#মন_পাড়ায়
পর্ব_৩৪
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
প্রভা ও অর্ক ড্রইংরুমে যেয়ে দেখে প্রভার বাবা সোফায় বসে আছে এবং পরিশ তার সামনে দাঁড়ানো। তাকে রাগান্বিত দেখাচ্ছে। প্রভা জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া তুমি না বলে কেন ঝিনুককে আনলে? আমরা কত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম জানো?”
“আর তোরা যে না বলে ওকে বিয়ে দিয়ে দিলি তার কী? তোদের সাহস কত বড় তোরা ওর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”
“আমি যতটুকু জানি ঝিনুকের গার্জিয়ান আপনার মা-বাবা, আপনি না। তাই আপনার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন তাদের আছে বলে আমার মনে হয় না।” অর্ক কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল পরিশকে। পরিশ অর্কের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “বিয়েতে আপনার সাথে দেখা হয় নি। আশা করি, আপনি আমার বোনকে সুখে রাখবেন।”
অর্ক হেসে একটি সোফায় বসে বলল, “অবশ্যই। আমাদের পরিবারে আপনার দুই বোনই সুখে থাকবে।”
পরিশ কপাল কুঁচকে তাকাল অর্কের দিকে। আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, “ঝিনুককে আর আপনাদের সামলানো লাগবে না।”
প্রভার বাবা দাঁড়িয়ে বলল, “তোকে কেউ এইসব জিজ্ঞেস করে নি। এই ঘরে কখন কী হবে না হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমি এখনো আমি আছি।”
“তোমার বয়স হয়েছে বাবা এইজন্য তোমার এতটুকু বিবেক হারিয়ে গেছে যে নিজের ঘরের মেয়েকে অন্যকোথাও পাঠানোর পূর্বে দেখা উচিত ছেলেটা কেমন? আগে প্রভার জীবন শেষ করছ এখন আবার ঝিনুকের জীবন শেষ করতে চাচ্ছো তুমি?”
পরিশের কথার ধরণ দেখে প্রভা চমকে উঠলো। বিশেষ করে অর্কের সামনে পরিশ এমনভাবে কথা বলবে সে ভাবতেও পারে নি। সে পরিশের সামনে যেয়ে শান্ত গলাতেই বলল, “ভাইয়া তুমি এইভাবে বাবার সাথে কথা বলতে পারো না। আমার সাথে যা হয়েছে তা আমার ভাগ্যে ছিলো। এইখানে বাবার তো কোনো দোষ নেই। আর সৈকত তো ভালো ছেলে। আমি ওকে ছোট থেকে দেখে এসেছি। ঝিনুক ওর সাথে সুখে থাকবে। আর আমার মনে হয় দুইজন একে অপরকে মেনেও নিয়েছে।”
“তুই মুখের উপর কথা বলা শিখলি কবে থেকে?”
“না ভাইয়া আমি তো……” প্রভা কথা বলা শেষ হওয়ার পূর্বেই পরিশ ধমকের সুরে বলল, “তুই আমাকে শিখাবি এখন আমার কী করা উচিত আর কি না? এত বুদ্ধি থাকলে তোর স্বামী অন্য মেয়ের কাছে যায় কীভাবে? দুই বছর ধরে মাথায় বসে বসে খেয়েছিস নিজের দুই বাচ্চা নিয়ে এখন এই ঘর থেকে যাওয়ার পরও তোর শান্তি নেই? বিয়ে করেছিস নিজের সংসারে মনোযোগ দেয়। আমাদের ঘরের ব্যাপারে নাক ঘলানোর প্রয়োজন নেই।”
প্রভার মা চিন্তিত সুরে বলল, “ঘরের জামাইয়ের সামনে এইসব কী শুধু করলি তোরা?”
পরিশ বলল, “তোমার মেয়েকে বুঝাও। বড় ভাইয়ের সাথে তর্ক না করে যেন নিজের সংসারে মনোযোগ দেয়, নাহলে আবারও আগের মতো হলে আমি ওর বোঝা টানতে পারব না।”
“ভাইয়া আমি তো শুধু বলছিলাম যে ঝিনুককে…..” পরিশ আবারও কথা কাটলো প্রভার। সে ভীষণ রাগান্বিত স্বরে বলল, “আবারও এক কথা। বলেছি না নিজের সংসারের চিন্তা কর। এই ঘরের কোনো কথায় কথা বলার অধিকার তোর নেই। কথা কানে যায় না তোর?”
পরিশ এতই জোরে কথাটা বলল যে প্রভা ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। কাঁপতে শুরু করল ভয়ে। নিজের এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্যহাত খামচে ধরলো।
অর্ক প্রভার সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজের দুই পকেটে হাত রেখে কঠিন দৃষ্টিতে পরিশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর আপনার কী মনে হয় যে আপনার এই অধিকার আছে যে আপনি আমার স্ত্রীর সাথে এইভাবে কথা বলতে পারবেন?”
পরিশের কন্ঠস্বর মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে বলল, “আসলে মার মাথা গরম হয়ে গেছিলো। ক্ষমা করবেন। কিন্তু ও আমার ছোট বোন। ওর উপর অধিকার আমার আছে।”
“তাহলে আপনি এই কথা কীভাবে বলতে পারেন যে প্রভার এই ঘরে কোনো ব্যাপারে কথা বলার অধিকার নেই? ও এই ঘরের মেয়ে। আর ঝিনুকের বড় বোন। যতটুকু অধিকার আপনার আছে ততটুকু ওরও আছে এই ঘরের উপর এবং ঝিনুকের উপরও।” অর্কের কথা শেষ হতেই প্রভার বাবা সোফায় বসে ছোট এক নিশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল, “আর আমার যতটুকু মনে আছে আমি এখনো আমার পেনশন পাই সেই টাকা দিয়ে আমি প্রভা ও আমার নাতি-নাতনীদের দায়িত্ব নিয়েছি। তোর বোঝা ও কীভাবে হলো? আর এই ঘর আমার। আমার সব সন্তানেরই এইখানে একরকম অধিকার আছে। তোর, প্রভার, ঝিনুকের সবার।”
প্রভার মা বলল, “উফফ একটু চুপ করো না। ছেলেটা এত বড় যাত্রা করে এসেছে।” আবার পরিশের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা তুই এমন জেদ করিস না। এইসব বলিস না। শান্ত হো বাবা, শান্ত হো।”
“মা তুমি যাই বলো না কেন ঝিনুককে আমি কোথাও যেতে দিচ্ছি না।”
অর্ক হেসে পরিশের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আসুন আপনার সাথে একটু আলাদা কথা আছে আমার।”
অর্ক পরিশকে আলাদাভাবে নিয়ে গেল। প্রভার মা প্রভাকে জিজ্ঞেস করল, “কী কথা বলবে? তুই কী বলেছিস যে পরিশ ঝিনুককে…… ” সম্পূর্ণটা বলতে যেয়েও থেমে গেল প্রভার মা। সামনে বলতে যেয়ে নিজেরই যেন কেমন লাগছে। প্রভার চুপি দেখে তিনি বলল, “তুই কেন বলতে গেলি? জামাইবাবু কী ভাববে?”
“মা তুমি উনাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি ঝিনুক ও সৈকতকে দেখে আসছি।”
প্রভা যেতেই প্রভার মা চিন্তিত সুরে প্রভার বাবাকে বলল, “এখন কী হবে? পরিশ কখনো রাজি হবে না ঝিনুককে যেতে দিতে।”
প্রভার বাবা উওর দিলেন না।
প্রভা ঝিনুকের রুমে যেয়ে দেখে ঝিনুক নিচে বসে আছে। সৈকত কোথাও নেই। সে ঝিনুক সামনে যেয়ে বসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তুই কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে তোকে? ভাইয়া কিছু বলেছে? আর সৈকত কোথায়?”
ঝিনুক উঠে দাঁড়ালো। বিছানার কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। বলল, “ভাইয়া বলেছে সৈকতের সাথে সম্পর্ক না রাখা ভালো।”
প্রভাও উঠে বলল, “ভাইয়ার রাগ নিয়ে চিন্তা করিস না। ভাইয়া বললেও নিয়ে যাব তোকে আমরা। তোর আর সৈকতের বিয়ে হয়েছে। চাইলেই তো তোদের আলাদা করতে পারে না। এইটা বিয়ে কোনো পুতুল খেলা না।”
“আমি ওর সাথে সম্পর্ক রাখতে চাই না আপি।” কথাটা শোনা মাত্রই যেন প্রভা আকাশ থেকে ভেঙে পড়লো। এতদিন সৈকত ও ঝিনুককে দেখে বুঝেছিলো তাদের বিয়েটা যদিও জোরপূর্বক হয়েছে তবুও তো একে অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেছে অথবা ভালোবাসতে শুরু করেছে। একে অপরের দিকে যেভাবে তাকায়, একে অপরের যেভাবে যত্ন করে, একে অপরের জন্য যেভাবে চিন্তা করে সবটা দেখে মনে হয়েছিলো যে ওরা একে অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেছে অথবা ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন সে নিজেও বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে!
প্রভা ঝিনুকের সাথে শান্ত মাথায় কথা বলতে চাইত তাই এখন কিছু না বুঝানোটা ভালো মনে করল। সে বলল, “ঠিকাছে এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব। তুই তৈরি হয়ে থাক আমরা কিছুক্ষণ পর বের হব। আগামীকাল না’কি আবার কোন অনুষ্ঠান আছে তার জন্য দেরি হয়ে যাবে। ”
“আমার কোনো ইচ্ছে নেই যাওয়ার। আর তুমি আপাতত ঐ বাসায় আর দুলাভাইকে এই ব্যাপারে কিছু বলো না। সময় হলে আমি বলব। আমরা কাল সকালে যাই আপি? আমার এখন ভালো লাগছে না।”
প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিকাছে আরাম কর।” আর চলে গেল। ড্রইংরুমে যেয়ে দেখল। বাবা ও অর্ক বসে আছে। তার মা পিছনে এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, “পরিশ রাজি হয়ে গেছে ঝিনুকের যাওয়ার জন্য। এখন যেয়ে তোর রুমটা পরিষ্কার করে দেয়। আমি খাবার গরম করছি। জামাইকে জিজ্ঞেস করায় বলে কেউ খেয়ে আছিস নি। তুই আমাকে বলবি না? সৈকত ও ঝিনুককেও ডাক দেয়।”
“সৈকতের কিছু কাজ ছিলো দেখে চলে গেছে মা।”
“এত রাতে কেন গেল?”
প্রভা মাথা নামিয়ে নিলো। কী উওর দিবে বুঝতে পারলো না। অর্ক প্রভার চেয়েরার উদাসীনতা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলোও বলল, “আমি পাঠিয়েছি। বাবার একটা কাজ ছিলো।”
“ওহ আচ্ছা। বাবা তুমি প্রভার রুমে যেয়ে আরাম করো একটু। আমি পরিশের কিছু কাপড় পাঠাচ্ছি প্রভাকে ছিলো। পোশাক পরিবর্তন করে ভাত খেতে আসো। আয় প্রভা আমার সাথে আয়।” প্রভা মায়ের পিছনে গেল।
প্রভা রুমে দেখে দেখে অর্ক বিছানায় বসে ফোনে কিছু একটা করছে। সে বিছানায় কাপড় রেখে বলল, “ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলুন। আরাম লাগবে।”
অর্ক প্রভার কন্ঠ শুনে ফোনটা পাশে রেখে জিজ্ঞেস করল, “সৈকত কোথায় গেছে?”
“দুইজনের মধ্যে সম্ভবত কিছু হয়েছে। আমি মা ঘুমালেই ওকে কল দিব। তবে আপনি ভাইয়াকে কী বলে মানিয়ে নিলেন? আমি কখনো ভাবি নি ভাইয়া মেনে যাবে।”
অর্ক ঝুঁকে প্রভার মুখোমুখি হয়ে মৃদু হেসে বলল, “তা সিক্রেট বলা যাবে না।”
প্রভা বলল, “তাহলে ধন্যবাদ বললাম তাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। ”
“শুধুই ধন্যবাদ? কোনো উপহার দিবে না?” কপাল ভাঁজ করে বলল অর্ক।
“উপহার? কী উপহার লাগবে আপনার?”
অর্ক প্রভার ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “এইটা।”
সাথে সাথে কেঁপে উঠলো প্রভা। এমনটা সে মোটেও আশা করে নি। মুহূর্তে তার দেহের ভেতরে অজানা এক বিদ্যুৎ বয়ে গেল মনে হলো। তার গাল দুটো লাল হলো। তার চোখদুটো হলো লজ্জামাখা। সে সাথে সাথে চোখ দুটো নামিয়ে নিলো।
এমন দৃশ্য দেখে অর্কের দুষ্টুমির ইচ্ছে যেন আরও তীব্র হলো। সে মিটিমিটি হেসে আলতো করে প্রভার ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বুঝেছ তো কী উপহার চাই?”
প্রভা একপলক অর্কের দিকে তাকিয়ে দৌড় দিলো রুমের বাহিরে।
অর্ক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হেসে দিলো প্রভার এমন কান্ডে। সে জানতো প্রভা এমন কিছুই করবে। সে ঝুঁকে নিজের ফোনটা হাতে নিতে যাবে তখন আবারও শব্দ পেল প্রভার নুপুরের। সে উঠে ফরে তাকিয়ে দেখে প্রভা তার দিকে আসছে। সে বাঁকা হেসে মশকরার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “কী উপহার দিতে ফেরত আসলে না’কি?”
প্রভা তার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। অর্কের চুলের পিছনে হাত গুঁজে তার মাথা একটু নামিয়ে চোখ বন্ধ করে তার গালে একটু চুমু খেল। আবার সাথে সাথে ছেড়ে দিলো। ছাড়ার পর আশেপাশে তাকাতে শুরু করল লজ্জা লুকানোর চেষ্টায়।
অর্ক কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে যায়। প্রভা এমন কিছু করবে সে ভাবতেও পারে নি। সে গালে হাত দিয়ে প্রভার যাওয়ার দিকে তাকালো। তার ঠোঁটের কোণে এক মোহনীয় হাসি।
প্রভা এমন হাসি দেখে লজ্জায় মেখে গেল যনে। এই মুহূর্তে লজ্জা লুকাতে পালানোটাই ভালো মনে করল সে। তাই দৌড়ে গেল বাহিরে।
অর্কের হাসিটা ঠিক তখনই মলিন হয়ে গেল যখন প্রভা দৌড়ে পালালো আর তার নুপুরের শব্দ বাজতে শুরু করল, ছনছন করে…..
এই শব্দটি বারবার তাকে মনে করিয়ে দেয় তার ভালোবাসার মানুষটি অন্যকারো প্রেমের বাঁধনে জড়িয়ে আছে।
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
***আমি আজ ঠিক মতো এডিটের সময় পাই নি। তাড়াতাড়ি করতে হয়েছে কারণ এখন না দিলে একদম রাত ১১.৩০ এ দিতে হতো তাই তাড়াতাড়ি এডিট করে দিয়ে দিয়েছি। তাই ভুল বেশি থাকতে পারে।
পর্ব-৩৩ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1237622986607278/