মন_পাড়ায় পর্ব_২৯

মন_পাড়ায়
পর্ব_২৯
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

সাথে সাথে কেঁপে উঠলো প্রভা। চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। হাত তার পিছনে নিয়ে বারান্দার গ্রিল চেপে ধরলো। তার মনে হচ্ছে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

চোখ দুটো বন্ধ করতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক বেমানান দৃশ্য। একটি লোক তার দিকে আসছে। তার লোভাতুর দৃষ্টির কথা মনে পরতেই বুকে কেঁপে উঠলো প্রভার। ঘিনঘিন করতে শুরু করল তার সম্পূর্ণ দেহ। পরের দৃশ্যতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সে ঘটনায় ভীতিকর অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও কিভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়েছিলো বিনয়কে। কারণ বিনয় তাকে চেয়েছিলো। হাজারো কষ্ট নিজের বুকে দাবিয়ে নিজের অস্তিত্বের উপর প্রশ্ন তুলে সেদিন বিলিয়ে দিতে হয়েছিলো নিজেকে। সেদিন থেকে এক অজানা ভয় তার বুকে কাবু করে যা ধূম্র হয়ে তার স্বপ্নে তাকে মিটিয়ে দেয় বারবার। তাকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায় এই জীবনটা সহ্যের। তার সুখের নয়, তার ইচ্ছের নয়, তার জীবনটা পরাধীন। যেমনটা সেদিন বিনয় করেছিলো আজ হয়তো অর্কও তেমন কিছু করবে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। যেখানে তার কোনো অস্তিত্বের, তার কোনো স্বপ্নের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। ভাবতেই কিছু নোনাপানি এসে তার চোখে বিরাজ করতে চাইছিল। এর পূর্বেই অর্ক মুখ তুলে তাকালো। বলল, “তোমার অনুমতি ছাড়া এমনটা করা উচিত হয় নি।”

প্রভা চোখ খুলে চমকে তাকাল। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

অর্কের মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব। সে চোখ নামিয়ে মাথার পিছনে হাত দিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছিলো তাই…… হঠাৎ করে কী হয়ে গেছিলো জানা নেই আমার। নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিলাম না সরি।”

প্রভা কিছু বলল না। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। অর্ক চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। ফিরে তাকিয়ে যেতে নিলেই দেয়ালে ধাক্কা লেগে কপালে ব্যাথা পেল। সে কপালে হাত বুলিয়ে পিছনে প্রভার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে আবার রুমে চলে গেল।

প্রভা কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো বিস্মিত দৃষ্টিতে। এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। পরের মুহূর্তে অর্কের একটু আগের দৃশ্য মনে পরতেই ফিক করে হেসে দিলো।

অর্ক রুমের ভেতর থেকে উঁচু স্বরে বলল, “আমি টেবিলে খেতে বসছি।”

প্রভা রুমে যেয়ে দেখে অর্ক নেই অর্থাৎ সে খেতে বসেছে। খাবার দিতে সে বের হতে নিলো। যাওয়ার পূর্বে এক পা পিছিয়ে আয়নায় নিজের দর্শন করল একটিবার। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করল। তাকে অতি সাধারণ লাগছে। অতি সাধারণ। তবে অর্ক বলল কেন যে তাকে সুন্দর লাগছে বিধায় সে নিজের অজান্তেই কাছে এসে পড়েছে?

ভাবতেই একরাশ লজ্জা কাবু করল প্রভাকে। যখন অর্ক এই কথাটা বলেছিল তখন তার লজ্জা লাগে নি কিন্তু এখন ভাবতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। সাথে একরাশ ভালোলাগাও কাজ করছে।

.

.

ঝিনুক কানে হেডফোন লাগিয়ে বিছানার উপর লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছিলো। তার চোখ দুটো বন্ধ। আচকায় এক টান দিলো কেউ তাকে। সে চমকে চোখ দুটো খুলল। চোখ খুলতেই দেখল সৈকত নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তার কোমর দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে, চিবুক তার পেটে ঠেকিয়ে উপরে তাকালো। আর বলল, “বিছানার উপর এমন উড়াধুরা নাচের কারণ কী জানেমান?”

মুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে গেল ঝিনুকের৷ সে ক্রোধিত স্বরে বলল, “তোমাকে আমি বলেছিলাম আমার কাছে আসবে না। কথা তো কানে যায় না তাই না?”

“ইশশ তোমাকে রাগে এত কিউট লাগে কেন?”

“লাত্থি মারলে আরও বেশি কিউট লাগে। এখন ছেড়ে দেও, নাহয় উড়াধুরা মাইর খাবে।”

“এখন নাহয় নাটক করছ যখন মা ও দাদিমা বলবে তাদের এই ঘরে একটা বাবু লাগবে তখন কী করবে?”

ঝিনুক চোখ দুটো বড় বড় করে তাকাল সৈকতের দিকে। তার গাল দুটো মুহূর্তে লালচে হয়ে গেছে। সে একটু কেশে বলল, “আমি তো তোমার সাথে সারাজীবন আর কাটাবো না। প্রভা আপু ও দুলাভাইয়ের মাঝে সব ঠিক হলেই ফুরুৎ করে চলে যাব। তারপর তুমি বাকি জীবন কাটিও তোমার জ্যোতির সাথে। ”

জ্যোতির কথা শুনতেই সৈকত ঝিনুককে ছেড়ে বিছানায় বসল। ব্যাপারটা আরও বেশি মেজাজ খারাপ করল ঝিনুকের। অন্যকোনো কথায় সৈকত তাকে ছাড়লে সে শান্তি পেত। এই কথাটা ভীষণ অভিমানী করে তুলল তাকে। সে বিছানা থেকে নামতেই সৈকত জিজ্ঞেস করল, “তুমি ও জ্যোতি না’কি বাজি লেগেছ? যে জিতবে সে যা চাইবে পরাজিত জন তাকে তাই দিবে। ও যদি আমাকে চায়?”

ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে তাকালো সৈকতের দিকে। মিথ্যে এক হাসি ঠোঁটের কোণে এঁকে উওর দিলো, “প্রশ্নই আসে না। যে মানুষ আমারই না তাকে চাইলে আমি কীভাবে দিব?”

“আমি তোমার না?”

“তুমি আমার? তাহলে তুমি জ্যোতির কে?”

প্রশ্নটা ভীষণ দ্বিধায় ফালিয়ে দিলো সৈকতকে। সে কথা ঘুরানোর জন্য বলল, “আজ আমায় নিজ হাতে খাইয়ে দিবে একটু?”

“কেন নবাবজাদা আপনার হাতে ছালা পড়ে গেছে?” ঝিনুক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও বিরক্তিকর হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করল। সৈকত অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ঝিনুকের দিকে। তার ডান হাত উঠিয়ে দেখালো তার হাতের ব্যান্ডেজ। সে বলল, “আজ হাতটা পুড়ে গেছে?”

ঝিনুক তা দেখে অস্থির হয়ে তার সামনে যেয়ে হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে পুড়ে গেছে?”

“ইকবালের বাসায় গিয়েছিলাম জানালায় হাত রাখলাম। জানালার কাঁচ ভাঙা ছিলো সেভাবে।”

ঝিনুক সৈকতের হাত ছেড়ে কাঠখোট্টা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “জানালার কাঁচের সাথে হাত লেগে তোমার হাত পুড়ে গেছে? একদম কয়লা এনে হাতে লাগিয়ে দিব।”

সৈকত বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল, “এমন করো কেন জানেমান। রোদে হাত পুড়ে গেছে সানবার্ন আর কি?”

ঝিনুক কতক্ষণ সৈকতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চলে গেল।

.

.

আকাশটা জ্যোৎস্নাময়। চাঁদের একরাশ জ্যোৎস্না এসে পরছে অঞ্জলির উপর। সে বিছানার এক কোণে বসে কথা মৃদুস্বরে কথা বলছিলো সাবেকের সাথে, “তুমি দয়া করে একটু সিরিয়াস হও না প্লিজ। তুমি জানো যে আমার পরিবার তোমার জন্য মানবে না এর উপর তুমি যদি এমন গাফলতি কর তাহলে কীভাবে আমি আমার মা বাবাকে তোমার কথা বলব বলো?”

“উফফ জান এত অসহায় ভঙ্গিতে বলো না তো। একদম বুকে যেয়ে লাগে।”

“মজা না সাবেক। আই এম ড্যাম সিরিয়াস। আমার পর আমার দুই ছোট বোন ও এক ভাই আছে। বাবারও বয়স হয়েছে। বাবা মায়ের ইচ্ছা এমন কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দিবে যে আমাদের সংসারও দেখতে পারবে।”

“ডিরেক্ট বললেই তো হয় টাকাওয়ালা বর চায় তারা। আর এইদিকে তুমি প্রেম করে বসসো এক মুদির দোকানের ছেলের সাথে যে জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করে। তার ভবিষ্যত কী সে তা নিজেও জানে না।”

“এইজন্যই তো বলছি ভালো মতো পড়াশোনা কর যেন ভালো পজিশনে চাকরি পাও।”

“করছি তো জান্টুস। এখন চাকরি পাওয়া না পাওয়া আল্লাহর ভরসা। তুমি এখন ভালো মেয়ের মতো ঘুমিয়ে যাও আমিও যেয়ে ঘুমাই। আজকে এক প্লেট বিরিয়ানি খাইসি এত মজার ছিলো যা বলার মতো না। এখন ঘুম পায় শুধু। সময় আসলে আংকেল আন্টির সাথে কথা বলে তাদের বুঝানো যাবে। তুমি চিন্তা কর না।”

অঞ্জলি ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। একপলক তার পাশে ঘুমন্ত দুই বোনের দিকে তাকিয়ে আবার তাকালো জানালার ওপাড়ের স্নিগ্ধময় চাঁদের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটুর উপর মাথা রাখল। সে জানে সবাই তাকে ভালোবাসে। সাবেক, তার পরিবার সবাই। অথচ কেউ তাকে চায় না। মানুষ কেন ভালোবেসেও ভালোবাসার মানুষদের বুঝতে চায় না?

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-২৮ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1226593191043591/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here