মুহূর্তে পর্ব-১৩

0
689

#মুহূর্তে
পর্ব-১৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ধ্রুব ভার্সিটি থেকে বের হয়ে রাগের মাথায় কল দেয় তার মা’কে, “আম্মু তুমি আমাদের এলাকার কাজি অফিসে আসো। আমি এই মুহূর্তে তাহিরাকে বিয়ে করতে চাই।”
তাহিরা ধ্রুবর পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলো। ধ্রুবকে রাগের সময় কিছু বললে তার রাগ বেড়ে যায়, এই কারণে চুপ থাকাটাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই কথা শুনে তাহিরা হতবাক হয়ে যায়। ধ্রুবর হাত থেকে ফোন নিয়ে শিল্পা আক্তারকে জানায় ধ্রুব রাগে এ-সব বলছে। তার আসার প্রয়োজন নেই। ফোন রেখেই সে বকা দেয় ধ্রুবকে, “তোর মাথা কী খারাপ হয়ে গেছে? রাগের মাথায় কী যা তা বলছিস আন্টিকে ফোন দিয়ে?”
“যা তা বলি নি। আমি তোকে বিয়ে করব। তারপর দেখব কেউ আমাদের সম্পর্ক নিয়ে খারাপ কথা কীভাবে বলে।”
“একটা থাপ্পড় দিব। তুই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে আমি কখন বিয়ে করব? কেউ কোনো খারাপ কথা বলেছে এর মানে এই নয় যে আমার তাদের কথা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য প্রমাণ দেওয়া লাগবে।” অনেকটা ক্রোধিত স্বরে বলে তাহিরা। এরপর শান্ত হবার চেষ্টা করে বলে, “আমি বাসায় যাব। মাথা ব্যাথা করছে।”
ধ্রুব মলিন গলায় বলে, “আমি বাইক বের করছি।”
“না, তুই রাগে। আপাতত বাইক চালানো ঠিক হবে না। বাইকের চাবি লিমনকে দিয়ে রিকশা ঠিক কর।”

তাহিরা বাসায় এসে দেখে ঘরে তালা দেওয়া। সম্ভবত দাদী বাহিরে গেছে। ভাগ্যিস তাহিরা সকালেই চাবি নিয়ে গিয়েছিলো! তাহিরার পিছনে ধ্রুব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “মা আর দাদীমণি তো আমাদের বিয়ে ঠিকই করেছে। আমরা আজ বিয়ে করি বা ক’বছর পর পার্থক্য কী?”
“ধ্রুব প্লিজ দয়া করে একই কথা বারবার বলিস না। বিরক্ত লাগে। এই কারণেই আন্টিকে মানা করেছিলাম তোকে বলতে। শুন পার্থক্য হলো, আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। তারপর বিয়ের কথা চিন্তা করব।”
“আমি কি বিয়ের পর তোর পড়াশোনা অফফ করাব না’কি?”
“আমি জানি তুই আমার পড়াশোনা বন্ধ করাবি না। উল্টো তুই সবসময় আমাকে সাপোর্ট করেছিস কিন্তু আমার ইচ্ছা থাকতে পারে না? আর আমি কি কোথাও পালিয়ে যাব না’কি? তুইও এইখানে আছিস, আমিও আছি। সবাই আছে। বিয়ে হতে হলে, একদিন না একদিন হবেই।”
“আচ্ছা, তোর ইচ্ছার আমি সম্মান করব।”

ধ্রুব তাহিরাকে সোফায় বসিয়ে তার জন্য একগ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দেয়। জুঁইয়ের কথার তার নিজেরই এখনো অশান্তি লাগছে তাহলে তাহিরার অবস্থা তো সে ভাবতেও পারছে না। তাহিরা পানি পান করে গ্লাস টেবিলে রাখার পর ধ্রুব তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তাকে একবার ভালো করে যাচাই করে। তাহিরার ঠোঁটের এক অংশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ধ্রুব তার গালে হাত রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে তার ঠোঁটের সে অংশে আঙুল বুলিয়ে দেয়। নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সেদিকে। তারপর আলতো করে চুমু খায় সে ঠোঁটের সে অংশে এবং বলে, ” তুই না থাকলে আজ ওই মেয়েকে খুন করে ফেলতাম। ওর সাহস কি করে হয় তোকে এত বাজে কথা বলার?”
তাহিরারও মনে পড়ে সে কথাগুলো।
“তুই ওর চরিত্র নিয়ে কী বলছিলি? ওর মা-বাবাকে কী বলতি তুই?”
তাহিরার কথা শুনে ধ্রুবর মুখের রং উড়ে যায়। সে অপ্রস্তুত হয়ে উঠে, “আরে ওই’যে আমার সাথে কথা বলতো এইটাই। ওর আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপের দুইদিন পর আমার সাথে তার যতসব আলাপ।”
“এত ছোট বিষয় নিয়ে ওকে হুমকি দিলি আর ও চুপ হয়ে গেল?”
“অতিরিক্ত ভাবছিস তুই ফুলটুসি। এক কাজ কর তুই আরাম কর। আমি খাবারের জন্য কিছু নিয়ে আসি।”
ধ্রুব তাহিরার চোখের দিকে একটিবারও তাকায় না। তার থেকে দৃষ্টি লুকিয়ে কথাগুলো বলে। তাহিরা তা ঠিক ধরতে পারে। ধ্রুবর এমন ব্যবহার তাহিরার মনে সন্দেহের প্রদীপ জ্বালায়। ধ্রুব উঠে যেতে নিলেই তাহিরা তার হাত ধরে নেয়। নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে ধ্রুবর মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করে, “তুই আমার কাছ থেকে মিথ্যা বলছিস। কি লুকাচ্ছিস তুই আমার কাছ থেকে?”
“অতিরিক্ত ভাবছিস তুই।”
“ধ্রুব, আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার সত্যি করে উওর দে।” কঠিন গলায় প্রশ্ন করে তাহিরা।
ধ্রুবর মাথা নত। সে আমতা-আমতা করে বলে, “তাহিরা আমি তোকে কথাটা জানাতাম সঠিক সময়ে। প্লিজ রাগ করিস না। আমি…আমি ওর সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটিয়েছিলাম।”
প্রথম মুহূর্তে তো তাহিরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। নিশ্চয়ই সে ভুল শুনছে। ধ্রুব এমন করতে পারে না। কখনো না। পরের মুহূর্তেই ধ্রুব তার বাহু ধরে তাকে বুঝানোর চেষ্টায় জুটে যায়, “ফুলটুসি দেখ তুই আমার কথা শুন। এইটা তোর সাথে ওয়াদা করার আগের কথা। তখন ভুল হয়ে গেছে। আমার মাথায় কখনো আসেও নি আমি আসলে তোকে ভালোবাসতে পারি। গাঁধা আমি। সারাজীবন তোর যত্ন নিলাম, তোর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও দূরত্ব সহ্য হতো না, তোর প্রতি এতটা পজিসিভ ছিলাম অথচ একবার মাথায় আসে নি আমি তোকে ভালোবাসতে পারি। সত্যি বলছি তোকে ওয়াদা করার পর আমি কোনো মেয়ের সাথে কথাও বলি নি। জুঁইয়ের সাথে ভুলে এমনটা হয়ে গিয়েছিলো।”

অন্তরটা কেঁপে উঠে তাহিরার। সে স্তব্ধ হয়ে যায়। সে অনুভব করতে পারছে তার কাঁপুনি, তার বুকে প্রচন্ডভাবে আঘাতের পীড়া। সে অনুভব করতে পারছে ধ্রুবর সাথে কাটানো প্রতিটি স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে আসা। তার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির থাকে। সে প্রশ্ন করে, “জুঁই ছাড়া অন্যকারো সাথে এমন কিছু করেছিস?”
“তাহিরা আমি ভুলে….”
“করেছিস কি’না আমি তা জিজ্ঞেস করেছি।” তাহিরা ধ্রুবর চোখে চোখ রেখে রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করে। তার দৃষ্টি ক্ষোভে ভরা। ধ্রুব চোখ মেলাতে পারে না তাহিরার সাথে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ উওর দেয়। তারপর আবার তাহিরার গালে হাত রেখে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে, “তখন ভুল হয়ে গেছে ফুলটুসি। আর হবে না। আই প্রমিজ।”
“তুই কী আমার সাথেও শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য আমার সাথে আছিস?”

“কী! তুই এইটা ভাবতেও কীভাবে পারিস?” ধ্রুবর গলার স্বরও উঁচু হয়ে আসে। কথাটা শুনে তার মাথাও খারাপ হয়ে যায়। তাহিরা তাকে নিয়ে এমনটা ভাবতেও কীভাবে পারে? সে আবারও একইসুরে বলে, “তাহিরা তোর মাথা ঠিক আছে? আমি তোকে নিয়ে কখনো এমনটা চিন্তাও করি নি। আমি তোকে ভালোবাসি। আমি তোকে কখনো কোনোভাবে কষ্ট দেবার কথা ভাবতেও পারি না।”
“কেন আমার মন আছে, ওই মেয়েদের মন নেই?”
“আমার অন্যকারো কিছুতে আসে যায় না।”
তাহিরা তার দুইহাত ধ্রুবর বুকে রেখে সজোরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। শত চেষ্টার পরও তার চোখের জল আটকাতে পারে নি সে। সে চিৎকার করে বলে, “ভুল বলছিস তুই। তোর কাছে নিজের সুখ সর্বোপরি। আমাকে তুই কষ্ট দিতে পারিস না তাই না? এই জীবনে আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট তুই দিয়েছিস। তোর জন্য আমি কত রাত নিজের চোখের পানি ঝরিয়েছি এই ধারণাও তোর নেই। তুই আমার কোলে মাথা রেখে অন্যমেয়েদের সাথে প্রেমালাপ করতি তখন আমার মনের অবস্থা একবার ভেবে দেখেছিস?”
ধ্রুব অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তাহিরার দিকে। তার দিকে এগিয়ে যেয়ে বলে, “আমি তখন কি জানতাম না’কি যে তোর মনে আমার জন্য কিছু আছে অথবা আমি তোকে ভালোবাসি।”
“ওইটাই তো। যখন তোর নিজের মনের কথা অনুভব হলো তখন তুই ছুটে এলি আমার কাছে। কারণ তোর ভয় লাগছিল যে আমি অন্যকাওকে বিয়ে করে নিব। আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না। তুই আমাকে হারিয়ে ফেলবি। তুই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি না। তুই কষ্ট পাবি। সবকিছু তোর, তোর এবং তোরই জন্য। অন্যকারও কোনো অনুভূতি নেই। আমি তোকে এত করে বলতাম কাওকে পছন্দ না করলে অকারণে তাদের মনের সাথে খেলিস না। তুই আমার কথা শুনেছিলি? আর আজ শুনছি তুই তাদের সাথে….ছিঃ! কোনো ছেলে আমার শরীর নিয়ে এইভাবে খেললে তোর কেমন লাগতো?”
“তাহিরা!” আর্তনাদ করে উঠে ধ্রুব।
তাহিরা ধ্রুবর মুখের সামনে আঙুল তুলে বলে, “চুপ। একদম চুপ। তোর আমার এক কথায় এমন রাগ উঠে গেল আর তুই যে ওই মেয়েদের সাথে এমন করেছিস তাদের মনে কি চলছে তা বুঝতে পারবি? আজ জুঁইকে তুই এতকিছু বলে আসলি তাও এতটা দৃঢ় কন্ঠে অথচ তুই ওর কাছে অপরাধী।”
“কেউ দুধ খাওয়া বাচ্চা না যে ঠিক-বেঠিক বুঝতে পারে না। আমি কারও সাথে কোনো জোর করি নি। আমার যতটা ভুল ছিলো ওদেরও ততই ভুল ছিলো। আমি অপরাধী হলে কেবল তোর কাছে।”
ধ্রুব এসে তাহিরার হাত ধরতেই তাহিরা এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে নেই। বলে, “আমি এই মুহূর্তে তোর চেহেরাও দেখতে চাই না। এইখান থেকে যা।”
ধ্রুব তাহিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমার ভুল হয়ে গেছে আমি মানছি। কিন্তু দয়া করে আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিস না।”
তাহিরার নিশ্বাস আটকে আসছিল। কান্নার চোটে সে কথাও ঠিক মতো বলতে পারছিলো না। সে বহু কষ্টে বলল, “ধ্রুব, দয়া করে এইখান থেকে চলে যা। আমার তোর চেহেরা দেখতেও কষ্ট হচ্ছে। তোর কন্ঠ শুনে বিরক্ত হচ্ছে। তোর ছোঁয়া থেকে…. ঘৃণা লাগছে আমার।”

ধ্রুব আচমকায় ছেড়ে দেয় তাহিরাকে। কিছু মুহূর্ত আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সে তাহিরার দিকে। তার দৃষ্টিও নম্র। চোখদুটো লালচে। সে আর কথা বাড়ায় না। চলে যায় সেখান থেকে।

তাহিরা নিজেকে সামলাতে না পেরে বসে পড়ে মেঝেতে। তার শরীরটা ভীষণ অবশ লাগছে। তার মাথা ঘেরাচ্ছে। বুকের ভেতর ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে বারবার আঘাত করেছে তার বুকের ভেতর।

অনেকটা সময় সেখানে বসে চোখের জল ঝরায় তাহিরা। তারপর বহু কষ্টে উঠে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ায়৷ রুমে যেয়ে আয়নায় একবার নিজেকে দেখে। তার চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে গেছে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তাহিরা অসহায় দৃষ্টিতে নিজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। তার জীবনটা এমন কেন? তার মা বাবা যাবার পর থেকে কেবল ধ্রুবই ছিলো তার একমাত্র খুশির কারণ অথচ সে খুশিটাও সময়ের সাথে সাথে বিষের মতো তিক্ত হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে নিজেকে দেখেই আফসোস হয় তার। সান্ত্বনা দিতে ইইচ্ছা হয়, কিন্তু পারে না।

ভাঙচুরের শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই পাশের বাসায় ধ্রুব ভাঙচুর করছে। তার এখন দ্রুত ধ্রবর কাছে যেয়ে তাকে থামানো উচিত ছিলো, কিন্তু সে গেল না। আয়নায় তাকিয়ে নিজের জীবন নিয়ে আফসোস করতে করতে হাতের চুড়িগুলো রুক্ষভাবে খুলতে থাকলো। এরই মধ্যে দু’টো কাঁচের চুরি ভেঙে ঢুকে যায় তার হাতে। কিন্তু সে ‘টু’ শব্দও করে না। অনেকসময় শরীর আঘাতটা মনের আঘাতের কাছে কিছুই মনে হয় না।
.
.
কবিতা অপেক্ষা করছিলো তীর্থের। সে চেঞ্জিং রুমে গেছে। কবিতা তার শাড়ির সাথে মিলিয়ে তীর্থের জন্য একটি সাদা শার্ট নিয়েছে। যদিও তার প্রথম ইচ্ছা ছিলো তীর্থকে পাঞ্জাবি পরাবে কিন্তু তার কোনো সাদা পাঞ্জাবিই ভালো লাগে নি। যা ভালো লেগেছে তা হয়তো কালো, নাহয় রঙিন।
কবিতা আশেপাশের শার্টগুলো আবারো যাচাই করছিলো। এমন সময় চেঞ্জিং রুম থেকে বের হয় তীর্থ, “কবিতা ঠিক লাগছে?”
কবিতা ডাক শুনে তাকায় তীর্থের দিকে। তাকে দেখেই কবিতার চোখদুটো কপালে উঠে যায়। তীর্থের তমাটে রঙে সাদা কালারের শার্টটা ফুটে আছে। সে মনে মনে বলে, ‘ঠিক লাগছে? সেই লেভেলের হট লাগতেছে। কিন্তু এইটা মুখে বলা যাবে না। বললে ভাব নেওয়ার চান্স থাকবে না।’

কবিতা তার পাশের দুইটা মেয়ের কথা শুনে। দুইজনই তীর্থকে নিয়ে কথা বলছিলো। তীর্থকে কতটা আকর্ষণীয় লাগছে এই নিয়ে। কবিতা সরু চোখে তাকায় দুইজনের দিকে। তার ইচ্ছা করল দুইজনের ঠোঁটে পিন মেরে দিতে। সে একপ্রকার দৌড়ে যেয়ে দাঁড়ায় তীর্থের সামনে যেন মেয়ে দুটো তীর্থকে দেখতে না পারে। সে পা’য়ের পাতা উঁচু করে তীর্থের চুলগুলো আঙুল দিয়েই আঁচড়ে দিলো। তারপর শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল, “আপনাকে এমন শার্টে কত মানায়। আর আপনি ওগুলো কি পরে থাকেন? আপনাকে একদম গুন্ডা টাইপ লাগতো আর আজ একদম জেন্টালম্যান লাগছে। আজ যেয়ে দাঁড়ি এবং চুলটাও ঠিক করে নিবেন। একদম নায়ক লাগবে।”
“কি করব ছোটবেলা থেকে গুছিয়ে দেবার মতো কেউ ছিলো না।”
“কেন? আপনাকে এভাবে দেখে আংকেল আন্টি আপনাকে কিছু বলতো না?”
“আমার কাছে কেউ ছিলো না।”
কবিতা চমকে তাকায় তীর্থের দিকে কেবল একপলকের জন্য। তার ঠোঁটের হাসি প্রায় নাই হয়ে যায়। তীর্থ জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলে, “চিন্তা করো না দুইজনই বেঁচে আছে, কেবল আমার সাথে নেই।”
কবিতা স্পষ্ট দেখতে পারছিলো তীর্থের মুখে ভেসে উঠা কষ্ট। তাই সে নিজের ঠোঁটে হাসি এঁকে তীর্থের হাত ধরে তাকে এক আয়নার সামনে নিয়ে যায়। খুশিমনে জিজ্ঞাসা করে, “দেখেন কত ভালো দেখাচ্ছে।”
তীর্থ আয়নাতে দেখতে পারছিলো তাকে ও কবিতাকে। হ্যাঁ, আজ দুইজনকে মানাচ্ছে। একসাথে বেশ মানাচ্ছে। সে একগাল হেসে তাকাল কবিতার দিকে, “অনেক ভালো দেখাচ্ছে।”
কবিতা প্রথমে ভাবলো তীর্থ কেবল নিজের কথা বলছে। কিন্তু আয়নায় তীর্থকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার ভুল ধারণা ভাঙে। তীর্থ তার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় মাখা মাখা হয়ে যায় সে। চোখ নামিয়ে বলে, “চলুন যাওয়া যাক।”

তীর্থ পেমেন্ট করে সেখান থেকে বের হয়ে যায়। বাইকে উঠে মাঝরাস্তাতেই কবিতা আবদার করে সে ফুসকা খাবে। তীর্থ রাস্তার একপাশে বাইক থামায়। কবিতা ফুসকা ওয়ালা মামার কাছে যেয়ে বলে, “মামা ঝটপট দুই প্লেট ফুসকা তৈরি করুন। একটা অনেক ঝাল হবে।”
তীর্থ থামায় তাকে, “আমার ফুসকা পছন্দ না। তুমি খাও।”
কবিতা এমন মুখ করলো যেন এমন আজব কথা সে আগে কখনো শুনে নি, “আয়হায় কী বলেন এইসব? ফুসকা কার পছন্দ হয় না? আমি তো পাড়লে ফুসকাকে জাতীয় ফাস্টফুড বানায় দিতাম।”
তীর্থ হাসে, “আমার ভালো লাগে না।”
কবিতা চুপ করে আশেপাশে কি যেন দেখে তারপর তীর্থকে সেখানে দাঁড়াতে বলে দৌড়ে কোথাও চলে যায়। কিছুক্ষণ পর উপস্থিত হয় একটা কোক ও বার্গার নিয়ে। তীর্থের হাতে তা ধরিয়ে বলল, “লিমন ভাইয়ার কথা শুনেছিলাম অনুষ্ঠানের কাজে ব্যস্ত থাকায় কিছু খান নি। এমনটা করা একদম উচিত না। যত যাই হোক ঠিক সময়ে খাবার খাওয়া উচিত বুঝলেন?”
তীর্থ মনে মনে ভীষণ খুশি হয় তার জন্য কবিতা ভাবে এই কারণে। কিন্তু মুখে বিশেষ কিছু বলে না। কবিতাকে ফুসকা খেতে দেখে সে। কেমন মিষ্টি লাগে তাকে। চোখ বন্ধ করে ফুসকাটা মুখে দেয়। আবার একটুপর লাফিয়ে উঠে। ঝালের কারণে তার চোখ মুখ লাল হয়ে যায় তবুও সে সম্পূর্ণ প্লেট খেয়ে শেষ করল। তাকে দেখে তীর্থ অবাক না হয়ে পারলো না। তার মনে হলো মেয়েটা এত আজব কেন? পরের মুহূর্তেই তার মনে হয়, এতটা আজব বলেই হয়তো এতটা ভালো লেগেছে তার কবিতাকে।

খাওয়া-দাওয়ার পরও তারা ভার্সিটিতে গেল না। সোজা গেল রমনায়। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে বিকেলে রওনা দেয় বাসার জন্য। তবে বাসায় যাওয়ার পূর্বে ভার্সিটিতে জরুরী কাজে যেতে হতো তীর্থর। তীর্থের হঠাৎ মনে হলো এইটা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। এত সুন্দর মুহূর্ত সে শেষ কবে কাটিয়েছিলো তার মনে নেই, কিন্তু তার এইটা মনে আছে আজ পনেরো বছর পর সে এতটা হাসলো। আর সে এটাও বুঝতে পারছে কবিতার প্রতি সে মুহূর্তে মুহূর্তে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এই দুর্বল হওয়াটা কি উচিত না’কি তাও সে জানে না।

আচমকায় দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেল। চারদিকে সুরভিমাখা বাতাস। হাল্কা বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে। কবিতা আকাশের দিকে তাকাল। তীব্র হাওয়ায় বৃষ্টির ছোঁয়াটা স্বপ্নের মতো লাগছিলো তার। আজকের দিনটা এমনিতেই স্বপ্নের মতো সুন্দর ছিলো, এর উপর এই অসময়ের বৃষ্টি তার ভালোলাগা বাড়িয়ে দিলো। তার হঠাৎ করেই ইচ্ছা হলো তীর্থের কাঁধে মাথা রাখার জন্য কিন্তু তা তো হয় না। তাদের মধ্যে তো এমন কোনো বিশেষ সম্পর্ক নেই। তীর্থ ভার্সিটির সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে বলল, “তুমি এইখানে বসো আমি পাঁচমিনিটের মাঝে আসছি। তারপর তোমাকে বাসায় দিয়ে আসব।”
কবিতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। তীর্থের প্রতি তার অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। তীর্থের যাওয়ার সময়ও কবিতা অপলক তাকিয়ে রইলো তীর্থের দিকে। তীর্থ যাবার পরও কবিতার দৃষ্টি থাকে দরজার দিকেই। প্রায় দশ মিনিট পর তীর্থ লিমনের সাথে কথা বলতে বলতে বের হলো। একপলক তাকাল কবিতার দিকে। কবিতা রাস্তার ওপাড়েই বাইকে বসা ছিলো। তীর্থের হাসিটি দেখে তার নিজের হাসিও গাঢ় হলো। কিন্তু তার হাসিটি উধাও হতেও মুহূর্তেখানিক সময় লাগে না।

কবিতা দেখল কয়েকজন এসে কথা বলছিল তীর্থের সাথে। তাদের কথোপকথন স্বাভাবিক বলে মনে হলো না তার। কিছুক্ষণ পরই সেখানে মারামারি শুরু হয়ে যায়। তাও ভয়ানকভাবে। তীর্থের বন্ধুরা এসেও সেখানে যোগ দেয়। অপর দলের কাওকেই আগে কবিতা দেখে নি। কবিতা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে জীবনে কখনো এমন ভয়াবহ দৃশ্য আগে সামনা-সামনি দেখে নি। ভয়ে সে কাঁপতে থাকে। তার চোখে দিয়েও পানি বয়ে যায়। বিশেষ করে তীর্থের এমন রূপ সে মেনে নিতে পারে না। আজ যে ছেলে সারাদিন তার সাথে এত মিষ্টিভাবে কথা বলল তার এত ভয়ানক রূপ সে দেখবে সে ভাবতে পারে নি। কবিতা দেখল হঠাৎ করে একজন তীর্থের মাথায় আঘাত করেছে। তীর্থের মাথা বয়ে বয়ে রক্ত পড়ছে। কবিতা আর নিজেকে সামলাতে পাড়ল না। সে ছুটে গেল তীর্থের কাছে। গন্ডগোলের মাঝে কবিতা যেতে নিলেই লিমন তাকে থামায়, “ভাবি আপনি এইখানে কি করেন?”
কবিতা প্রায় কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে, “আপনারা মারামারি কেন করছেন?”
“তাদের সাথে আগের থেকেই আমাদের নানান ঝামেলা ছিলো। এর উপর আজ না’কি ধ্রুব ভাই তার বোনের সাথে কি করছে। এই জায়গা সুবিধার না, আপনি যান এইখান থেকে।”
“কিন্তু তীর্থকে অনেক জোরে মেরেছে। ওর মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে।”
“আমরা ভাইকে দেখে নিব আপনি যান।”
“আমি তীর্থর চিকিৎসা না করা পর্যন্ত কোথাও যাব না।আমি পুলিশকে কল দিচ্ছি।”
“ভাবি জেদ কইরেন না। আচ্ছা আমি কোনো ভাবে পাঠাই ভাইকে।”

ইতিমধ্যে অনেকে আহত হয়েছে। আহত হবার পর মারামারির অবস্থা আগের থেকে শান্ত। কিন্তু রক্ত পড়ার কারণে তীর্থের প্রচন্ড মাথা ঘুরাচ্ছিলো। এরইমধ্যে লিমন এসে তীর্থকে কবিতার কথা জানালো। তীর্থ ভেবেছিল কবিতা এতক্ষণে চলে গেছে। সে কবিতাকে দেখে হতবাক। সে দৌড়ে যায় কবিতার কাছে। অস্থির হয়ে বলে, “তুমি এখানে কি করছ?”
কবিতা উত্তর দেয় না। তীর্থের দিকে তাকিয়ে কান্না করতে থাকে। তাকে কান্না করতে দেখে তীর্থ তার দুইগালে হাত রেখে নরম সুরে বলে, “তুমি প্লিজ এইখান থেকে যাও। প্লিজ।”
“আপনাকে এই অবস্থায় ছেড়ে…. ”
“এইসব আমার জন্য স্বাভাবিক কবিতা। তুমি যাও। আমি চাই না তুমি আমার এই পৃথিবী দেখো।”
কবিতার চোখ দুটো বড় হয়ে এলো। সে শক্ত করে তীর্থের শার্ট ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল, “আপনার পিছনে…”
তীর্থ সাথে সাথে বুকে জড়িয়ে ধরে কবিতাকে শক্ত করে। আঘাতের শব্দও পায় সে। যখন তীর্থ তাকে ছাড়ে তখন সে দেখে তীর্থের ঘাড় গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। মুহূর্ত না গড়াতেই তীর্থ তার পিছনে ফিরে ছেলেটার হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে অমানুষের মতো তাকে মারতে থাকে। কবিতা শঙ্কিত হলো। বিস্ময়ে তার মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছিলো না। তীর্থের এমন ভয়ানক রূপ তার সামনে না আসলেও পারতো। এই মানুষটার প্রতি তার ভালোটা না লাগলেও হতো। কিন্তু এখন সম্ভবত একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। তার মনে জন্ম নিয়েছে তীর্থের জন্য এক অতি সুন্দর অনুভূতি এবং আজ জন্ম নিলো কুৎসিত ভয়।

কিছুক্ষণ পরই সামনের দলের লোকেরা পালিয়ে যায়। ঝগড়া শেষে কাছের এক ফার্মেসিতে যেয়ে তারা ব্যান্ডেজ করছিল। কবিতাও একপাশে শঙ্কিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার সাদা শাড়িতে রক্ত লেগেছে আছে। তার নয়, তীর্থের।
রতন বলছিল, “ধ্রুব মানুষ পাইলো না পাঙা নেওয়ার জন্য। সে তো নাই। ভুগতে হইলো আমগো।”
“থাক ভাই। বন্ধু তো আমগোই।” তার পাশে বসা ছেলেটা বলে। তীর্থের ধ্যান তাদের কারও কথায় নেই। সে তো অপলক তাকিয়ে আছে কবিতার দিকে। ভয়ে মেয়েটা কুঁকড়ে গেছে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়।কান্নায় সম্পূর্ণ মুখটা লাল হয়ে গেছে। চোখ ও ঠোঁট কেমন ফোলা। ব্যান্ডেজ শেষে তীর্থ কবিতার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কোথাও ব্যাথা লাগে নি তো?”
কবিতা মাথা নাড়িয়ে না করে, “আপনার কী বেশি ব্যাথা করছে?”
“উঁহু, এইসব আমার জন্য স্বাভাবিক। আসো তোমাকে আমি বাসায় দিয়ে আসি। তোমার দেরি হয়ে গেছে।”
তীর্থ হাত বাড়িয়ে কবিতাকে ছুঁতে গেলেই কবিতা পিছিয়ে গেল, “আমি রিকশা নিয়ে চলে যাব।”
তীর্থ চমকে উঠে কবিতার এমন ব্যবহারে। হঠাৎ তার বুকের ভেতর শুরু হয় অসহ্যকর তুফান।
“তুমি কী আমার কাছ থেকে ভয় পাচ্ছ কবিতা?”
কবিতা এইবারও মাথা তুলে তাকাল না তীর্থের দিকে, “আপনি ঠিক আছেন এটা দেখার জন্যই ছিলাম এতক্ষণ নিজের খেয়াল রেখেন। লিমন ভাইয়া উনার সাথে থাকবেন অনেক রক্ত ঝরেছে উনার। আমি আসি।”
বলেই যত দ্রুত সম্ভব কবিতা সেখান থেকে চলে গেল। তীর্থ সেখানে নিথর হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো। তার মাথায় একটিই প্রশ্ন ঘুরছিলো। কবিতা কী তাকে আজকের পর থেকে ঘৃণা করবে?

কলিংবেলের শব্দ শুনে তাহিরা মুখে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। তারপর যে দরজাটা খুলে সে। দরজাটা খুলতেই সে দেখে। কবিতা দাঁড়ানো। তার চোখ-মুখ লাল। তার সাদা শাড়িতে রক্ত ভরা। তাকে দেখেই বুক কেঁপে উঠল তাহিরার। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে তোর? এ’কী অবস্থা?”
কবিতা কান্না করতে করতে জড়িয়ে ধরে তাহিরাকে, “আপু আমার অনেক ভয় লাগছে। আমি এইখানে থাকব না। আমি বাড়িতে যাব। আপু আমি এখনই বাড়িতে যাব।”

একদিকে তাহিরা নিজের সাথে এক লড়াই করছে, আর অন্যদিকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে কবিতাকে। কবিতা শান্ত হয় শেষ রাতে। বুঝাই যাচ্ছিলো বেশ ভয় পেয়েছে সে। তাহিরা জানে, কবিতা বাহির থেকে নিজেকে যতই শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক, তার মনটা ভীষণ নরম। তাহিরারও এইখানে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। সে নিজেকে কীভাবে সামলেছে তার উওরই পাচ্ছে না। কিন্তু সে এতটুকু জানে ধ্রুবর চেহেরাটাও সে দেখতে চাইছে না। আর না তার সাথে কথা বলতে চাইছে। ধ্রুবকে নিয়ে ভাবতেই কথাগুলো তার কানে ভাসে। তার বুকের ভেতরের ব্যাথাটা বাড়ে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। আজ তার হঠাৎ মনে হলো তার মা বাবার সাথে সে মরে গেলে কী বিশেষ কোনো ক্ষতি হতো?

তাহিরা সিদ্ধান্ত নিলো কবিতাকে নিয়ে সে কাল সকালেই কুমিল্লা যাবে। কবিতাদের বাড়ি। কবিতারও ভালো লাগবে আর সেও ক’টা দিন ধ্রুবর থেকে দূরে থাকবে। যদিও দাদী প্রথমে এই নিয়ে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করে কিন্তু পরে রাজি হয়। সেও সিদ্ধান্ত নেয় কবিতা ও তাহিরা যাবার পর সে নিজেও ক’টা দিন নিজের বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। অনেকবছর যাওয়া হয় না।

যেই কথা সেই কাজ। পরেরদিন সকালে কবিতা ও তাহিরা রওনা দেয় কাউকে এই বিষয়ে না জানিয়েই।

চলবে….

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here