মন_পাড়ায় পর্ব_২২

মন_পাড়ায়
পর্ব_২২
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

অঞ্জলি পিছনে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো সাবেকের দিকে। বলল, “তুমি বলবে না যে অর্ণব ভাইয়া আমার পিছনে দাঁড়ানো?” উঠে আবার দাঁড়িয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি উনাকে থামাও, নাহয় বড়সড় একটা তামাশা হয়ে যাবে।”

সাবেক অঞ্জলির হাত ধরে বলল, “আরে দরকার কী? একটু তামাশা হোক, আমরা সিঙ্গারা অর্ডার দেই। ফ্রী’তে মজার একটা সিনেমা দেখা হয়ে যাবে।”

অঞ্জলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সাবেকের দিকে। সাবেক আবারও বলল, “কয়টা সিঙ্গারা অর্ডার দেই?”

অঞ্জলি বিরক্ত হয়ে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঝিনুক তুমি কিছু একটা কর।”

“আমি তো ফুসকা খেতাম। সিঙ্গারার সাথে ফুসকা অর্ডার দেই?”

অঞ্জলি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। বিরক্তি নিয়ে বলল, “ঝগড়া থামানোর জন্য কিছু কর।”

“ধ্যুর কয়টা মেরে আসুক কার কী?”

“ঝিনুক এইটা মজার সময় না। অনেক বড় একটা তামাশা হয়ে যাবে। এমনিতেই অর্ণব ভাইয়া ও সৈকত ভাইয়া একে অপরের চরম শত্রু। কি না কি হয়ে যায় কে জানে? গতবার প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে খবর পৌঁছে গেছিলো। এইবারও যদি জানে একটা মেয়ের কারণে এইসব করছে দুইজনকে সাসপেন্সও করে দিতে পারে।”

ঝিনুক কিছুক্ষণ চোখ দুটো ছোট ছোট করে অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর উঠে গেল।

ইকবাল বলল, “দেখ অর্ণব আসছে। রাগে মনে হচ্ছে ওকে।”

নীরা বিরক্তি নিয়ে বলল, “নট আগেইন। ওর একবছর পুরনো আশিকী এখনো যায় নি? আবার একখানে একটা সিন ক্রিয়েট করতে এসেছে?”

“সম্ভবত না। সৈকতে ওর পছন্দের মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়েছিল, পরিবর্তে অর্ণব আমাদের সৈকতের বউকে মন দিয়ে দিয়েছেন।”

“হোয়াট দ্যা হেল! আমাদের ঝিনুককে এই আবালে পছন্দ করে?”

“মনে তো হয়।”

নীরা তার হাতটা মুঠোবন্দী করে তা বলে বলল, “দাঁড়া আমি মজা দেখিয়ে আসছি। আর কখনো ঝিনুকের উপর নজরও দিবে না।”

সৈকত ইকবাল ও নীরার কথোপকথনে কিছুই বলছিল না। সে শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সামনের দিকে। তার চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো। অর্ণব তাদের টেবিলের সামনে আসতেই সে উঠে দাঁড়ালো। প্রস্তুতি নিতে শুরু করল এক বিরাট ঝামেলার।

অর্ণব তার সামনে আসার পূর্বেই ঝিনুক তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল, “আমার জন্য এত ঝামেলা করার প্রয়োজন নেই।”

“ঝিনুক ও তোমার সাথে বাজে ব্যবহার….. ” ঝিনুক অর্ণবের কথা কেটে বলল, “আমি বলেছি আমার জন্য এ-সব ঝামেলা করার প্রয়োজন নেই। ওর কথায় আমার কিছু আসে যায় না। চলুন আমার সাথে।” ঝিনুক অর্ণবের হাত ধরে তাদের টেবিলের দিকে ফেরত নিয়ে গেল। সৈকত কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে দৃশ্যের দিকে।

নীরা একটু কেশে বলল, “বুঝলি মামা কেউ তো জ্বইলা পুইড়া ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে।”

সৈকত সে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো নীরার দিকে। নীরা হাই তুলে বলল, “আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে লাভ নাই আমি এইসবে ভয় পাই না। এইবার বল ভার্সিটির পর কী বিশেষ প্লান আছে?”
.
.
ঝিনুক ভার্সিটির ক্লাস শেষে আসলো দুপুর আড়াইটায়। এসে ভীষণ ক্লান্ত ছিলো তাই গোসল করে ঘুম দিলো একটা। ঘুম থেকে উঠালো সৈকতের মা। ঝিনুক ঘুমের তালে ছিলো বিধায় নিজ হাত খাইয়ে দিলো তারপর অনেকক্ষণ গল্প করলো তার সাথে আবার গল্প করলো দাদীমা’য়ের সাথে। মানুষ বলে বিয়ের পর জীবনটা পরিবর্তন হয়ে যায় খারাপ দিকে। অথচ তার ভালোই লাগছে এই বাসায়। অবশ্য ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না দাদীমা পড়ার জন্য বকা দিয়ে পাঠালো তাকে রুমে। বই দেখলেই তার মাথা ঘুরানো শুরু করে। ছোট বেলায় ভাবতো বিয়ের পর সে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে। অথচ যে লাউ সেই কদু। পড়া বোধহয় জীবনেও পিছু ছাড়বে না।

ঝিনুক বই খুলে দেখে আজ ক্লাসে যা পড়েছিল সব তার মাথা থেকে ছুঁ মন্তর হয়ে গেছে। তবুও কিছুক্ষণ পড়ার ভান করা শেষে সে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। সৈকত তখনও এলো না। মা এক প্লেট খাবার তাদের রুমে দিয়ে গেছে। ঝিনুক ভেবেছিল সে ঘুমিয়ে পড়বে, ওই লোকটার অপেক্ষা করে কে? তবুও কী বুঝে অপেক্ষা করল। বিছানায় বসে বসে মোবাইল টিপছিল আর একটু পর পর তাকাচ্ছিল দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। তবুও সৈকত আসছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সামনে তাকাতেই দেখে সৈকত রুমে ডুকছে। তার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে, গালে রক্ত জমে আছে হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সৈকত সোজা ওয়াশরুমে যেতে নিলেই ঝিনুক ডাক দিলো তাকে। সৈকত ফিরে তাকালো। ঝিনুক বিছানার উপরই দাঁড়িয়ে দুই কোমরে হাত রেখে বলল, “এইদিকে আসো।”

সৈকত ঝিনুকের দিকে গেলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

ঝিনুক ঝুঁকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে পর্যবেক্ষণ করল সৈকতের মুখখানি। জিজ্ঞেস করল, “এইসব কোথা থেকে করে এসেছ?”

“কোনসব?”

ঝিনুক সৈকতের গালে রক্তজমা স্থানে খোঁচা মেরে বলল, “এইসব।”

সৈকত তার গালে হাত দিয়ে বলল, “এইভাবে কেউ জিজ্ঞেস করে হৃদয়হীনা নারী। আর তোমার কী? তুমি তো অন্যকারো চিন্তায় মরে যাচ্ছিলে, তার চিন্তাই কর। আমার চিন্তা করার কী প্রয়োজন?”

সৈকত ফেরত যেতে নিলেই ঝিনুক বিছানা থেকে নেমে তার দৌড়ে তার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। বলল, “এহ আসছে নিজে আমাকে সম্পূর্ণ ক্যান্টিনের সামনে অপমান করেছে তার কিছু না। আর এখন আমি স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছি তুমি চুপচাপ বসবে।”

“কোনো প্রয়োজন নেই তোমার সেবা যত্নের।”
বলেই সে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে ঝিনুক ফার্স্ট এইড বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সৈকত তার কাটিয়ে যেয়ে বিছানায় বসতেই ঝিনুক একটু তুলায় স্যাভলন নিয়ে ঝুঁকতেই সৈকত উঠে দাঁড়ালো। ঝিনুক তার কাঁধে হাত দিয়ে আবার বসায় আবারও উঠে দাঁড়ালো। ঝিনুক রেগে মেগে বলল, “সমস্যা কী তোমার?”

“আমি তোমার হাতে কিছু লাগাবো না।”

“কেন আমার হাতে কী কাঁটা লাগানো?”

“এমনই ভেবে নেও।” ঝিনুক কথাটা শুনে আবারও সৈকতকে বসিয়ে তার কোলে বসে পড়লো। সৈকত হতবাক। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। ঝিনুক বলল, “তাইলে কাঁটাই সহ্য কর।”
ঝিনুক আলতো করে ফুঁ দিলো সৈকতের গালে। আর স্যাভলন লাগিয়ে দিলো তার আঘাতের স্থানে। সৈকত ব্যাথা চোখ বন্ধ করে আবারও খুলল। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। আলতো করে তার কোমরে হাত আবদ্ধ করতেই কেঁপে উঠলো ঝিনুক। তাকাল সৈকতে দিকে। সৈকতের এমন মুগ্ধ নয়নে যেন ডুব দিলো সে।
.
.
ভীষণ অন্ধকার। চারদিকে কিছু দেখা যাচ্ছে না শুধু আঁধার আর আঁধার। এক জঙ্গলের মাঝে আছে সে। চারদিকে কেউ নেই। সে দৌড়াচ্ছে গাছ পালার মাঝে। কিসের থেকে?
সে জানে না। জানে সে শুধু না পালালে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক বিকৃতি এক প্রাণী তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশাল কালো এক ধূম্র দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ধূম্রটার বিশাল দুই চোখ, চোখ ও দুই হাত। সে হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠলো।

চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠতেই দেখে অর্ক তার সামনে বসা। তার দুই গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “প্রভা….., প্রভা তুমি ঠিক আছ? দুঃস্বপ্ন দেখেছ?”

প্রভা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে শুরু করল। বিস্মিত দৃষ্টিতে অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই’যে ওইটা……”

“কিছু নেই। তুমি স্বপ্ন দেখেছ শুধু।”

“কিন্তু…… ” প্রভা আর কিছু বলার পূর্বেই অর্ক তাকে বুকে টেনে নিলো। প্রভা আর কিছু বলল না। প্রভা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছিল শুধু। অর্কের গেঞ্জিটা আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে।

প্রভার মা দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করল। আর বলল, “প্রভা…মা দরজা খুল….”

অর্ক প্রভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুমি বসো আমি দরজা খুলে আসছি।”

অর্ক উঠতে নিলেই খেয়াল করল প্রভা তার গেঞ্জিটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে, ছাড়ছেই সে। তার চোখে মুখে ভয়। অর্ক প্রভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আমি দুই মিনিটে আসছি।”

প্রভা অসহায় কন্ঠে বলল, “দয়া করে যেও না।”

অর্ক প্রভার মাথায় একটা চুমু খেয়ে তাকে বিশ্বাস দিয়ে বলল, “আমি ফিরে আসছি। চিন্তা কর না।”

প্রভা তাকে ছেড়ে হাঁটু দুটো গুঁজে নিলো। তার থুতনিটা হাঁটুর উপর রাখল।

অর্ক দরজা খুলে প্রভার মা’কে দেখে বলল, “ও বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখেছে।”

“না না বাবা দুঃস্বপ্ন না। ওর সাথে প্রায়ই এমন হয়। এই স্বপ্নই দেখে বারবার। ওই বিনয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কয়েকমাস আগের থেকে। বিনয় ওকে ডাক্তারকেও দেখিয়েছিল। এই স্বপ্ন দেখলে দুইদিন খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে দেয়। কিছু করতে পারে না। তুমি যেয়ে ঘুমাও বাবা, আমি রাতে ওর সাথে থাকছি।”

“না আন্টি আপনি যেয়ে ঘুমান। ও আমার স্ত্রী আমি ওকে সামলে নিব।”

“কিন্তু…..” অর্ক প্রভার মা’কে থামিয়ে দিয়ে তাকে জোর করে নিজের রুমে পাঠিয়ে দিলো।

রুমে যেয়ে দেখে প্রভা সে অবস্থাতেই বসে আছে। প্রভার সামনে বসে তার হাতের উপর হাত রেখে বলল, “ভয় পেও না। আমি আছি তোমার সাথে।”
প্রভা চোখ তুলে তাকালো অর্কের দিকে। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অর্কের বুকে মুখ গুঁজে নিলো।
অর্ক শক্ত করে প্রভাকে বুকে আঁকড়ে ধরলো।

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here