মন_পাড়ায়
পর্ব_৯
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
অর্কের কথাটা কেমন যেন বিশ্রী লাগলো। বিয়ের উপহার বলতে তার দেওয়া উপহার নয়, বিনয়ের দেওয়া উপহারের কথা বলছে প্রভা। তার নিজের স্বামীর সামনে আগের স্বামীর উপহারের কথা বলাটা কী মানানসই?
অর্ক সে পায়েল পরালো না। উঠে দাঁড়ালো। বলল, “যেয়ে এইবার দেখিয়ে আসো।”
“কিন্তু এখনো কয়েকটা আছে।”
অর্ক কাঠখোট্টা কন্ঠে বলল, “গয়না পরে দেখাতে বলেছে। বলে নি সবগুলো পরে দেখাতে হবে। যা পরিয়েছি তাই অনেক।”
বলেই অর্ক চলে গেল।
.
.
ঝিনুক বাসায় এসে আরামে বিছানায় বসলো। গত কয়দিন ধরে তার যে খাটুনি হচ্ছে তা কম কিসের। তার মনে হচ্ছে এত ঝামেলার পরও মানুষ বিয়ে কেন করে? আর তার বিয়েতো এমন এক মহান মানুষের সাথে হয়েছে যাকে সে দুইচোখে সহ্য করতে পারে না। ঝিনুক চোখ বন্ধ করে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে শুরু করল।
হঠাৎ করে তার মনে হলো তা পাশে কেউ শুয়ে আছে। চোখ খুলে পাশে তাকাতেই দেখে সৈকত। মুহূর্তে লাফ দিয়ে উঠলো সে। কান থেকে হেডফোন খুলে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এইখানে কেন এসেছ?”
সৈকত এক গাল হাসি নিয়ে বলল, “মাই ডিয়ার ওয়াইফ আপনি হয়তো ভুলে গেছেন যে এইটা আমার রুম।”
“তোমার সাথে ঝগড়া করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি তাই যাচ্ছি আমি। থাক নিজের রুম নিয়ে। ফাজিল একটা।”
ঝিনুক উঠে যেতে নিলেই সৈকত তার হাত ধরে এক টান দিল। ঝিনুক যেয়ে পড়ল তার বাহুডোরে। ঝিনুক বিরক্তি নিয়ে উঠতে নিলেই সৈকত দুইহাত দিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরল। ঝিনুক ঝাঁজালো গলায় বলল, “কি ফাইজলামি করছ আবার। ছাড় তো।”
“উফফ মাই ডিয়ার ওয়াইফ। গতকাল আপনার জন্য আমি ঘুমাতে পারি নি। তাই এখন ঘুমাব।”
“তো ঘুমাও না মরে যাও আমার কিছু আসে যায় না। আমাকে ছাড় তো।”
“আমার তো কোলবালিশ ছাড়া ঘুম হয় না। আর কোলবালিশটা বিনুর জন্য নিয়ে গেছে। তুমি কোলবালিশের রিপলেশমেন্ট।”
ঝিনুক রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “নিজের বউকে কেউ এইভাবে বলে?”
“মানে তুমি মেনে নিয়েছ যে তুমি আমার বউ।”
ঝিনুককে আবারও কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। হুমকির সুরে বলল, “এখন ছাড়, নাহয় তোমার সব কর্মকাণ্ড আমি বাহিরে যেয়ে বলে দিব।”
“তুমি যে বাসায় মিথ্যা বলে আমার সাথে পালিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলে সেটাও?”
ঝিনুক চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইল সৈকতের দিকে। তারপর অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী চাই?”
“শুধু তোমাকে।” বুকটা কেঁপে উঠলো ঝিনুকের।সৈকতের সুরে এক ধরনের নেশা থাকে। যে নেশা মাতাল করার জন্য যথেষ্ট।
সৈকত এক হাত ঝিনুকের কোমর থেকে সরিয়ে তার চুলগুলো খুলে দিলো। ঝরঝরে ছড়িয়ে গেল তার কেশ। মিষ্টি সুরভী এসে লাগলো তার নাকে। সৈকত দীর্ঘশ্বাস নিশ্বাস নিয়ে সে চুলগুলোতে মুখ ডোবাল। আর বলল, “শুধু একটুখানি এমন মাতাল থাকতে দেও। তোমার নেশার সামনে পৃথিবীর সকল নেশা তুচ্ছ।”
ঝিনুক চোখ বন্ধ করে সৈকতের শার্টটা আঁকড়ে ধরল। ঘন নিশ্বাস ফেলে বলল, “দোহাই লাগে এমন অত্যাচার আর কর না।”
“একটু বুকের মাঝে ভরে রাখতেই তো চাইছি। এতটুকুতেও এত কেন বাঁধা।”
“ছেড়ে দেও। তোমার বুকে মাথা রেখে আগেও দহনই শুধু পেয়েছি।”
সৈকত ছাড়লো না। উল্টো আরও মিশিয়ে নিলো তার সাথে। বলল, “দুটি বছর তোমাকে নিজের করে পাই না আর এখন বলছ পেয়েও যেন যেতে দেই? একদম না।”
“অনেক জ্বালাচ্ছ।”
“তুমিও তো এত বছর ধরে জ্বালিয়েছ।”
“আমার কাছে আসার প্রয়োজন কী? মেয়েদের কমতি আছে না’কি?”
সৈকত মুখটা ঘুরিয়ে ঝিনুকের গালে আলতো করে চুমু খেয়ে আবারও কেশের মাঝে মুখ ডোবাল। তার চোখ বন্ধই ছিলো। বলল, “যে কেউ তো আর তুমি না।”
ঝিনুক আর কিছু বলল না। অবশ্য বলতে পারল না। তার চোখের কোণে থেকে শুধু জল গড়িয়ে পরল। সে জল সৈকতের কাঁধে এসে পরল। সৈকত সাথে সাথে মাথা তুলে নিলো। উঠে বসে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “তুমি কাঁদছ কেন? সরি জান সরি আমি আর তোমার কাছে আসব না। শুধু কান্না কর না। এইতো আমি চলে যাচ্ছি।”
সৈকত যেতে নিলেই আচমকায় ঝিনুক তার গলা জড়িয়ে ধরলো। ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বলল, “তুমি আমার কাছে থাকলেও জ্বালা দূরে গেলেও জ্বালা। একবার তো দূরে চলেই গিয়েছিলে ফিরে এলে কেন আবার?” আবার সৈকতের গলা ছেড়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, “কেন এলে আবার ফিরে?”
“আমি আসি নি, নিয়তি ফিরিয়ে এনেছে।”
ঝিনুক চোখ খুলে তাকাল। চোখে চোখ পড়ল। ঝিনুক চাইছিল সে নেশাগ্রস্ত চোখ দুটোয় ডুবে যেতে। ডুবে গেলও। চোখ দুটো বন্ধ করে আবারও সৈকতের গলা জড়িয়ে ধরতেই দরজায় টোকা পরল। সাথে সাথে ঝিনুক পিছিয়ে যেয়ে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে গাল মুছে নিল।
সৈকত উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, “আবার কে আসছে আমার রোমেন্সের দুশমন। আর সময় পায় না মানুষগুলা, আমার রোমেন্সের সময়ই টপকায়তে হবে।”
দরজা খুলে মা’কে দেখে বলল, “আরে মা তুমি? আমি তোমাকেই মনে করছিলাম।”
কথাটা শুনেই ঝিনুক চমকে তাকালো সৈকতের দিকে। সৈকত আবারও বলল, “ঝিনুক তুমিও না বুঝে কী আবল তাবল বকছিলে। মা ও আসলে বুঝে নি যে তুমি, নাহলে তো বলতোই না যে মানুষ কেন যে রোমেন্সের মাঝে টপকায়।”
ঝিনুক হা হয়ে গেল কথা শুনে। উঠে দাঁড়িয়ে মা’য়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আন্টি ও মিথ্যা কথা। আমি—-”
মা তাকে থামিয়ে বলল, “তোমার সাফাই দিতে হবে না মামনী। আমি জানি তো এই ছেলেটা কত দুষ্টু। কথাটা নিশ্চিত ওই বলেছে।”
মা সৈকতের কান মলা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক বলেছি না?”
“মা ব্যাথা পাচ্ছি তো।”
মা সৈকতের কান ছেড়ে বাক্সগুলো বিছানায় রেখে বলল, “ঝিনুক এখান থেকে একটা বাছাই কর।”
“আন্টি এইসবের প্রয়োজন নেই।”
“প্রভার মতো কর না তো। মেয়েটা তো নিতেই চাইছিল না। একটা বাছাই কর, মা’য়ের আদেশ এইটা।”
ঝিনুক দ্বিধায় পরে বলল, “মা আপনি করে দিন।”
তখনই সৈকত একটা কুনদনের সাদা ও সোনালী সেট উঠিয়ে বলল, “এইটা ঝিনুকের উপর ভালো লাগবে। এটা সাথে লাল, নীল, কমলা আসলে যে কোনো রঙের ড্রেসেই ওকে মানায়।” চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “কালোর উপর সোনালী রঙের কাজ,” চোখ খুলে বাকিটা বলল, “এর উপর এই সেট। একদম পরীর মতো লাগবে।”
এই ছেলেটা কি তাকে লজ্জায় ফালাতে ভালোবাসে? একটু আগে এক কান্ড করল আবার এখন। মা বলল, “ঠিকাছে, তুই ঝিনুককে এইটা পরিয়ে দাদিমাকে দেয়। আর দাদিমা’কে যেয়ে দুইজনে একসাথে দেখিয়ে আয়।”
“তুমি থাক আমার সমস্যা নেই।”
ঝিনুক বিরক্ত নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আন্টি আজ একটু খারাপ লাগছে আরেকদিন পরিয়ে দেখাই?”
সৈকত বলল, “আজব তো পরাব তো আমি। তোমার সমস্যা কী?”
সৈকতের কথা যেন কারও কানেই গেল না। মা উঠে বলল, “ঠিকাছে তুমি আরাম কর। আমি মা’কে বলে দেই।”
মা যেতেই সৈকত বলল, “সমস্যা কী? আমি পরিয়ে দিতাম।”
ঝিনুক হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “মাই ডিয়ার হাসবেন্ড আপনার মতলব কী আমি ভালো মতো জানি। খবরদার কালকে আমাদের বাসায় যেয়ে এইসব লুইচ্চামি কররা না, নাইলে মাথা ফাটায় দিব।”
বলেই ঝিনুক প্রভাকে খুঁজতে যেতে নিলো। আবার একবার ফিরে তাকালো সৈকতের দিকে। বলল, “দয়া করে অতীত আমার সামনে আর এনে রেখ না আর। আমি বহু কষ্টে সে স্মৃতিগুলোর ভবন থেকে বেরিয়ে এসেছি। সে স্মৃতি ভবনে আর যেতে চাই না।”
চলে গেল ঝিনুক।
রাতে বৌভাতে অনুষ্ঠানের পর ফেরার জন্য দুই জোড়াকে নিয়ে যাওয়া হলো বাবার বাড়িতে৷ সকালে আসার কথা হলেও প্রভার বাবা মেয়ের শশুড়বাড়িতে রাত থাকবে না বিধায় রাতেই এসে পরলো। সেখানে কোনো মেহমান নেই বলেই চলে। ঝিনুক তার খালুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। আর মেয়ের দ্বিতীয় বিয়েতে লোকেকে কথা বলার সুযোগ করে দিবে এমনটা প্রভার মা চাইতেন না। তাই বিয়েতে অনেক কম মানুষ এসেছিল আর এর মধ্যে প্রায় সবাই চলে গেছে। শুধু প্রভা ও ঝিনুকের মামার পরিবার ছিলো।
রাত তখন বারোটা বাজে। ঝিনুক ও প্রভা গল্প করছিল প্রভার মা’য়ের সাথে। তখনই গিটারের শব্দ কানে এলো ঝিনুকের। সাথে তার চিরচেনা এক গানের সুর কানে ভেসে উঠলো,
বেখেয়ালি দিনগুলো আজ ফিরে পেতে চাই,
চাই না যে আর কিছু শুধু তোকে চাই,
আমার….. মনের ধারে শুধু তোকে তোকে চাই,
এই মন পাড়ায় আর জায়গা নাই,
শুধু তোকে চাই, শুধু তোকে চাই।
এই মন পাড়ায় আর জায়গা নাই,
শুধু তোকে চাই, শুধু তোকে যে চাই।
ও হো হো হো…..ও হো হো হো….
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
পর্ব-৮ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1193112441058333/