মুহূর্তে পর্ব-৩

0
893

#মুহূর্তে
পর্ব-৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

বাস এসে থেমেছে। আবিরকে বকা দিয়ে কবিতা নিজে সারা রাস্তা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। আবির ঘুম থেকে উঠায় কবিতাকে। কবিতা যখন ঘুমঘুম চোখে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে তখনই সে অনুভব করে তার হাত যেয়ে কাউকে লেগেছে। সে নির্বাক হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে সে তীর্থ। সাথে সাথে সে হাত সরিয়ে নেয় কিন্তু ক্ষমা চায় না। অন্যকেউ হলে চাইলেও তীর্থের কাছে সে ক্ষমা চাইতেই পারে না। কিন্তু তার পরিবর্তে আবির বলল, “সরি ব্রো আমার বোনের চেহেরার সাথে একটু মাথায়ও সমস্যা আছে। প্লিজ মাইন্ড করো না।”

কবিতার চোখ তো ছানাবড়া। তার ভাই অচেনা কারও সামনে তার মর্যাদার এমন বারোটা বাজাতে পারে না। সে আবিরের হাতে মারে জোরে।
“ভাইয়া এইসব ফাজিল টাজিল ছেলের সামনে কী বলছ তুমি?”
“তো তুই বাসার বাহিরেও এমন বান্দরগিরি করলে কী বলব? স্বাভাবিক মেয়েরা কী এমন বিহেভিয়ার করে।”
“তাই না? দাঁড়াও বড় ভাইয়াকে কল দিয়ে যদি তোমার গার্লফ্রেন্ডের কথা না বলছি আমার নামও কবিতা না।”
তারপর সে তীর্থের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে নিজের ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে যায়।
কবিতা যাবার পর আবির হেসে তীর্থের দিকে তাকিয়ে বলে, “ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। ওর মাঝে এখনো কিছুটা বাচ্চামি রয়ে গেছে। কথা আগে বলে পরে ভাবে। আর ধন্যবাদ আমার বোনকে তখন যে রক্ষা করলেন। আমি আবির, আপনার সাথে দেখা করে ভালো লাগল।”
আবির হাত বাড়ায় তীর্থের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য। তীর্থও হাত মিলিয়ে বলে, “আমার নাম তীর্থ। আর আমি কিছু মনে করি নি। ডোন্ট ওয়ারি।”

কবিতা বাস থেকে নেমে আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পেল একটু দূরেই তাহিরা দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলের সাথে। ছেলেটাকে সে চিনে। তার তাহিরা আপু ছবি দেখিয়েছিলো ছেলেটার। যদিও তাহিরা মানতে রাজি নয় কিন্তু কবিতার সন্দেহ আছে ছেলেটাকে তার বোন পছন্দ করে।

কবিতা দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে তাহিরাকে, “আপু কত মাস পড়ে দেখা তোমার সাথে। এত্তগুলা মিস করেছি তোমাকে।”
তাহিরা কবিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, “আমিও। কত বড় হয়ে গেছিস কিন্তু তোর বাচ্চামিটা আর গেল না।”
কবিতা তাহিরাকে ছেড়ে উৎসুক গলায় বলে, “আপু জানো আজ সেই লেভেলের ড্রামা হয়েছে বাসে।”
“তাই? কি হলো?”
“বাসায় যেয়ে খেতে খেতে বলব নে। আগে ধ্রুব ভাইয়ার সাথে পরিচয় করাও।”
এই কাজটা তাহিরার করা লাগলো না। ধ্রুব নিজের হাত এগিয়ে দিলো কবিতার দিকে, “নাম তো জানোই কেবল সাথে ভাইয়া লাগানো লাগবে না। এত সুন্দরী মেয়েদের মুখে ভাইয়া শুনলে বুকে ব্যাথা হয়।”
তাহিরা ধ্রুবর দিকে তাকায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। আদেশের ভঙ্গিতে বলে, “ও আমার ছোট বোন। ওর সাথে এইসব কাহিনী করলে তোর খবর আছে।”
“আচ্ছা বাবা রাগ করছিস কেন? তোর বোন মানে আমার বোন সিম্পল।” তারপর সে কবিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার জন্য স্পেশাল ছাড়। তুমি আমাকে অবশ্যই ভাইয়া বলে ডাকতে পারো। সুন্দরী বোন থাকাটাও মন্দ নয়।”
কবিতা হাসলো। সে তাহিরার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “দুলাভাইয়ের কথাগুলো কিউট তো। আপু তোমাদের জুটি সেই লাগে।”
“মাইর খাবি তুই।”

“আরে ভাই তুই এইখানে?” ধ্রুবর কন্ঠ শুনে কবিতা ও তাহিরা দুইজনই তাকায় ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব এগিয়ে যায়।
কবিতা দেখতে পায় ধ্রুব যেয়ে জড়িয়ে ধরে তীর্থকে। মুহূর্তে সে মুখ বানায়। ঝাঁজালো গলায় বলে, “ধ্রুব ভাইয়া এই বেয়াদবটাকে চিনে কীভাবে?”
“তুইও তীর্থকে চিনিস না’কি?” তাহিরা উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে। কবিতা অবাক হয়ে তাহিরা দিকে, “তুমি এই বেয়াদব ছেলেকে চিনো?”
“ধ্রুবর বন্ধু।”
“দুলাভাই ভালো কাওকে পাইলো না বন্ধু বানানোর জন্য? আস্ত বেয়াদব এই ছেলেটা।”
“তুই তীর্থকে চিনিস?”
“আরো বাসে অর্ধেক ড্রামা তো ওর সাথেই হইল। ফাজিল পোলা। মনটা চাইতেছিলো ওই পোলার সাথে ওরে গালে কয়টা চটাং চটাং করে মেরে দেয়।” এক নিশ্বাসে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতা। রাগে ফুলছে সে। তাহিরা কি হয়েছে তা জিজ্ঞেস করতে চাইলো কিন্তু ধ্রুব তীর্থের সাথে আসায় কোনো প্রশ্ন করলো না।

ধ্রুব এসে তাহিরাকে বলল, “ফুলটুসি কোয়েন্সিডেন্স দেখেছিস? আমি তো জানতামও না ও কুমিল্লা গেছে। আর তীর্থ আজ আসবে তাও এই বাসে। কবিতা পরিচিত হও, ও আমাদের বন্ধু তীর্থ।”
কবিতা তীর্থের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাল। আবার পরের মুহূর্তে ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিলো। ধ্রুব তা দেখে অবাক। এমন সময় লিমন বলে, “ভাই তীর্থ ভাই আর এই আপুর আগেই পরিচয় হয়ে গেছে। শুধু পরিচয়টা ভালোভাবে হয় নি।”
“তা বুঝাই যাচ্ছে।”

আবিরও আসে এর মাঝে। তাহিরাকে দেখে বলে, “ও’মা তাহু তুই দেখি এত বড় হয়ে গেছিস।”
তাহিরা আবিরকে দেখে উৎসুকভাবে বলে, “ভাইয়া বড় তো মনে হবেই শেষ দুইবার গেলাম তুমি তো ছিলেই না। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলে। আমাকে মনে রেখেছ এইতো অনেক।”
আবির হেসে তাহিরার গাল টেনে বলে, “শেষবার যখন দেখেছি তখন বাচ্চাদের মতো লাগতো তোকে আর এখন কত ম্যাচিউরড লাগছে। আর সুন্দরও।”

ধ্রুব চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে দুইজনের দিকে। বিড়বিড় করে বলে, “ভাই খোঁজ খবর নিলে দূরে থেকে নিবি। এত গালে হাত দেবার কি আছে?”
ধ্রুব দ্রুত যেয়ে আবির ও তাহিরার মাঝে দাঁড়ায়। তারপর আবিরের সাথে পরিচিত হয়ে তার ব্যাগটা নিজে নিয়ে বলে, “ভাই এক কাজ করেন আপনি আমাদের বাসায় থাকেন। এমনিতেও তাহিরদের দুটো রুম আপনাদের সমস্যা হবে।”
তাহিরা বিস্ময় নিয়ে তাকায় ধ্রুবর দিকে। আগে তো তাদের মাঝে এই বিষয়ে কথা হয় নি।
“না, আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। আমি আর কবিতা দাদীর রুমে ঘুমাব এই দুইদিনের জন্য।”
“কবিতা আজই এলো আর এখনই ওকে কষ্ট দিবি তুই? একদম না। আবির ভাই আমার সাথে থাকুক। এমনিতেও আজ রাতে ম্যাচ আছে। দেখতে পারব সবাই মিলে। কি বলেন ভাই?”
আবির হেসে উওর দেয়, “আইডিয়া খারাপ না।”

ধ্রুব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে বোধহয় তার জানে জান এসেছে। সে হাসিমুখে তীর্থের দিকে তাকিয়ে বলে, “ভাই তুইও আয়। এমনিতেও আন্টি তোর মামার বাসায়। হুদাই বাসায় যেয়ে আবার রান্নাবান্না নিয়ে ঝামেলা করবি।”
তীর্থ গম্ভীর গলায় বলল, “প্রয়োজন নেই। তোদের অকারণে কষ্ট হবে।”
“আরে না কীসের কষ্ট? তাহিরা আজ সেই মজার বিরিয়ানি রান্না করছে না খেলেই মিস ভাই।”
“তোদের মেহমান এসেছে, আমি গেলে ঝামেলা আরও বাড়বে।”
কবিতার এই মুহূর্তে তীর্থকে দুই চোখে সহ্য হচ্ছে না। এর উপর সে যাবে তাদের সাথে? বাসের জার্নিটা কী কম ছিলো? কবিতা বিরক্তির সুরে বলল, “ভাইয়া দেখেন আপনার বন্ধু গেলে যাবে, না গেলে এইখানে বসে থাকবে। এইটা আমার দেখার বিষয় না। আমার পেটে ইন্দুররা তুম তুম ধিরুম ধুম ভুড়ুম নাচছে। আমি বাসায় যেয়ে গোসল দিয়ে এই ইন্দুরের নাচ বন্ধ করব। তাই আপনার বন্ধুকে বলেন আসলে আসতে না আসলে আমি আপুর সাথে চলে যাই।।”
তীর্থ সে মুহূর্তে কবিতার কথা শুনে প্রভাবিত হলো কিন্তু কবিতাকে কিছু বলল না।
.
.
বাসায় এসে সবার আগে তাহিরার দাদীর সাথে দেখা করে নেয় আবির ও কবিতা। ভীষণ লম্বা জার্নি করায় সবার খিদে লেগে গেছে তাই দেখা হবার পরই খাবার খেতে বসে যায় তীর্থ ও আবির। আর কবিতা যায় গোসল করতে। খাবার রান্না মজা হওয়ায় তাহিরার বেশ প্রশংসা করে আবির।

তাহিরা রান্নাঘরে আরও খাবার নিতে গিয়েছিলো। এইবার ধ্রুবও তার পিছনে আছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে বলে, “প্রশংসা শুনে তো আকাশে উড়ছিস।”
তাহিরা হেসে জিজ্ঞেস করল, “তোর কি হলো? আর তুই হঠাৎ করে ভাইয়াকে নিজের বাসায় থাকতে বললি কেন?”
“তো কি সে তোর সাথে এক বাসায় থাকবে?”
“থাকতেই পারে, আমার ভাই হয়।”
“আপন ভাই না, কাজিন হয়। আর আজকাল কাজিনদের মাঝেও প্রেম হয়।”

কথাটা শুনে মেজাজ খারাপ হয় তাহিরার। সে ঝাঁজালো গলায় বলল, “দেখ ধ্রুব এইসব মেন্টালিটি নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসবি না। আবির ও কবির ভাইয়া আমার আপন ভাইয়ের মতোই। আর ভাইয়ারা সবসময় আমাকে কবিতার মতোই ট্রিট করেছেন।”
তাহিরাকে রাগে দেখেই ধ্রুব সচেতন হয়ে গেল। সে তাহিরার কাছে যেয়ে তার দুই কাঁধে হাত আবদ্ধ করে বলে, “আমার ফুলটুসিটা রাগ করে না। আমি তো এমনিতেই বলেছিলাম। এখন তুই এত সুন্দর হলে আমার কি দোষ। মনে হয় সবাই তোর প্রেমে পড়ে যাবে। ভার্সিটির একেকটা ছেলে যেভাবে তোর পিছনে লেগে থাকতো ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয় আমার। মন হয় একেকটাকে ধরে মেরে তক্তা করে দেই। এত গা জ্বলে।”
“কেন? আমার প্রেমে পড়লে তোর কি?”
আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো তাহিরা ধ্রুবর দিকে। হয়তো এইবার ধ্রুব তাকে উওর দিবে এই আশায়।
কিন্তু ধ্রুবর উওর শুনে আবারও নিরাশ হয় তাহিরা, “অফকোর্স আমার মেজাজ খারাপ হবেই। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”
উওরটা শুনে ভীষণ বিরক্ত দেখায় তাহিরাকে। সে ধ্রুবকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে বলে, “তাহলে বেস্ট ফ্রেন্ডের মতোই থাক। আজ হোক বা কাল কেউ আমাকে বিয়ে করে তো নিয়ে যাবেই। যা তুই চেয়েও থামাতে পারবি না।”

তাহিরা বিরক্তি নিয়ে ফিরে রান্না বাড়ার জন্য। কিন্তু ধ্রুব তার বাহু ধরে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। ধ্রুব চোখ দুটো তীক্ষ্ণ। তার চোয়াল শক্ত। তার রাগ মুখে স্পষ্ট ফুটে আছে। সে তাহিরার চোখে চোখ রেখে কঠিন গলায় বলল, “কার এত সাহস আছে যে তোকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবে? একদম খুন করে ফেলব তাকে। তুই শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমার সাথে থাকবি, আমার পাশে থাকবি।”
তাহিরা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। তার দেহ কেঁপে উঠে। সে ধ্রুবর এত কাছে যে ধ্রুবর নিশ্বাসের প্রতিটি ছোঁয়া সে অনুভব করতে পারছে। এই নিশ্বাসের উষ্ণ ছোঁয়া তার হৃদয়ের স্পন্দন বাড়িয়ে দিলো। তার দেহের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হতে ইচ্ছা করছে। সে মুচকি হাসি দিলো। হাত দিয়ে ধ্রুবর গালে আলতো করে ছুঁয়ে নরম গলায় বলল, “তুই এমন কেন? না তোর সাথে থাকতে ইচ্ছা হয়, আর না তোকে ছাড়া থাকতে পারি।”

“তোর আমার সাথে থাকতে ইচ্ছা হয় না? কেন?” প্রশ্নটা করার সময় ধ্রুব গলা উদাসীন হয়ে আসে। কিন্তু তাহিরার ঠোঁটের হাসি মলিন হয় না। সে স্পষ্ট উওর দেয়, “তুই আমাকে খুব কষ্ট দিস এই কারণে।”
“আমি? অসম্ভব। আমি তোকে কীভাবে কষ্ট দিতে পারি?”
তাহিরা উওর দেয় না। সে নিজেকে ধ্রুবর বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে খাবার বাটিতে বাড়তে থাকে। উওর না পাওয়ায় ধ্রুব আবারও জিজ্ঞাসা করে, “তুই আমার কোনো ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছিস?”
তাহিরা থেমে যায় কিন্তু ফিরে তাকায় না ধ্রুবর দিকে, “কিছু প্রশ্নের উত্তর বাক্যে নয়, সময়ের সাথে পেতে হয়।”

চলবে….

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

আগের পর্বঃ
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=379946510411379&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here