মন_পাড়ায় পর্ব_৩৬

মন_পাড়ায়
পর্ব_৩৬
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

“প্রিয় বসন্তিকা, একটা প্রশ্নের উওর দিবে? পৃথিবীর কোনো নেশায় আমি আসক্ত হই না তবে তোমার নেশায় আমি এমনভাবে আসক্ত হই কেন যে নিজেকেই হারিয়ে ফেলি?”
কথাটা শুনতেই প্রভা চমকে উঠে। অতীতের কিছু স্মৃতি আবারও হানা দিয়ে যায় তার বুকে। কতগুলো বেদনার স্মৃতি। তার মনে আছে কয়েকবছর অন্যকেউও এমনই এক কথা বলেছিলো। সে সাথে সাথে অর্ককে ছেড়ে পিছিয়ে যায়। অনেকটা অস্বস্তি বোধ করে। সে কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলল,
“রাত অনেক হয়েছে ঘুমিয়ে যাওয়া উচিত আমাদের। হ্যাঁ তাই ঠিক হবে। আসুন ঘুমিয়ে পরি আবার সকালে রওনা দিতে হবে। রাত এমনিতেই দুইটা বাজে।”
বলেই প্রভা বিছানায় শুয়ে পড়লো।

অর্ক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রভার দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই মানুষের আচরণ এতটা পালটে যেতে পারে তা সে জানতো না। সে অনেকটা অবাক হলো তবে কিছু না বলে নিজেও যেয়ে শুয়ে পড়লো প্রভার দিকে পিঠ করে।
অর্ক অনেকটা সময় পর বলল,
“প্রভা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হুম।”
“তুমি কী এখনো বিনয়কে ভালোবাসো?”
প্রভা কিছু সময় নিয়ে উওর দিলো, “জানি না।”
“জানো না?”
“আমি জানি না আপনার আমার উপর এখন বিশ্বাস আছে না’কি এখনো বিশ্বাস নেই। কিন্তু এতটুকু বলতে পারব যে বিনয়কে আমি প্রচুর ভালোবেসেছিলাম। কেননা ও আমার জীবনের প্রথম পুরুষ ছিলো। ওর আগে আমার কোনো ছেলে বন্ধুও ছিলো না। তাই ওর সঙ্গ অতিরিক্ত ভালো লাগতো। তখন আরও আবেগের বসয় ছিলো তাই হয়তো আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম। বাস্তবতার সাথে কখনো মুখোমুখি হই নি। সে সাংসারিক জীবনেই বাস্তবতাকে খুঁজে পাই।”
“বিয়ে তাড়াতাড়ি হয় এইজন্য হয়তো কোনো বন্ধু বানানোর সুযোগ পাও নি। আর তুমি এমনিতেই শুধু থেকে ইন্ট্রোভার্ট টাইপের।”
” সত্যি বলতে আমার এই জীবনে শুধু একটি ছেলে বন্ধু আছে।”
অর্ক বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“কে? আমি কখনো জানতাম না যে তোমার কোনো বন্ধু আছে।”
প্রভা একটু হেসে বলল, “সৈকত। আপনি হয়তো জানেন না কিন্তু সৈকত ঝিনুক থেকেও আমার বেশি কাছের। বিনয়ের সাথে বিয়ের কয়েকবছর পর ও সবসময় এসে আমার খোঁজ নিতো, কথা বলত, সে সাংসারিক জীবনে আমি যদি কখনো হেসেছি তা শুধু সৈকত ও ফাতেমার জন্য। সৈকত থাকা অবস্থায় আমার কখনো আফসোস হয় নি যে আমার কোনো ছোট ভাই নেই।”
“তুমি আমার ভাইকে চুরি করেছ?”
প্রভা হাসলো এই কথা শুনে।
অর্ক আবারও জিজ্ঞেস করল, “বললে না যে?”
“চুরি করি নি তো।”
“এইটা না। এখনো বিনয়কে ভালোবাসো? উওরটা তো জানি না হতে পারে না। আমি জিজ্ঞেস করেছি এখনো, আগে কেন করেছিলে তা না। তুমি আমার বর্তমান, অতীত না।”
“আমি জানি না। এখন আর আগের মতো নিজের অনুভূতিকে বুঝতে পারি না। আমি ওকে ভালোবেসেছি, ওর ছোট বড় সকল আঘাতে বারবার ভেঙে যাওয়া ভালোবাসাকে আবারও গড়ে তুলেছি কিন্তু একবার ও আমার ভেতরটা এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে যে সে ছোট বড় সকল আঘাত মনে পড়লো আর ওর প্রতি আমার ভালোবাসা বিলীন হয়ে গেল অথবা বন্দী হয়ে গেল মন পাড়ার কোনো এক খাঁচায়।”
অর্ক জোরপূর্বক হেসে বলল, “আচ্ছা ঘুমিয়ে যাও।” বলে আবার অন্যপাশে ফিরে শুয়ে পড়লো।

প্রভার নিজের উপর জেদ উঠছিল। অর্ক এখন কী ভাববে তা ভেবে। শেষেদিকে তার মুখের ওপর এক বিষণ্ণতার ছায়া ছিলো কিন্তু এর কারণ ঠিক কি সে ধরতে পারলো না। সে অর্ককে ডাকতে চাইলো কিন্তু সাহস হলো না তার। আবার ফিরে অন্যদিকে শুয়ে পড়লো। তার চোখের সামনে কালো ধোঁয়া একত্রিত হলো। সে ধোঁয়া এক ভয়ানক রূপ নিলো। প্রভা চাদর চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল। তার মনে পড়লো যেদিন প্রথম এই ভয়াবহ কল্পনার সম্মুখীন হয়েছিলো সে…..
সেদিনটা স্বভাবিকই ছিলো বাকি দিনগুলোর মতো। বিনয়ের এক বন্ধুর বাসায় তারা যেত দাওয়াতে। বিনয় বলেছিলো সেখানে ভালোমতো সেজে যেতে তাই তার ননদ ফাতেমাকে বলল সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিতে।
বিনু ও অদিনকে ফাতেমার কাছে রেখে তারা দুইজন রওনা দিলো। বিনয় রাস্তায় তার প্রশংসা করছিলো বেশ কিন্তু সেখানে যেয়ে তার মতামত পাল্টে গেল। সেখানে সবাই প্রভার থেকে অনেক মর্ডান পোশাক পরিধান করেছিলো। সাথে সজসজ্জাও ছিলো বেশ। সে অচানা লোকের ভিড়ে বিনয় নিজেও যেন অচেনা হয়ে গেল। সব অচেনা লোকের মাঝে ফেলে গেল তাকে একা।

বিনয়ের বন্ধু রাহান যার জন্মদিনের দাওয়াত ছিলো সে এসে বলল,
“আরে ভাবি আপনি এইখানে? আর বিনয় কোথায়?”
“সম্ভবত ব্যস্ত। অনেক বছর পর বন্ধুদের সাথে দেখা ব্যাস্ত থাকাটা স্বাভাবিক।”
“তাই বলে আপনাকে এইভাবে একা ছেড়ে যাবে? ভাবি আপনি আমার সাথে আসুন। আমি আমার ওয়াইফের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আপনারও সময় কাটবে সাথে ওরও।”
“না ভাইয়া থাক। প্রয়োজন নেই।”
“আসুন না। আমার ওয়াইফ একটু অসুস্থ তাই আজ রুমে বসে আছে। আপনি এইখানে একা আর ও ওইখানে। দুইজনে একসাথে বসে গল্প করলে ভালো লাগবে।”
প্রভার তেমন ইচ্ছা ছিলো না যাওয়ার কিন্তু রাহানের জোর করায় তাকে সাথে যেতেই হলো। রুমে যেয়ে দেখে রুমে কেউ নেই। সে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার ওয়াইফ কোথায়?”
পিছনে ফিরতেই দেখে দরজা লাগাচ্ছে রাহান দরজা লাগাচ্ছে। প্রভা বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “দরজা লাগাচ্ছেন কেন?”
রাহান উওর দিলো না। প্রভার বুকের ভেতরটা কামড়ে ধরল। এক ভয় সাক্ষাৎ দিলো। আগে কখনো এমন জঘন্য পরিস্থিতিতে পরতে না হলেও সে লোকটার চোখদুটো দেখে তার বুক কেঁপে উঠছে। লোকটা যেন সে জঘন্য দৃষ্টি দিয়ে তাকে গিলে খাচ্ছে। তার হঠাৎ করে সম্পূর্ণ দেহ ঘিনঘিন করতে শুরু করল। সে দ্রুত দরজার কাছে যেতে নিলো আর লোকটা তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। প্রভার সে মুহূর্তে উঁচু স্বরে বলল, “ছাড়েন আমাকে, নাহলে ভালো হবে না কিন্তু।”
“উফফ আপনি জানেন আপনার প্রতি এইজন্যই আকর্ষণ হয়। সহজে পাওয়া জিনিসের মূল্য কারও কাছেই থাকে না। এইতো দেখেন বিনয়ের কাছেও আপনার মূল্য নেই। কিন্তু চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকই আপনার মূল্য দিব।”
“আপনার লজ্জা লাগা উচিত। সবাই আপনার এই রূপ জানলে কী হবে আপনি জানেন?”
“আপনাকে একবার হলেও পাওয়াটা আমার নেশা। যা হবে আপনাকে পাওয়ার পর দেখা যাবে।”
প্রভা যখন নিজেকে ছাড়াতে যেয়েও পারলো না তখন নিজের কনুই দিয়ে সজোরে মারল রাহাতের পেটে। যখন রাহান একটু ঢিল দিলো তখন পরপর চারবার মারল। আর পায়ে কয়েকটা লাথি মারলো।
রাহাত তার পেটের উপর হাত রেখে পিছিয়ে গেল। পরের মুহূর্তে সে রাগে বলে উঠলো,
“শালী তোর এত বড় সাহস! তোর তারিফ করসি দেইখা সাহস বাইড়া গেছে? ভাবছিলাম ভালোবেসেই নিজের তৃষ্ণা মেটাব কিন্তু তোর দেখি পাখনা লেগে গেছে। দাঁড়া তোর পাখনা কাটতিছি।”

মুহূর্তে এক জানোয়ার মতো রাহান তার দিকে এগিয়ে এলো। প্রভা নিজেও ছুটে বেড়াল। চিৎকার করলো অনেক। কিন্তু বাহিরের উঁচু স্বরের গানের তালে প্রভার কন্ঠ এই চার দেয়ালেই চেপে গেল। সে প্রভাকে ধরে ড্রেসিং টেবিলে ঠেকাল।
প্রভা সে প্রথম বুঝল অশোভন ছোঁয়ার অর্থ। তার নিজের শরীরকে ঘৃণা লাগছিলো এমন ছোঁয়ায়। মঅনে হচ্ছে কতগুলো কীটপতঙ্গ তার দেহের উপর রাখা হলেও এতটা ঘিন লাগতো না যা এই ভয়ঙ্কর বিশ্রী ছোঁয়াতে লাগছে। প্রভা নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করল। অনেক ভিক্ষা চাইলো কিন্তু সে মানুষরূপী জানোয়ারটার বুকে মায়া ছিঁটেফোঁটাও নেই। অবশেষে সে দেখতে পেল তার পাশের টেবিলে থাকা এক কাঁচের ফুলদানি। সে এক মুহূর্তে না ভেবে সে ফুলদানি উঠিয়ে মারলো রাহানের মাথায়।

প্রভা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছিল। রাহান তাকে ছেড়ে দুই’পা পিছিয়ে গেছে। মাথা ধরে আছে। টুপ টুপ করে ঝরছে শুধু রক্ত। তার কান, মুখ, গলা, সারা শরীর ধরে বয়ে মেঝেতে পরছিলো রক্ত। রাহান নিজেও মেঝেতে বসে পড়লো।

যে মেয়ে সারাজীবনে কাওকে কথা দ্বারাও আঘাত করে নি সে মেয়ের আজ একজনকে এতটা আঘাত করার পরও বিন্দুমাত্র মায়া হচ্ছিলো না তার।

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-৩৫ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1240214646348112/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here