মন_পাড়ায় পর্ব_৩৩

মন_পাড়ায়
পর্ব_৩৩
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

সে লজ্জামাখা হিম সময়ে সে মানুষটার চোখে ডুব দিয়ে ঝিনুকের বুকে বয়েছিল এক উষ্ণময় অনুভূতি। তার ভয় করছিলো এই হৃদয়ের দ্রুত কম্পন সৈকত না শুনে নেয়। সে এমনিতেই লজ্জায় মাখা আর মাখতে চায় না এই লজ্জার রঙ।

ঝিনুক চোখ নামিয়ে বলল, “সম্ভবত মিথিলা ডাকছে আমার যাওয়া উচিত।”

ঝিনুক উঠে যেতে নিলেই সৈকত তার হাত ধরে ফেলল, “আমার হাতের উষ্ণতা পেয়ে দেখি তোমার গাল দুটো আরও বেশি লাল হয়ে গেছে।”

ঝিনুক উওর দিলো না। হাত ছাড়িয়ে চলে গেল। ভাবনারঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের হাতটিই আলতো করে ছুঁয়ে অতীতের সে মধুর স্পর্শ অনুভব করল আর দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
.
.
ফোন বেজে উঠলো। অর্ক দেখলো সৈকত তাকে ছাড়ার পর অনেকটা অস্বস্তি বোধ করছে। হয়তো তাদের মাঝে আজ এতটা দূরত্বের কারণে। সময়ের সাথে সাথে সকল সম্পর্ক পরিবর্তন হয়। কারও সম্পর্ক দৃঢ় হয় তো কারও দুর্বল। এই দৃঢ়তা বা দুর্বলতা নির্ভর করে সম্পর্কে থাকা দুটো মানুষের উপর বা পরিস্থিতির উপর।

অর্ক পকেট থেকে ফোমন বের করে দেখে প্রভা কল দিয়েছে। কল রিসিভ করে জিজ্ঞেস করল, “খোঁজ পেয়েছ?”

“পরিশ ভাইয়া বাংলাদেশে এসেছে।” কথাটা শুনতেই অর্ক চমকে উঠলো। রাগান্বিত স্বরে বলল, “তোমার এখন এই কথা মনে পড়েছে? আমরা এতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোমার মাথায় আসে নি যে পরিশ বাংলাদেশে এসেছে সেটা আমাদের জানানো উচিত।”

সৈকত অবাক হয়ে বলল, “পরিশ বাংলাদেশে এসেছে? নিশ্চয়ই ঝিনুক ওর কাছে।”

অর্ক আবারও ধমকের সুরে বলল, “প্রভা তুমি এত বেখেয়ালিপনা কীভাবে দেখাতে পারো? আমরা এত চিন্তায় ছিলাম। আমাদের জানানোটা তো উচিত ছিলো তোমার।”

প্রভা নম্র সুরে বলল, “আমি জানতাম না। ঘরে কেউই জানতো না। পরিশ ভাইয়া সবে কল দিয়ে জানায় যে ঝিনুক তার সাথে আছে। জিজ্ঞেস করায় বলে যে স্যারপ্রাইজ দিতে এসেছিলো। এসে যখন জানে যে ঝিনুকের বিয়ে……” এইখানেই থেমে গেল প্রভা। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে, “আপনি বাসায় আসুন। আমি ঠিকানা নিয়েছি। কাল যাব সেখানে।”

“কাল না এখন যাচ্ছি আমরা। তুমি আমাকে ঠিকানা পাঠিয়ে দেও।”

“এখন গেলে আপনি আমায় বাসায় এসে নিয়ে যান। ভাইয়া ভীষণ রাগে আমার তার সাথে কথা বলতে হবে।”

“বিনু ও অদিনের কী হবে?” অর্কের প্রশ্নে প্রভা উওর দিলো, “দুইজনই ঘুমিয়ে পড়েছে। মা’কে বললে উনি সাথে থাকবে দুইজনের।”

অর্ক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “ঠিকাছে। আমরা আসছি।” অর্ক ফোন রেখে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল।”

সৈকত তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “সম্পূর্ণ কথা বা পরিস্থিতি বিবেচনা করার পূর্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনার পুরনো স্বভাব। এই স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন, নাহয় আবারও নিজের অজান্তেই কাছের কাওকে হারিয়ে ফেলবেন।”

“তুই প্রভার কথা বলছিস? এতটুকু কথায় ও মন খারাপ করবে না। জলদি চল, পরিশ আবার যদি ঝিনুকের কোনো ক্ষতি করে!”

“পরিশ যেমনই হোক না কেন, আমার এতটুকু বিশ্বাস আছে ও ঝিনুকের ক্ষতি করবে না। কিন্তু কাল ঝিনুকের এইখানে থাকাটা প্রয়োজনীয়। নবীনবরণের অনুষ্ঠান আছে এবং আমি ঝিনুককে কারও কাছে হারতে দেখতে পারব না। ওর পরাজিত হওয়াটা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ।” বলেই সৈকত হাঁটতে শুরু করল। গাড়িতে যেয়ে উঠে বসল। অর্কও সাথে এলো। অর্ক গাড়িতে বসতেই সৈকত বলল, “ছোট ছোট আঘাতও অনেক বড় চিহ্ন রেখে যায়। একটি সম্পর্ক ভাঙ্গার জন্য একটি বড় কারণ প্রয়োজন হয় না, ছোট ছোট আঘাতও একটি সম্পর্ককে ধীরে ধীরে শেষ করতে পারে। সাথে শেষ করে দিতে পারে সম্পর্কে জড়িত মানুষগুলোকেও।”

“প্রভার উপর রাগ হলাম দেখে এই কথা বলছিস?” অর্কের সৈকতের কথা ধরতে না পেরে প্রশ্নটা করল। সৈকত তাচ্ছিল্য হেসে জানালার বাহিরে তাকিয়ে বলল, “এত বড় ব্যবসা চালান ঠিকই কিন্তু এতটুকু কথার অর্থ ধরতে পারলেন না? যাই হোক জলদি চলুন।”

অর্ক গাড়ি চালাচ্ছে। বাসা থেকে প্রভাকে রিসিভ করে যাচ্ছে ঝিনুককে নিতে। প্রভাদের বাসার রাস্তাতেই আদিলদের বাসা পরে। সেখানেই যাচ্ছে তারা।

সৈকত বলল, “ভাবি আপনি কি রাস্তায় কিছু খাবেন? যেহেতু রাতে…..” বলতে বলতে পিছনে তাকিয়ে থেমে গেল সৈকত। পিছনে তাকিয়ে দেখে প্রভা ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ির জানালায় মাথা লাগছে বারবার। সে মৃদু কন্ঠে বলল, “মিঃঅর্ক আপনি ভাবির কাছে যান আমি গাড়ি চালাচ্ছি।”

“আমার অসুবিধা হচ্ছে না। তুই একটু আরাম কর।”

“ভাবির অসুবিধা হচ্ছে দেখে বলছি।” সৈকতের কথা শুনে অর্ক গাড়ির কাঁচ দিয়ে প্রভাকে দেখে গাড়ি থামাল। নিজে যেয়ে পিছনে বসলো এবং সৈকত ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো।

গাড়ি স্টার্ট করতেই প্রভা আরেক দফা জানালার কাঁচে প্রভার মাথা লাগতে নিলেই অর্ক জানালার কাঁচে হাত রাখে আর প্রভার মাথাটা যত্নে নিজের বুকে রাখে। প্রভা একটু নড়ে-চড়ে অর্কের শার্ট আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। অর্ক মৃদু হাসে। একহাত দিয়ে প্রভাকে ধরে রাখে আর অন্যহাত দিয়ে তার অগুছালো চুলগুলো ঠিক করে দিলো।
সৈকত আয়নায় এই দৃশ্যটা দেখছিলো। সে মৃদু হাসলো ও সামনে তাকাল।

প্রভার ঘুম ভাঙ্গে কিছু শব্দে। সে চোখ খুলতেই দেখে অর্ক তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়লো। সাথে সাথে অর্ক চোখ সরিয়ে নিলো। তাকে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগতে দেখা গেল।
প্রভা খেয়াল করল সে অর্কের বুকে শুয়ে আছে। সামনের সিট থেকে সৈকত জিজ্ঞেস করল, “ভাবি ঘুম ভেঙ্গেছে আপনার?” সৈকতের কন্ঠ শুনে চমকে তাকাল সৈকতের দিকে। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো। সৈকত তাদের এমন অবস্থায় দেখেছে ভাবতেই তো সে লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে লজ্জা পেয়ে সাথে সাথে সরে গেল। ঝুঁকে হাঁটুতে কনুই রেখে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করল তাও এমন ভাবে যেন কেউ না দেখে।
অর্ক প্রভাকে এমন করতে দেখে হাসলো। তার শাড়ির আঁচল নিয়ে তার মুখ ঢেকে দিলো।
প্রভা একটু অবাক হলো। তারপর ঘোমটা থেকে উঁকি মেরে তাকাল অর্কের দিকে। অর্ক মৃদু হাসছে।
অর্কের এমন হাসি দেখে প্রভা নিজেও মুচকি হাসলো।
প্রভা তার ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল পরিশের মেসেজ। সে বলল, “সৈকত আমাদের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিও। ঝিনুককে পরিশ ভাইয়া বাসায় নিয়ে গেছে।”

বাসায় যেয়ে তারা দেখতে পায় থমথমে পরিবেশ। দরজা খুলতেই প্রভা তার মায়ের ম্লান মুখ দেখে হাজারো প্রশ্ন করে বসে। সৈকত সেদিকে ধ্যান না দিয়ে ঝিনুকের কথা জিজ্ঞেস করে। জিজ্ঞেস করার পর জানতে পায় সে নিজের রুমে।
সৈকত দৌড়ে যায় ঝিনুকের রুমে। দেখে ঝিনুক দাঁড়িয়ে আছে জানালার কাছে। সৈকত দৌড়ে যেয়ে ঝিনুকএর বাহু ধরে তাকে একনজর দেখে নেয়। এক টানে বুকে জড়িয়ে নিয়েপ্রশান্তির নিশ্বাস ফেলল সে। আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল, “আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো হারিয়ে ফেলেছি তোমায়। আমার নিশ্বাসও যেন আটকে আসছিলো।”
আবার ছেড়ে ঝিনুকের দুই গালে হাত রেখে তার কপালে এক ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো। আবার তাকে জড়িয়ে ধরতে নিলেই ঝিনুক জোরে ধাক্কা দিলো সৈকতকে।

সৈকত বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। আবার কাছে এসে বলল, “কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?” সৈকত আবার ঝিনুকের গালে হাত দিতে নিলো আর ঝিনুক হাত সরিয়ে বলল, “খবরদার আমাকে ছুঁবে না।

“তোমাকে পরিশ কী আবার উল্টাপাল্টা কিছু বুঝিয়েছে?”

“ভাইয়া তোমাদের মতো না। তুমি আর আমার বাবা দুইজন একরকম। তুমি এখন এইসব নাটক করছ কারণ তুমি তোমার লালসা মিটাতে চাও। আমি তোমাকে ডিভোর্সের কথা বলেছি এইজন্য তুমি চাচ্ছো তুমি যত জলদি পারো আমাকে ভোগ করে নেও যা দুইবছর আগে পারোনি সে কাজ এখন করতে চাইছ। যেমনটা আমার বাবা আমার মা……” বলতে বলতে দম বন্ধ হয়ে এলো তার। সে এক ঢোক গিললো। কথাটা সম্পূর্ণ করতেও ঘৃণা হয় তার। আবার বলল, “তোমার স্পর্শ থেকেও আমার ঘৃণা হয়, এইটা ভেবে যে কতগুলো মেয়েকে ছুঁয়ে এসে আমাকে ছুঁয়ে দিতে চাও। আমি তোমার কাছে একটা ভোগের বস্তু ছাড়া কিছু না। কিন্তু এখন আর না মিস্টার সৈকত। আমি এখন আর তোমার এই অভিনয়ের জালে ফেঁসে যাব না। আর না। অন্যমেয়ের সাথে হয়তো পারবে কিন্তু তুমি ভালোবাসার নামে এইসব নোংরামি করতে পারবে না আমার সাথে। এইসব ভেবেও আমার ঘৃণা হয় তোমার স্পর্শ থেকে। আমি ভয় পাই তোমার ছোঁয়া থেকেও।”

সৈকত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। তারপর হেসে দিলো অথচ তার চোখে জল ছলছল করছে। সে ভেজা কাঁপানো কন্ঠে বলল, “তুমি জানো আমি আগে ভাবতাম সে দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন যে দিন আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি অনুভব করেছি সেদিন। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছে আজ সে দিনটি আমার জীবনের পৃষ্ঠা থেকে মুছে দেই। তুমি এতদিন আমার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলেছ আমি কখনো তোমাকে কিছু বলি নি, আমার ভালোবাসার উপর প্রশ্ন তুলেছ আমি কিছু বলি নি কিন্তু আজ তুমি আমার ভালোবাসার অপমান করেছ। আমার ভালোবাসা তোমার কাছে নোংরামি?”

ঝিনুক উওর দিলো না। সে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সৈকত আবারও বলল, “ঠিকাছে আমার স্পর্শ থেকে তোমার ঘৃণা লাগলে আমি আর কখনো তোমার কাছে আসব না। তুমি একবার বললেই হতো ঝিনুক কিন্তু আমার স্পর্শ থেকে তো তোমার ভয় পাওয়ার প্রয়োজন ছিলো না।” সৈকতের সম্পূর্ণ মুখ লাল হয়ে গেছে। সে তার হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ মুখে নিলো আর বলল, “হয়তো ভাগ্য এমন খেলা না খেললেও পারতো। তোমাকে আমার ভাগ্যের রেখায় না রাখলে না দেখা করালেও পারতো, দেখা করালে না ভালোবাসা হলেও পারতো, ভালোবাসার পর না ছিনিয়ে নিলেও পারতো, ছিনিয়ে আবার ফেরত দিয়ে আবারো আমার ভালোবাসার অপমান না করালেও পারতো। আমি তোমাকে আগেও বলেছিলাম তুমি আমার থেকে দূরে থাকো সমস্যা নেই, আমাকে আপন না করো সমস্যা নেই, আমাকে ভালো না বাসো সমস্যা নেই তবুও এমন কিছু করো না যেন আমি তোমাকে ভালোবেসে অনুতাপ করি। আজ আমার অনুতাপ হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি বলে। তুমি আমার মন পাড়ায় রাজত্ব করার অধিকার দিয়েছি বলে। ”

কথা শুনতেই ঝিনুকের যেন দম আটকে গেল। সে মুহূর্তে সে যেন ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। অথচ তা অদৃশ্য। না কষ্ট কেউ দেখতে পায়, না শুনতে পায় অথচ কষ্টই মানুষের ভেতরটা একপ্রকার শেষ করে দেয় অথচ তার আশেপাশে সব স্বাভাবিক থাকে….এমনকি সে নিজেও।

ঝিনুক তাকাল সৈকতের দিকে। সৈকত কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ঝিনুকের দিকে। চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেই সে চলে গেল।

ঝিনুক তাকিয়ে রইলো তার চলে যাওয়ার দিকে। সে সাথে সাথে মেঝেতে বসে পরলো। সে নিজের ভেতরে এক শূন্যতা অনুভব করছে।

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-৩২ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1233297667039810/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here