মন_পাড়ায় পর্ব_৩৮

মন_পাড়ায়
পর্ব_৩৮
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

দুইজনের মাঝে নিরবতা থাকে আরও কিছুক্ষণ। নিরবতার রেশ কাটে সৈকতের প্রশ্নে,
“জায়গাটা সুন্দর তাই না?”
“ভীষণ।”
“আমাদের জীবনটাও যদি এমনই সুন্দর ও পার্ফেক্ট হলে ভীষণ ভালো হতো। তাই না।?”
“আপনার জীবন সুন্দর না?”
“জীবনের কিছু অংশ সুন্দর এবং কিছু অংশ বিষাক্ত।”
ঝিনুক মৃদু হেসে অন্যদিকে তাকাল আর বলল,
“জীবনটা পার্ফেক্ট হলে বাঁচার কারণটাই তো শেষ হয়ে যায়। জীবন নামক যুদ্ধটা করে সবাই শুধুমাত্র সুখটাই খুঁজে। কিন্তু কষ্ট না থাকলে সে সুখের মূল্য থাকবে না। তাই না?”
সে আবার তাকাল সৈকতের দিকে। সে অপলকভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। সে দৃষ্টি দেখে বুক কেঁপে উঠলো ঝিনুকের। সাথে সাথে সে চোখ নামিয়ে নিলো।

শুবলং ঝর্ণার কাছাকাছি যেয়ে নামলো সবাই। সবাই-ই পানিতে নামলো। ঝিনুক রুহানির সাথে পানি নিয়ে খেলছিলো এমন সময় রুহানি থেমে গেল। বলল, “দেখ তোর পিঠ পিছনে কত কি হচ্ছে!”
ঝিনুক অবাক হয়ে পিছে তাকাল দেখল সৈকত তার কিছু বান্ধবীর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। তাদের সাথে ছবি তুলছে।
রুহানি আবারও বলল, “সবগুলার সৈকত ভাইয়ের উপর ক্রাশ ট্রাশ আছে। সামলে থাকিস।”
ঝিনুক রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল রুহানির দিকে। বলল, “আমার কী? আমাকে বলছিস কেন?”
বলেই অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করল।
রুহানি পিছন থেকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছিস?”
“ঝর্ণা দেখতে আসছি না? ভালোমতো দেখতে যাচ্ছি।”
রুহানি দৌড়ে এসে ঝিনুকের হাত ধরে বলল, “পাগলামি করিস না ঝিনুক।”
“জীবনে আধ একটু পাগলামি না করলে জীবন বেঁচে কী লাভ?”
ঝিনুক রুহানির হাত ছেড়ে চলে গেল। গলায় স্কার্ফ জড়িয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। একটু পরই দেখে নিচ থেকে সৈকত তাকে ডাকছে। সে উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছো?”
“জাহান্নামে। আপনি আসবেন? আপনি আসলে ফ্রী এন্ট্রি দিয়ে দিবে।”
আর ভেংচি কেটে উপরে উঠতে শুরু করল। একটু পর হয়রান হয়ে বিশ্রাম নিলো কিছু সময়ের জন্য। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে সৈকতও প্রায় তার সাথে উঠে পড়েছে। সে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। যখন সৈকত তার পাশে এসে দাঁড়ালো তখন সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এইখানে কেন?”
“তুমি এইখানে কেন?”
সৈকতও কঠিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। ঝিনুক বলল,
“আমরা ঝর্ণা দেখতে এসেছি তাই তা কাছের থেকে দেখব বলে।” বলে আবারও উপরে উঠতে শুরু করল। সৈকত অধৈর্য হয়ে বলল, “আরে বোকা মেয়ে জায়গা তো পিচ্ছিল। একা কোথায় যাচ্ছো?”
“হ্যাঁ আমি তো বোকাই। যান না আপনার চালাক মেয়েদের কাছেই যান।”
সৈকত হেসে দিলো ঝিনুকের কথার ভঙ্গিতে। সে বলল, “আমার মেয়ে আবার কবে হলো? তবে তুমি চাইলে হতেও পারে।”
ঝিনুক বড় সড় এক ঝটকা খেল কথাটা শুনে। একবার পরে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নিলো। ভীষণ লজ্জাও পেল বটে। তাই দ্রুত উঠতে শুরু করল পাহাড়ের উপর। সে লজ্জাটা সৈকতকে দেখাতে চাইলো না।
পাহাড় কিছুটা পিচ্ছিল ছিলো বটে কিন্তু সে কোনো ভাবে অনেকটা উঠে পড়লো। উপরে উঠতে যেয়ে সে ঝর্ণার পানিতে সম্পূর্ণ ভিজে গেল। সাথে বেশ ক্লান্তও হয়ে গেছে। সে বসলো একজায়গায়। কিছু সময় পর সৈকতও তার পাশে বসলো। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “তোমার এত সাহস দেখে আমি দেখে আমি অবাক। এত পিচ্চি মেয়ে ফুরফুর করে উঠে গেছে। তোমার ভাগ্য ভালো কোনো পিচ্ছিল জায়গায় পা লাগলেই একদম নিচে যেয়ে পড়তে।”
“আমি আগে তিনবার এইখানে এসেছি। এখানে উঠেছিও। পরিশ ভাইয়ার এক বন্ধু সাজেক থাকে উনি শিখিয়েছেন। আমি দেখেই বুঝতে পেরেছি কোথায় বেশি পিচ্ছিল থাকতে পারে। আপনি যে আমাকে ফলো করে উঠেছেন তা ভুলবেন না।”
সৈকত মৃদু হেসে বলল, “ওকে মেডাম। তো মেডাম আপনি কেন আমার উপর রাগ করে আছেন জানতে পারি?”
“কে বলল আমি আপনার সাথে রাগ করেছি? রাগ তো আপন মানুষদের সাথে করে।”
“তুমি চাইলে আমার আপন হতেও সমস্যা নেই।”
ঝিনুক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল সৈকতের দিকে। একবার মুচকি হাসি দিয়ে আবার গম্ভীর ভঙ্গি নিয়ে বলল, “তো কয়টা মেয়েকে এই কথা বলেছেন?”
“যদি বলি তুমিই প্রথম?”
“তাহলে জিজ্ঞেস করব আমার বান্ধবীদের সাথে আপনার এত খাতির কীসের?”
“ও’মা আমার হবু শালিকা সবাই। তাদের সাথে খাতির না থাকলে তোমার সাথে থাকবে না’কি?”
ঝিনুক আবারও বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। চোখ নামিয়ে মুচকি হাসলো। লজ্জায় মেখে গেল।
সৈকত একটু ঝুঁকে তার মুখের লালিমা দেখে বলল,
“তুমি লজ্জা পেলে তোমার গালদুটো গোলাপি হয়ে যায় জানো তো। লজ্জা পেলেই ধরা খাও।”
ঝিনুক একপলক তাকাল সৈকতের দিকে। তারপর উঠে দাঁড়ালো। সৈকত জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছ?”
“নিচে।” বলেই সে নামতে শুরু করল।
সৈকত বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার মতো মেয়ে আমি জীবনে দেখি নি। তোমার মুড মিনিটে মিনিটে পাল্টায়।”
ঝিনুক একটু নিচে নেমে গিয়েছিল তাই উঁচু স্বরে বলল, “পাবেনও না। ঝিনুক একপিস মাত্র।”
সৈকত হেসে নিজেও নামতে শুরু করল।
ঝিনুক নামার পর রুহানির কাছে বকা খায় কতক্ষণ।
.
.
হোটেলে ফেরার পর সবাই প্রায় সবাই বাহিরে যায় কিন্তু ঝিনুক কাপ্তাই লেক থেকে এসেই যে ঘুম দেয় সে উঠে রাত আটটায়। উঠে ঘুম ঘুম চোখে কফি বানিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়। কফিতে এক চুমুক দিয়ে চোখ তুলতেই তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। সৈকত তার রুমে থেকে বের হচ্ছে। তাও বিনা শার্ট পরে। সে এক হাত চোখের উপর রেখে বলল,
“আপনার লজ্জা লাগে না আপনি শার্টলেস হয়ে ঘরে ঘুরাঘুরি করছেন?”
“আমি ভেবেছি তুমি ঘুমাচ্ছো।”
“মিলিও তো আমাদের সাথে থাকে।”
“মেডাম সবাই বাহিরে গেছে আর আপনি সে বিকেল থেকে ঘুমাচ্ছেন।”
ঝিনুক চোখ থেকে হাত সরিয়ে বিস্মিত সুরে বলল,
“আমাকে না নিয়ে চলে গেছে! আপনি যান নি কেন?”
“তোমাকে তো আর একা রাখা যায় না। কখন কী কান্ড ঘটিয়ে ফেলো কে জানে?”
“আপনার লজ্জা লাগে না এখনো দাঁড়িয়ে আছেন? দেখছেন আমি জেগে গেছি তাও।”
সৈকত উল্টো তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল ঝিনুকের দিকে। ঝিনুক পিছিয়ে যেয়ে আমতা-আমতা করে বলল, “কী আজব আমার দিকে আসছেন কেন?”
“কত ভদ্র মেয়ে সাজা হচ্ছে তাই না?”
“আমি তো ভদ্রই।”
“ঝর্ণা থেকে নামার পর যখন গেঞ্জি চেঞ্জ করছিলাম তখন কে যেন রুহানিকে বলেছিল ‘ইশশ তোর দুলাভাইটা কী হট! শয়তানও আছে শুধু জ্বালায় বলে, নাহলে তো……..” ঝিনুক ভ্রু কপালে তুলে সৈকতের কথা কেটে বলল, “নাউজুবিল্লাহ এইসব কী বলেন? আমি সারাজীবনে এইসব কথা বলি নি।” পিছাতে পিছাতে রান্নাঘরের তাকে তার পিঠ ঠেকে যায়। সৈকত তার দুইপাশে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল,
“তাই?”
ঝিনুক এক ঢোক গিললো। তার হৃদয়ের স্পন্দন মুহূর্তের জন্যও স্বাভাবিক হচ্ছে না। মুহূর্তে মুহূর্তে বাড়ছে শুধু।
সৈকত আবার তার কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমার কিছু চাওয়ার আছে তোমার কাছ থেকে। আশা করছি প্রত্যাখ্যান করবে না।”
ঝিনুকের বুকের ভেতর ধ্ক করে উঠলো। সে কতক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। সৈকত যখন কাছে এলো তখনও সে চাইছিল তাকে মানা করতে। কিন্তু আবার চাইছিলোও না। একপ্রকার যুদ্ধ করে চোখ বন্ধ করলো।
তার হাতে ছোঁয়া পেল সৈকতের। সাথে সাথে সে কেঁপে উঠলো। সৈকত তার হাত থেকে কফির মগটা নিলো। সে বুঝেছিলো তার হাত থেকে নিয়ে অন্যকোথাও মগটা রাখবে কিন্তু সে উল্টো বলল, “কফির জন্য থ্যাঙ্কিউ। প্রচুর ঘুম পাচ্ছিলো।”
ঝিনুক চমকে চোখ খুলে। দেখে সৈকত পিছিয়ে গেছে। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে রইলো সৈকতের দিকে। সৈকত রান্নাঘরের দরজায় যেয়ে দাঁড়িয়ে আবার পিছনে ফিরে বলল, “তোমার এতটুকু মাথায় এতটা আজেবাজে চিন্তা ঘুরে। আমার তো রুহানির কথাই বিশ্বাস করতে হবে তাই না?”
বলেই চলে গেল।
ঝিনুকের প্রচুর কান্না পেল সাথে রাগও উঠলো। আর সাথে লজ্জাও লাগলো প্রচুর। সে তার জীবনে এতটা কারও সামনে বিভ্রান্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। সে রাগী কন্ঠে বলল, “রুহানির বাচ্চা তুই এসে নেয় শুধু। তোর খবর আছে আজ।”
বলেই আহ্লাদী করে কাঁদতে শুরু করল।

অতীত ভেবেই হাসলো ঝিনুক। সে দিনগুলো কত সুন্দর ছিলো আর আজ কী হয়ে গেল। তার মাঝেমধ্যে মনটা চায় যেন সে দিনগুলোতে ফিরে যায়। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় যেয়ে বসল আর মোবাইল হাতে নিলো অঞ্জলির মেসেজ দিবে বলে। তাকে বলা উচিত যে সে কালকের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে না। তাই তার জলদি উঠে তাড়াহুড়ো করে আসার প্রয়োজন নেই।

মোবাইল অন করার সাথে সাথে দেখে দেড়টায় অঞ্জলির একটা মেসেজ এসেছে। সেখানে লেখা, “দোস্ত কাল আমি তোর সাথে যেতে পারব না। বাসায় অনেক ঝামেলা হয়েছে। মা আমার বিয়ের কথা বলছিলো, কোন ছেলে দেখেছে তার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য আর আমি সাবেকের কথা বলে দিয়েছি। এই নিয়ে মা ভীষণ রাগে আছে। বাবা তো জানেই না, জানলে কী হবে ভাবতেও পারছি না। মা কোনো মতে রাজি না সাবেকের সাথে আমার সম্পর্কের জন্য।”

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-৩৭ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1242852376084339/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here