মন_পাড়ায় পর্ব_২৩

মন_পাড়ায়
পর্ব_২৩
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

সৈকতের এমন মুগ্ধ নয়নে যেন ডুব দিলো সে।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। নামিয়ে নিলো। এক ঢোক গিলে আবার গালের দিকে দৃষ্টি আটকালো। গালে লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সে আলতো করে উপরের জমা রক্ত পরিষ্কার করতে শুরু করলো। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে হলো এমনটা?”

সৈকত ঝিনুকের কাঁধে নিজের কপাল ঠেকাল। বলল, “তোমার তো আমার চিন্তা করাটা অনুচিত তাই না? আরও অনেক মানুষ আছে যাকে নিয়ে তুমি চিন্তা কর। তাই আমার জন্য এতটুকুও চিন্তা করে নিজের সময় ব্যয় কর না।”

ঝিনুক একপলক তাকালো সৈকতের দিকে। তার কথা সম্পূর্ণ মাথার উপর দিয়ে গেল তার। তবুও কিছু বলল না। নিজের কাজ করতে শুরু করল।

সৈকত আবারও বলল, “তোমাকে আমি কি বলেছি আমার সবচেয়ে বেশি রাগ উঠে যখন কেউ আমার মা কষ্ট পায়?”

ঝিনুক মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। সৈকত আবারও বলল, “আমি কি বলেছি আমার দ্বিতীয় কারণে রাগ উঠে যখন আমাকে ছাড়া অন্যকোনো ছেলে তোমার প্রেমে পড়ে?”

ঝিনুক আচমকায় চোখ তুলে তাকালো সৈকতের চোখের দিকে। সে কি বলবে বুঝতে পারলো না তাই চোখ নামিয়ে সৈকতে ঠোঁটের কাঁটা সাথে প্রথমে শুকনো তুলা দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করল এরপর ডেটল লাগাতে নিবে তখনই সৈকত ঝিনুকের কোমর আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে বিছানায় বসালো।

তার দৃষ্টিতে না কথাতে ভয় পেল ঝিনুক, সে নিজেই বুঝল না। সে বসা অবস্থাতেই একটু পিছালো যতক্ষণ না পর্যন্ত তার বালিশে পিঠ ঠেকলো। সে যত পিছালো সৈকত ততই সামনে এলো। অবশেষে ঝিনুকের কাঁধে দুইপাশে হাত দিয়ে বলল, “একটা প্রশ্নের শুধু উওর দেও, তুমি কী আমাকে ছাড়া কখনো অন্যকাওকে ভালোবাসতে পারবে?”

এটা কেমন প্রশ্ন? এই প্রশ্নের অর্থটা কী ঝিনুক বুঝতে পারলো না। সে কখনো অন্যকাওকে ভালোবাসার চিন্তাও করে নি বা অন্যকাওকে ভালোবাসে নি তাহলে সে কীভাবে জানবে? তখনই ঝিনুকের মনে পড়ল আজকের সকালে কীভাবে সৈকত সম্পূর্ণ ক্যান্টিনের সামনে তার অপমান করেছিলো। তাই সে বলল, “হয়তো।”
সুখের পরিবর্তে সুখ ও কষ্টের পরিবর্তে কষ্ট- এই কথাটা ঝিনুক সবসময় মেনে চলে।

সৈকত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। ঝাঁজালো গলায় বলল, “হয়তো?”
ঝিনুকের চুলের পিছনে হাতে গুঁজে নিয়ে তার আরও কাছে গেল। চোখে চোখ রেখে আবারও বলল, “আবারও বলোতো, হয়তো।”

ঝিনুক এক ঢোক গিললো সৈকতের এমন রূপ দেখে। তার শব্দগুলো যেন গলায় এসে জমাট বেঁধেছে। সৈকত তার ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিলো।
ঝিনুকের চোখজোড়া হঠাৎ বড় বড় হয়ে গেল। ঝিনুক সৈকতের বুকে হাত রেখে তাকে দূরে সরাতে চেষ্টা করল। আজকে তার ছোঁয়াটা প্রেমময়ী নয়। রূক্ষ। ভীষণ রূক্ষ।

সৈকত ঝিনুকের হাতদুটো এক হাতে ধরে তার পিঠে নিয়ে রাখল। আর ডুবে রইলো ঝিনুকের মাঝে।

যখন ঝিনুককে ছাড়লো তখন সে কাঁদছিল। তার গালে হাত ছোঁয়াতেই ঝিনুক সৈকতকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার থেকে দূরে সরে গিয়ে বলল, “তুমি এত নিচু হতে পার আমি ভাবতেও পারি নি। আমার অনুমতি ছাড়া আমাকে তুমি ছোঁয়ার সাহস কোথায় পাও?”

ঝিনুক ভেবেছিল অন্যান্য দিনের মতো আজও সৈকত নিজের ভুল মেনে চুপ থাকবে অথবা মাফ চাইবে। তার কথার উপর কথা তোলার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সৈকত বলল, “এক, তুমি আমার স্ত্রী। দুই, তুমি নিজে আমার কোলে এসে বসেছ। তিন, আমি তোমাকে কাছে টেনে নিয়েছি তুমি কিছু বলোনি, সেটা তোমার সম্মতি মানলে ভুল হয় না। চার, তুমি তোমার স্বামীর সামনে অন্য পুরুষকে ভালোবাসার কথা বলছ। আমি তোমার স্বামী ঝিনুক। আমি চাইলেই তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্কও করতে পারি কিন্তু আমি এমন কিছু করছি না। কিন্তু তুমি দিন দিন আমার ধৈর্য ভেঙ্গে দিচ্ছ।”

“বাহ, ক্যান্টিনে তুমি সবার সামনে আমার অপমান করেছ আর এখন সব দোষ আমার?”

“আমি যা করছি শুধু তোমার জন্য করেছি।”

“আমাকে কষ্ট দিয়েছ আমার জন্য?”

সৈকত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এমনটাই কিছু ভেবে নেও।”

যেতে নিলেই ঝিনুক তার বাহুর শার্ট আলতো করে ধরে নিলো। ভেবেছিল মোটেও মানুষটার চিন্তা করবে না। প্রতিবারই ভাবে। ভেবেও অবশেষে তার চিন্তা না করে পারে না। কেন? কেন হয় তার সাথে এমনটা। এর কষ্ট পেয়েও কেন ভালোবাসে এই মানুষটাকেই?

সৈকত জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?”

“আঘাতগুলোতে ডেটল লাগিয়ে দেই।”

“যদি আবারও কষ্ট দেই?”

“দিও। তবুও আসো।” মনে মনে বলল, “আমার তোমার ক্ষতগুলো দেখে বেশি ব্যাথা লাগছে যে, তার কী?”

সৈকত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে তাকালো ঝিনুকের দিকে। এক হাত ভরে দিলো ঝিনুকের খোলা চুলে। অন্যহাত দিয়ে তার চিবুকে হাত দুয়ে মুখ তুললো তার। আলতো করে চুমু খেল ঝিনুকের ঠোঁটে। ঝিনুক এইবার বাঁধা দিল। বিলিয়ে গেল সৈকতের ছোঁয়ায়। হারিয়ে গেল। এই ছোঁয়াটা রুক্ষ ছিলো না। মধুর ছিলো।
.
.
সারারাত প্রভা ঘুমালো না। না অর্ক ঘুমাতে পারল। প্রভা ভয় তার মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো অর্ক। যতই ওকে কষ্টে দেখছিল ততই তার বুক কেঁপে উঠছিল।
প্রভা সকালে আযান দেওয়ার পর অর্কের বুক থেকে সরে গেল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন সে সবে বুঝতে পেরেছে যে সে এতক্ষণ ধরে অর্কের বুকের মাঝারে মাথা রেখেছিলো। লজ্জায় সে একটিবারও তাকায় নি অর্কের দিকে। তার গালদুটোয় সে কী গোলাপি আভা!

অর্ক সকাল আটটার দিকে ফোন দিলো বিনয়ের মা’কে। বিনয়ের মা ফোন ধরেই বলল, “আরে বাবা আজ হঠাৎ এত সকাল সকাল ফোন দিলে যে? কোনো দরকার ছিলো?”

“জ্বি খালা। কিছু জানার ছিলো।”

“হ্যাঁ, বাবা বলো।”

“খালা প্রভার কী কোনো সমস্যা ছিলো? মানে শুনলাম বিনয় না’কি ওকে ডাক্তার দেখাতো।” অর্ক প্রশ্ন করার সাথে সাথে বিনয়ের মা উওর দিলো, “আরে বাবা ও তো পাগল। বিনয় ওকে পাগলের ডাক্তার দেখাতো। তোমাকে না বলেছিলাম?”

অর্কের কাছে উওরটা বেশ বাজে মনে হলো। অন্তত শুনতে ভীষণ খারাপ লাগলো। সাধারণত অর্ক বিনয়ের মা’কে ফোন দিলে তার খোঁজ খবর নেয় আর কিছু প্রয়োজন আছে নাকি জিজ্ঞেস করে। আজ করল না। সে বলল, “আচ্ছা খালা এতটুকু জানার ছিলো। এখন রাখি।”

“বাবা শোনো, আমি জানি তোমাকে অনেক জ্বালাই আমরা কিন্তু ফাতেমার ভার্সিটির কিছু বেতন বাকি ছিলো। যদি তুমি…..” অর্ক তার কথা কেটে বলল, “আমি ঢাকা এসেই আপনাদের বাসায় আসছি খালা।”

“আচ্ছা বাবা আল্লাহ তোমাকে বাঁচায় রাখুক। আসো আসো। আমি তোমার পছন্দের কিছু রান্না করব নে।”

অর্ক ফোন রাখতেই দেখে প্রভা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক প্রশ্ন করল, “কিছু বলবে?”

প্রভা তাকাল না অর্কের দিকে। চোখ দুটো মেঝেতে আটকে রেখে বলল, “নাস্তা করার জন্য মা ডাকতে বলেছে।”
বলে সেখান থেকেই যেতে নিলে অর্ক বলল, “এদিকে আসো।”

প্রভা কুড়কুড় করে এসে হাজির হলো অর্কের সামনে। অর্ক আদেশের সুরে বলল, “বসো।”

প্রভা বসলো বিছানার ঠিক অপরদিকে। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “তুমি অসুস্থ?”

আজ প্রভাত হতে প্রথম প্রভা অর্কের দিকে তাকালো। একপলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। আঙুল দিয়ে খেলতে শুরু করল। বলল, “আপনি বলেছিলেন আপনি আমার ব্যাপারে যা জানার সবই জানেন তাই এই ব্যাপারটা আলাদাভাবে বলি নি। আমি ভেবেছি আপনি জানেন।”

“আমার উওর এইটা না। তুমি অসুস্থ?”

“জানি না, এইটাকে অসুস্থ বলা হয় না’কি?”

“তুমি কোন ডাক্তার দেখাও?”

“দুইবছর ধরে দেখাই না। আগে দেখাতাম। সাইকিয়াস্ট্রিট
দীপ্তি চক্রবর্তী।” বলেই প্রভা ভীতিকর দৃষ্টিতে তাকালো অর্কের দিকে। সে ভেবেছিলো অর্ক রাগ করবে বা অন্যকিছু কিন্তু সে স্বাভাবিক। অর্ক আবারও জিজ্ঞেস করল, “তাহলে হঠাৎ বন্ধ করলে কেন?”

“ভালো লাগে না তাই।”

“গতরাতে যে ভীতিকর অবস্থায় ছিলে তা আমি দেখেছি। তোমাকে দেখে আমার…..” বলতে বলতেই থেমে গেল অর্ক। গলা পরিষ্কার করে আবারও বলল, “এই ভয়ের মধ্যে বাঁচতে ভালো লাগে। ডাক্তার দেখাতে না তাই না? ফাইজলামি কর আমার সাথে? আমরা ঢাকায় যেতেই উনার সাথে দেখা করছি।”

প্রভা ম্লান মুখে তাকালো অর্কের দিকে। বলল, “কিন্তু এইটা তো স্বাভাবিক ডাক্তার না। অর্থাৎ কোনো রোগের ডাক্তার না। গেলেও মানুষ নানারকম কথা বলে। আমি যাব না।”

“মানুষের কথায় কান নিয়ে নিজের শরীর খারাপ করছ তুমি?” অর্ক কথাটা এতটা জোরে বলল যে ভয়ে প্রভা দাঁড়িয়ে পড়ল। অর্ক আবারও রাগান্বিত স্বরে বলল, “দাঁড়িয়ে গেছ কেন? আমি দাঁড়াতে বলেছি তোমাকে?”

প্রভা কাঁদোকাঁদো চেহেরা নিয়ে মাথা ডানে বামে নাড়ল। অর্ক আগের মতো রাগান্বিত স্বরে বলল, “এদিকে আমার কাছে আসো।”

প্রভা নড়ল না। সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। অর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো প্রভার দিকে। আবারও বলল, “কানে কথা যাচ্ছে না? এদিকে আসো।”

প্রভা কুড়কুড় করে অর্কের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। অর্ক বলল, “এইটা কোন ধরনের অস্বাভাবিক রোগ তোমার মনে হয়? তোমার জ্বর বা অন্যকোনো অসুখ হলে তুমি যেমন ডাক্তার কাছে যাও তেমনি এইটাও একটা রোগ। মানসিক অশান্তির কারণে অনেকের বাঁচাটাও দুষ্কর হয়ে পড়ে একসময়। শরীর এক রোগ শুধু এক অংশকে ক্ষত করে অথচ মানসিক অশান্তি সম্পূর্ণ তোমাকে ক্ষত করে দেয়। আমি বুঝি না আজকাল নিজের চিন্তাভাবনা পাল্টাচ্ছে অথচ এইসব দিকে সবার চিন্তাভাবনা পাল্টাতে সমস্যা। তুমি আমার সাথে যাচ্ছ, বুঝেছ?”

প্রভা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। অর্ক উওর না পেয়ে আবারও ধমকের সুরে বলল, “কী কানে যায় নি কথা?”

প্রভা কেঁপে উঠলো। দ্রুত গতিতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। অর্ক বলল, “গুড। এখন যাও আমি কিছু মিনিটে আসছি নাস্তা করার জন্য।”

অর্ক নিজের ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল। প্রভা সুযোগ পেয়ে একপ্রকার বাচ্চাদের মতো দৌড়ে চলে গেল। অর্ক আড়চোখে প্রভার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। মেয়েটা এভাবে ভয় পেলে বোধহয় একটু বেশিই কিউট লাগে তাকে।

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-২২ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1212870579082519/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here