মন_পাড়ায় পর্ব_২৪

মন_পাড়ায়
পর্ব_২৪
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

সৈকত ইকবাল ও নীরার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। নীরা সামনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “ওর আবার কী হইসে?”

সৈকত পিছনে তাকিয়ে দেখে নিহিন তাদের দিকে দৌড়ে আসছে। নিহিন এসে হাঁপাতে শুরু করল। নীরা খোঁচা মেরে বলল, “কী’রে বাপু তোর পিছে কী তোর গার্লফ্রেন্ড চাকু নিয়ে ঘুরতাছে না’কি?”

“হুদাই ফালতু কথা কইবি না তো।” সৈকতের দিকে তাকিয়ে নিহান আবার বলল, “ওই জ্যোতি ঝিনুককে ধরছে।”

সৈকত এক গাছের নিচে বসে ছিলো। কথাটা শুনতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাথে নীরা ও ইকবালও। সৈকত চিন্তিত সুরে বলল, “হোয়াট দ্যা হেল! কী হইছে ঠিক জানিস?”

“আমি যেয়ে দেখি ভিড়। ভাবলাম উঁকি মেরে দেখি ইন্টারেস্টিং কিছু হয় না’কি? দেখি ঝিনুক ও জ্যোতি ঝগড়া করছে। ঝিনুকের বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করায় বলে তেমন কিছুই হয় নি, ওরা দুইজন যাচ্ছিল কথা বলতে বলতে। কখন জ্যোতির সাথে ধাক্কা খেল বুঝতে পারে নি। সরিও বলেছে ঝিনুক। তারপরও না’কি জ্যোতি ইচ্ছা করে কথা বাড়াচ্ছে।”

নীরা বিরক্তির সুরে বলল, “এই মাইয়া আমাদের আর জীবনে শান্তি দিব না। আমি কইসিলাম আমি কয়টা মাইরা টাইরা হাস্পাতাল পৌঁছায় দেই। তোরা তো সাধুগিরি করার লাইগা করতে দিলি না। একেকটা আবাইল্লা।”

সৈকত আড়চোখে একবার নীরার দিকে তাকিয়ে নিহানকে বলল, “কোথায় কান্ডটা ঘটছে?”

“ঝিনুকের ক্লাসের সামনেই।”
.
.
অন্যদিকে, ঝিনুক নিজেকে শান্ত রাখার জন্য দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার কথা শুনুন, এইখানে তো এত চিল্লাচিল্লি করার কিছু নেই। আমি বলেছি তো আমার ভুল হয়ে গেছে আমি ক্ষমা চাইছি এরজন্য।”

“মানে তুমি এখন এমন দেখাচ্ছ যে আমি ভুল করছি? যেখানে তুমি ইচ্ছা করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফালিয়ে দিয়েছ।”

“আজব তো আমি আপনাকে চিনি না জানি না আপনার সাথে আমি এমন কেন করব?”

“কারণ তুমি তোমার বোনের মতো সাইকো।”

ঝিনুকের কপাল কুঁচকে গেল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমার বোনকে না চিনে উল্টাপাল্টা কথা বলছেন।”

“ওহ প্লিজ, আমার তোমাদেরকে চেনা আছে। বিশেষ করে তোমার বোনকে। শী ইজ মেন্টালি সিক। আর মজার কথা হলো তার স্বামী মৃত্যুর দুইবছরের মধ্যে স্বামীর বন্ধুকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছে। বাহ! আর তুমিও তো কম না। বোনের দেবরের সাথে একসময় রিলেশন ছিলো। ব্রেকাপ হওয়ার পর ছেড়েই না দিবে কিন্তু না তার পিছু পিছু ঘুরছ আবার তাকে ফাঁসানোর জন্য। এর জন্য এই ভার্সিটিতেও ভর্তি হয়েছ তাই না? ওয়েট, তুমি তো বেহায়ার মতো তোমার বোনের শশুড়বাড়িতে থাক তাই না? তুমি আর তোমার বোন দুইজনই নিলজ্জ।”

ঝিনুক নিজের চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। হলো না। নিজের কথা তাও সে সহ্য করে নিবে কিন্তু তার বোনকে কীভাবে কেউ কিছু বলতে পারে? তার মনে হচ্ছে তার হচ্ছে দেহের ভিতরে বয়ে যাওয়া রক্ত টগবগ করে ফুটছে। নিজেকে সামলাতে না পেরে সে মেয়েটার গালে জোরে একটা থাপ্পড় মারল। মেয়েটার মুখের সামনে আঙুল তুলে বলল, “খবরদার আমার আপির ব্যাপারে একটা কিছু বললে এইখানে মেরে কবর দিয়ে দিব।”

জ্যোতি তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “এইতো নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দিলে। তুমিও তো তোমার বোনের মতো। তুমি তো তাও ধমক দিচ্ছো তোমার বোন তো…..” হঠাৎ সৈকতের কন্ঠে থেমে গেল জ্যোতি। সৈকত এসে দুইজনের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “এইখানে দুইজন কী তামাশা শুরু করেছ? মানুষ দেখছে।”

ঝিনুক নালিশে সুরে বলল, “ও আপির ব্যাপারে কত আজেবাজে বকছে জানো? আমার আর আপির ব্যাপারে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছে।”

“তোমার বোন আমার পরিবারের সাথে কী করেছে তা জানো? কতগুলো জীবন নষ্ট……” সৈকত জ্যোতির কথা কেটে নরম সুরে বলল, “জ্যোতি তোমাকে না বলেছিলাম ভার্সিটিতে আসবে না। তুমি না অসুস্থ? চল তোমায় বাসায় দিয়ে আসছি।”

ঝিনুক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার কথাগুলো যেন গলায় জমাট বেঁধেছে। সে বলেছে যে মেয়েটা তার ও প্রভা আপির ব্যাপারে খারাপ কথা বলেছে তাও সে এত সুন্দর ভাবে কথা বলছে মেয়েটার সাথে?

জ্যোতি সৈকতের বাহু আঁকড়ে ধরলো। বলল, “তুমি জানো ও আমাকে প্রথমে ধাক্কা দিয়েছে। আমি হাঁটুতে ব্যাথা পেয়েছি তারপর থাপ্পড়ও দিয়েছে। আমি শিউর জান আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড দেখে ও এমনটা করছে। ও আবার তোমাকে পেতে চায় তাই আমার সাথে এমন করছে।”

গার্লফ্রেন্ড? মেয়েটা সৈকতের গার্লফ্রেন্ড? ঝিনুকের হঠাৎ মনে হলো তার শরীরে সকল শক্তি মুহূর্তে হাওয়ায় মিশে গেছে। অবশ লাগছে নিজেকে। সে চোখ নামিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেললো। সে বুঝছে তার চোখ দিয়ে জল বয়ে যাওয়ার জন্য যুদ্ধ করছে।

এমন না যে সে জানতোনা যে সৈকত এমন। তার কতগুলো গার্লফ্রেন্ড ছিলো সে জানতো। তার চরিত্র ভালো না তাও জানত, এইজন্য এককালে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু সে এতদিনে বুঝেছিল ও পাল্টেছে। তাকে বিশ্বাস দিয়েছিল যে সৈকত তাকে ভালোবাসে। এত ভালো অভিনয় কীভাবে করতে পারে কেউ?

সে নিজেকে সংযত করার প্রচুর চেষ্টা করল কিন্তু পারলো না। কিছু বলতেই পারলো না। শুধু সৈকতের কথা শুনতে পেল, “আচ্ছা বাসায় চলো আমরা গাড়িতে বসে কথা বলছি। তোমার সবার সাথে কথা বলে নিজের মুড নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।”

ঝিনুক চোখ তুলে তাকাতেই তার চোখের কোণে দিয়ে জল বেয়ে পরলো। সে দেখল মেয়েটা সৈকতের হাত জড়িয়ে ধরে হেঁটে যাচ্ছে অন্য পথে।
সৈকত এক পিছনে ফিরে তাকাতেই ঝিনুকের চোখে চোখ পরলো। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো সে।
ঝিনুক তাকিয়ে রইলো তাদের যাওয়ার পথের দিকে। তার হৃদপিণ্ডে অসম্ভব পীড়ন হচ্ছে।
.
.
ভার্সিটির পিছিনের দিকে একটা বার্স্কেটবল কোর্ট আছে। সেখানে একপাশে আছে বড় মাপের সাদা তিন ধাপের সিঁড়ি আছে। কোর্টটা এই মুহূর্তে খালি। শুধু দেখা যাচ্ছে দুইজনকে। ঝিনুক মুখে হাত রেখে কাঁদছে ও অঞ্জলি তার পাশে বসে আছে চুপচাপ। এতক্ষণ ভরে অনেক সান্ত্বনা দেওয়া সত্ত্বেও বিশেষ লাভ হলো না তাই অবশেষে হাল ছাড়তে হলো তাকে। অর্ণব ও সাবেককে ফোন দিয়ে সবটা বলেছিল তারা আসছে না। আবারও যখন কল দিতে নিলো তখন এলো তারা।

অর্ণব ইশারা দিতেই অঞ্জলি উঠে গেল। অর্ণব এসে পাশে বসলো ঝিনুকের। ঝিনুকের মুখ থেকে আলতো করে এক হাত সরিয়ে দেখল তার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। অর্ণব বিস্মিত কন্ঠে বলল, “তুমি নিজের এই কী অবস্থা করে নিয়েছ? তাও ওই সৈকতের জন্য? তোমার মনে হয় তোমার এই কান্না দিয়ে ওর কিছু হবে? ও কখনো ভালো হবে না। সবাইকে এইভাবে ব্যবহার করে ছেড়ে দিবে শুধু। অতীতেও তোমার সাথে এমন করেছে। এখনো করতে চাচ্ছে। তোমার ওর থেকে দূরত্ব বজায় রাখাটাই ভালো হবে।”

ঝিনুক তাকালো অর্ণবের দিকে। দেখল তারও মুখে আঘাতের চিহ্ন। জিজ্ঞেস করল, “গতকাল কী আপনার সাথে সৈকতের মারামারি হয়েছিল?”

অর্ণব মাথা নিচু করে নিজের চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “তোমাকে কেউ কষ্ট দিলে আমার সহ্য হয় না তাই।”

ঝিনুক তাকিয়ে রইল অর্ণবের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে। ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাকে নিয়ে প্লিজ ঝামেলা করবেন না। আমি এইখানে কিছুদিনের মেহমান মাত্র। জলদি এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব।”

ঝিনুক সিঁড়ির এক ধাপ নামতেই অর্ণব তার হাত ধরে ফেললো। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবে?”

ঝিনুক তার হাতটা ছাড়িয়ে বলল, “সময় আসলে জানবেন। আর আমার জন্য আপনার কিছু করার প্রয়োজন নেই। এইসব আমার অপছন্দ।”
ঝিনুক চলে গেল সেখানে থেকে। তার পিছনে গেল অঞ্জলিও।
.
.
অর্ক সারাটাদিনে দেখল না প্রভাকে। সম্ভবত সকালের কথাটায় ভীষণ ভয় পেয়েছে, নাহয় রাগ করেছে। সারাটা ঘরে খুঁজে পেল না প্রভাকে। সে সাধারণত সামলায় বিনু ও অদিনকে। কিন্তু তারা ঘুমায় এ সময়। এ সময়টায় সে কী করে অর্ক জানে না। অর্ক সারা ঘরে না পেয়ে ছাদে যেয়ে পেল প্রভাকে। সে দাঁড়িয়ে উদাসীন মনে তাকিয়ে ছিলো নিচে। অর্ক যেয়ে দাঁড়ালো তার পাশে। একপলক নিচে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখছ?”

প্রভা অর্ককে দেখে চমকে গেল। মুহূর্তে তার গতরাতের কথা মনে পড়ল। তার গালদুটো লজ্জার লালিমায় রঙে গেল। প্রভা একটু পিছিয়ে ছাদের বর্ডার থেকে একটি শুকনো পাতা হাতে নিয়ে ঠোঁটের কোণে এক মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “বসন্ত আগমন দিচ্ছে তা দেখছি।”

“তুমি ভয় পাচ্ছ আজ সকালের বকায়?”

প্রভা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, এমন কিছু না।”

“তাহলে সকাল থেকে আমার থেকে পালাচ্ছো কেন?”

প্রভা খোঁপা করা ছিলো। তার সামনের কিছু চুল হয়েছিল এলোমেলো। সে মাথা নামিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলল, “গতরাতের জন্য।”

“তুমি ভয় পেয়েছিলে তাই?”

প্রশ্নটার উওর প্রভা দিলো না। তার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। অথচ তার অস্বস্তি দেখেই অর্ক তার উওর পেয়ে গেল। সে প্রভার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো।
প্রভা যখন অর্ককে তার সামনে দেখলো তখন পিছাতে চাইলো একটু পারলো না। আর কোনো জায়গা খালি নেই যে পিছনে। সে মৃদুস্বরে বলল, “আমার কিছু কাজ আছে আসছি।” বলে যেতে নিলেই অর্ক তার দুই হাত প্রভার দুইপাশের বর্ডারে রেখে তাকে আটকালো।
প্রভা লজ্জায় ও অস্বস্তিতেই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে।

অর্ক জিজ্ঞেস করল, “গতকাল আমি তোমাকে বুকে নিয়েছিলাম তাই?”

প্রভা চোখ তুলে তাকাতেই অর্কের চোখে চোখ পরল। সাথে সাথে তার চোখ নামিয়ে নিলো। তার গালদুটো ভারী ভারী লাগছে। সে কী লজ্জা পাচ্ছে? না অন্যকোনো কারণে এমন হচ্ছে।

অর্ক তার আরেকটু সামনে এলো। এতটা কাছে এলো যে তার নিশ্বাসের উষ্ণতা তার মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার কেমন যেন লাগছে এই উষ্ণ ছোঁয়ায়। তার মনে হচ্ছে তার দমটা গলায় আটকে গেছে। এর থেকে বেশি লজ্জা অর্কের জন্য পাবে তা সে কখনো ভাবে নি কিন্তু পেল সে। যখন অর্ক তার খোঁপার কাঁটা খুলে দিলো। বসন্ত আগমনের হাওয়া বইছিল সে মুহূর্তে। সাথে বইছিল তা ঘন কালো কেশগুলো। তার একপাশ থেকে হাত সরানো হয়েছে। সে চাইলেই পালাতে পারতো এই বিদঘুটে পরিস্থিতি থেকে। কিন্তু পারলো না। তার মনে হচ্ছে সে চেয়েও নড়তে পারছে না।

প্রভা চোখ তুলে তাকাতেই আরেকদফা দৃষ্টিমিলন ঘটলো। অর্ক সে কেশের একটুখানি অংশ তার হাতে নিলো সে খোলা চুলে আলতো করে চুমু খেল।

প্রভার ত্বকে্র কোনো অংশে অর্কের ঠোঁটে ছোঁয়া লাগলো না। তবুও সে কেঁপে উঠলো। তার বুকের ভেতরটাও কেঁপে উঠলো।

অর্ক বোধহয় আজ তাকে এই লজ্জায় শেষ করার জন্য কোনো পরিকল্পনা করে এসেছে। সে তার কানের কাছে এসে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘কুয়াশাময় সকাল ভোরে
তোমায় দেখেছিলাম নয়ন ভরে,
কোকিলের সুরে, ফুলের সুরভীর ভিড়ে
উপস্থিত হলো প্রিয় বসন্তিকা।’

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-২৩ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1217788401924070/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here