মন_পাড়ায়
পর্ব_৭
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, “সুখের সময়সীমা এত কম আর দুঃখের এত বেশি কেন?”
“কারণ সুখ জীবনের মিথ্যে আশা ও দুঃখ কটু সত্য।”
ঝিনুকের উওর না পেয়ে প্রভা আবারও বলল, “ইনশাআল্লাহ তুই দুঃখগুলোকেও ও জয় করে নিবি একদিন। ”
ঝিনুক তাচ্ছিল্য হাসলো। বলল, “আমার জীবনটাই কটু সত্য। জন্মের পর থেকেই এই কটু সত্য আমার পিছু ছাড়ে না। আর এইসব ওই লোক ও মহিলাটার জন্য। ওই অক্ষম লোকটার জন্য যে আমার জন্মের কথা শুনে পালিয়ে গেছে আর ওই দুর্বল মহিলা যে আমাকে জন্ম দেওয়ার পর আমাকে ফেলে চলে গেছে। আমাকে যদি এইভাবে ফালিয়েই যেতে হতো তাহলে জন্ম দিলো কেন? আমাকে যদি কখনো প্রশ্ন করা হয় না পৃথিবীতে সবচেয়ে ভীরু মানুষ কে? আমি বলব, আমার সো কল্ড মা বাবা। যারা মা বাবা নামে কলঙ্ক। না তারা আমাকে এইভাবে ফেলে যেত আর না কেউ অনাথ ভেবে আমার জীবন নিয়ে খেলতে পারতো। আর না কথা শুনাতে পারতো। কারণ তারা জানে আমার মা বাবা নেই যে আমার জন্য লড়াই করবে। তাই যা ইচ্ছা তাই করুক সমস্যা কোথায়?”
প্রভা ঝিনুককে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, “এইভাবে বলতেই নেই ময়না পাখি। যতই হোক তোর মা ও বাবা। আর খালামণি তো এখন এই পৃথিবীতে নেই, মৃত মানুষ সম্পর্কে বাজে বলতে নেই। আর প্রতিবার এই কথা তুলে লাভ কী বলত? আর কে বলল তোর কেউ নেই, আমরা আছি না?”
“থাকলেও কি হয় আপি। অনাথ সন্তান অনাথই থাকে আর অবৈধ অবৈধই।” ঝিনুক চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
প্রভা জিজ্ঞেস করল, “কেউ কিছু বলেছে ময়না পাখি?”
“আপু ক্লাসে স্যার এসেছে আমি রাখি।”
প্রভা কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেল। ঝিনুক ফোন কেটে দিয়েছে। মেয়েটাও না, রাগ সবসময় নাকে বসে থাকে। যাক তার স্বপ্ন তো পূরণ হবে তো অবশেষে । প্রভা আশেপাশে তাকিয়ে আয়নার সামনে যেয়ে নিজেই বলল, “অর্ক আমার সাথে যাই করুক না কেন কিন্তু তার এই কাজে আমি খুব খুশি হয়েছি। যদিও অর্কের খারাপ ব্যবহারেরও কারণ রয়েছে। অর্ক ও বিনয় পনেরো বছর ধরে বন্ধু এবং আমার জানা মতে অর্ক প্রায় আট বছর ধরে নূহাকে ভালোবাসে। তাহলে কীভাবে অর্ক আমার কথা বিশ্বাস করবে?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রভা আয়নায় তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। বলল, “মুখে হাসি নিয়ে আয় প্রভা। বাহিরে অনেক মেহমান। এই রুম থেকে বের হতেই মানুষের ভিড়ে কষ্টগুলো হাসির চাদরে ঢেকে রাখতে হবে। তাই মুখে হাসি বজায় রাখ।”
প্রভা মৃদু হেসে রুম থেকে বের হলো।
প্রভা তার প্রথম বিয়ের সাত মাস পর থেকে আয়নায় নিজের সাথে কথা বলে। যখন নিজের কষ্টগুলো ভাগ করার জন্য কোনো বন্ধু থাকে না তখন নিজেকেই বন্ধু বানাতে হয়। নিজেকে দেখে হাসতে হয়, কাঁদতে হয়, উপদেশ দিতে হয়। প্রভারও তো কেউ নেই। প্রথম বিয়ের পর শশুড়বাড়ির লোকেরা তার সাথে ঠিক মতো কথা বলত না। এমনকি তার স্বামীও রাগ করতো ভীষণ। কেন রাগ করতো ঠিক সে জানত না। পরে জানতে পারে বিনয় তাকে কখনোই পছন্দ করে বিয়ে করে নি। তার বাবার কয়েকটা টেন্ডারে অংশীদারি লাগতো তাদের। একটা নিজের গাড়ি লাগতো তাই বিয়ে করেছে। কিন্তু পরে আস্তে-ধীরে তার ব্যবহার পরিবর্তন হয়। তবুও তার পরিবারের নির্যাতন কমে নি। তার এখনো মনে আছে যে মেয়ে তার বাবার বাসায় একবার চাও বানায় নি সে মেয়ে সারাদিন ঘরের পরিষ্কার করতো, কুটা বাছা থেকে শুরু করে সব রান্না করতো, ঘরের সবার কাপড়চোপড় ধুয়ে দিত। আর দিনশেষে সবার খাওয়া শেষে কিছু থাকলে তা খেতে দিত। আর না থাকলে,সেদিন বাদ যেত। এমনকি বিনু হওয়ার সময়ও তার শাশুড়ী তাকে ঠিক মতো খাবার দেয় নি। ভালো কিছু রান্না করার পর তা ছুঁতেও দিত না। এমনও হয়েছে সে একদিনে শুধু মরিচ ও লবণ দিতে ভাত একবেলা খেয়েছে। বিনয় সব জেনেও তার মা’কে কিছু বলতে পারে নি। সে চাইত প্রভার বাবার বাসায় বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত প্রভা থাকুক। কিন্তু তার বাবার বাসাতেও আট মাস না হওয়া পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয় নি। এমনকি মেয়ে হওয়ায় বিনয়ের মা হাস্পাতাল থেকেই বের হয়ে যায় রাগে। কিন্তু বিনয় সেদিন খুব খুশি হয়। সেদিন প্রথম তাকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলেছিল। প্রভার জন্য পৃথিবীর অনেক মূল্যবান কিছু ছিলো। অথচ তাদের আবার অদিন হওয়ার পর সব আগের মতো হয়ে যায়। অথবা বলা যায় আরও খারাপ হয়ে যায়।
প্রভা বাহিরে বের হওয়ার আগেই মাথায় ঘোমটা দেয়। সোজা রান্নাঘরে যায়। যেয়ে দেখে তার শাশুড়ী চা বানাচ্ছে। সে মৃদু কন্ঠে বলল, “মা আমি আপনার সাহায্য করব?”
উনিও হেসে উওর দিলেন, “না মামনী তুমি এখন ক্লান্ত যেয়ে আরাম কর। গতকাল কত দখল গেল তোমার উপর।”
“একা তো ভালো লাগছিলো না। মা ভাদ্র ভাইয়া কোথায়?”
“ও নিজের মামার বাসায় আছে আপাতত। বেশি মানুষ দেখলে সমস্যা হয়। তোমাদের ফেরার পর একেবারে আসবে।”
প্রভা অনুরোধের সুরে বলল, “মা আপনি আমি আপেলটা কেটে দিই দিন। আমার ভালো লাগছিলো না তাই।”
“আচ্ছা নেও। আমি ততক্ষণে চা তোমার শশুরকে দিয়ে আসি।”
প্রভার শাশুড়ী যাওয়ার প্রভা আপেল কাটতে শুরু করলো। তখন দুইজন মহিলা পাকঘরে প্রবেশ করল। তারা দুইজনের প্লেট রাখলো। প্রভা মৃদু হেসে সালামও দিলো তাদেরকে। সম্ভবত এরা দাদিমার বাড়ির কেউ। তারা ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই একে অপরকে বলল, “আমি বুঝতে পারলাম ছোট বউয়ের বিয়ে ভাঙা সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করিয়ে আনল কারণ মেয়েটা অনেক সুন্দর। কিন্তু অর্ক বাবা এই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হইসে কেন? একতো কয়লার মতো কালো রঙ, এর উপর দুই বাচ্চার মা। আরও বিধবা। জামাই মরার দুইবছর হয় নি লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে বিয়ে করতে।”
প্রভা আপেল কাটছিলো। কথাগুলো কানে আসতেই থেমে গেল। সে জানে কথাগুলো তাকে শুনিয়েই বলা হচ্ছে। কিন্তু কেন তা আজও বুঝতে পারে না সে। অন্যের জীবন নিয়ে তাদের এত চিন্তা কেন? কারও মুখে হাসি না আনতে পারলে কষ্ট দেওয়ার কী দরকার?
সেখানে আরেকটি মহিলা বলল, “আমার তো মনে হয় জাদু টোনা করছে। নাইলে অর্কের জন্য তো কত সুন্দর স্মার্ট মেয়ে আনলাম এই মেয়েকে কেন পছন্দ করবে?”
প্রভা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একসময় এইসব শুনে কষ্ট লাগতো। এখন লাগে না। বড় বড় কষ্ট ভোগ করা শেষে এত তুচ্ছ কষ্টে আর কাঁদা আসে না। এতগুলো ঠোকর খাওয়ার পর কান্নাও শুকিয়ে যায়।
চোখ খুলতেই দেখে তার শাশুড়ী মা এসে পড়েছে। সে বলল, “প্রভা মামনী এই চা নিজের দাদিমায়ের জন্য নিয়ে যাবে একটু?”
“জ্বি মা দিন।”
মহিলা দুটো যাওয়ার পর। মা চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা সামাজিক প্রাণী মামনী। এইখানে একেকজন একেক কথা বলে। আর বেশিরভাগই খারাপ হয়। ভালো বলার মানুষ এই সমাজে অনেক কম। কারণ মানুষ খোঁট ধরতে ভালোবাসে গুণ ধরতে নয়। আর মেয়ে মানুষ হলে তো আর রেহাই নেই। আমি যখন এই বাসায় নতুন বিয়ে করে এসেছি আমাকেও অনেক কিছু শুনতে হয়েছিলো যেখানে কেউ আমাকে চিনতোই না। সব কথায় কান দিলে জীবনটা শোকেই কেটে যাবে তাই এইসব কথায় কান দিও না। নেও এই ট্রে টা নিয়ে তোমার দাদিমার কাছে নিয়ে যাও।”
.
.
ছেলেটাকে ঝিনুক জিজ্ঞেস করল, “এই ফ্রম ফিলাপ কে করেছে?”
“সৈকত ভাইয়ে করছে। আর কইসে যেন আমনে সই নিয়া আহি। আর আমনেরে ডাকছে।”
ঝিনুক ফর্মটার দিকে তাকালো। তার নাম, রোল, জিপিএ থেকে শুরু করে সব ঠিক। সৈকত এইসব জানল কীভাবে? তাদের তো দুইবছর কোনো যোগাযোগই হয় নি। তাহলে কীভাবে? প্রশ্নের একটা উওর যখন পেল বুকের ভিতরটা যেন মুচড়ে উঠলো। না, সৈকত কেন এই দুইবছর তার খোঁজ রাখবে? সে তো মেয়েদের থেকে সময়ই পাবে না আবার তার খোঁজ!
ঝিনুক ছেলেটার সাথে লাইব্রেরি গেল। আরও কিছু কাজ শেষ করতে হবে তাই। আশেপাশে মানুষ আছে কয়েকজন। কিন্তু সে পেল না সৈকতকে। ছেলেটাও চলে গেছে। ধ্যুর। সে খুঁজতে খুঁজতে একদম ভিতরের দিকে চলে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজছিল শুধু। এক শেল্ফের সামনে যেয়ে পিছনে তাকাতেই দেখে সৈকত। ঝিনুক বিরক্ত নিয়ে বলল, “দেখা দিতে এত সময় লাগে? আর লাইব্রেরিতে কেন ডেকেছ?”
“পড়ছিলাম তাই উঠে যেতে মন চাইল না। এইজন্য তোমাকেই ডাক দিলাম।”
ঝিনুক তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “পড়া আর তুমি! প্লিজ, এই শব্দ তোমার পারসোনালিটির সাথে একদম যায় না।”
সৈকত ঝিনুকের দুইপাশে দুই হাত রেখে তার সামনে ঝুঁকে বলল, “মনে আছে চ্যালেঞ্জ করেছিলে যদি আমি ভার্সিটিতে ফার্স্ট হই আমাকে কিছু দিবে।”
ঝিনুক চিন্তা করতে শুরু করল। কিন্তু মনে পড়লো না। সে জিজ্ঞাসুক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। সৈকত বলল, “তোমার রিভোর্ডের আশায় দুই বছর নিজের ডিপার্টমেন্টে প্রথম হয়েছি। আমি আমার উপহার নিয়ে নিলাম।”
ঝিনুক তবুও কিছু বুঝলো না। তার মনেই পড়ছে না কিছু। সৈকত চোখ বন্ধ করে একটু ঝুঁকে তার ঠোঁটে আলতো করে তার ঠোঁট ছোঁয়াল। মুহূর্তে কেঁপে উঠলো ঝিনুক। এটা তার আশার বাহিরে ছিলো।
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
পর্ব-৬ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1190581281311449/