মন_পাড়ায় পর্ব_৮

মন_পাড়ায়
পর্ব_৮
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

ঝিনুক তবুও কিছু বুঝলো না। তার মনেই পড়ছে না কিছু। সৈকত চোখ বন্ধ করে একটু ঝুঁকে তার ঠোঁটে আলতো করে তার ঠোঁট ছোঁয়াল। মুহূর্তে কেঁপে উঠলো ঝিনুক। এটা তার আশার বাহিরে ছিলো।

সৈকত মাথা তুলে চোখ টিপ মেরে বলল, “আমার রিভোর্ডটা আমার পছন্দ হয়েছে। এইটা দ্বিতীয় বর্ষে আর তৃতীয় বর্ষেরটা—-”

কথা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই ঝিনুক সৈকতের বুকে ঘুষি মারতে শুরু করল। আর বলতে শুরু করল, “শয়তান, গরু, ছাগল, ভেড়া, জিরাজ, ভুরুম তুরুম তোর সাহস কত তুই আমাকে কিস করসোস তাও না জিজ্ঞেস করে।”

সৈকত খপ করে তার এক হাত দিয়ে ঝিনুকের দুইহাত ধরে ফেলল আর বলল, “জিজ্ঞেস করলে কী কিস করতে দিতে না’কি?”

ঝিনুক সৈকতের পায়ে মারতে শুরু করল। বলল, “তোকে আমি আজকে খুন করে ফেলবো লুইচ্চা ব্যাটা। সাহস কত বড় হয় আমার পারমিশন ছাড়া কিস করার?”

“আজব তো পাবলিক প্লেসে এভাবে কেউ মারে না’কি?”

কথাটা শুনেই ঝিনুক থেকে গেল। ড্যাবড্যাব করে তাকালো সৈকতের দিকে। নাক ফুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ তো পাবলিক প্লেসে তো কিস করার পোস্টার লাগিয়ে রাখসে।”

“ইশশ রাগ করলে তোমাকে কত কিউট লাগে! পুরো মুখ লাল।হয়ে যায়। একদম টমেটোর মতো লাগে।”

“তোকে আমি টমেটো খাওয়াচ্ছি।”

সৈকত ঝিনুকের হাত ছেড়ে ঝিনুকের গালে হাত রেখে বলল, “তুমি চাও আমি তোমাকে খেয়ে ফেলি।”

“একদম খুন করে ফেলবো।”

“তুমিই তো বলেছে খাওয়াচ্ছি। নিজে ডাবল মিনিংয়ের কথা বলে আমাকে বকে যাচ্ছ। বেচারা মাসুম আমি।”

ঝিনুক আবারও সৈকতকে মারতে নিলে সৈকত এক দৌড় দেয়। ঝিনুক তার পিছনে দৌঁড়ে গেল। ঝিনুক দেখল সৈকত এক চেয়ার টান দিয়ে বসে গেছে। তখনই একটা লোক তাকে ধমকের সুরে বলল, “এটা লাইব্রেরি না’কি অন্যকিছু? তোমার কন্ঠ সে কখন থেকে শুনছিলাম। লাইব্রেরিতে কীভাবে থাকতে হয় জানো না?” আবার সৈকতকে দেখিয়ে বলল, “ওর থেকে শিখা উচিত। ওদের ডিপার্টমেন্টে ফাস্ট হয় সবসময়ই। সবসময় কত শান্ত হয়ে থাকে ছেলেটা। আর তোমাদের মতো পোলাপান আমাদের ভার্সিটির সম্মান নষ্ট করে। হয়তো চুপচাপ কোথাও বসো, নাহয় এখনই বের হয়ে যাও।”

ঝিনুক ভীষণ লজ্জিত হলো। তার লজ্জায় কোথাও ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে। বিনা কারণে এতটা লজ্জিত হতে হলো তাকে। তবুও এই টেবিলের সারিতে কেউ বসে নেই দেখে অন্যকেউ দেখে নি, নাহয় প্রথম দিনেই তার সম্মান ধুঁয়ে যেত। সৈকতের উপর ভীষণ পরিমাণে রাগ উঠছে তার। সে সৈকতের সামনে যেয়ে তার দিকে ঝুঁকে বলল, “বাসায় আসো খবর করছি তোমার।”

সৈকত চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “উফফ মাই ডিয়ার ওয়াইফ, তুমি এতটা দুষ্টু আমি জানতাম না। এইসব চলে তোমার মাথায়।”

“তোমাকে আমি—-” কিছু বলার আগেই সৈকত ফট করে উঠে ঝিনুকের নাকে একটা চুমু খেয়ে আবার বসে পরলো। ঝিনুক থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কী হলো তা বুঝলোই না। সৈকত গালে হাত দিয়ে বলল, “কন্টিনিউ কিটি ক্যাট।”

ঝিনুক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমাকে আমি একদম খুন করে ফেলব।”

সৈকত বুকের বা’পাশে হাত রেখে বলল, “উফফ জান তোমার হাতে আমি একশোবার খুন হতে রাজি আছি।”

ঝিনুক শেষ না পেয়ে অসহায় গলায় বলল, “তুমি এত বেহায়া কেন?”

“তোমার এক্স ছিলাম না? তোমার সাথে থাকতে থাকতে প্রভাব পড়েছে মনে হয়।”

আবারও লাইব্রেরিয়ান ডাক দিলো ঝিনুককে। ঝিনুক তার কথা শুনে আবার সৈকতের দিকে তাকিয়ে রেগেমেগে বলল, “আই হেইট ইউ, আই হেইট ইউ সো মাচ।”

“মি টু মাই ডিয়ার ওয়াইফ।” বলেই চোখ টিপ মারলো।

ঝিনুক কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু সৈকতকে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে মেঝেতে লাথি মেরেই চলে গেল।

ক্লাসে ফেরত যাওয়ার সময় অর্কের মেসেজ পেল, “প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে বোধহয় সৈকতই কথা বলে নিয়েছে। তোমার এডমিশন হয়ে গেছে। আমি মাঝ রাস্তায় ছিলাম ফিরত যাচ্ছি। তুমিও জলদি চলে এসো। যেহেতু রাতে বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হতে হবে।”

ঝিনুক ক্লাসে না যেয়ে একদম নিচে গেল। নিচে যেতেই অর্ণবের সাথে দেখা হয়। সে ও সাবেক এক জায়গায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। অর্ণব তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কাজ শেষ?”

“কাজ না ক্লাস। ওই ফাজিলটা ইচ্ছা করে জ্বালাচ্ছিল। প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কথাই বলতে হয় নি। একটু আগে জিজুর মেসেজ আসলো যে ভর্তি হয় গেছে। সবই আমাকে জ্বালানোর জন্য।”

“এইজন্যই তো বলেছিলাম ওর থেকে দূরে থাক। শুধু শুধু ঝামেলা বাঁধানোর প্রয়োজন নেই।”

ঝিনুক জোরপূর্বক হাসলো। মনে মনে বলল, “একই রুমে থেকে দূরে থাকব কী করে ভাই?”

তাদের কথোপকথন চলাকালীন একটি ছেলে তাদের মাঝে এসে দাঁড়ালো। বলল “এক্সকিউজ মি।”

ঝিনুক তাকালো তার দিকে। সম্ভবত তাকে আগেও দেখেছে। সৈকতের বন্ধুই। নামটা ঠিক মনে আসছে না। ছেলেটা হেসে বলল, “চিনেছ? আমি ইকবাল রুহানি ভাবি ও রাশেদ ভাইয়ের বিয়েতে দেখা হয়েছিলো। আর এরপরও সৈকতের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”

ঝিনুক আড়চোখে তাকালো অর্ণবের দিকে। তারপর বিচলিত না হয়ে ইকবালকে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন ইকবাল ভাই?”

“এইতো ভালো। সৈকত বলেছে তোমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিতে। যেতে যেতে কথা বলি আসো।”

অর্ণব সাথে সাথে দাঁড়িয়ে রুক্ষ গলায় বলল, “ওকে রিকশায় উঠিয়ে দিতে হলে আমি দিয়ে আসছি।”

ইকবাল হেসে অর্ণবের দিকে তাকালো। কাঁধে হাত রেখে বলল, “ধন্যবাদ ভাই কিন্তু সৈকত বলেছে অচেনা কারও সাথে যেন না পাঠাই। ওর ভাবির বোন তো তাই।”

অর্ণব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের কাঁধের দিকে তাকিয়ে ইকবালের হাত নিজের কাঁধের থেকে সরিয়ে দিলো। ইকবাল ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আসো।” ঝিনুক বিদায় নিয়ে ইকবালের সাথে চলল।

সৈকত চারতলা থেকে নিচে তাকিয়ে ছিলো। ঝিনুকের যাওয়া পর্যন্ত সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। অবশেষে যখন ঝিনুক চলে গেল। সে নিচে নামলো। গেইটের বাহিরে বাইক নিয়ে বের হয়ে দেখে ইকবাল দাঁড়িয়ে আছে। ইকবাল বলল, “মাত্র রিকশা নিয়ে দিয়েছি। তুই তো এখন বাসাতেই যাবি, ওকে সাথে করে নিলেই পারতি।”

সৈকত বলল, “ভার্সিটিতে আমার শত্রু কম না। কেউ যদি জানে ও আমার ওয়াইফ তাইলে ওর ক্ষতি করতে পারে।”

“ওহ আচ্ছা।” পরবর্তী মুহূর্তে ইকবালের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। অচমকায় সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওয়েট, হোয়ার! ওয়াইফ?”

সৈকত তার বাইক চালু করে বলল, “একটু পর পাঞ্জাবি পরে নিহানকে নিয়ে বাসায় এসে পরিস আজই বৌভাত। আর কাউকে ভুলেই এই কথা বলবি না।”
.
.
অর্ক বাসায় ঢুকতেই বিনু বলে, “আংকেল আংকেল আপনার মা ডেকেছে।”

অর্ক বিনুকে কোলে তুলে বলল, “আমার প্রিন্সেস কেমন আছে? তার রাতে ঘুম হয়েছে ঠিক মতো?”

বিনু মলিন মুখেই বলল, “হয়েছে আংকেল।”

“আংকেল না। অদিনের মতো তুমিও বাবা ডাক দিও।”

বিনু মুখ মলিন করে তাকাল অর্কের দিকে। বলল, “কিন্তু আপনি আমার বাবা না তো ডাকবো কেন? আমার বাবাকেই শুধু আমি বাবা ডাকব। আর আপনি আমার বাবা না। কখনো হবেন না, কখনো না।”

বলেই বিনু অর্কের কোল থেকে নেমে চলে গেল। আর দৌড়ে তার রুমের ভিতরে ঢুকে পরল। আর অর্ক গেল দাদিমার রুমে যেয়ে দেখে সৈকতের মা ও দাদিমা প্রভার সাথে বিছানায় বসে আছে। দাদিমা তাকে দেখে বলল, “আয় আয় ভিতরে আয়।”

প্রভা পিছনে ফিরে অর্ককে দেখতেই উঠে একপাশে যেয়ে দাঁড়ালো। অর্ক এসে সেই জায়গাতেই বসল। জিজ্ঞেস করল, “ডেকেছিলেন দাদিমা?”

“হ্যাঁ, দাদুভাই ডেকেছিলাম। এই’যে দেখ গয়না। তোর দাদাভাই আমাকে এই গয়নাগুলো উপহার দিয়েছিল। তোমার দাদাভাই মারা যাওয়ার পর আমি ভেবে রেখেছিলাম এগুলো আমার তিন নাতির বউদের দিব বিয়ের পরেরদিনই দিব। এই সেট তোমার বউয়ের জন্য। ওর এইসবের মধ্যে এই রূপার গয়নাই পছন্দ হলো। নেও পরায় দেয়।”

“দাদিমা ওকে দিন ও নিজেই পরে নিতে পারবে।”

“ওইটা তো আমিও জানি পরতে পারব কিন্তু আমি চাই তুমি পরাও, নাহলে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতাম তোমার? আর তোমার কী সমস্যা পছন্দ করোই তো বিয়ে করলে। যে পাগল হয়ে গেছিয়ে বিয়েটা করার জন্য আর এখন লজ্জা পাচ্ছ?”

সৈকতের মাও বলল, “হ্যাঁ, অর্ক পরিয়ে দেও। মা অনেক খুশি হবে।”

অর্ক তবুও দ্বিধাবোধ করল। দাদিমা সৈকতের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলে মা রেনু, তোমার ছেলে লজ্জায় এখন ডুইবা যাবে। প্রভা নেও এইটা নিয়ে তোমাদের রুমেই যাও। পরিয়ে দেওয়ার পর আমাকে এসে দেখিয়ে যাবে”

কথাটা শুনতেই অর্ক উঠে রওনা দিলো। দরজায় দাদিমা আবার ডাক দিলে সে দাঁড়ায়। দাদিমা বললেন, “আমার কথার মান রাখবা কিন্তু দাদুভাই।”

“জ্বি দাদিমা।” অর্ক মাথা নামিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

সৈকতের মা প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও মামনী।”

প্রভাও যাওয়ার পর দাদিমা সৈকতের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “রেনু মা এই চারটা সেট নিয়ে যাও যেটা ঝিনুকের পছন্দ সেটা ওকে দিবে।”

“জ্বি মা ঠিকাছে।”

প্রভা রুমে ঢুকেই একবার অর্কের দিকে তাকালো। তারপর সামনে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেয়ে বক্সটা খুলতেই অর্ক তার পিছনে দাঁড়িয়ে গলার মালাটা বাক্স থেকে উঠিয়ে নিলো।
প্রভা জিজ্ঞেস করল, “কি করছেন?”

“দাদিমার আদেশ পালন। দাদিমা বলেছে যেন তোমাকে আমি নিজে পরিয়ে দেই।”

“প্রয়োজন নেই। আমি নিজে পরতে পারব।”

অর্ক আয়নাতেই কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। বলল, “তুমি চাও আমি কথা দিয়ে ফিরে যাই?”

অর্ক গলার মালাটা নিয়ে প্রভার গলায় পরাল। ঘাড়ে আঙুল ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠলো প্রভা। তার হাত পা কাঁপতে শুরু করে দিলো। মাথা নিচু করে নিলো।
অর্ক একপলক তাকালো আয়নার দিকে। তার নিজেরও অস্বস্তি লাগছিলো কিন্তু প্রভার বিচলিত মুখ দেখে তার অস্বস্তি বেড়ে গেল। কানের দুল পরানো হলো। চুড়ি পরানোর জন্য হাত ছুঁতেই প্রভা নিজের চোখ দুটো চেপে ধরল। তার কেমন যেন লাগছে। এক ধরনের অস্বস্তি। কিন্তু সেই অস্বস্তির সাথে স্বস্তিও লাগছে যে এই লোকটা তার স্বামী, অন্যকেউ নয়। কিন্তু এই বিয়েটা তো শুধু একটা ছলনা, তাই না? তাহলে এমনটা লাগছে কেন?

অর্ক হাঁটু গেড়ে নিচে বসল। টুল এগিয়ে দিয়ে বলল, ” এইখানে বসে পা উঁচু কর।”

প্রভা তাই করল। পায়েল পরানোর সময় প্রভা জিজ্ঞেস করল, “আপনি বললেন আপনি কথা দিয়ে ফিরে যান না অথচ আপনি আমার মা’কেও কথা দিয়েছেন যে আমাকে কখনো কষ্ট দিবেন না।”

অর্ক চমকে উঠে তাকাল প্রভার দিকে। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মাথা নামিয়ে নিলো। কিছু বলল না। অর্ক অন্যপায়ে পায়েল পরাতে যাবে তখন দেখে সেখানে আগের থেকেই একটা সোনালী রঙের নুপুর পরা। অর্ক তা খুলতে নিলেই প্রভা বলল, “এইটা খুলবেন না। আমার বিয়ের উপহার ছিলো।”

অর্কের কথাটা কেমন যেন বিশ্রী লাগলো। বিয়ের উপহার বলতে তার দেওয়া উপহার নয়, বিনয়ের দেওয়া উপহারের কথা বলছে প্রভা। তার নিজের স্বামীর সামনে আগের স্বামীর উপহারের কথা বলাটা কী মানানসই?

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-৭ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1191442417892002/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here