মন_পাড়ায়
পর্ব_১১
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
প্রভা কারও ছোঁয়া পেতেই চমকে উঠে পাশে তাকালো। অর্ক তার দিকে চুলে ফুল গুঁজে দেয়। চোখে চোখ পড়লো। হলো প্রথম শুভ দৃষ্টি মিলন।
অর্ক সে চোখে ডুবেই বলল, “তোমার শাড়ির সাথে রঙে মিলেছে তাই লাগিয়ে দিলাম।”
প্রভা চোখ নামিয়ে নিলো। অর্ক উঠে দাঁড়ালো। জলে প্রভার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলল, “তোমার পছন্দের রঙ কী হলুদই?”
প্রভা মাথা নাড়িয়ে বলল, “পছন্দের কোনো রঙ নেই।”
“কেন?”
প্রভা জলের থেকে সে নকল সাদা শাপলাটি হাতে তুলে নিলো। সে শাপলার দিকে তাকিয়েই বলল, “যার নিজের জীবনই বেরঙা তার আবার পছন্দের রঙ হয়? যদি তবুও একটি বাছাই করতে হয় তাহলে সাদা বলব, রঙবিহীন।”
“সাদাতে যে কোনো রঙ মিশাও তা রঙিন হয়ে যাবে।”
প্রভা শাপলাটি পানিতে আবার রেখে বলল, “তাহলে কালো। কালোর সাথে কোনো রঙ মিশালে তার রঙ পাল্টায় না। রঙিন হয় না। কালো রঙটা সবসময়ই মানুষের পছন্দ অথচ তা মানুষের রঙ হলে অপছন্দ করে। আমার সাথে এই রঙ মিলে।”
অর্ক মাথা নাড়িয়ে বলল, “উঁহু, তোমার রঙ হওয়া উচিত হলুদ।”
প্রভা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
অর্ক উওর দিলো না। মৃদু হেসে চলে গেল সেখান থেকে।
.
.
ঝিনুকের ঘুম ভাঙে সকালে সৈকতের বুকে। সে ঘুম ঘুম কন্ঠে চোখ খুলে সৈকতকে দেখে বলে, “আমি কি আবার ঘুমে পড়ে গিয়েছিলাম?”
আবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখল তারা বিছানাতেই। ঝিনুক একবার ভাবল সৈকতকে বকা দিবে। কিন্তু ওর ঘুমন্ত চেহেরা দেখে থেমে গেল। আধশোয়া হয়ে একগাল হেসে সৈকতের গাল টেনে বলল, “ইশশ আমার জামাইটা কী কিউট! একদম হিরোদের মতো হ্যান্ডসাম।”
আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শুধু কর্মকাণ্ডগুলো না কিউট হয় আর না হিরোদের মতো হয়।”
ঝিনুক সৈকতের কপালের চুলগুলো সরি একখানা ভালোবাসার পরল আঁকল তার কপালে। আর বলল, “জানো, তোমাকে অনেক মনে পড়ে আমার। এই ঘরের সব দেয়ালে আমাদের যেন আমাদের লুকোচুরি প্রেমের গল্প লেখা, আজও মনে পড়ে সে দিনগুলো। এই শহরজুড়ে আমাদের স্মৃতির সাম্রাজ্য, আজও সে স্মৃতিগুলো উঁকি মারে মনে চাদর থেকে। তোমার আমার প্রেমের গল্প এই হৃদয়ের এক খাঁচায় বন্দী রেখেছি। সে প্রেমের পাখি বন্দী থাকুক না সে খাঁচায়। কেন বারবার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি কর যেখানে সে প্রেমপাখিটি আবারও উড়াল দিতে চায়?”
সৈকত একটু নড়ে চড়ে উঠতেই ঝিনুক আগের মতো শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
সৈকত চোখ খুলে দেখে ঝিনুক তার বুকের মাঝারে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। সে আলতো করে ঝিনুকের কপাল থেকে গালে পর্যন্ত আঙুল ছোঁয়াল। পরে বলল, “ইশশ পরী, ঘুমন্ত অবস্থা কেমন পরী পরী লাগে তোমায়। শুধু জাগলেই ডাইনীদের মতো ব্যবহার কর। আহ তুমি যদি তোমাকে স্লিপিং বিউটি হতে আর সারাক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতে কী ভালোই না হতো। আমি তোমাকে কিস করে একদমই উঠাতাম না। পাশে বসে শুধু দেখতাম তোমায়, নাহয় উঠলেই চাপর চাপর শুরু করে দিতে।”
ঝিনুকের প্রচন্ড রাগ উঠলো তারপরও সে চুপ করে শুয়ে রইল। সৈকত যখন আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলো তখনই চোখ খুলে এমন ভান করল যেন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। হাই তুলে চোখ খুলে সৈকতের দিকে তাকিয়ে তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলো। ঝিনুক বলল, “তুমি বিছানায় কী কর? তোমাকে না বলেছি নিচে ঘুমাতে?”
“আমার ঠান্ডা লাগছিলো। পরে অসুস্থ হয়ে গেলে তো তোমারই সেবা যত্ন করতে হতো। তাই ভাবলাম তোমাকে কষ্ট না দেই।”
“সেবাযত্ন মাই ফুট। তোমাকে নদীর মধ্যে ছেড়ে আসতাম।”
ঝিনুক ভেংচি কেটে বিছানা থেকে নিচে নামতেই সৈকত বলল, “এক মগ কফি দেও না।”
ঝিনুক সৈকতের দিকে তাকিয়ে মুখের প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলল, “কয় চামচ চিনি নিবেন স্যার?
” দেড় চামচ।”
“আর বিষ?”
সৈকতের হাসি মুহূর্তে উড়াল দিলো। সে একটু কেশে বলল, “লাগবে না।”
ঝিনুক বলল, “গুড বয়। আসছে নবাবজাদা আমাকে হুকুম দিতে। সাহস কত বড়!”
ঝিনুক ফ্রেশ হয়ে বাহিরে যেতেই ডাইনিং রুমে তার খালুকে পায়। খালু খবরের কাগজ পড়ছিলো। সে ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “তুমি গতকাল পরিশের গিটার ভেঙেছ?”
ঝিনুক মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বলল না। প্রভা বলল, “থাক না বাবা। নেও নাস্তা খাও।”
প্রভার বাবা খবরের কাগজ নামিয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকালো তার দিকে। তারপর ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এমন কেন করেছ?”
অর্ক রুমে এসে এমন বৈঠক দেখে একটু অবাক হলো। টেবিলের কাছে এসে সালাম দিল প্রভার বাবাকে। তিনিও সালামের উওর দিলেন। অর্ক ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কাঁদোকাঁদো চেহেরা নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আংকেল?”
“বল না মেয়েটা গতরাতে পরিশের পছন্দের গিটার নষ্ট করে ফেলেছে। কোনো কাজ তো পারেই না সব কাজ নষ্ট করে।”
“থাক না আংকেল, বাচ্চা মানুষ।”
খালু আবারও গম্ভীর গলায় বললেন, “কোন দিক থেকে ওকে বাচ্চা মনে হয়। সব ভুল মাফ করা যায় না। পরিশের সবচেয়ে পছন্দের গিটার ছিল। এইটা যে কেউ করুক, শাস্তি পেতেই হবে।”
“সরি খালু ভুল আমার ছিলো।” ঝিনুক সৈকতের কন্ঠ শুনে অবাক হয়। সামনে তাকিয়ে সৈকতকে দেখে। সৈকত সামনে এগিয়ে এসে ঝিনুকের পাশে দাঁড়ায়। বলে, “আমার হাত থেকে ভুলে পড়ে গিয়েছিলো খালু। আই এম এক্সট্রিমলি সরি।”
ঝিনুক অনেকটা ভয় পায়, খালু যদি সৈকতকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয়। তাই নিজের ভুল স্বীকার করাই উচিত ভাবল সে। কিছু বলতে যাবে তখনই খালু বলল, “আরে ভুলেই তো করেছ সমস্যা কি?”
খালুর হাসি উজ্জ্বল মুখ দেখে ঝিনুক হা করে তাকিয়ে রইল। উনি আরও বললেন, “একটা গিটারে কী আসে যায়, এমনিতেই তো ও বাংলাদেশের বাহিরে৷ আসার আগের সেম একটা গিটার কিনে দিব। তুমি যে এমন কিছু ইচ্ছা করে করবে না তা তো আমি জানিই। ভালো কথা আজকে ইন্টারেস্টিং একটা খবর পেয়েছি নাস্তা করে চা নিয়ে কথা হবে।”
“আরে খালু আমার কাছেও মশলাদার কতগুলো খবর আছে। একদম জমবে আড্ডা। শুধু একটা সমস্যা আমি চা বাদ দিয়ে দিয়েছি এখন কফি খাই।”
“তাই নাকি? তাহলে আমিও আজ কফি ট্রাই করে দেখব নে। ঝিনুক আমাদের দুইজনের জন্য কফি করে দিও।”
ঝিনুক হা করে একবার তার খালুর দিকে তাকায় আবার সৈকতের দিকে। আবার তার খালামণি ও প্রভার দিকে। তাদের চোখে মুখেও বিস্ময়।
সৈকত ঝিনুকের পাশ কাটিয়ে চেয়ারে বসতে যেয়ে বলে, “সৈকতের জাদু থেকে কেউ বাঁচতে পারে না। প্রমাণ পেলে এইবার?”
সৈকত যেয়ে বসল খালুর পাশের চেয়ারে। খালু অর্ক দিয়ে তাকালো। আগের মতো গম্ভীর গলায় বলল, “অর্ক তোমার যদি সমস্যা না হয় তাহলে কি আজ আমার ফুফুর সাথে দেখা করে আসতে পারবে প্রভাকে নিয়ে? উনি অনেক বয়স্ক তাই বিয়েতে আসতে পারে নি। কিন্তু তোমাদের দেখতে চেয়েছে।”
অর্ক মৃদু হেসে বলল, “অবশ্যই আংকেল।”
.
.
ঝিনুক কাজ প্রভাকে তৈরি করে দিয়ে রুমে এলো। তার ছোট মা বলেছিল সুন্দর মতো সাজিয়ে দিতে। যাদের বাড়িতে যাচ্ছে তারা যেন মনে না করে প্রভার দ্বিতীয় বিয়ে দেখে এমন ভাবে এসেছে। কথাটা অনেকটা আজব লাগলেও ঝিনুক কিছু বলল না।
রুমে এসে দেখে তার ফোনে কার যেন ফোন এসেছে চারবার। আননোউন নাম্বার। কল ব্যাক করে জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। ওপাশ থেকে এক পুরুষের কন্ঠ, “ঝিনুক বলছ?”
“জ্বি আপনি কে?”
“আমি অর্ণব। আজ ভার্সিটি আসোনি যে?”
“আমি একটু দূরে আছি তাই। কিন্তু আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?”
“অঞ্জলির কাছ থেকে। তোমাকে দেখি নি তাই বলে—-”
অর্ণব থেমে গেল ঝিনুকের কথা শুনে, “এইটা কোন ধরনের ফাইজলামি?”
সৈকত হঠাৎ করে এসে ঝিনুককে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে দুইহাত তার পেটে আবদ্ধ করে। আর তার চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়। ঝিনুক চমকে উঠে। বলে “এইটা কোন ধরনের ফাইজলামি?” তারপর তার মনে উঠে ফোনে অর্ণব আছে তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “ঘরে বাচ্চা আছে তো। দুষ্টামি করছিলো।” ঝিনুক তার আরেক হাত দিয়ে সৈকতের হাত সরানোর চেষ্টা করে।
সৈকত আরও শক্ত করে ঝিনুককে জড়িয়ে ধরে আর তার গলায়, ঘাড়ে নাক মুখ ঘষতে শুরু করে। ঝিনুক আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। নিশ্বাস হচ্ছে ঘন। অর্ণব ওপাশ থেকে বলল, “ও আচ্ছা। তাহলে কবে আসছ?”
ঝিনুক বহু কষ্টে উওর দিলো, “ক-কয়েকদিন পর। আমি আপনাকে পরে কল দেই, ও জ্বালাচ্ছে খুব।”
“হ্যাঁ অবশ্যই।”
অর্ণব ফোন কাটতেই। সৈকত ঝিনুককে নিজের দিকে ঘুরালো। তার কাঁধের দুইপাশের গ্রিল ধরে বলল, “আমি জ্বালাই তোমাকে?”
ঝিনুক চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “খুব।”
সৈকত একটু ঝুঁকে ঝিনুক গলায় থাকা তিলটায় আলতো চুমু খেল। ঝিনুক সাথে সাথে কেঁপে উঠলো। সৈকতের চোখ যেয়ে আটকালো তার ঠোঁটে। সৈকত এক ঢোক গিলে ঝিকের দিকে এগোতেই দরজা থেকে খটাখট শব্দ এলো। ওপাশ থেকে বিনুর কন্ঠ পাওয়া গেল, “ছোট মা ছোট মা আমাকে আর অদিনকে বাহিরে নিয়ে যাও না।”
ঝিনুক চোখ খুলে বিস্ময় নিয়ে তাকালো সৈকতের দিকে। এতক্ষণ যেন সে যেন অন্যরম এক ঘোরে ছিলো। সে গভীর এক নিশ্বাস ফেলে, ঝুঁকে সৈকতের হাতের নিচ দিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজা খুলে দেখল বিনু ও অদিন দাঁড়িয়ে আছে। সে আড়চোখে একবার সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল।”
সৈকত কপালে হাত রেখে বলল, “এই জালিম জামানা মেরে পেয়ারকা দুশমান। মনটা যায় পুরা পৃথিবীর উপরই একটা কেস কইরা দেই। যখনই একটু রোমেন্স করতে নিব তখনই কারও না কারও টপকায়তেই হবে। ধ্যুর!” রাগে গ্রিলে ঘুষি মারতে যেয়ে নিজের ব্যাথা পেল সৈকত।
.
.
অর্ক রুমে ঢুকে চমকে যায়। বিছানায় প্রভা বসে আছে। লাল হলুদ শাড়ি পরে। দুইহাত ভর্তি চুড়ি, কানেরদুল, ও গলায় একটি চিকন চেইন পরা। চুলে খোপা করা। সে বসে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে তার নুপুরের দিকে। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “আমারও কী পাঞ্জাবি পরতে হবে না’কি?”
প্রভা অর্কের কন্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে যায়। আমতা-আমতা করে বলল, “আপনার ইচ্ছা, তবে বিশেষ প্রয়োজন নেই।”
অর্ক দেখল প্রভার চোখের পলক ভেজা, কাজল লেপ্টে গেছে। অর্থাৎ সে কাঁদছিল। সে প্রভার সামনে গেল। প্রভার গালে হাত রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে তার চোখের নিচে লেপ্টে থাকা কাজল মুছে বলল, “আজ সকাল থেকে তো আমি তোমাকে কিছুই বলি নি, বাজে ব্যবহারও করি নি। ভালোভাবেই কথা বলছি, তাহলে কাঁদছ কেন?”
প্রভা একটু দূরে সরে গেল অর্ক থেকে। বলল, “আমি আপনার জন্য কখনোই কাঁদি নি।”
কথাটা যেন সুঁইয়ের মতো বুকে লাগল অর্কের।
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
পর্ব-১০ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1196456440723933/