মন_পাড়ায় পর্ব_৩৫

মন_পাড়ায়
পর্ব_৩৫
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

“অর্থাৎ আজ ঝিনুকের জন্মদিন?” সৈকত রুহানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। রুহানি মাথা নাড়ালো। বলল, “ওকে জন্মের কয়দিন পর থেকেই ওর মা মারা যায়। এইজন্য ও কখনো জন্মদিন পালন করে না। আজ ওর জন্মদিন। আমাদের বন্ধুত্ব অনেক বছরের কিন্তু আমি তা জেনেছি গতবছর। ও কখনো এইমাস নিয়ে কথা বলে না। আর কখনো মন খারাপও করে না। ওর মন খারাপ হলে অন্যেরাও মন খারাপ করবে তাই।”
সৈকত সামনে তাকাল ঝিনুকের দিকে। ঝিনুক তার বান্ধবীদের সাথে হেসে কথা বলছে, ছবি তুলছে, মারছে, মজা করছে। পার্কে এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখে বুঝাই যায় না তার মাঝে এত বড় একটা শূন্যতা বিদ্যমান আছে। যে কেউ তাকে দেখলে বলবে তার জীবনও অন্য দশটা কিশোরী মেয়েদের মতো।
সৈকত রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওর জন্মদিন পালন করতে চাও?”
রুহানিকে অনেকটা উৎসুক দেখাল। সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। সাথে বলল, “তা আর বলতে ভাইয়া? কিন্তু আমরা চাইলেই তো হবে না যদি ঝিনুক না চায় তাহলে কীভাবে হবে?” রুহানির কথা শুনে সৈকত দাঁড়িয়ে বলল, “একঘন্টার জন্য ওকে আটকে রেখো আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?”
“আমি আসছি, তুমি অপেক্ষা করো।”
রুহানি কিছু বুঝলো না। সৈকত ইকবাল ও নীরাকে নিয়ে চলে গেল।

প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পর সেখানে পৌঁছায় সৈকত নীরার সাথে। তারা বেলুন, কেক ও প্যাকেটে আরও কয়েকটা জিনিস নেয়। তাদের দেখে ঝিনুক রুহানি এবং মিথিলাকে আলাদা নিয়ে রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তোরা কী ওকে বলেছিস আজ আমার জন্মদিন?”
মিথিলা মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমি এমন কেন করব?”
ঝিনুক তাকাল রুহানির দিকে। ভয়ে সে আশেপাশে তাকাচ্ছে শুধু।
ঝিনুক আবারও কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই বলেছিস রুহানি?”
“আমি….আমি…..”
রুহানির কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই সৈকত উঁচু স্বরে বলে, “গাইজ আজকের দিনে এক বিশেষ উৎসব আছে। আমরা বন্ধুরা বছরে কয়েকটা দিন কিছু বাচ্চাদের সাথে জন্মদিন পালন করি। যাদের সামর্থ্য থাকে না সারাবছরে এইসব করার অথবা তারা জানেও না তাদের জন্মদিন কবে! তোমাদের সমস্যা না হলে তোমরা জয়েন করতে পারো। আমার বন্ধু ইকবাল বাচ্চাদের নিয়ে আসছে।”
রুহানি সাথে সাথে ঝিনুকের হাত ধরে বলল, “ভাইয়া আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমরা তো আরও খুশি হব।”
ঝিনুককে অনেকটা চিন্তিত দেখালো। সে আড়চোখে তাকাল রুহানির দিকে তারপর মৃদু হাসলো।
ইকবাল সাতটা বাচ্চাকে নিয়ে এলো। দূর থেকেই হাত দিয়ে ঝিনুকের দিকে ইশারা করল।

ঝিনুক স্বভাবগতই মিশুক ছিলো। অল্প সময়েই সব বাচ্চাদের সাথে মজা করতে শুরু করল। সবাইকে বেলুন ও কিছু খেলনা দিলো যা আনা হয়েছিলো। এইজন্যই হয়তো কেক কাটার সময় যখন দুটো বাচ্চা তাদের জোর করে নিয়ে এলো সে সন্দেহ করল না। একে অপরকে কেক খাওয়ালো। তারপর সবাইকে দুই প্যাকেট করে বিরিয়ানি দেওয়া হলো। অবশেষে যখন সন্ধ্যা নেমে এলো, লালিমা মেখে এলো আকাশের কোলে তখন সৈকত বলল, “তো বাচ্চারা তোমাদের আজ কে সবচেয়ে বেশি খেয়াল রেখেছে? তাকে এক বিশেষ উপহার দেওয়া হবে।”
সব বাচ্চারা ইশারা করল ঝিনুকের দিকে।
মিথিলা বলল, “এইটা ঠিক না আমরা সবাই তো কত খেয়াল রাখলাম।”
একটা ছেলে হেসে বলল, “আফা মিথ্যা কইবেন না। আমনে তো বইয়া বইয়া ভাইয়ের লগে কেক খাইলেন হুদা। আমগোরে দেখছেন কহন?”
মিথিলা লজ্জা পেল অনেকটা সবার সামনে এইটা কথাটা বলায়। দোষটা রাজু’র উপর চাপিয়ে দিয়ে বলল, “সব দোষ তোমার। আমি মানা করেছিলাম না আমাদের এখন একা সময় না কাটিয়ে বাচ্চাদের দেখা উচিত।”
“তুমি কখন বললে?” রাজু বিস্মিত সুরে বলল।
মিথিলা রাজুর পেটে কনুই দিয়ে মেরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি বলি নি?”
রাজুর কিছুক্ষণ পেটে হাত দিয়ে দম আটকে রাখলো। তার মলিন মুখে বলল, “আমিই বলেছি। আমিই বলেছি।”
সবাই হেসে উঠলো একসাথে।
সৈকত একটি ব্যাগ থেকে ব্রেসলেট বের করে ঝিনুকের সামনে গেল। ঝিনুক ব্রেসলেটটা দেখেই বলল, “এত দামী ব্রেসলেট আমি নিতে পারব না।”
মিথিলা বলল, “আপাতত নিয়ে নেয় পরে আমাকে দিয়ে দিস।”
সৈকত ঝিনুকের হাত হাতে নিয়ে বলল, “এইটা আজকের দিনের স্মৃতি হিসেবে তোমার কাছে থাকবে সবসময়।”
ব্রেসলেটটা পরিয়ে চোখ উঠাতেই ঝিনুকের চোখে চোখ আটকালো। মিষ্টি হাওয়ার মাতাল ঘ্রাণে এক অদ্ভুত জাদু ছিলো। যা এই চোখ দুটোর মায়াজালে আটকে আরও গাঢ় হয়ে গেল।
অতীতের সে প্রথম অনুভূতি মনে করতেই সৈকতের বুক চিরে বেরিয়ে এলো আফসোসের নিশ্বাস। সে বুঝতে পারছে না। তার সাহসী স্বভাবের কিন্তু নম্র মনের ঝিনুকটা কোথায় হারিয়ে গেল? আজকের এই ঝিনুক তো তার কাছে ধাঁধার মতো। মাঝেমধ্যে মনে হয় সে এই দুটো ঝিনুক একই না। মানুষ পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন হয় তাদের স্বভাব। কিন্তু এতটা যে দুটো মানুষের মাঝে আকাশ পাতালের পার্থক্য থেকে যায় এতটা পাল্টে যাওয়াও মানানসই না।

ফোন বেজে উঠলো তার। সে পকেট থেকে ফোন বের করে প্রভার ফোন দেখে ফোন রিসিভ করে।
“জ্বি ভাবি, বলুন।”
“তুমি কোথায় সৈকত? এত রাতে চলে গেলে কেন?”
“কাজ ছিলো।”
প্রভার দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল ফোনের ওপাড় থেকে। সে বলল, “ঝিনুকের কথায় গিয়েছ বুঝতে পারছি। ও এখনো ছোট সৈকত। ওর কথা মনে নিও না। আমি ওকে বোঝাব।”
“ভাবি আপনারা কখন রওনা দিবেন?”
“কাল সকালে।”
“কিন্তু ভাবি ঝিনুকের কাল অনুষ্ঠানে পার্ফোরমেন্স আছে।”
“ওকে বলেছি। কিন্তু ও যাবে না। আচ্ছা না গেলে কী সমস্যা হবে?”
সৈকত কিছুক্ষণ চিন্তা করে উওর দিলো, “না। আমি সব সামলে নিব। কোনো সমস্যা হতে দিব না। আচ্ছা ভাবি আপনার স্বামীকে একটু দিন তো।”
“মানে তোমার ভাই?”
সৈকত কাশলো একটু। তারপর বলল, “হুম। একটু দিন।”
প্রভা হাসলো সৈকতের এমন ব্যবহারে। সে জানে দুইজন একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে। সৈকত অর্কের ভীষণ সম্মানও করে যা একবার নিজের চোখে সে দেখেছিল কিন্তু নিজ থেকে কথা বলতে চায় না। দুই ভাই যতই ভিন্ন হোক দুইজনের ইগো তাদের থেকেও বড়।

প্রভা অন্যরুমে যেয়ে অর্কের দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। অর্ক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“আপনার ছোট ভাই।”
সাথে সাথে অর্ক খপ করে ফোনটা নিয়ে নিলো। কানে লাগিয়ে বলল, “সৈকত কোথায় তুই? না বলে গেলি কেন?”
“এত অধিকার জমিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই আপনার। এতটুকু বলুন যে আপনি কীভাবে জানলেন যে পূর্বে আমার ও ঝিনুকের সম্পর্ক ছিলো।”
হকচকিয়ে গেল অর্ক। সে আমতা-আমতা করে বলল, “কী…কী বলছিস তুই?”
“ঢঙ করবেন না। আপনি লিটিলারি তখন বলেছিলেন যে আপনি ছিলেন না দেখে আগে একবার ঝিনুক আমার থেকে দূরে গিয়েছে আর যেতে দিবেন না।”
“আমি এমন কিছু বলি নি।”
“বলেছেন।”
“বলি নি।”
“বলেছেন।”
“দেখ সৈকত ঝগড়া করবি না। ভালো হবে না কিন্তু।”
“একশোবার করব।”
প্রভা হেসে উঠলো দুইজনের কান্ডে। সে বলল, “অদিন ও বিনুও চকোলেট বা টিভির জন্য এমনভাবে ঝগড়া করে। আপনারা একদম বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছেন। দুইজনই একরকম।”
অর্ক ও সৈকত দুইজন একত্রে বলল, “একদম না।”
সৈকত বলল, “আমি ফোন রাখছি।” বলেই কল কেটে দিলো।

অর্ক ফোন রেখে বলল, “অনেক হাসি আসছে তাই না?”
প্রভা দ্রুত মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে যেতে নিলেই অর্ক তাকে ধরে ফেলল। বাহু ধরে তার দিকে টান দিতেই প্রভা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। অর্ক বলল, “একটু আগে তুমি আমার গালে একটা গিফট দিয়েছিলে। রিটার্ন গিফট তো আমার দেওয়া উচিত তাই না?”
“লাগবে না।”
“আমি কারও ঋণ রাখি না তো।”
প্রভা বুকের ভেতর অজানা এক ঝড় উঠলো। সে চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জায় মেখে গেল। আবার চোখ তুলতেই দেখে অর্ক তার অনেক কাছে এসে পরেছে। ঠোঁটের কাছে ঠোঁট আনতেই সে অর্কের ঠোঁটের উপর হাত রেখে বলল, “দরজা খোলা কেউ এসে পরলে?”
অর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। ভীষণ বিরক্ত বোধ করল। এমন সময় কেউ থামায়? তবুও ছুট দিলো তাকে।
প্রভা ছুট পেয়ে দৌড়ে গেল। দরজা দিয়ে বের হতে নিবে তখনই অর্ক বলল, “পালিয়ে কোথাও গেলে তোমার মা তোমার জন্য প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসবে।”
প্রভা থেমে গেল। অর্কের কথা ভুল নয়। দুইদিকেই ঝামেলা। অর্ক ছুঁলেই এমনিতেই সে লজ্জায় শেষ হয়ে যায় এর মধ্যে কাছে আসলে তো মরেই যাবে বোধহয়।
সে সুন্দর মতো দরজা লাগিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ করে তার কানের কাছে নেশায় মাখা এক কন্ঠে শুনে তার দমটা আটকে এলো, “তুমি কোথায় পালাচ্ছিলে?” বলেই অর্ক না সরেই পাশের সুইচ বোর্ড থেকে লাইট বন্ধ করে এক মৃদু আলোর নীল লাইট জ্বালায়।
অর্ক প্রভার চুলগুলো আলতোভাবে সরিয়ে তার পিঠে একখানা চুমু খায়। সাথে সাথে কেঁপে উঠে প্রভা। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়।
প্রভা তার পেটে অর্কের আলতো হাতের ছোঁয়া পেতেই যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সাথে সাথে অর্কের দিকে ঘুরে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে। এক হাত দিয়ে খামচে ধরে তার গেঞ্জি।
অর্কও তার কোমরে দুই হাত আবদ্ধ করে। অর্ক প্রভার একটু ঝুঁকে প্রভার গলায় গাল ঘষে বলল, “প্রিয় বসন্তিকা, একটা প্রশ্নের উওর দিবে? পৃথিবীর কোনো নেশায় আমি আসক্ত হই না তবে তোমার নেশায় আমি এমনভাবে আসক্ত হই কেন যে নিজেকেই হারিয়ে ফেলি?”

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-৩৪ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1238528896516687/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here