মেঘে_ঢাকা_চাঁদ পর্ব ৩৬

0
974

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৩৬)
সায়লা সুলতানা লাকী

রিকশার হুড ফেলে দিতেই ঠান্ডা বাতাস শিরশির করে এসে লাগল লাবন্যের গায়ে। ও একটু জড়োসড়ো হয়ে বসলো হিমেলের হাতটাকে জড়িয়ে ধরে । হিমেল ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল হুডটা আবার তুলে দিবে কি না।সাথে সাথে মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে মানা করল । কারউ মুখে কোন কথা নাই, দু’জনই বসে আছে চুপচাপ । একটু পর লাবন্য ওর মাথাটা কাত করে হিমেলের কাঁধে নামিয়ে রাখল আর অমনিই হিমেল বলে উঠল
“এই বন্য, তুই আবার ঘুমিয়ে পড়িস না কিন্তু!”

” উঁহু ঘুমোবো না। এমনি চোখ বুজে আছি। আলো আঁধারের এই কম্বিনেশনে চোখ বুজে থাকতে ভালো লাগছে। সাথে তুমি তোমার কাব্য চালাতে পারো তাহলে আরও ভালো লাগবে। তবে হয়ত তখন ঘুমিয়েও যেতে পারি।”

” মামা একটু দেখে শুনে চালাইয়েন, প্যাসেন্জার কিন্তু পাগল! রিকশায় উঠেই ঘুমানো শুরু করছে, একটু ধাক্কা লাগলেই পড়ে যাবে।পরে কিন্তু আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করবে চিৎকার করে। ”

” মোটেও পড়ব না। আমি তোমাকে শক্ত করে ধরে আছি। আর তুমি কি আমাকে পড়তে দিবে নাকি? শুধু শুধু মামাকে কেন ভয় দেখাচ্ছো? মামা আপনি চালান আপনার মতো করে বিন্দাস ফুরফুরা মেজাজে। আপনে হইলেন এখন রাস্তার রাজা। এর কথা শুনে ভয় পাইয়েন না। আমি মোটেও এমন না। দেখছেন না আমারে? আমারে কি ওই রকম মনে হইছে আপনের?”

রিকশাওয়ালা কোন উত্তর দিলো না। শুধু একটু হেহেহে করে হাসল। তবে একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে ছিল তবে তা আর দ্বিতীয়বার করার সাহস পায় নাই। হিমেলের অবাক হওয়া চেহারাটা দেখে সামনে ফিরে গেছে সাথে সাথেই।

“তুই আর মানুষ হলি না, বন্য বন্যই রইল। থাক চোখ বুজেই থাক।ঘুমা।”
“কবিতা চাই….”
“তুই কর।”
“আমি কেন? তুমি কর। আজতো বেশ ভালোই চলছিলো তোমার !”
“সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে, বুঝলি।”
“মানে? তুমিই কিন্তু প্রথম শুরু করেছিলে, ভুলে গেছো?”
“কি করে ভুলি? ”
“পারলে কি ভুলে যেতে চাইতে?”
“তোর কি মনে হয়?”
“তুমিও স্বার্থপর। বড় স্বার্থপর। ”
“স্বার্থপরের সাথে আসলি কেন?”
“এত কথা বলছো কেন? ফুচকা খাওয়াবা বলছো তা খাওয়াও।”
“মামা সামনেই রাইখেন রিকশাটা” বলে হিমেল মোবাইলটার স্ক্রিনে চোখ দিলো।

লাবন্যের চোখ বন্ধ কিন্তু মোবাইলের ভাইব্রেশনটা ঠিকই টের পাচ্ছিলো বারবার। হিমেল কেন যে কল রিসিভ করছে না তা বুঝতেছে না। এর আগে কখনওই খালামনির কল পেলে এমন করে নাই। আগে রিসিভ করেছে। মনে মনে ভাবলো কারনটা কি একবার জিজ্ঞেস করবে? এরপর আবার মনকে ঘুরালো না জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না।
এরই মধ্যে রিকশা থামল। হিমেল ওকে নামার ইশারা করে নিজেও নামল।

দুই প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে বসতেই লাবন্য চিৎকার করে উঠল
“ও মামা আপনেও আসেন আমাদের সাথে ঝাল টক ফুচকা খাবেন।”

রিকশাওয়ালা এমন প্রস্তাব পাবে তা ভাবতে পারে নাই। তাই কি বলবে তা ভেবে কিছুটা ইতস্তত করতে লাগল। এবার হিমেলও ডাকল
“মামা আসেন, রিকশা সাইডে রাইখ্যাই আসেন।”
“না মামা আপনারা খান, আমি খামু না।”
“কেন মামা এইডা বুঝি আপনের পছন্দ না?”
“না মানে এইডা আমার মাইয়ার বড় পছন্দ। এগুলা আমি তেমন একটা খাই না।”
“তাই নাকি! তো আজকে মেয়ের পছন্দের জিনিসটা আপনেও একটু খাইয়া দেখেন?”
“না মামা, যদি দিতেই চান তয় আমার মাইয়ার লাইগ্যাই দেন ঘরে ফিরা ওরেই দিমুনে।” কথাটা বলে একটা লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে নিজের মাথা চুলকাতে লাগল রিকশাওয়ালা।

লাবন্য চুপ হয়ে গেল। অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
“কি দেখছিস? এমনটাই হয়। ওরা খুব কঠিন, বাবা চরিত্রগুলো এমনই হয়। মেয়েকে খুশি করতে একটু সুযোগও হাতছাড়া করল না। কি নিখাঁদ ভালোবাসা মেয়ের জন্য।”

“আমার আব্বুটা কেন এমন হল না? ”

“খালুজি বাবা হিসাবে একদমই পারফেক্ট। এতে কোন সন্দেহ নাই। তবে তিনি প্রেমিক হিসেবে আমার কাছে পুরাই ফেল। খালামনিকে ভালোবাসছে কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে আগলে রাখতে পারেন নাই। নিজের পরিবারের কাছে বারবার তার ভালোবাসাকে নির্যাতিত হতে দেখেছে কিন্তু নিজে চুপ থেকেছে।শুধু এই একটা দিক আমি তার একটুও পছন্দ করতে পারি নাই। এছাড়া বাবা হিসাবে সেও ভালো।”

“তুমি কীভাবে এসব বলো? তার সবটা অপকর্ম তুমি জানো। মা মরা দুইটা বাচ্চাকে অনিশ্চয়তার সাগরে ডুবিয়ে নিজের নতুন সংসার পাতল……”

“তোকে পেপারটা সাইন করে দিয়ে এসে আমাকে কল দিয়েছিলো সেদিন । যে মানুষটাকে দেখলে মনে হত শক্ত এক পারসোনালিটির মানুষ তিনি , হুট করেই দেখলাম সেই মানুষটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো হিমেল আমার মেয়েটা আমি থাকতেই নিজেকে নিরাপত্তাহীন ভাবছে। ওতো ভেতরে ভেতরে অনিশ্চয়তার সাগরে ডুবে যাচ্ছে। এখন আমি কি করব? ওকে তুমি বলো শুধু ফ্ল্যাট কেন ওকে আমি আমার সব দিয়ে দিব। ওদের বাবা থাকতে ওরা কখনোই অনিরাপদ না। আমার মেয়েটার বড় কষ্ট হচ্ছে, আমি দেখছি, বুঝছি কিন্তু বুকে টেনে নিয়ে বলতে পারছি না মা তোর কোন চিন্তা নাই আমি আছি। আমি আছি। তোর বাপ আছে।”

“কেন পারেনি? কে তাকে বাঁধা দিয়েছিলো? সত্যিকারে তেমনটা মনে করলে কারউ সাধ্য ছিলো না তাকে সেদিন আটকে রাখতে পারতো তার মেয়েকে বুকে নিয়ে একটু আশ্রয় দিতে।”

“তোর চোখেমুখে তখন ছিলো শুধু আতংক আর ভয়ংকর হতাশার আগুন। সে আগুনে তুই তখন সব পুড়িয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলি। খালুজি তেমনটাই বলেছিলেন। সেদিন এক অসহায় বাপ কে দেখেছিলাম যে তার সন্তানদের জন্য পাগল হয়ে ছুটছিলেন শুধু মাত্র তাদের ভালোর জন্য। তুই শুধু জানিস এই ফ্ল্যাটটা তোদের আসলে তার পরের দিন সেই বাপ হিরো থেকে পুরোটাই জিরো হয়ে গিয়েছিলেন শুধু মাত্র সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে।”

“মানে?”

“মানে পরেরদিন ওই এডভোকেটের সাথে কথা বলে তোদের দুইজনের নামে খালুজির যেখানে যত সম্পদ ছিল সব তোদের নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছিলেন। খালুজির শুধু অফিসটাই ছিলো নিজের। বারবার শুধু বলতেছিলেন হিমেলরে এরচেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে। আমি বেঁচে থাকতেও আমার মেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, কি করলাম জীবনে তবে ওদের জন্য?”

“আমি যে তখন কীসের মধ্যে ছিলাম তা শুধু আমিই বুঝি অন্য কেউ তা বুঝবে না। চারপাশে এমন একজন মানুষ পাইনাই যে আমাদের জন্য কোন পজেটিভ কথা বলেছে। সবার মুখে তখন এক কথাই। “মা মরলে বাপ হয় তালোই”। আব্বুরও হাবভাব ছিলো সেরকমই। দাদি ফুপুদের তাবেদারিতে চলতে শুরু করল সে, যখন কি না দরকার ছিলো আমাদের সাপোর্ট হয়ে থাকা।
আম্মু মরে সারে নাই এরই মধ্যে দেখলাম আব্বু বিনা নোটিশে হুট করে বিয়ে করে আসল বাসায়। এমনটাই আভাস দিচ্ছিলো চারপাশের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। মিলে গেল তাদের ভবিষ্যদ্বানী। তাদের কথা মতে এমনটাই হয়। তারা এমনসব গল্প করেছিল যেখানে মুলকথা ছিল এমন যে আব্বুর বিয়ের পর আমার আর রুশের ঠিকানা হবে রাস্তায়। নানিবাড়ির সাথে তেমন কোন যোগাযোগ নাই আমাদের, দাদি ফুপুরা হল বড় শত্রু।কেউ নাই আশ্রয় দেওয়ার। তুমিও নাই। আমি তখন যা মাথায় আসছে তাই করেছি। রুশ আর আমি রাস্তায় ঘুরছি একেক জনের দ্বারে দ্বারে দয়া প্রার্থনা করছি এমন জীবন ভাবতেও ভয় পাচ্ছিলাম।”

” আমি তোর আর তোর বাবার মাঝখানে আসতে চাইনি। সবসময় চেয়েছি তোর পাশে থাকতে।বাদ দে যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আবার সব কিছু আগের মতো হয়ে ওঠুক তেমনটাই কাম্য।”

“কীভাবে সম্ভব, আম্মু কী আর ফিরবে আমাদের জীবনে?”
“যে যায় সেতো না ফেরার জন্যই যায়। কিন্তু যা আছে তা গুছিয়ে নিয়ে চলটাই জীবন। তোর যে এমন একজন মাতামহ আছেন তা কি বুঝতে পেরেছিলি? ধরে নে আল্লাহ সেই সুবাদে তোকে এই পর্ব দান করেছেন।”

“মানে? মাতামহ কি?”
“হা হা হা নানুমনি”

” ওওও, এই তোমার মোবাইলটা কখন থেকে বেজে চলছে রিসিভ করছো না কেন?”

” নিজের ভালোবাসাকে সারাজীবন বুকের মধ্যে আগলে রাখতে ।”
“মানে?”
“সবকিছুর এত মানে বুঝতে চাস কেন?”
“খালামনিকে কষ্ট দিও না। মা বড় অমূল্য সম্পদ। যার নাই শুধু সেই বোঝে।”

“আমি কোনোদিনও আম্মুকে কষ্ট দিতে চাই না। বড়পু যা করল এর পর ইচ্ছে করলেই আমি অন্যভাবে হলেও মনের জিদ পূরণ করতে হলেও আমেরিকায় যেতে পারতাম গিয়ে তাদেরকে দেখাতে পারতাম তারা ছাড়াও মানুষ আমেরিকায় যায়। ওখানে যেতে কারও ননদ বিয়ে করতে হয় না। কিন্তু আমি আম্মুর জন্যই যাইনি। কিন্তু তাই বলে আম্মুর যেকোন আবদার মেনে নিব তাও তো ঠিক না। আম্মুকেও আমার ভালোবাসার কদর করতে হবে। বাদ দে এসব কথা। ভাললাগছে না এসব নিয়ে কথা বলতে।”

“তোমার চাকরি করাটা আমার পছন্দ হয় নাই। তুমি আরও পড়তে চেয়েছিলে!”
“এই মুহুর্তে চাকরিটার বড় দরকার ছিলো।”
“আর তোমার স্বপ্ন? ”
“এখনতো শুধু একটাই স্বপ্ন দেখি, প্রতিসকালে তোর হাতের এককাপ চা আমার সামনে, ধোঁয়া উড়ছে আর তুই…… । ”

“মানে? তুমি কিন্তু সবসময় আনফেয়ার স্বপ্ন দেখো? আগে দেখতা আমাকে রেখে তুমি তোমার বই নিয়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছো। এখন দেখছো তুমি আরাম করছো আর আমি চা বানিয়ে বানিয়ে জীবন শেষ করছি।”

“যাহ তোর চা আর লাগবে না আমার। চা ছাড়াই বাসা থেকে বের হব। এত মেজাজ দেখতে পারব না এক কাপ চায়ের জন্য। ”

“হুমম সবই বুঝি এই বাহানায় যদি কোন কলিগের সাথে বাহিরে বসে বৌয়ের বদনাম ভিজিয়ে ভিজিয়ে এককাপ গরম চায়ে চুমুক দেওয়া যায়। তাই না?”

“হুমম তাইতো! ভাববি যখন তখন আরও ভাব যদি কলিগটা হয় কোন মায়াবতী রমনী তবেতো বেশ জমবে। একটু পর পর বলবে –আহা! হিমেল কেন সহ্য করছো এই রাক্ষসীর অত্যাচার যে কি না তোমাকে এক কাপ চা এই সকালে করে দিতে পারে না।”

“কি আমি রাক্ষসী? এমন কথা যে বলবে তুমি তার সাথে বসে চা খাবে? তবে আর আজ এখানে এলাম কেন? এই শাড়ি দিলা কেন? আজকে তোমার……”

“আস্তে আস্তে! বাকি ঝগড়াটুকু আগামীর জন্য অবশিষ্ট রাখ। সব আজই শেষ করলে পরে কম পড়বেতো।”

হিমেলের কথা শুনে এবার লাবন্য হোহোহো করে হেসে উঠল। একটু পর ওর সাথে হিমেলও হাসতে শুরু করল।

“হয়েছে এবার চলো উঠি। আমাকে বাসায় দিয়ে তোমাকেতো আবার ফিরতে হবে। খালামনি দিবেতো বাসায় ঢুকতে? আমাদের বাসায় কিন্তু থাকতে পারবে না, তা আগেই বলে রাখছি।”

“চল পালিয়ে যাই। রোজ রোজ তোর স্বপ্নগুলো ঘুমাতে দেয় না। চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা সরি বন্য….”

“আবার আরেক রেশমার জীবন! খালামনি তখন আমার মৃত মা’কে শান্তি দিবে ভাবছো? কখনো এমনটা হবে না। পালিয়ে বিয়ে আমি কোনোদিনও করব না। অনন্তকাল তোমার জন্য অপেক্ষা করতে বলো, আমি তাও পারব।”

“বিশ্বাস রাখ সব তোর চাওয়া মতোই হবে। তবে চা কিন্তু তোকেই বানিয়ে দিতে হবে বলে রাখলাম।”

লাবন্য আর উত্তর দিলো না শুধু একটু হাসল।

রিকশা এগিয়ে যেতে লাগল চেনা পথ ধরে। চারপাশ স্তব্ধ রাস্তায় লোকসংখ্যা কম। হিমেল টুকটাক কথা বলছে রিকশাওয়ালার সাথে কিন্তু লাবন্যের আজ সেদিকে কোন খেয়াল নাই।ওর মন আর মনন জুড়ে তখন চলতে শুরু করেছে হিমেলের দেখা স্বপ্নে গুলোর মহড়া। রঙিন রঙিন স্বপ্নতে ডুবতে থাকল একটু একটু করে লাবন্য ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here