মেঘের_বন্ধু_বৃষ্টি (১২)

#মেঘের_বন্ধু_বৃষ্টি (১২)

ব্যক্তিগত কারনে হোক বা অন্য কোনো কারনে মধুপ্রিয়া কে পছন্দ হয় নি সুষমার। দিন গুলো খুব দ্রুত কেঁটে গেল যেন। অসুস্থতার আজ পঞ্চম মাস। সব টা উপর দিয়ে স্বাভাবিক হলে ও ভেতরের অবস্থান খুব ই গম্ভীর। জিমাম আবার আগলে নিয়েছে আরুশি কে। পরিবারের সাথে এই নিয়ে ব্যবধান চলছে তাঁর। তবে সুষমার পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে ছেলেটা। কান্না করতে করতে চেয়েছে তাঁর মেয়ের হাত। মেয়ে কে ভালোবাসেন সুষমা, তবে মেয়ের শশুর বাড়ির সাথে যদি আগেই দ্বন্দ্ব চলে তবে কি করে যাবে বাকি জীবন টা। এই প্রতিউত্তরে জিমাম বলেছিলো সে নাকি আরুশি কে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। এই বিশেষ মতামতে সায় দেন নি সুষমা। তিনি জানেন একটি সন্তান একটি পরিবারের নিকট কতো টা গুরুত্বপূর্ণ। তাই এক প্রকার মনোযুদ্ধ চালিয়েই স্থির করেছেন মেয়ে কে পরীক্ষার মাঝে ফেলে দিবেন। শশুর বাড়ি তে মানিয়ে নিতে হবে আরুশির। মেয়েরা পারে না এমন কিছু নেই। আর ভালোবাসার ক্ষেত্রে এই শক্তি বেড়ে যায় কয়েক গুন। আরুশি যেহেতু ভালোবেসেছে তাই শাস্তি স্বরূপ কিংবা আর্শীবাদ ভেবেই হোক তাকে লড়াই করতেই হবে। মাঝে মধুপ্রিয়ার প্রতি মন টানছে না ওনার। খুব করে চান ছেলের মিষ্টি এক বউ। মধুপ্রিয়া তেমনি একজন। সুন্দরী, লক্ষী গুনবতী। কিন্তু তিনি যে এই পরিকল্পনার বাহিরে পরিকল্পনা সাজিয়ে ছিলেন। শেষ সময়ে এসে ছেলে টা এভাবে হাজির হবে ভাবতে ও পারেন নি তিনি। উপন্যাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এসব ই কল্পনা করলেন সুষমা। আজ বৃথা পার করলেন লাইব্রেরি তে। সময় টা খুব ই খারাপ। টিভি তে মৃদু শব্দে গান চলছে। তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা মন জানো না গান টি। এক কালে খুব শোনা হতো এই গান। আজকাল মনে রস নেই একদম। তাছাড়া বয়স টা ও কম হলো না। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠার সময় পিছু ডাকলো আওয়ান।
” আম্মি, সময় হবে তোমার? ”

” হ্যাঁ। আমি তো সব সময় ই ফ্রি। কাজ নেই, ঘরে বসেই যতটুকু করা হয় আরকি। কিছু বলার থাকলে বলো এখন। ”

” চুলে একটু বিলি কেঁটে দিবে আম্মি? ”

” ঘরে আসো। ”

সুষমার সরল কন্ঠে একবার শুকনো ঢোক গিললো আওয়ান। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে গেছে। ঘুম হয় না বহুদিন। এক টা দুটো চিন্তা নয়, হরেক রকমের চিন্তা কে পুষতে হচ্ছে এই অন্তরে। তবে কোনো টার ই ঠিক ঠাক সমাধান নেই।

” আন্টি আসবো? ”

তিয়াশার কন্ঠ। ফট করেই মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে নিলো আওয়ান। হালকা নীল রঙের জামায় বেশ ভালোই লাগছে তিয়াশা কে। মুখে রয়েছে হাসির সরল রেখা। সুষমা সম্মতি প্রদান করলো। তিয়াশা সালাম করে শুধালো–
” তোমার শরীর কেমন আছে এখন? ঔষধ খাচ্ছো তো ঠিক মতো। ”

” খাচ্ছি রে মা। দুদিন পর পর ই তো খবর নিচ্ছিস। ”

” নিতে তো হবেই। শরীর টা যে ভালো নেই তোমার। আগে বললে এমন টা হতো না। ”

” ভাগ্য কে বদল ঘটানো কার সাধ্যে আছে বল তো তিয়া? অবিনশ্বর আমার জীবনী শক্তি এখানেই শেষ করেছেন। ”

” বললেই হলো। তোমাকে তো অনেক বছর বাঁচতে হবে। আমার বাচ্চা কাচ্চা হবে নাতি নাতনি কে বিয়ে দিবে তুমি। তারপর না হয় মৃত্যুর স্বাদ। ”

কথা বলতে বলতে তিয়াশার চোখ ভিজে গেছে। সুষমার কন্ঠ টা ও ভারী হয়ে এলো। তিনি ও চান না মৃত্যু কে আগলে নিতে।মন টা বড় ই বিচলিত। পাশে বসে থেকে ও বিশেষ প্রতিক্রিয়া নেই আওয়ানের। গত তিন মাসে যা হয়ে চলেছে এতে করে পাথর বনে গেছে ছেলেটা। নিজের মন কে কড়া করে শাসন করে নিয়েছে নিশ্চিত। ফ্যাচ ফ্যাচ কান্নার আওয়ান শুনে আরুশি ছুটে এলো। কি হলো কে জানে মেয়েটা ও মুখে হাত চেপে কান্না জুড়ে দিলো। তিনটে মানুষ কাঁদছে। অথচ আওয়ানের চোখ দু খানা নিষ্প্রাণ। টং করেই কলিং বেজে উঠলো। উত্তপ্ত শ্বাস বুকে চেপে চেপে নিয়ে মেইন ডোর খুললো আওয়ান। মধুপ্রিয়া কে এই সময় আশা করে নি সে। আজকাল বেশ আনাগোনা চলছে এই বাড়ি তে। হবু শশুর বাড়ি বলে কথা।
” ভেতরে আসতে বলবে না? ”

” হু আসো। ”

” আন্টি কোথায় গো? ”

” ঘরেই আছে। ”

” আচ্ছা বসো পাশে,কথা আছে। ”

হাত ধরে আওয়ান কে পাশে বসিয়ে দিলো মধু। মেয়েটার মুখের পানে তাকালে শুধু ই দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে বুক চিরে। কতো হাসি খুশি মেয়েটা। ঘোলা চোখের মনি গুলো মধুর অগোছালো চুলে আনাগোনা করছে। হাত দিয়ে বিন্যস্ত করে দিলো সেসব চুল। হালকা স্পর্শ কে গাঢ় করতে আওয়ানের হাত দুটো গালে চেপে ধরলো মধু। দুটো চুমু খেয়ে বলল
” ভালোবাসা সুখ দুঃখ দুটোই দেয় তাই না? ”

” হ্যাঁ। ”

দুজনের মাঝে নীরবতা পালন চলছে এখন। মাঝে আরুশি এসে জয়েন করলো ওদের সাথে। মধুপ্রিয়ার সাথে গল্প জমিয়ে দিলো আরুশি। যাক এবার মন টা ভালো হলো। তবে তিয়াশার প্রতি ক্ষীণ রাগ জমায়েত হয়েছে। এই মেয়েটা যতো বার এসেছে ঠিক ততোবার ই সকল কে কান্না তে ভাসিয়েছে। সুষমার রুমের কোনে এসে তাচ্ছিল্য হাসলো আওয়ান। তিয়াশা ওর জীবনের কষ্টের প্রতীক হয়ে এসেছে। এই মেয়ে কখনোই ভালো থাকতে দেয় নি। তবু ও সে বন্ধু। আর এটাই জীবনের প্রথম শ্রেনীর ভুল।

সুষমা কিছু তেই লাঞ্চ না করিয়ে ছাড়লো না তিয়াশা কে। মধুপ্রিয়া সহ সবাই এক সাথে লাঞ্চে বসলো। টুকটাক গল্পের মাঝেই আসল কথাই ভুলে গেছে তিয়াশা। মাথায় হাত রেখে বলল
” যাঁর জন্য আসা সেটাই ভুলে গেছি। “।

” কোনটার কথা বলছো তিয়াপু? ”

” ওয়েট। ”

” মাঝ পথে উঠতে নেই তিয়া। খাবার শেষ করে যা। ”

পুরো টা সময়ের মাঝে এই মাত্র কথা বললো আওয়ান। এখানে এসেছে তিন ঘন্টার ও বেশি সময়। অথচ এক টা কথা ও বলে নি সে। মধুপ্রিয়া ও সায় জানিয়ে বলল
” খাবার শেষ করে তারপর যাও। ”

তিয়া খাবার শেষ করলো কোনো মতে। হাত ধুয়ে এসে ব্যাগ থেকে কার্ড বের করলো। ঝলমল করা লাল রঙের কার্ড। শীতল চাহনি ফেলে সে দিকে তাকালো আওয়ান। বোঝার মতো বোধগম্যতা আছে তাঁর। কার্ডের উপর সাইন করলো তিয়াশা। মধুপ্রিয়া আর সুষমার কাছে কার্ড দিয়ে বলল
” সবাই কে আমার বিয়ের ফাংশনে কাম্য করছি আমি। না আসলে কিন্তু বিয়েই করবো না আমি। সবাই কে আসতে হবে। খুব সেজেগুজে আনন্দ করবো আমরা। ”

*

রেজাল্ট এর আগেই একটা ভালো মানের জব পেয়ে গেছে আওয়ান। অত্যন্ত খুশি মনে মিষ্টি হাতে বাসায় ফিরছিলো। তখনি চোখে পরে রাযীন আর তিয়া কে। খুব সম্ভবত বিয়ের শপিং এ এসেছে। হাতে সময় কম থাকাতে সে দিকে আগালো না আওয়ান। মিষ্টির বক্স নিয়ে বাড়ির পথে ছুট লাগালো। গ্লাসে আওয়ানের বিম্ব দেখে ছুটে এলো তিয়াশা। ততক্ষণে ছেলেটা চলে গেছে অনেকদূর।
” এভাবে ছুটে এলেন কেন? ”

” না এমনি। ”

” ভেতরে আসুন। অনেক শপিং করতে হবে। মেয়েদের পছন্দের উপর আমার চৌদ্দ পুরুষ ও কল্পনা করতে পারবে না। ”

দু হাত ভর্তি শপিং করেছে তিয়াশা। রাযীন যে কৃপন নয় সেটা খুব ভালো মতোই অনুভব হয়েছে। তবে তিয়াশার নিজের ই খারাপ লাগছে এতো গুলো টাকা খরচ করা তে। শুধু শুধু এই দামি উপহার গুলো। রাযীনের সাথে লাঞ্চ করে বাসায় আসলো তিয়া। ছেলেটা কেয়ার করতে জানে বটে। তিয়াশা ঘরের ভেতরে না যাওয়া অব্দি গাড়ি নিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। মৃদু হেসে ভেতরে এলো তিয়া। আওয়ান মাত্র ই বের হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে ঠিক তখনি তিয়ার আগমন। মেয়েটা কে দেখে হালকা করে হাসলো আওয়ান। তবে তিয়া কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া দিলো না। শপিং ব্যাগ গুলো কাউচে ফেলে নিজের ঘরে অবস্থান করলো।

আলুথালু চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হলো তিয়াশা। কিছু সময় এভাবেই কেঁটে গেছে। চোখ দু খানা নিষ্প্রভ হয়ে সামনের দিকে নিবদ্ধ।

চোখে মুখে সবে পানির ঝাপটা দিয়েছে ওমনি করে দরজায় বেল বাজা শুরু। দ্বার খুলেই বুঝতে পারলো ঐ পাশের ব্যক্তি টি আওয়ান। নিজেকে সংযত করলো তিয়া। মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে কানে বালিশ চাঁপা দিয়ে শুয়ে রইলো। সামান্য বিব্রত বোধ করছে রাযীন। আওয়ান হাত দিয়ে আশ্বস্ত করে আবার দরজায় নক করলো। প্রতি উত্তরে ভাঙা কন্ঠের উত্তেজিত বানী শুনতে পেল।
” তুই যাবি না নাকি? আমি রেস্ট নিবো এখন। দয়া করে যা। ”

” আমি তো চলেই যাচ্ছি। তবে রাযীন ভাই যে অপেক্ষা করছে। ”

ফট করেই দরজা খুলে ফেললো তিয়া। আলুথালু দেহ নিয়েই সামনে এগোলো। রাযীনের হাতে এক টা প্যাকেট। যা গাড়ি তেই ফেলে এসেছিলো তিয়া। ক্ষীণ স্বরে ধন্যবাদ জানালো। রাযীনের হাতে সময় কম তাই সে সকলের থেকে বিদায় নিলো। আওয়ান ও চলে যাচ্ছিলো। তবে তিয়াশার হাতের বাঁধনে যেতে পারলো না। পেছন না ঘুরে ও আওয়ান বুঝতে পারলো ছলছল করছে কারো নয়ন। তবে অসময়ে জাগ্রত হওয়া সব কিছু যে ধ্বংস ডেকে দেয়। ফট করেই মেয়েটি হাত ছেড়ে দিয়ে শার্ট খামচে ধরলো। রসিকতা ঢেলে আওয়ান বলল
” ভাই তোর এই অদ্ভুত স্বভাব রাযীন ভাই জানে তো? ”

” কী। ”

” এই যে উল্টো পাল্টো স্বভাব। ছেলেদের উপর টহলদারি করা। ”

” আওয়ান প্লিজ। আমি ফাজলামির মুডে নেই। ”

” আমি ও নেই। তাছাড়া এখন আমার ভালো লাগছে না। মধুর সাথে দেখা করা হয় নি। তোর বিয়ের দিন টা কেন যে আসছে না। ”

” আমার বিয়ে নিয়ে তোর এতো উত্তেজনা কেন? ”

” উত্তেজনা থাকবে না! আফটারঅল এক প্যারা নেমে যাচ্ছে ঘাড় থেকে। ”

মলিন হয়ে এলো তিয়াশার মুখ। মেয়েটার থেকে সরে গিয়ে চলেই যাচ্ছিলো আওয়ান। পরমুহূর্তে কোন মতলবে কাছে এলো। তিয়াশার এক গাছি এলোচুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল
” সময় সব থেকে বড় স্বার্থপর। এরা শুধু চলে যায়। তবে সঠিক সময়ে সময় আসে না।আমরা কেবল ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। তাই বলবো যেমন টা হচ্ছে হোক। আর শোন
ফ্রিজে মিষ্টি আছে, তোর ফেবরেট মিহিদানার লাড্ডু। ”

গ্রুপ :Fatema’s story discussion

আইডি : https://www.facebook.com/fatema.tuz.9469

“পরবর্তী তে যে গল্প টা আসতে চলেছে সেটা সম্পূর্ন ভিন্ন ধাঁচের। পুরোই ভিন্ন রকমের গল্প হবে ইনশাআল্লাহ।”

#চলবে
#ফাতেমা_তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here