মন_পাড়ায়
পর্ব_১২
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
প্রভা একটু দূরে সরে গেল অর্ক থেকে। বলল, “আমি আপনার জন্য কখনোই কাঁদি নি।”
কথাটা যেন সুঁইয়ের মতো বুকে লাগল অর্কের।
অর্ক আশেপাশে তাকাতে শুরু করল। বলল, “আমিও তাহলে পাঞ্জাবি পরে আসছি।”
অর্ক তার ব্যাগ থেকে একটা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। বের হয়ে আয়নার সামনে হাত দিয়েই চুল আঁচড়ে নিল। আর মানিব্যাগ ও গাড়ির চাবি নিয়ে বলল, “আসো।”
প্রভা উঠে রুম থেকে বের হতে নিলো তখনই আচমকায় অর্ক তার খোঁপার কাটা খুলে দিলো। ঝরঝরে পরল তার ঘন কালো কেশ। পিছনে তাকিয়ে মুখটা মলিন করে বলল, “এইটা কী করলেন? আমার খোঁপা করতে অনেক সময় লেগেছিল।”
অর্ক আরেকটু সামনে এগিয়ে এসে প্রভার চুলের একপাশে হাত দিয়ে সিঁথি কেটে ঠিক করে দিলো। আর বলল, “এখন বেশি ভালো দেখাচ্ছে।। আমি বাহিরে যেয়ে গাড়ি বের করছি। তুমি আসো।”
অর্ক সেইখান থেকে চলে গেল। গাড়িতে বসে অপেক্ষা করে প্রভার। প্রভা আসে কিছু মুহূর্ত পর। সে চুলে আবারও খোঁপা করেছে। তবে এইবার অনেকটা এলোমেলো তার কেশ।
অর্ক কিছু না বলেই গাড়ি চালু করল। জিজ্ঞেস করল, “তুমি বলেছিলে তুমি বিনয়কে ঘৃণা করে এখন অথচ তার পছন্দের খোঁপা ঠিকই আজও কর।”
প্রভা তাকিয়ে রইলো জানালার বাহিরের দিকে উদাসীন মনে। বলে, “খোঁপা ওর পছন্দের ছিলো না। আমি খোলা চুলে কেউ দেখুক তা শুধু অপছন্দের ছিলো।”
“আজও ওর পছন্দ অপছন্দের এত চিন্তা?”
“না, শুধু অভ্যস্ত হয়ে পরেছি। অভ্যাস একবার লেগে গেলে ছুটতে চায় না। তা মানুষের হোক, জিনিসের হোক কিংবা অনুভূতির।”
অর্ক অবাক হয়ে একপলক প্রভার দিকে তাকালো। আবার সামনে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “অনুভূতির কীভাবে?”
“মানুষ সুখের অভ্যস্ত হয়ে গেলে দুঃখ তাদের সহ্য হয় না এবং যারা দুঃখে অভ্যস্ত তাদের সুখ দেখলে ভয় লাগে।”
প্রভা বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এক যুগ আগে এইসব রাস্তা তার চেনা ছিলো যা আজ অচেনা হয়ে পড়েছে। সবকিছু কত দ্রুত বদলে যায়!
.
.
বিকেল হয়ে এলো। ঝিনুক ছাদের বর্ডারে বসে আছে।তার পরনে একটি গাড় লাল স্কার্ট যেখানে কালো রঙের কাজ ও কালো রঙের টপ। সাথে লাল রঙের একটি স্কার্ফ পরা। সে তাকিয়ে আছে তার পায়ের আলতার দিকে। পাঁচ মিনিট হলো দিল। অথচ এখনই পা ডুবিয়ে দিলো পুকুরের জলে। তার আঁকা লাল আলতা মুহূর্তে মিশে যাচ্ছিলো পানিতে। ঝিনুক তা দেখছিল মগ্ন হয়ে। আর সে মগ্নতায় অতীত কথা মনে পড়ল তার।
অতীতে এই পুকুরটা ছিলো না। কিন্তু ছাদে বসে সে প্রায়ই আলতা মাখত পায়ে। সেদিনও ব্যতিক্রম ছিলো না। সে যখন আলতা মাখছিল তখন তার খালামণি ডাক দিয়ে বলল, “ঝিনুক তুই কী ছাদে? নিচে আয় তো।”
ঝিনুক একবার তার আলতোভরা পায়ে তাকাল। আবার তা রেখেই উঠে চলে গেল নিয়ে যেয়ে কেউ বসে আছে তার খালুর সাথে। পর্দা লাগানো দেখে চেহেরা দেখতে পেল না। রান্নাঘরে যেয়ে খালামণিকে জিজ্ঞেস করল, “কে এসেছে খালামণি?”
“বিনয়ের পরিচিত একজন, তুই বোধহয় চিনিস না। আগে প্রায়ই বিনয়ের সাথে আসতো। আজ অনেক বছর পর এলো।” খালামণি এক ঝিনুকের দিকে এগিয়ে দিয়ে আবারও বলল, “এইটা নিয়ে ড্রইংরুমে দিয়ে আয়।”
ঝিনুক গেল ড্রইংরুমে। সেখানে যেয়ে দেখে একটি ছেলে কথা বলছে খালুর সাথে। মুখ দেখতে পেল না। ঝিনুক সামনে এগিয়ে ট্রে টা টেবিলে রেখে মুখ তুলতেই দেখে ছেলেটা সৈকত। সাথে সাথে তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল।সে মুখ ফুটে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো।
সৈকত তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছিল। সে খালুকে বলল, “আংকেল এইসবের প্রয়োজন নেই। আমি এমনিতেও এখন চলে যাব। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।”
“আরে না কিছু খেয়ে যাও। এতটুকু সময়ের জন্য আসলে হয় না’কি?”
“আরেকদিন আংকেল। আজ যাই। আচ্ছা আংকেল আপনার নাম্বারটা দেওয়া যাবে? আজ বাসা খুঁজে পাই নি। যদি নাম্বার থাকতো তাহলে খুঁজতে সমস্যা হতো না। এছাড়া বিনু প্রায়ই আপনাদের কাছে আসার জেদ করে, ভাবি তো ব্যস্ত থাকে তাই মাঝেমধ্যে আমি নিয়ে আসতে পারতাম।”
“অবশ্যই।” বলে খালু ফোন বের করল। সৈকত আবারও বলল, “আংকেল আপনি তো ব্যস্ত মানুষ যদি ফোন না ধরতে পারেন? ল্যান্ডলাইনের নাম্বার দিলে সুবিধা হতো।”
ঝিনুক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। কত সুন্দর মতো নিজের কাজ বের করে ফেলল!
খালু বলল, “একটু দাঁড়াও আমি লিখে আনছি।”
খালু যেতেই ঝিনুক সৈকতের সদিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি পাগল না’কি? আসলে বাসায় এসে পড়েছেন নাম্বার নিতে?”
“অফকোর্স সুইটহার্ট, তোমারও জানা উচিত সৈকত কোনো চ্যালেঞ্জে পরাজিত হয় না। আর হ্যাঁ রাতে কল দিব, তুমিই ধরবে।”
“ওহ হ্যালো, আমি আপনার কথা মানবো কেন? আমি ধরব না, যখন খালু ধরবে তখন বুঝবে।”
হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিলো ঝিনুক।
সৈকত বলল, “ঠিকাছে তাহলে খালু ধরলে আমি বলব তোমার আমার প্রেম চলে তাই আমি কল দিয়েছি।”
ঝিনুক তার হাতের ভাঁজ খুলে অবাক হয়ে তাকালো সৈকতের দিকে। রাগী কন্ঠে বলল, “আপনার সাথে আমার কবে থেকে প্রেম চলে?”
“চলে না তো কী হয়েছে? চলবে। ফোন ধর, নাহলে পরে বুঝবে।”
“একদম না। আমি ফোন ধরবই না। দেখি কী করেন।”
বলেই চলে গেল ঝিনুক। অথচ রাতে সে অপেক্ষা করল ফোন এলো না।
ফোন এলো দুইদিন পর। অবাক করার বিষয় হলো সেদিনও ঝিনুক অপেক্ষা করছিলো। রাতে ফোন এলো। দুই রিং বাজতেই ফোন উঠিয়ে নিলো ঝিনুক। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ এলো। সৈকত বলল, “অপেক্ষা করছিলে তাই না?”
ঝিনুক প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলল। বলল, “একদম না।”
“তুমি গত দুইদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলে।”
খালামণির দরজা দিয়ে বের হতেই ঝিনুক ফোন নিচে নামিয়ে নিলো। সে জিজ্ঞেস করল, “ঝিনুক কে ফোন করেছে রে?”
“রং নাম্বার খালামণি।”
খালামণি আবার ভিতরে চলে গেল। টেলিফোনটা ছিলো তার রুমের দরজার কাছেই। সে টেলিফোন উঠিয়ে নিজের রুমে গেল। দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বলল, “এইবার বলুন।”
“মিথ্যা বললে কেন?”
ঝিনুক উওর দিলো না। সৈকত আবারও হেসে জিজ্ঞেস করল, “আজ রাত কথা বলতে পারি?”
“একদম না, আমার ঘুম আসছে।”
অথচ ঝিনুক ফোন রাখল না। কানের কাছে ধরেই রইল। ফোনের ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শোনা গেল। সৈকত জিজ্ঞেস করল, “কলেজে উঠেছ তাই না? কলেজ কেমন লাগছে?”
এভাবেই কথা চলতে থাকলো। কতক্ষণ? ঝিনুক সময় তো দেখে নি।
.
.
জায়গাটা ঢাকার বাহিরে ছিলো বিধায় পৌঁছাতে সময় লেগেছিলো। প্রভার আত্নীয়রা অনেক আপ্পায়ন করল অর্কের। কিন্তু প্রভাকে কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে সেখান থেকে আসার সময় থেকেই।
রাস্তায় গাড়িটা হঠাৎ থেমে গেল। অর্ক নিচে নেমে দেখে টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে। আশেপাশে শুধু ক্ষেত, পুকুর ও গাছপালা। আরেকটু সামনেই কয়টা চায়ের দোকান ছিলো। অর্ক সেখানে যেয়ে সাহায্য চাইল। একটা ছেলেকে পাঠানো হলো মেকানিক আনতে। ফেরত এসে দেখে গাড়িতে প্রভা নেই। ফোন দিয়ে দেখে ফোন গাড়িতেই। অবশ্য তার বেশি চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ল না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো কিছুটা দূরত্বে এক হলুদ লাল শাড়ি পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুকুর পারে। অর্ক সেখানে যেয়ে পাশে দাঁড়ালো প্রভার। প্রভা তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবার তার দিকে তাকিয়ে বলল, “মাফ করবেন না বলে এসে পরেছি। চলুন ফেরত যাই।”
প্রভা যেতে নিলেই অর্ক তার হাত ধরে নিলো। মুহূর্তখানিক পর ছেড়েও দিল।বলল, “গাড়ি ঠিক হতে সময় লাগবে। এখানো মেকানিক আসে নি। ততক্ষণ এখানেই দাঁড়াই।”
প্রভা আগের জায়গায় আবার দাঁড়ালো। তাকিয়ে রইল পুকুরটার দিকে। অর্ক তাকালো প্রভার দিকে। আবার সামনে তাকালো। অর্ক বলল, “তুমি আবারও কান্না করেছ?”
প্রভা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো অর্কের দিকে। অর্ক মৃদু হাসলো। মেয়েটা হয়তো জানেই না ও চোখ, গাল মুছলেই ওর চোখগুলো মুছে যায় না। ও পলকগুলোতে ওর চোখের নোনাজল তখনও আটকে থাকে।
অর্ক প্রভার দিকে ফিরে তাকালো। সামনে এগোল। চোখে চোখ রাখল।
প্রভা সে মুহূর্তেও বুঝতে পারছিলো না অর্ক কী করতে চাচ্ছে। শুধু বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। কেননা, আজ পর্যন্ত কেউ তার হাসিটাও খেয়াল করে নি এই মানুষটা কান্না লক্ষ্য করল কীভাবে?
অর্ক প্রভার খোঁপার কাঁটা খুলে দিলো আবারও। পুকুর পারের মিষ্টি ঘ্রাণের হাওয়া এলো তীব্র বেগে। মুহূর্তে প্রভার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। সে সময় যখন সূর্যোস্তের কমলা আভা তার উপর এসে পড়ছিল তখন যেন অর্কের মনে হচ্ছিলো অসময় তার জীবনে বসন্ত এসে পড়েছে, আবারও।
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
পর্ব-১১ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1197894847246759/
পিক- আলাউদ্দিন ভাইয়া