মন_পাড়ায় পর্ব_২৮

মন_পাড়ায়
পর্ব_২৮
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

অঞ্জলি বলল, “তুইও কম না ঝিনুক। জ্যোতি তোকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে আর তুই লাফিয়ে লাফিয়ে বাঘের সামনে নাচতে যাস।”

“নবীন বরণে বাঘ আসবে?”

“মজা করছি আমি তোর সাথে? আমি জানি তুই গতকাল সৈকতকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথায় এমন রাগ করেছিস আর রাগে নিজের নাম দিয়ে আসলি ওর বিরুদ্ধে?”

“এইটা তোর ভুল ধারণা বাছা। এমন কিছু না। আমার মন চাইছে আর আমি নাম দিয়ে আসছি। ওই সৈকতকে নিয়ে জাহান্নামে যাক আমার কি?”

“তোর মন তাহলে আগে চায় নি কেন? তুই জানিস ও আসলে অনেক ভালো নাচ জানে? সাবেক প্রায়ই ওর নাচের প্রশংসা করতো।”

“কারণ আমি প্রশংসনীয় কাজ করি।”

ঝিনুক অঞ্জলির পিছনে তাকিয়ে দেখে জ্যোতি আসছে। সে বিরক্তি নিয়ে বলল, “আচ্ছা একটা কথা বলেন আমার মধ্যে কী চুম্বক লাগানো আছে? বারবার আপনি আমায় খুঁজে বের করেন কীভাবে?”

“তুমি আমার কাছে খুব বিশেষ যে তাই।”

ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অঞ্জলির দিকে ঝুঁকে মৃদু কন্ঠে বলল, “বিশেষ দেখে বাঁশ দিতে আসছে।”

অঞ্জলি মিটিমিটি হাসলো ঝিনুকের কথা শুনে।

জ্যোতি আবারও বলল, “শুনলাম তুমি নাকি নাচে নাম দিয়েছ?”

“আপনার অনেক আফসোস হচ্ছিলো কেউ আপনার বিরুদ্ধে নাম দেয় নি বলে। আপনার আফসোস দেখে আমার আফসোস হলো। আফসোসে আফসোসে নাম দিয়ে এলাম।”

জ্যোতিকে প্রচন্ড বিরক্ত দেখালো। সে বলল, “ফাইজলামি করছ আমার সাথে?”

“শুরু কে করেছে?”

জ্যোতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা শর্ত রাখলে কেমন হয়? যে জিতবে সে পরাস্তজনকে যা করতে বলবে তার তা করতে হবে।”

“এইটা প্রতিযোগিতা না, কেবলমাত্র নাচ প্রদর্শন।”

“আমাদের জন্য প্রতিযোগিতা ধরতে সমস্যা কী? দর্শকবৃন্দের প্রতিক্রিয়া দেখে কে জিতেছে তা বোঝাই যাবে। চ্যালেঞ্জ কী এক্সেপ্ট করলে নাকি ভয় পাচ্ছো যে হেরে গেলে আমি কী করতে দেই তা ভেবে?”

ঝিনুক তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড।”

অঞ্জলি আতঙ্কিত স্বরে বলল, “ঝিনুক না চিন্তা করে কি বলছিস? উনি তো এটাই চাইতো তাই উস্কানিমূলক কথা বলছে। প্লিজ এমন করিস না।”

ঝিনুক অঞ্জলির কথা শুনল না। জ্যোতিকে বলল, “তৈরি থেকেন পরাজিত হওয়ার জন্য।”

“দেখা যাবে।” বলেই জ্যোতি চলে গেল।

রুমটায় রয়ে গেল শুধু অঞ্জলি ও ঝিনুক। অঞ্জলি বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো ঝিনুকের দিকে। নীরাও একটুপর ভিতরে ঢুকলো। তাকে একটু আগের কাহিনি বলার পর সে ঝিনুকের কাঁধে হাত রেখে বলল, “সাবাস একদম ঠিক করেছিস, নাহলে সাহস বেড়ে যাবে ওই জ্যোতি ফ্যুতির।”

অঞ্জলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এদের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই সে ভালোমতো বুঝেছে। এরা সহজে কথা বুঝার পাবলিক না।

নীরা অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বলল, “অঞ্জলি ওই চিন্টু ফিন্টুকে কল দেও তো।”

অঞ্জলি চোখ মুখ কুঁচকে বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করল, “চিন্টু ফিন্টু কে?”

“মানে তোমার সাথে যে দুইটা কার্টুন থাকে না সবসময় ওই দুইজন।”

“আপনি অর্ণব ভাইয়া ও সাবেকের কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ, ওদের কল দেও এই রুম খালি করার জন্য।”

অঞ্জলি কিছুই বুঝতে পারলো না। সে বলল, “খালি করার জন্য মানে?”

নীরা এক বেঞ্চে আরামে বসে পায়ের উপর পা তুলে বলল, ” বেঞ্চগুলো সরানোর জন্য। এইসব বেঞ্চ তো আর তুমি সরাতে পারবে না।”

“কিন্তু এগুলো সরানো লাগবে কেন?”

“কারণ তোমার সন্দেহ আছে সে ঝিনুক পারবে না কারণ তুমি ওর নাচ দেখোনি। তোমার আশঙ্কা দূর করব এইজন্য।”

অঞ্জলি একবার না করতে যেয়েও থামলো। অর্ণব ও সাবেককে ডেকে সবটা বলল। সাবেক একটা বেঞ্চ সরিয়ে বসে থাকলেও অর্ণবের না চাওয়া সত্ত্বেও করতে হলো কাজটা। তার ঝিনুককে প্রয়োজন। তাকে বুঝাতে হবে সে তাকে পছন্দ করে। এক না একসময় তাকে সৈকতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে।

রুমের মাঝখানটা খালি করে গান ছাড়া হলো,

যে পাখি ঘর বোঝেনা

উড়ে বেড়ায় বন বাদাড়ে

ভোলা মন মিছে কেন

মনের খাঁচায় রাখিস তারে

ও পাখি ছন্নছাড়া বাঁধন হারা

মানেনা প্রেমের শিকল

ও পাখি দশ দুয়ারে, শত মন করে দখল…..

ঝিনুক নাচ শুরু করতেই সবাই হতবাক। সাবেক, ঝিনুক ও অর্ণব প্রায় তিনমাস ধরে চেনে। ঝিনুকের মুখ থেকে আগে কখনো শুনে নি তার নাচের কথা, না আগে কখনো দেখেছে তার নাচ। কিন্তু আজ তারা দেখে মুগ্ধ। অঞ্জলি নীরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি জ্যোতির নাচ না দেখেও বলতে পারব ওর জিততে ভারী কষ্ট হবে।”

সাবেক বলল, “দুইজনের ভালো টক্কর হইব। আমি পপকর্ণ নিয়ে যাব না সমুচা চিন্তায় আছি।”

অঞ্জলি বিরক্তি নিয়ে বলল, “এত বছরের সম্পর্ক অথচ এই ছেলের মুখে খাবার ছাড়া কিছুই শুনি নি আজ পর্যন্ত।”

“খাওন ছাড়া জীবন আছে না’কি? কী কস অর্ণব?” সাবেক অর্ণবের দিকে তাকিয়ে দেখল অর্ণব অপলকভাবে তাকিয়ে আছে ঝিনুকের দিকে।

সাবেক একবার ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে আবার অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব এক মুহূর্তের জন্যও তার চোখ সরাচ্ছে না ঝিনুকের নাচ থেকে। সাবেক তার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, “তুই ঠিকাছিস দোস্ত?”

সে সময় গানে ‘পাখিটা হাসে খেলে অন্তরালে

সুনিপূণ করে কত’ পংক্তি চলছিল। অর্ণব তার বুকের বাঁ দিকে হাত রেখে বলল, “পাখিটা আমার অন্তরালে ক্ষত করে দিচ্ছে এমন সুনিপুণ হাসিতে।”

.

.

অর্ক দুপুরের খাবার খেতে বাসায় এসেছে। এসে দেখে বিনু তার ভায়োলিন নিয়ে খেলছে। বাজানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছু বুঝতে পারছে না। সে অর্ককে দেখে উঠে দাঁড়ালো। মুখটা ম্লান করে বলল, “সরি আংকেল। আমি এমনিতেই দেখছিলাম। আর করব না এমন প্রমিস।”

বলেই মাথা নিচু করে নিলো।

অর্ক হেসে এসে বসলো বিছানায়। বিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি শিখবে?”

বিনুর চোখ ঝলমলে উঠলো। সে অর্কের দিকে তাকিয়ে একরাশ হাসি দিয়ে বলল, “আমি শিখতে পারব?”

“অবশ্যই। আসো আংকেল তোমাকে শিখাই।”

অর্ক বিনুর কাঁধে ভায়োলিনটা রেখে ছড়ি হাতে দিয়ে শেখাচ্ছিল।

প্রভা গোসল করে বের হলো বাথরুম থেকে। বের হতেই এমন দৃশ্য দেখে সে মৃদু হাসলো। তাকিয়ে রইলো দৃশ্যটির দিকে।

সে জানে বয়স হিসেবে বিনুর বুদ্ধি বেশি। মাঝেমধ্যে অদিন বিনয়কে নিয়ে কাঁদলেও কখনো বিনু তার সামনে কিছু বলে না। হয়তো জানে যে বললে তার মা’য়ের মন খারাপ হবে এইজন্য। কিন্তু সে তার বাবাকে ভীষণ মনে করে। কেননা বিনু সবসময় তার বাবার পুতুল ছিলো। আর আজও সে বিনয়কে প্রচুর মনে করে অথচ চেয়েও বলে না। হয়তো অর্ক কখনো বিনয়ের জায়গা নিতে পারবে না কিন্তু বিনুর জীবনে বাবার কমতি পূরণ করলেও তার জন্য অনেক।

বিনু ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল, “আংকেল আমার মিস আসবে পড়াতে। আমি কী রাতে শিখতে আসতে পারি?”

বিনুর এমন জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি দেখে হেসে দিলো অর্ক। মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দিলো। বিনু দৌড়ে রুম থেকে বের হতেই অর্ক তার শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করতে করতে পিছনে তাকালো। তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল অর্ক। প্রভার পড়েছিল সাদা রঙের সুতির শাড়ি। অতি সাধারণ। চুল ভেজা তার। চুলগুলো মুখের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। বিমোহিত দেখাচ্ছে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো অর্ক। প্রভা মধুর এক হাসি মেখে বলল, “ধন্যবাদ বিনু ও অদিনের এত যত্ন নেওয়ার জন্য।”

প্রভা চলে গেল বারান্দায়। পিছু গেল অর্কও। প্রভা তার ভেজা শাড়ি ও তোয়ালে মেলে দিল বারান্দায়। পিছনে ফিরে তাকিয়ে অর্ককে দেখেই চমকে এক পা পিছিয়ে গেল। বুকে হাত রেখে বলল, “আপনি হঠাৎ করে এইখানে? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।” বলেই গভীর নিশ্বাস ফেলল।

অর্ক এক পা এগিয়ে এসে প্রভার কাছে এলো। প্রভা পিছালো। আমতা-আমতা করে বলল, “খাবার টেবিলে দিব?”

অর্ক উওর দিলো না। প্রভার একদম কাছে এসে পরলো। তার কাঁধের একপাশের গ্রিল ধরে প্রভার দিকে ঝুঁকে নেশা মাখা কন্ঠে বলল, “আমার থেকে ভয় পেয়েছ?”

প্রভা উওর না দিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। অর্ক আরেকটু ঝুঁকে প্রভার গলার কাছে মুখ নিয়ে প্রভার কেশে তার মুখ ডোবাল। সাথে সাথে কেঁপে উঠলো প্রভা। চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। হাত তার পিছনে নিয়ে বারান্দার গ্রিল চেপে ধরলো। তার মনে হচ্ছে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-২৭ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1225010991201811/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here