মেঘের পরে রংধনু পর্ব-১১

0
1322

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১১
লিখা: Sidratul Muntaz

আচ্ছা, সেদিন কি সত্যিই অরিন ইলহানকে এতো জোরে চড় দিয়েছিল যে গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেছিল একদম? হতেই পারে! ফরসা মানুষের গালে তো একটু আঘাত লাগলেই দাগ বসে যায়। তবে দ্বিতীয় চড়ে এতো গাঢ় দাগ বসার কথা নয়। প্রথম চড়েই হয়তো দাগটা বসেছিল। কিন্তু অরিনের গায়ে এতো শক্তি এলো কিভাবে? সে তো তখন রায়হানকে নিয়ে ডেস্পারেট ছিল। তাহলে কি সেটা রায়হানের ভালোবাসার শক্তি ছিল? এই কথা ভাবতেই হাসি পেল অরিনের। কোথ থেকে যেনো পাখির কলকাকলী শোনা যাচ্ছে। আশেপাশে তো কোনো পাখি দেখা যাচ্ছে না। আকাশে ভোরের আলোর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। প্রকৃতির এই রঙটা এতো দারুণ কেনো? যখন আধার ছাপিয়ে সূর্য আসে তখন প্রকৃতিতে আধার-আলোর অন্যরকম একটা মিশ্রণ তৈরী হয়। চারদিক নীরবতায় ছেঁয়ে থাকে। যেনো ঘুমন্ত নগরী। সেই সময়টা অরিনের খুব ভালো লাগে। একাকী বসে, একটা নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখতে চায় সে। প্রত্যেকবার মনে হয়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, আজকেই সেই সুন্দরতম দিনের শুরু হতে যাচ্ছে। যেইদিন রায়হান আবার তার জীবনে ফিরে আসবে। পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সুখী হয়ে বেঁচে থাকার জন্য অরিন তো খুব বেশি কিছু চায় না। শুধু একটা রায়হান চায়। অরিন হঠাৎ খেয়াল করলো তার থেকে কয়েক হাত দূরে হলুদ-সাদার মিশ্রণে একটা কূর্তি পরিহিত মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটা নৌশিন। এই ভোরে নৌশিন যাচ্ছে কোথায়? ওর হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে চুরি করতে বের হয়েছে যেনো! মেয়েটা পা টিপিয়ে হাঁটছে কেনো? আশেপাশে তাকিয়ে দৃঢ় সতর্কতার সাথে কি যেনো খুঁজছে। কি খুঁজছে? অরিন হাত উঠিয়ে ডাকলো,
” এই নৌশিন।”
নৌশিন ভয় পেয়ে গেল। ওর কেঁপে উঠা দেখেই বুঝা গেল ভয় পেয়েছে। অরিন বললো,
” এইদিকে তাকা।”
নৌশিন অরিনের কাছে এগিয়ে আসলো। অরিন প্রশ্ন করার আগেই নৌশিন আতঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করলো,
” তুই কি ভূত?”
” ভূত হবো কেনো?”
” তাহলে এই ভোরবেলা এখানে একা বসে আছিস যে? ভয় লাগে না?”
” আমার ভয় তোর থেকে কম। তুই বের হয়েছিস কেনো ভোরবেলা?”
নৌশিন অরিনের পাশে বসতে বসতে বললো,
” নামায পড়তে উঠেছিলাম। তারপর ইচ্ছে করলো একটু হাঁটতে বের হই।”
” বাহ, জীবনে তো তোকে এক ওয়াক্ত নামায পড়তে দেখলাম না। আজ একদম ফজরের নামায পড়তে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে গেছিস? আমার তো অবাক লাগছে।”
” আমি ঠিক করেছি এখন থেকে নিয়মিত নামায পড়বো। তাহাজ্জুদসহ।”
” বলিস কি? এখন তো বিস্ময়ে আমার মাথা ঘুরে পড়ে যেতে ইচ্ছে করছে।”
” ধূর ঢং করিস না। আমি সিরিয়াসলি বলছি। জানিস, আল্লাহর কাছে মন থেকে চাইলে সব পাওয়া যায়। আমি অনেক দোয়া কবুলের গল্প শুনেছি। টানা একচল্লিশ দিন তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে সেই দোয়া কখনও বিফলে যায় না। অবশ্যই কবুল হয়।”
” একচল্লিশ দিন নাকি একচল্লিশ রাত?”
” এই তুই কি ফাজলামির মুডে আছিস? শোন আমার সাথে এখন একদম ফাজলামি করবি না। আমি খুব সিরিয়াস। কালরাতের জ্বরটা মাত্র ছেড়েছে। তবে আমার মনে হচ্ছে আবার জ্বর আসবে। ”
” জ্বর আসবে কেনো?”
” জানি না। এই, তোর গালটা এমন লাল হয়ে ফুলে আছে কেনো রে? ভিমরুলের কামড় খেয়েছিস নাকি?”
অরিন থতমত খেয়ে গালে হাত রাখলো। চুল দিয়ে গাল ঢাকার চেষ্টা করলো। নৌশিন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। অরিন বললো,
” আরে না, ভিমরুলের কামড় খাবো কেনো?”
” মনে তো হয় কেউ চড় মেরেছে। আঙুলের ছাপ দেখা যাচ্ছে। এই দেখি, দেখি!”
” কালো মানুষের গালেও আবার চড়ের দাগ বসে? এতো লাল-নীল বোঝা যায়?”
” তুই কালো হলেও আমার থেকে ভালো। আমাকে দ্যাখ, চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল। মুখ ভর্তি লাল- সাদা ব্রণ। ছি, ইয়াক! একটা দাগ লাগলেও ভেসে থাকে। কি যে যন্ত্রণা! তার চেয়ে তোর স্কিন কত সুন্দর! সব এক! একদম নিঁখুত! তোকে তো আমার মাঝে মাঝে ডার্ক চকলেট মনে করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”
অরিন মনে মনে খুব হাসলো। মানুষ যে ওকে কেনো এতো সান্ত্বনা বাণী শোনায়! অথচ একদিন নৌশিন নিজেই বলেছিল, ‘তোকে অন্ধকারে দেখলে আমার ভয় লাগে। সাদা চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। মনে হয় অশরীরী দেখছি। ভূতের মতো তুই একদম।’ যদিও তখন নৌশিন খুব ছোট ছিল। অরিন নিজেও তো ছোট ছিল। তার এসব কথা শুনলে খারাপ লাগতো। নিশিতার ষোলতম জন্মদিনের কথা এখনও অরিনের মনে আছে। বার্থডে পার্টিতে নিশিতা সবার সাথে ছবি তুলেছিল। শুধু অরিনের সাথে ছবি তুলেনি। অরিন যখন ছবি তোলার উদ্দেশ্যে নিশি আপুর পাশে দাঁড়ালো তখন নিশিতা খুব কটাক্ষ করে বললো,’ তুই আমার পাশে দাঁড়াবি না। তুই থাকলে আমার ছবিই সুন্দর আসবে না।’ অরিন তখন বোকার মতো হা করে তাকিয়েছিল। এখন অবশ্য কেউ আর তাকে গায়ের রঙ নিয়ে কথা শোনায় না। কিন্তু কিছু আঘাত আছে, যা মনে করতে না চাইলেও বারবার মনে পড়ে যায়। নৌশিন অরিনের ব্যাগ দেখে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললো,
” সত্যি করে বলতো, তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
অরিন অন্যমনস্ক ছিল। তাই মুখ ফসকে বলে ফেললো,” যাচ্ছি না, গিয়েছিলাম। কালরাতে শ্যানিনদের বাসায় গিয়েছিলাম।”
নৌশিন অবাক হয়ে বললো,” কি?” অরিন হেসে ফেললো। নৌশিন ওর হাসি দেখেই ঘটনা আন্দাজ করতে পারলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
” শ্যানিনের ওই সাইকো ভাইটা কি কোনো কাহিনী করেছে?”
” আর বলিস না। অস্ট্রেলিয়ান গরু একটা। মাথাখারাপ করে ছাড়বে আমার।”
” প্লিজ বল না বল, কি হয়েছিল?”
অরিন শ্যানিনদের বাসায় যাওয়া থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত সব ঘটনা বললো। নৌশিন অরিনের হাত চেপে ধরে বললো,
” অরিন, তুই কি জানিস? তুই খুব লাকি। আজ-কালকের যুগে কেউ কাউকে এতো ভালোবাসতে পারে না। আর শ্যানিনের বাবার কথা শুনে তো আমার আরও অবাক লাগছে। আজ-কাল এমন কয়জন মা-বাবা আছে যারা এতো সহজে সব মেনে নেয়? তোকে একদম বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিলো!”
” আমার কাছে এই বিষয়টাই সবচেয়ে বাজে লেগেছে। উনি কাজটা একদম স্বার্থপরের মতো করেছেন। শুধু নিজের ছেলের দিকটাই দেখলেন। আমার দিকটা তো একবারও ভাবলেন না। তুই জানিস, উনি আমার মত পর্যন্ত জানতে চাননি। শুধু বলেছেন বিয়ে হতেই হবে। এইটা কোন ধরণের কথা?”
” আঙ্কেলের দোষ নেই। উনি হয়তো ভেবেছেন উনার ছেলে সুপাত্র। তাকে বিয়ে করতে তোর কেনো আপত্তি থাকবে? তাছাড়া তুই নিজেই তো বলেছিস। তোর ফ্রেন্ডদের মধ্যে সবাই নাকি ইলহান ভাই বলতে পাগল? যাকে পৃথিবীর সবমেয়ে পছন্দ করে তাকে তোর কেনো এতো অপছন্দ?”
” তুই এইমাত্র একটা চড় খাওয়ার মতো কথা বললি।”
” মানে?”
” বেশিরভাগ মানুষ যেটা পছন্দ করবে সেটাও যে আমাকেও পছন্দ করতে হবে এমন কি কোনো অলিখিত বিধান আছে? ধর, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ কাচ্চি পছন্দ করে। তাই বলে কি আমাকেও পছন্দ করতে হবে? আমার কি একটু পান্তা পছন্দ হতে পারে না?”
” কোথায় কাচ্চি আর কোথায় পান্তা। তুলনাই তো হয় না।”
” অবশ্যই তুলনা হয়। কাচ্চি খেলেও পেট ভরবে, পান্তা খেলেও পেট ভরবে। কিন্তু কাচ্চি খাওয়ার পর যদি আমার ডায়রিয়া হয় আর পান্তা খেয়ে যদি আমি সুস্থ থাকতে পারি তাহলে ক্ষতি কি?”
” তার মানে তুই বলতে চাইছিস ইলহান ভাইকে বিয়ে করলে তোর ডায়রিয়া হবে?”
” উফফ, সেটা কখন বললাম?”
নৌশিন হাসতে শুরু করলো। অরিন বললো,
” খাবারের বিষয়টা যেমন আলাদা। লাইফ পার্টনার চুজ করার বিষয়টা আরও আলাদা। খাবার তো আমি একবেলার জন্য খাবো। কিন্তু লাইফ পার্টনার সারাজীবনের। সারাজীবন যার সাথে আমি হ্যাপি হতে পারবো তাকেই আমার চুজ করা উচিৎ। ”
” যে তোকে এতো ভালোবাসে, তোর জন্য এতো পাগলামি করে সে তোকে হ্যাপি রাখতে পারবে না? এইটা একটা কথা বললি?”
” কেউ কখনও কাউকে হ্যাপি রাখতে পারে না নৌশিন। হ্যাপিনেসটা সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। তুই যদি মন থেকে সন্তুষ্ট থাকিস, তাহলে কুঁড়েঘরে বাস করেও তুই হ্যাপি। আর যদি মনে অসন্তুষ্টি থাকে তাহলে রাজপ্রাসাদে গিয়েও কোনো লাভ নেই।”
” বুঝলাম। তুই এখনও সেই রায়হানের মধ্যেই আটকে আছিস। ওই ছেলের ভূত কি কোনোদিন তোর মাথা থেকে যাবে না অরিন? কতকিছু করলি ছেলেটার জন্য। সুইসাইড পর্যন্ত করতে গেছিলি। একসাথে অনেকগুলো পিলস খেয়ে একদম অজ্ঞান। তোকে যদি সেদিন তাড়াহুড়ো করে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে যেতাম তাহলে তো আজকে কবরে থাকতিস। ভাগ্যিস হালিমা ফুপু এই বিষয়টা জানে না। ফুপুকে বলেছিলাম তোর ফুড পয়জনিং হয়েছে। নাহলে যদি জানতো তুই পিলস খেয়ে আত্মহত্যা করতে গেছিলি তাও একটা ছেলের জন্য, তাহলে ফুপুই দায়িত্ব নিয়ে তোকে পিটিয়ে মেরে ফেলতো।”
অরিন চুপ করে রইল। নৌশিন বললো,
” আচ্ছা, তুই কি কখনও রায়হানকে নিজের চোখে দেখেছিস?”
” উহুম। তবে ওর একটা ছবি আছে আমার কাছে।”
” দেখা তো। ওই ছবিটাও দেখা আর ইলহানের ছবিও দেখা। দু’জনকে একসাথে কম্পেয়ার করি।”
” কম্পেয়ার করার জন্য আমি তোকে ছবি দেখাবো না।”
” আচ্ছা কম্পেয়ার না। এমনিই দেখবো। দেখা।”
অরিন মোবাইল থেকে ছবি বের করতে করতে বললো,
” আচ্ছা, তুই হঠাৎ নামায পড়া শুরু করলি, তাহাজ্জুদও পড়বি বলছিস? এসবের কি বিশেষ কোনো কারণ আছে?”
নৌশিন লাজুক হাসি দিয়ে বললো,” আছে। আমি সেই ডেলিভারিম্যানকে আবার দেখতে চাই।”
অরিন ফিক করে হেসে দিল।
” সো লেইম নৌশিন!”
” লেইম বলছিস কেনো? এইটা আমার ভালোবাসার বিশ্বাস। তবে তোকে কিন্তু আমি একটা বিষয় মিথ্যে বলেছি। আমি আসলে হাঁটতে বের হইনি। ফজরের নামায শেষ করার পর আমার কেনো যেনো মনে হয়েছে এখন বাসা থেকে বের হলেই আমার আবার ছেলেটার সাথে দেখা হবে। তাই বের হয়েছি।”
” দেখা হলো না তো।”
” মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা হবে।”
অরিন রায়হানের ছবিটা বের করে বললো,” এইযে দ্যাখ, এটা রায়হান।”
নৌশিন ছবিটা কিছুক্ষণ দেখে বললো,” এই ছবি তো তুই আমাকে আগেও একবার দেখিয়েছিলি। আচ্ছা এবার ইলহানের ছবি দেখা।”
” ওর ছবি আমার ফোনে নেই। ফেসবুক থেকে বের করতে গেলে এমবি লাগবে। আমার ফোনে এখন সিম নেই। গরুটার যন্ত্রণায় সিমও ফেলে দিয়েছি।”
নৌশিন কপালে হাত ঠেকালো। অরিন দূরে তাকাতেই খেয়াল করলো ইলহান ওদের দিকেই আসছে। অরিন চোখ বন্ধ করে আবার তাকালো। ইলহান তাহলে যায়নি? এতোক্ষণ এখানেই ছিল? ওর মুখ আর চুল এখন অনেকটাই শুকনো দেখাচ্ছে। কিন্তু টি-শার্ট এখনও ভেজা। অরিন বিরবির করে বললো,
” ছবি দেখার দরকার নেই। চলে এসেছে। এখন সরাসরি দেখ।”
নৌশিন মাথা তুলে তাকালো আর হতভম্ব হয়ে গেল। ইলহান অরিনের সামনে এসে বললো,
” আমার ফোনটা না তোমার কাছে ছিল? নিতে এসেছি।”
” আপনার ফোন আমি গাড়িতেই রেখে এসেছি।”
ইলহান অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বললো,” ও আচ্ছা। গাড়িতেই? দেখতে হবে।”
অরিন খুব ভালো করে জানে ইলহান ফোন নিতে আসেনি। বরং ফোনকে বাহানা বানিয়ে এসেছে। ইলহান বললো,
” এইটা কে?”
” আমার কাজিন, নৌশিন।”
ইলহান নৌশিনের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বললো,
” হায় নৌশিন, আমি ইলহান।”
এরপর যে কি হলো, অরিন-ইলহান কেউই কিছু বুঝলো না। নৌশিন হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here