মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-২৭

0
2224

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৭]

মাহবুবাকে দেখে সেদিন প্রথমবার বাবার দিকে রাগ অভিমান আর ঘৃনার দৃষ্টি তাকিয়ে ছিলো নওশাদ। যে বাবা সবসময় তার অজান্তেই তাকে পছন্দের সব জিনিসপাতি দিয়েছে আজ সে কিনা একটা কালো মেয়ের সাথে তার জিবন জুড়ে দিলো। একটা সুন্দর যুবতীর পাশে কালো ছেলে থাকলে মানুষ যতটা না অবাক হয় তার চেয়ে বেশী অবাক হয় একটা সুদর্শন যুবকের পাশে কোন কালো মেয়েকে দেখলে। নওশাদ এখন এই কালো বউকে নিয়ে সমাজে মানুষের পাশে দাঁড়াবে কি করে! সবাই যে তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করবে। না, নওশাদ পারবেনা কারো হাসির পাত্র হতে। মাহবুবাকে গেটের সামনে রেখে সে হনহন করে ভিতরে প্রবেশ করে। কিছুটা অসহায় মুখ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার ক্রোধান্বিত হয়ে মাহবুবার দিকে তাকায় সে। তারপর বলে,

– এই কয়লার ড্রাম যেন কিছুতেই ভিতরে প্রবেশ না করে। একে আমি আমার বউ হিসাবে মানি না।

নতুন শ্বশুর বাড়িতে পা রাখার সময় সব মেয়ের মনেই একটা স্বপ্ন থাকে। থাকে প্রিয়জনকে ঘিরে হাজারো স্বপ্ন। সেদিন নওশাদের কথা শুনে নিমিষেই মাহবুবার সব স্বপ্ন ভেঙে চুড়মার হয়ে যায়। ছলছল দৃষ্টিতে সে নওশাদের দিকে তাকায়। নওশাদের দৃষ্টি তখন স্থির তার বাবার দিকে। তাই সে মাহবুবার চোখের পানি দেখতে পায়নি। নওশাদের কথার সাথে তার মা ও বোনরা সকলে সায় দেয়। যখনি মাহবুবাকে তাদের বাড়ি থেকে বিদায় করবে ঠিক তখন রুখে দাঁড়ায় নওশাদের বাবা। নওশাদের বাবার এক কথা, এটা তার বাড়ি। এ বাড়িতে মাহবুবা থাকবে।এতে কারো অসুবিধা হলে সে বাড়ি থেকে চলে যেতে পারে।

সেদিন প্রথমবার বাবার মুখের উপর কথা বলে নওশাদ। সে রেখে গিয়ে বলে উঠে,

– তুমি আমার বাবা! নাকি ওই মেয়েটার?

– দুইজনের-ই। মৃদু হেসে জবাব দে নওশাদের বাবা। নওশাদ তুমি বলেছিলে আমি সবসময় তোমার জন্যে সেরাটাই বেছে নিবো। এবারও নিয়েছি। একটু সময় দেও একদিন এই কালো মেয়েটার জন্যে তোমার মুখ উজ্জল হয়ে উঠবে।

নওশাদ সেদিন স্মিত হেসে তার বাবার কথার প্রতিউত্তরে বলেছিলে,

– এই মেয়েটা উজ্জল করবে আমার মুখ! যার মুখ দেখতে গেলেই হাজারখানা লাইটের প্রয়োজন হবে।

অপমানে সেদিন মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো মাহবুবা। নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু নিরবে চোখের জল ফেলছিল মাহবুবা। তার বাবা তাকে এ কোথায় বিয়ে দিলো, এখানে তো সবাই সুন্দরের পূজারী। তার যে একটা ভালো মন আছে, সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখার একটা মন আছে সেটা কেউই দেখতে পারছে না। সবাই শুধু বাহিরের সুন্দরর্যটাই দেখছে। এ জন্যেই বোধহয় বলে, আগে দর্শনদারী পরে গুণবিচারী।

নওশাদের বাবা মাহবুবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

– কাঁদছিস কেন! আমি আছি তো। আমি তো আরেকটা বাবা। যে তোকে তোর সম্মান ফিরিয়ে দিবে।

বাবার কথায় মৃদু হেসেছিলো মাহবুবা। হয়তো সে তার আরেকটা বাবাই ছিলো।তারপর মাহবুবা সে বাড়িতেই থাকতে শুরু করে নওশাদের সাথে নওশাদের রুমে শুধু জায়গা পায়নি নওশাদের পাশে। কনকনে শীতে ফ্লোরে ঘুমিয়ে থাকতো মাহবুবা। কখনো কখনো নওশাদ রেগে গেলে তার উপর দিতো পানি ঢেলে। তীব্র গরমে বাহিরে শুয়ে থাকতো। মশা তার শরীরের অর্ধেক রক্ত খেয়ে নিতো। সে না পেতে কয়েল আর না পেতো এরোসল। খাবার সময় সবাই যখন টেবিলে বসে খেত তখন মাহবুবা রান্নাঘরের এক কোনে বসে খেত। নওশাদের বাবা যখন বাড়িতে থাকে তখন সে বাড়ির বউয়ের মর্যাদা পেত অন্যসময় তাকে কাজের লোকের মতো ব্যবহার করা হতো। কাজের কারনে বেশীর ভাগ সময়ই বাড়ির বাহিরে কাটাতো নওশাদের বাবা। মাহবুবা কারো কাছে কোন অভিযোগ করতো না। মুখ বুজে সব সহ্য করে নিতো। এভাবেই চলতে থাকে সময়। নওশাদের মা একদিন হঠাৎ করেই তার স্বামিকে জিগ্যেস করে,

– আমার এমন হিরের টুকরো ছেলেকে ওই কালো মেয়ের সাথে কেন বিয়ে দিলেন আপনি? এমন তো নয় যে আমাদের সংসারে অভাব অনটন, আর আপনি সেই অভাব ঘুচাতে একটা কালো মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। কি নাই আমাদের, বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা কিসের অভাব আমাদের। যেখানে একটা মডেল থেকে শুরু করে সব সুন্দরী মেয়েরা আমার ছেলেকে একবার দর্শনে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।

স্ত্রীর এমন অভিমানী সূরে মৃদু হাসে নওশাদের বাবা। তারপর তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মৌনতা গ্রাস করে তার মাঝে। কিছুক্ষণ পর মৌনতা ভেঙে সে বলতে থাকে,

– বাড়ি গাড়ি অর্থ সম্পৎ প্রপার্টি নাম জশ খ্যাতি এর কোন কিছুই আমার না। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার কথা শুনে অবাকে চরম শিখরে পৌঁছে যায় নওশাদের মা। তিনি আবার বলেন, এগুলো যদি কারো হয়ে থাকে তাহলে সেটা মাহবুবার বাবা। হ্যাঁ গিন্নী, আমি যা বলছি এসব সত্যি। সেদিন যদি মাহবুবার বাবা এসে আমার পাশে না দাঁড়াতো তাহলে হয়তো আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতাম না। গরীব চাষার ছেলের ছিলাম আমি। মানিকের বাবার ছিলো অঢেল সম্পত্তি আর আমার বাবা ওদের জমিতে চাষাবাদ করতো। মানিক আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। দুজনেই পড়াশুনায় ভালো ছিলাম। সেদিনের কথা আমার আজও মনে আছে। চারশত টাকার জন্যে আমার পরিক্ষা আটকে গিয়েছিলো। যে পরিক্ষা না দিতে পারলে আজ হয়তো আমি এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতাম না। জানো সেদিন মানিক নিজের জমানো টাকাগুলো আমায় দিয়েছিল আর আমি সে টাকা ফি দিয়ে পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করি। পরে অবশ্য আমি টাকাগুলো ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু সময়মত তো আমি টাকা যোগাড় করতে পারিনি। একেই হয়তো বলে সুসময়ের বন্ধু।তারপর শহরের বড় কলেজে ভর্তি হয়ে শহরে চলে আসি। স্কলারশিপের টাকা দিয়েই পড়াশুনার খরচ চলতো। শহরের আসার দুই বছর পর বাবা মারা যায় তারপর আমি আমার মাকে নিয়ে শহরে চলে আসি। তখন আমার উপরে পড়ে সংসারের ভাড়। পড়াশুনার পাশাপাশি দু-চারটা টিউশানি করেই সংসারের খরচ চালাতাম আর আমার মা শেলাই কাজ করতো। ব্যাস্ত হয়ে পরি শহরে জিবন চালাতে আর পড়াশুনা নিয়ে। গ্রামের কথা ভুলে যাই। পড়াশুনা শেষে যখন একটা চাকরি পাই তখনি গ্রামে যাই মানিকের সাথে দেখা করতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে মানিকের দেখা মেলে নি। কারন বছর তিনেক আগে নদী ভাঙনে মানিকরা ভিটামাটি হাড়ায়। মানিকের বাবা ওদের নিয়ে নাকি শহরে চলে আসে। ফিরে এসে শহরের অলিতে গলিতে খুঁজেছি মানিককে কিন্তু ওর দেখা মেলেনি। তারপর শুরু হয় আমার বিজনেস! বিজনেস নিয়ে এতটাই মত্ত ছিলাম ভুলেই গিয়েছিলাম মানিকের কথা। তারপর বিয়ে, বউ বাচ্চাদের নিয়ে সুখের সংসার সাজাই। ততদিনে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম মানিকের কথা। মানিক নামের কেউ আমার বন্ধু ছিলো সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন আমার নিজের একটা কোম্পানি আছে। সেখানে হাজার হাজার লেবার দিয়ে কাজ করাই আমি। মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী করেছি আমি। যেখানে কর্মহীন লোকেরা এসে কর্ম যোগাড় করে। এইতো সেদিনের কথা,
মিটিং শেষ করে মাত্র আমার কেবিনে এসে বসে বিশ্রাম করছি তখনি এক পিয়ন এসে বলল,

– স্যার একটা লোক কাজের সন্ধানে এখানে এসেছে। সেই সকাল থেকে বসে বসে অপেক্ষা করছে। আমি তাকে অনেকবার বলেছি এখানে কোন কাজ নেই তবুও সে বসে আছে।

পিয়নের কথায় লোকটাকে দেখার খুব ইচ্ছে হয়। আমি পিয়নকে বলি তাকে ভিতরে নিয়ে আসতে। পিয়ন তাকে ভিতরে নিয়ে আসে। তাকে দেখার পরে আমার চোখ কপালে উঠে যায় কারন সেটা আর কেউ না সেটা ছিলো মানিক। মাথার চুলে পাক ধরেছে শরীরের চমড়া কুঁচকে গেছে। ওকে দেখে খুব অবাক হই আমি। তারপর ওকে আমার পরিচয় দেই। কারন মানিক আমাকে চিনতে পারেনি। আমি মানিককে কোম্পানির ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করে চাইলে সে অস্বীকার করে কারন ওর সেই যোগ্যতা নাই। তাই সে বাকিদের মতো একজন সাধারন কর্মচারী হিসাবে আমা কোম্পানিতে কাজ করে।

মানিক কাজের মধ্যে কিছু নিয়ে ভাবতো। সবসময়ই সে ভাবতো। তাই একদিন সুযোগ বুঝে আমি ওর কাছে ওর ভাবনার কারন জানতে চাই। আর তখনি শুনি মাহবুবার কথা। মেয়েটা কালো ভিষন কালো। পাত্রপক্ষ বারবার এসে ওকে দেখে চলে যায়। কালো মেয়েকে কি আর কেউ ঘরের বউ করবে। এদিকে মানিকের ছেলে ছেলের বউরা মাহবুবাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্যে উঠে পরে লেগেছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই মাহবুবাকে ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্যে। পাত্রপক্ষ নিয়ে ওদের বাড়িতেও যাই। মাহবুবাকে দেখা মাত্রই আমি অবাক হয়। কারন এটাই সেই মেয়ে যে একদিন আমার আর তোমার ছেলের প্রান বাঁচিয়েছে। আমাকে রক্ত দিয়েছে। রওনাক মাহবুবাকে না চিনলেও আমি ঠিক চিনেছি। আচ্ছা তুমিই বলো যার বাবার মন এত উধার তার মেয়ে ভালো হবো এটাই স্বাভাবিক। আমি আমার মত পাল্টে ফেলি। মাহবুবাকে আমার ঘরে নিয়ে আসার প্ল্যান করি রওনাক তো বিয়ে করে ফেলেছে তাই নওশাদের সাথে মাহবুবার বিয়ে দেই।

স্বামির কথা শুনে সেদিন মন গলেছিল নওশাদের মায়ের। সে মেনে নিয়েছিলো মাহবুবাকে।

বিয়ের একবছর পর হঠাৎ করেই আফিয়ার সাথে দেখা হয় নওশাদের। শপিংমলে একটা দোকানে সেলম্যনের কাজ করতো সে। সেদিন আফিয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পরপর দেখা হওয়ার কারনে আবার ওদের মাঝে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। ততদিনে মাহবুবাকে ছুঁয়েও দেখেনি নওশাদ। তাই হয়তো আফিয়ার সাথে তার াসম্পর্কটা খুব তাড়াতাড়ি গটে। দিন দিন যায় তাদের সম্পর্কটা আরো। হঠাৎ করেই শুনতে পারে মাহবুবা সন্তান সম্ভবা। অনেক খুশি হয় নওশাদের বাবা। ঘটনাটা নওশাদ প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে মেনে নেয়।

আফিয়ার সাথে নওশাদের রিলেশন শুরু হয়। হঠাৎ একদিন আফিয়া নওশাদকে বিয়ে কথা জানায়। সেদিন নওশাদ মাথা নিচু করে কোন জবাব না দিয়েই চলে আসে। কি বলবে সে আফিয়াকে তার একটা বউ আছে সে সন্তান সম্ভাবনা।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here