মেঘবৃত্ত পর্ব_১৪

মেঘবৃত্ত
পর্ব_১৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

ঝলমলে এক বিকেল। মাথার উপর সুবিশাল আকাশ ছায়া। আকাশের নীলে টগবগে অস্থির এক সূর্য। লাল সূর্য থেকে আলোরা ফিনকি দিয়ে ঝরছে। এই মুহূর্তে বৃত্তরা একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। মেঘার মা এখনো স্বাভাবিক হতে পারেন নি। চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। আজ এতটা বছর পর তার নিজের শিক্ষার উপর প্রশ্ন উঠেছে। নিজের মেয়েকে তিনি ভালোভাবে মানুষ করতে পারেন নি। সেই আফসোসে তার বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠছে। মেঘার মা বৃত্তের দিকে তাকাতে অব্দি পারছেন না। বৃত্তই বা কি মনে করবে? যে মেয়েকে সে বিয়ে করেছে, তার পেটে অন্য একজনের সন্তান? ছিঃ! ছিঃ! কথাটা কতটা বিশ্রী শোনাচ্ছে! একসময় মেঘার মা সামলে উঠলেন। ভাঙ্গা গলায় বৃত্তকে বললেন,
— বৃত্ত বাবা? আমি সত্যিই অনেক লজ্জিত। আমি জানতাম না আমার মেয়ে এভাবে আমার নাম ডুবাবে। আমি সত্যিই জানতাম না। সত্যিই…
বাকি কথাটা আর বলতে পারলেন না। তার আগেই হু হু করে কেঁদে উঠলেন মেঘার মা। মেঘা মায়ের এমন ভেঙে পড়া দেখে অস্থির হয়ে উঠলো। হাত দিয়ে মাকে আগলে নিতে চাইলে মেঘার মা এক ছিটকে সরে যান। তেজ দেখিয়ে বললেন,
— দূর হ পাপী। তোর ছোঁয়া আমার শরীরে লাগলেও পাপ লাগবে। দূরে সর। দূরে স…
মেঘা চুপচাপ হাত গুটিয়ে নিল। মেঘার মা আঁচলে চোখ মুছে গলা খাকারি দিলেন। কম্পিত কণ্ঠে বললেন,
— যা হবার হয়ে গেছে। বৃত্ত? তুমি চাইলে আমি তোমাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে পারি। মেঘার বাচ্চার দায়িত্ত্ব তোমায় নিতে হবে না।
বৃত্ত এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। এই রেস্টুরেন্টে সব টেবিল-চেয়ার কাঠের। এমনকি তাদের প্লেট, গ্লাস বাকি খাবারের সামগ্রীসমুহ সবই কাঠের। ব্যাপারটাকে এক কথায় খুব শৌখিন বলা যায়। বৃত্ত কাঠের চেয়ারটাকে এগিয়ে এনে মেঘার মায়ের মুখোমুখি হলো। মেঘার মায়ের চোখের পানে চেয়ে মৃদু কন্ঠে সুধাল,
— প্লিজ আন্টি নিজেকে সামলান।আসলে, আমি কিছু বলতে চাইছি এ ব্যাপারে। বলবো?
মেঘার মা আঁচল তুলে তার অগ্রাংশ দিয়ে চোখের পাতা মুছলেন। আঁচলটা আবারও কোলে রেখে বৃত্তের দিকে তাকালেন। অস্ফুটসুরে বললেন,
— হুম,বলো।
বৃত্ত কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। উজ্জ্বল ফর্সা রঙের কপালে সূক্ষ ভাঁজ ফুটে উঠেছে। সেই ভাঁজ ধীরে ধীরে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হচ্ছে। বৃত্ত মাথা নত করে লম্বা করে গুটিকয়েক নিঃশ্বাস নিল। মুখের লালারস দিয়ে গলা ভিজিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
— আসলে আন্টি, মেঘার পেটের যে বাচ্চা আছে। সেটা আর কারো না। বরং আমার নিজের।
মেঘার মা এবার চমকে উঠলেন। না চাইতেও, চোখে-মুখে ফুটে উঠলো নিদারুণ স্বস্থি। চোখ থেকে আরো এক ফোঁটা জল বিসর্জন গেলো। কিন্তু পরক্ষণে মেঘার মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— কিন্তু তোমাদের বিয়ের তো মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে। তাহলে এই দু মাসের বাচ্চা….
বৃত্ত কিছু না বলে মাথা নত করে ফেললো। মেঘার মা যা বুঝার বুঝে গেলেন। তিনি রক্তচোখে মেঘার দিকে তাকালেন। হুংকার ছেড়ে বললেন,
— তার মানে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে তোরা এই জন্যেই করেছিস? ছিঃ! ছিঃ! আমার ঘৃনা হচ্ছে তোর উপর। তুই এসব কেমন করে করতে পারলি,মেঘা? একবারও বিবেকে বাঁধলো না?
মেঘা এবার আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না। মায়ের বুকে নিজের মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। মায়ের বুকের সাথে মিশে হু হু করে কেঁদে বললো,
— আমি সরি মা। আমি সরি,সরি। সেদিন কি থেকে কি হয়ে গিয়েছে, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আর এসব বলে আমাকে লজ্জায় ফেলো না। প্লিজ মা। পায়ে পড়ছি তোমার। আমাকে ক্ষমা করে দাও। প্লিজ মা, প্লিজ। দয়া করো আমার উপর। আমি এসব আর নিতে পারছি না। একবার অন্তত দয়া করো, প্লিজ।
মেঘার মা শক্ত দেহে বসে রইলেন। হাত দুটো শক্ত করে চেয়ারের উপর রেখে চোখ খিঁচে রেখেছেন। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। মেঘা সেসব চিন্তা না করে মায়ের বুকের সাথে মিশে রইলো। মেঘার মা একটা পর্যায়ে নিজেকে আর আটকাতে পারলেন না। মেয়ের প্রতি যত রাগ, সহস্র অভিমান বরফের ন্যায় গলে তরলে পরিনত হলো। দুহাতে মেয়েকে ঝাপটে ধরলেন তিনি। মেঘার মাথায় থুতনি রেখে অশ্রু ঝড়ালেন। মা-মেয়ের বিপরীতে বসে আছে বৃত্ত। দুচোখে ভাসছে, মা-মেয়ের মধ্যকার এক ঐশ্বরিক মমতা! বৃত্ত দুচোখ জুড়িয়ে চেয়ে আছে তাদের পানে। আজ সত্যিই মনে হচ্ছে, বুকের মাঝে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পাথরটা বুঝি এবার অপসারন হলো। অদ্ভুত এক বিশ্রাম ঘিরে ধরলো বৃত্তকে। নিজের চোখে অশ্রুর অস্তিত্ব লক্ষ্য করে বৃত্ত আঙ্গুলের ডগা দিয়ে জলটুকু মুছে পুনরায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মা-মেয়ের পানে।
______________________________
সেদিনের পর, মেঘার মায়ের উপর দায়িত্ত্ব দেওয়া হয়েছে মেঘার বাবাকে বিয়ের জন্যে রাজি করাতে। আর বৃত্তকে দায়িত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, তার বাবা-মাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসার জন্যে রাজি করানোর। বৃত্ত তো মাথা বেঁধে নেমেছে মা বাবাকে রাজি করানোর মিশনে। মেঘার মা এই নিয়ে অনেকবার নিজের স্বামীর কাছে বিয়ের কথা উঠিয়েছেন। তবে, প্রতিবার মেঘার বাবা প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। তবে, আজকে যা হলো তাতে দু পক্ষের মনে কিঞ্চিৎ আশার সৃষ্টি হয়েছে। এই তো আজকের কথা,
দুপুরের খাবারের পর, খাবার টেবিল গোছানোর কাজ মেঘার উপর চাপিয়ে দিয়ে মেঘার মা চলে গেলেন স্বামীর কাছে।
মেঘার বাবা তখন দুপুরের বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মেঘার মা পানের কৌটা নিয়ে বসলেন স্বামীর পাশে। নিজের হাতে পান সাজাতে সাজাতে বললেন,
— দেখো, মেঘা কেমন করে কাজ করছে। আমাদের মেয়েটা বড় হয়ে গেছে, কি বলো? এখন বিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে। সারাজীবন তো স্বামীর জন্যে পান বানালাম। ইশ! কবে যে মেঘার শাশুড়ির জন্যে পান সাজাবো? বুঝলে, মেয়ের বিয়ের জন্যে আমার তো আর তর সইছে না।
মেঘার বাবা এসব কথার উপর কোনোরূপ কথা বললেন না। বরং এক হাত পেটের উপর রেখে অপরহাত স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে বললেন,
— পান’টা দাও।
মেঘার মায়ের মুখখানা আধখানা হয়ে গেলো। স্বামীকে এতক্ষণ রসিয়ে রসিয়ে মেয়ের বিয়ের কথা বলা তাহলে কি বিফলে গেলো? কি নিষ্ঠুর দিল তার? কারো কথা কি কখনো শুনেছে? নাহ! কখনোই না। বরং, পুরোটা জীবন নিজের মর্জিমত চলেছে। এ আর নতুন কি? মেঘার মা পান এগিয়ে দিলেন। মেঘার বাবা পান খেয়ে পাশ মুড়লেন।চোখে বুজে বললেন,
— জানালার পর্দা আটকে দাও তো। আলো আসছে। আর এখন আমাকে বিরক্ত করো না। ঘুমাবো।
মেঘার মা মুখ ফুলিয়ে উঠে গিয়ে জানালার পর্দা মেলে দিলেন। অতঃপর, চুপচাপ দরজা কিঞ্চিৎ আটকে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়লেন। আজ তিনি আঁটসাঁট বেঁধেই মাঠে নেমেছেন। স্বামীকে রাজি করানোর ভয়ংকর পণটি করে তার ঘুম ভাঙ্গানোর পাঁয়তারা করছেন। স্বামীর কানের পাশে ঝুঁকে আলতো গলায় ডাক দিলেন,
— শুনছো? একটা কথা বলার ছিলো? বলবো?
জুয়েল রহমান এবার একটু নড়েচড়ে উঠলেন। চোখ বুজেই উত্তর করলেন,
— বলো।
মেঘার মা কাঁচুমাঁচু কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— বলছিলাম কি, মেঘার বিয়ে তো হয়ে গেছে। বিবাহিত মেয়েকে এমন করে ঘরে বসে রাখলে লোকে কি বলবে? ভাববে জামাইর সাথে মেয়ের সমস্যা চলছে। তখন তো আমাদেরই বদনাম। তাই বলছিলাম কি…
মেঘার বাবা হুট করে সোজা হয়ে শুলেন। স্ত্রীর দিকে চেয়ে থমথমে সুরে বললেন,
— কি বলছিলে?
স্বামীর এমন থমথমে কণ্ঠস্বর শুনে মেঘার মায়ের গলা শুকিয়ে এলো। একটা ঢোক গিলে মেকি হেসে বললেন,
— ভাবছি, মেয়েকে স্বামীর ঘরে তুলে দিবো। বৃত্তদের পরিবারও তাই বলছে। শুধু তোমার জন্যে ওরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। শোনো, রাজি হয়ে যাও না? আর তোমার মেয়েরও এই বাড়িতে মন টিকছে না। মুখে কিছু বলে না। কিন্তু আমি তো ওর মা। মনটা ঠিকই পড়তে পারি। বৃত্তের সঙ্গে থাকতে তোমার মেয়েও চাইছে। তুমি কি নিজের মেয়ের মনের বিষয়টা বুঝবে না? বলো?
মেঘার বাবার কপালে এবার ভাঁজ পড়লো। শ্যাম বর্ণের মুখে ফুটলো চিন্তার বলিরেখা। সত্যিই কি তিনি মেয়ের মনকে বুঝতে চাইছেন না? মেয়ের ভালো করতে গিয়ে অজান্তেই মেয়ের খারাপ করছেন? মেঘার বাবা কিছুক্ষণ ভাবলেন
মিনিট খানেক পর গম্ভীর সুরে বললেন,
— আচ্ছা। আমি ভেবে দেখবো। এখন ঘুমাতে দাও।
কথাটা বলেই মেঘার বাবা পাশ মুড়ে চোখ বুজলেন। স্ত্রীকে ঘুমানোর কথা বললেও, আজ বিকেলের বিশ্রাম যে পন্ড হয়েছে সেটা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন।

#চলবে
যাও, বড় করে দিলাম। ১১০০ শব্দ আছে এই পর্বে। এবার বড় বড় মন্তব্য করে আমার মনটাও মাতিয়ে তুলুন। যাতে পরবর্তীতে আরো বড়ওও করে পর্ব দিতে পারি। ভালোবাসা💜

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/264360785608489/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here