মন_পাড়ায় পর্ব_৩৭

মন_পাড়ায়
পর্ব_৩৭
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

যে মেয়ে সারাজীবনে কাওকে কথা দ্বারাও আঘাত করে নি সে মেয়ের আজ একজনকে এতটা আঘাত করার পরও বিন্দুমাত্র মায়া হচ্ছিলো না তার।

প্রভা কিছুক্ষণ মেঝেতে পড়ে থাকা লোকটির দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর নিজের শাড়ির আঁচল ঠিক করে দৌড়ে বের হলো রুম থেকে । বাহিরে যেয়ে বিনয়কে খুঁজতে থাকে দিশেহারা হয়ে। যখন বিনয়কে পায় তখন আরেকটা বড় ঝটকা খায় সে। সে দেখে রুমের এক কোণে সে নূহার সাথে নাচছে। দুইজনের মাঝে দূরত্ব বলতে কিছুই নেই। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। অঝোর অশ্রুও বইতে ভুলে গেল।

যখন বিনয়ের চোখ পড়ল প্রভার দিকে তখন সে স্বাভাবিক হয়ে তার কাছে গিয়ে বলল,
“তুমি কোথায় ছিলে? আমি তোমাকে ছাদে, বাগানে যেয়ে খুঁজে এলাম। সবাই নাচছিল। পরে তোমায় না পেয়ে নূহাকে ডান্সের জন্য জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা এখন আসো।”
বিনয় প্রভার হাত ধরে তাকে নিজের সাথে নিতে গেল কিন্তু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। প্রভা কঠিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার উচিত ছিলো না আমাকে না পেলে আমার খোঁজ নেওয়া। আমার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যেত?”
প্রথমে বিনয়কে ভীষণ বিস্মিত দেখা গেল। সম্ভবত সে আশা করে নি যে প্রভা কখনো তার সাথে এই সুরে কথা বলতে পারে।
কিছুক্ষণ পর বিনয় কেশে বলল, “এইখানে সবাই আমার পরিচিত কে তোমার ক্ষতি করবে। তুমি অযথা চিন্তা করছ।”
“তোমার বন্ধু একটু আগে আমাকে রুমে নিয়ে আমার ধর্ষণ করতে চেয়েছিলো আর তুমি বলছ আমি অযথা চিন্তা করছি!”
বিনয় কিন্তু মুহূর্ত স্থির রইলো। তারপর এক ঘন নিশ্বাস ফেলে বলল, “কী বললে?”
“তোমার বন্ধু রাহান আমাকে রুমে নিয়ে যেয়ে……. ” এইখানেই থেমে গেল প্রভা। তার দমটা যেন আটকে আসছে। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার সাথে জোরজবরদস্তি করতে শুরু করেছিলো। অবশেষে ওই জানোয়ারকে মেরে তারপর পালিয়ে এসেছি।”
বিনয় কথাটা শোনার পরও কিছুক্ষণ স্থির রইলো। তারপর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কোন রুমে?”
প্রভা হাত দিয়ে ইশারা করলো। বিনয় সেদিকে দৌড়ে গেল। পিছনে গেল নূহাও। প্রভার আর ইচ্ছে হলো না ওই জানোয়ারটার চেহেরা দেখার তাই সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।
কিছুক্ষণ পর নূহা এসে তার হাত ধরে বলল, “প্রভা রাহানের অবস্থা বেশি ভালো না। রক্ত অনেক পরেছে ওর মাথা দিয়ে। হাস্পাতালে নিয়ে যেতে হবে। তুমি বাসায় যাও এখন।”
“আমি কিছু মুহূর্ত পূর্বে সেখানে থেকে এসেছি। আমি তো দেখলাম না এত রক্ত ঝরতে। আরও কতগুলো মারলে ঠিক হতো।”
নূহা প্রভার হাত ধরে বাহিরে নিয়ে গেলো আর বলল, “প্রভা এখন এইসব কথা বলো না। আমি আমার ড্রাইভারকে বলছি সে তোমায় বাসায় দিয়ে আসবে। এইদিকে বিনয় সব সামলে নিবে। তুমি যাও।”
প্রভাকে না চাওয়া সত্ত্বেও বাসায় পাঠানো হলো।

সারারাত বিনয় এলো না। ফোনও ধরলো না। প্রভা কাউকে কিছু জানায় নি। সে বিনয়ের আসার অপেক্ষা করছিল। পরেরদিন বিকেলে এলো সে। যখন প্রভা কথাটা তুললো আর পুলিশের কাছে যাওয়ার কথা বলল তখন বিনয় বিরক্তি নিয়ে বলল, “আমার তোমাকে সেখানে নেওয়াটাই ভুল হয়েছে। রাহান সবার সামনে আমাকে বলল যে আমার বউ না’কি মেন্টালি সিক। এই কথা এখন সব জায়গায় ছড়িয়ে যাবে। ও তোমাকে ঘর দেখাচ্ছিলো আর তুমি হঠাৎ করে ফুলদানি উঠিয়ে ওকে মেরেছ। ওর বউও ওর সাথে ছিলো। ও তোমার সাথে আজেবাজে কিছু করলে ওর বউ মিথ্যা বলতো?”
প্রভা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বিনয়ের দিকে। কিছু বলতে পারলো না। তার গলায় যেন একগুচ্ছ শব্দ আটকিয়ে গেছে। বিনয় আবারও একই সুরে বলল,
“আর তোমার কথা যদি মেনে নেই তাহলেও কী দরকার ছিলো তোমার এত সাজগোজ করে সেখানে যাওয়ার? অন্য কাওকে তোমার সৌন্দর্য দেখাতে?”
প্রভার বিস্মিত দৃষ্টি পরিবর্তন হলো না। বিনয় আরও কিছু কথা বলল কিন্তু তা সে শুনতেও পেল না। আগের সে কথাগুলোই কানে গুঁজছে তার। অবশেষে যখন বিনয় বেরিয়ে গেল তখন প্রভা দরজা বন্ধ করে দিলো। সে রাতেই প্রথম এই কালো ধোঁয়ার আভাস পায় সে।

অতীতের সে বেদনাদায়ক স্মৃতির দোয়ার থেকে বেরিয়ে সে চোখ খুলল সাথে সাথে সে ভয়ানক ধোঁয়াটি তার ভীষণ কাছে দেখল প্রভা। ভয়ে সে আবারও চোখ বন্ধ করে অন্যপাশে ঘুরে অর্কের হাত ধরে ফেললো।

অর্ক জাগ্রতই ছিলো। সে প্রভার ছোঁয়া পেতেই অন্যপাশে ঘুরলো। প্রভার এমন নির্মম অবস্থা দেখে। সে সাথে সাথে প্রভার গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ভয় লাগছে?”
প্রভা চোখ দুটো বন্ধ করেই উওর দিলো, “হুম।”
অর্ক প্রভার কপালে আলতো করে এক ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো আর বলল,
“তোমার সাথে আমি আছি। ভয় পেও না, আমি থাকতে কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না।”
প্রভা চোখ খুলে তাকালো মলিন মুখ নিয়ে। কিন্তু অর্কের মনোহর দেখে মুহূর্তে যেন প্রভার মাঝের সব ভয় কেটে গেল। সে নিজেও মৃদু হাসলো। তারপর বলল,
“ক্ষমা করে দিয়েন।”
“কিসের জন্য?”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করল অর্ক। প্রভা লজ্জামাখা কন্ঠে বলল,
“সে মুহূর্তে হঠাৎ করে এত কাছে এসে আবার দূরে যাওয়ার জন্য।”
অর্ক আরেকটু হেসে প্রভার কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে নিলো আর বলল,
“তোমার অনুমতি বিহীন আমি এগোতাম না’কি?” আবার প্রভার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, “পাগলী!”
প্রভা লজ্জা পেল হঠাৎ করে। সে অর্কের বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে ফেলল।
অর্কও তার বুকে প্রভাকে পেয়ে তাকে শক্ত করে আঁকড়ে রাখল। প্রভা জিজ্ঞেস করল, “প্রশ্ন করি একটা?”
“যেহেতু আমিও প্রশ্ন করেছিলাম তাই না করা যায় না।”
“আপনি কী এখনো নূহাকে ভালোবাসেন?”
অর্ক সোজাসাপটা উওর দিলো, “না।”
“কখনো ভালোবেসেছিলেন?”
“সম্ভবত হ্যাঁ।”
“আমি যে আপনাকে আমার অতীতের কথা বলেছি তা বিশ্বাস করেছেন কখনো? এক মুহূর্তের জন্যও?”
অর্কের উওর এলো না এই প্রশ্নের। প্রভা জানতো এই প্রশ্নের উওর সে পাবে না। তাই আরেকটা প্রশ্ন করল,
“আপনাদের জীবনের প্রথম যে মেয়েটি ছিলো। আপনার প্রথম ভালোবাসা, এখনো ভালোবাসেন?”
অর্ক নির্দ্বিধায় উওর দিলো, “হ্যাঁ। এখন এই তদন্ত বন্ধ করো। আমি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম আর তুমি দেখি একদম প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসলে!”
প্রভা তবুও আবারও জিজ্ঞেস করল, “আজও ভালোবাসেন?”
অর্ক আরও শক্ত করে প্রভাকে বুকে জড়িয়ে বলল, “আজও ভালোবাসি।”
প্রভা আর প্রশ্ন করল না। চোখ বন্ধ করে নিলো। বুকের ভেতর এক সূক্ষ্ম ব্যাথার অনুভূতি পাচ্ছে সে। সে সূক্ষ্ম অনুভূতিও ভীষণ কষ্টদায়ক।
.
.
সূর্য উঁকি দিয়েছে। অথচ ঝিনুকে সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। জানালার বাহিরে দেখছে এই প্রকৃতির খেলা আর তার স্মৃতিতে ভেসে উঠলো অতীতের মেলা,
কাপ্তাই লেক, এই প্রকৃতির আরেকটি জাদু। সে জাদুর নদীর জলে ট্রলারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো তারা। আশমানী রঙের আকাশে দোল খাচ্ছিলো মেঘেরা। মিষ্টি হাওয়ার ঘ্রাণ উড়ে বেড়াচ্ছিল। নদীর জল নীলচে-সবুজ রঙের ঝিনুকের কাছে আর চারপাশে এই নদীর সৌন্দর্য বাড়াতে প্রস্তুত ছিলো হাজারো সবুজ গাছ। ঝিনুক সে জলে হাত ভেজাচ্ছিল। তখনই সৈকতের সাথে আসা কেউ একজন তার পাশে এসে বসলো। ছেলেটাকে সে ঠিক চিনতো না। ছেলেটা বলল,
“এক্সকিউজ মি, আপনি রুহানি ভাবির বান্ধবী না?”
“জ্বি।”
“আপনাকে বিয়েতে দেখেছিলাম। অনেক সুন্দর নাচ করেন আপনি। আপনি দেখতে আরও বেশি সুন্দর। এত সুন্দর কাওকে আমি কখনো দেখি নি।”
“ধন্যবাদ।”
“আপনার নাম্বারটা দেওয়া যাবে?”
ঝিনুক অনেকটা হকচকিয়ে যায় হঠাৎ এইভাবে নাম্বার চাওয়ায়। সে কিছু বলতে যাবে এর আগেই অন্যকেউ বলল, “ও ফোন চালায় না।”
আমি চোখ তুলে সৈকতকে দেখল। সে আবার ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি না ছাদে উঠতে। আসো আমার সাথে।”
“কিন্তু উপরে তো জায়গা নেই।” বলে সে ছাদের উপরে তাকাতেই দেখে ট্রলার ছাদ সম্পূর্ণ খালি আবার নিচে তাকিয়ে দেখল সবাই চাপাচাপি করে নিচে বসে আছে। এর মধ্যে ইকবাল ভাইয়া জোর করে হেসে বলল, “প্লিজ জলদি যাও। এই শয়তানে একপ্রকার জুলুম করে আমাদের নিচে নামিয়েছে।”
ঝিনুক হাসলো মুখ চেপে। সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার বান্ধবীরাও উঠুক?”
সৈকত ছেলেটির দিকে তাকিয়ে উওর দিলো, “তুমি আমার সাথে একা আসছ।”
তারপর তার হাত ধরে তাকে সবার সামনে উঠিয়ে নিয়ে গেল। ভীষণ লজ্জা পেল ঝিনুক সবার সামনে এমনটা করায়।
ছাদে দুইজনে পাশাপাশি বসে ছিলো। বাতাস ছিলো আরও তীব্র। চারপাশের সৌন্দর্য ছিলো আরও গভীর। নিচে ছিলো কোলাহল অথচ তাদের মাঝে এক অস্বস্তিকর নীরবতা। একে অপরের দিকে তাকায় অথচ চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয়৷

ঝিনুক একটু দূরত্ব নিয়ে বসে ছিলো সৈকতের থেকে কিন্তু হঠাৎ করে ট্রলার নড়ে উঠায় একপাশে পড়ে যেতে নেয় ও সৈকত তার কোমর জড়িয়ে ধরে নেয়। আবার যখন ট্রলার অন্যপাশে গেল তখন সে যেয়ে পড়লো সৈকতের বুকের একপাশে। সে এক মুহূর্তের জন্য তার হৃদয়ের স্পন্দন যেন আটকে গেল। পরের মুহূর্তে দ্রুত গতিতে দৌড়াতে শুরু করল। সে সৈকতের দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়লো। তখনই এক মাতাল হাওয়া তাদের ছুঁয়ে গেল। প্রেমের মাতাল হাওয়া…..

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-৩৬ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1241968919506018/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here