ে আলতো করে রিশাদের মাথায় বুলালো রেহনুমা। মনে মনে অজস্র দোয়া দিলো, সুখী হ তোরা। সুন্দর হোক তোর জীবনের মেহউইশের বন্ধনে বন্দী থেকে আমি মন থেকে দোয়া করি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here