মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৩২

0
2175

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩১]

দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানার উপর বসে আছে রাহি। ওর পাশেই বসে আলিহান অধোর কামড়াচ্ছে আর চোখ মিটমিট করছে। ওর ভাবতেই অবাক লাগছে আফিয়া আহমেদ এমন একটা কাজ করেছে। আর সৈয়দ নওশাদ সবটা জেনেও তাকে এ বাড়িতে তাকতে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে লিগালি কোন একশন নিচ্ছে না। আফিয়া আহমেদ যা করেছে তার জন্যে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ। অথচ সৈয়দ নওশাদ সব জেনেও চুপ করে আছে। এই তার পিতৃত্ব। আলিহান কি করে মেহেরের সামনে সত্যিটা তুলে ধরবে। মেহের যদি সবটা জানতে পারে তাহলে কষ্ট পাবে অনেক। তার থেকেও বেশী কষ্ট পাবে তার ছোটমনি। যে অতীত কে ছেড়ে চলে এসেছে সেই অতীত যদি আবার বর্তমান হয়ে আসে তাহলে যেন অতীতের সেই শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা আবার তাজা হয়ে উঠে। সৈয়দা মাহবুবা অনেক কষ্ট করে এতদূর এসেছে। একা পরিশ্রম করে মেহেরকে বড় করে তুলেছে। অনেক কষ্টে সে তার অতীত ভূলে বর্তমানে একটা সুন্দর জিবন পেয়েছে। মেহের আর মৌ-এর মতো দুটো মেয়ে আছে। তাদের একসাথে দেখলে মনে হয় এটা যেন স্বর্গের দ্বীপ। সেখানে আছে সুখ আনন্দ হাসি। আলিহান চায়না সৈয়দা মাহবুবার এই সুখের স্বর্গে নওশাদের মতো হৃদকালো মানুষের নজর না পরে। মেহের ও তার ছোটমনির উপর যেন সৈয়দ নওশাদের কোন ছায়াও না পরে। তাই সে পারবে না, না আলিহান পরবে না তার ছোটমনিকে আবার কষ্ট দিতে। কাপাকাপা হাতে রাহির মাথায় হাত রাখে আলিহান। রাহি মাথা তুলে সামনের দিকে তাকায়। রাহির চোখ দেখে আতকে উঠে আলিহান। কেমন ভিতী চোখ তার। এই চোখে আছে শুধু অনুতাপের ছোয়া। আলিহান রাহিকে তার বুকে জড়িয়ে নেয়। রাহি আলিহানের শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,

– আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চল ভাইয়া। আমি এই অমানুষগুলোর সাথে আর থাকতে চাই না।

আলিহান রাহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর উপরের দিকে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস ত্যাগ করছে। রাহি আবারও বলে উঠে,

– আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চল ভাইয়া।

আলিহানের হাত থেমে যায় এই ভেবে যে আজ প্রথমবার রাহি তার কাছে কিছু চাইছে আর সেটা আলিহান তাকে দিতে পারবে না। আলিহান যতই দূরেই থাকুক, যতই যে তার চাচার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করুক না কেন? এতে তো আর সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না। রাহি যে ওর বোন। আর বোনের আবদার পূরণ করতে না পারার কষ্ট শুধু একজন ব্যার্থ ভাই-ই জানে। আলিহান রাহিকে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে ওর এক হাত নিজের হাতের মুষ্ঠিতে আবদ্ধ করে নেয়। তারপর সে রাহির মুখের দিকে তাকায়। রাহির তখনো নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আলিহান রাহির হাতটা আরো শক্তকরে চেপে ধরে বলে,

– আমার দিকে তাকা। আমার চোখের দিকে তাকা রাহি।

রাহি মাথা তুলে আলিহানের চোখের দিকে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অতঃপর আলিহান বলে উঠে,

– এ বাড়ি ছেড়ে তুই কোথায় যাবি পাগলী। এ বাড়ি তোর। তুই এই বাড়ির রাজকন্যা। তুই চলে গেলে যে এই বাড়ির প্রাণটাও চলে যাবে রে রাহি।

– কিন্তু আমি ওই মানুষগুলোর সাথে এ বাড়িতে থাকতে পারবো না ভাইয়া। ওরা কেউই মানুষ নয়। ওরা দেখতে মানুষের মতো ঠিক-ই কিন্তু ওরা আসলে জন্তু জানোয়ার। না-হলে মেহের আপুর মতো এমন ফুটফুটে সুন্দর মেয়েকে মেরে ফেলার কথা ভাবতে পারতো না। কান্নামিশ্রত কন্ঠ রাহির।

– আমি তোর কষ্টটা ফিল করতে পারছি রাহি। কারন আমিও একদিন এই পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি। সেদিন আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছি কিন্তু তুই যাবি না। দেখ ছোট চাচা তোকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। তোর সব কথাই সে শুনে। একমাত্র তুই-ই পারিস ওদের সঠিক পথে আনতে। ওদের সব ভুল শুধরে দিতে পারিস। দেখ তুই ওদের সন্তান। তোকে ছোট থেকে বড় করেছে তারা। তোর কথা নিশ্চয় শুনবে। একটা সন্তান হিসাবে এটা তোর দায়িত্বের মধ্যে পরে। ইসলাম যেমন পিতামাতার সব কথা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে তেমনি পিতামাতা যদি কোন পাপ কাজ করতে বলে সেটা অমান্য করার ও নির্দেশ দিয়েছে। তবে সেটা তাদের কষ্ট দিয়ে নয়। বরং তাদের সাথে সদ্যব্যবহার করে। এটাও আল্লার নির্দেশ,

-বাবা এবং মা কাফের-অবিশ্বাসী, গুনাহগার বা পাপাচার যা-ই হোক না কেন কখনো সুসম্পর্ক নষ্ট বা ছিন্ন করা যাবে না। সন্তানের জন্য বাবা-মার সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট করা বা ছিন্ন করা বৈধ নয়। তবে তাদের কথায় বা নির্দেশে ইসলামি শরিয়তের বিরোধী কোনো কাজ করা যাবে না। কোনো কাজে আমল করা যাবে না। তাদের গুনাহের কাজের অনুসরণ ও অনুকরণ করা যাবে না।
ইসলামি শরিয়তের বিপরীতে তাদের অনুসরণ এবং অনুকরণ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি তাদের কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাদের সঙ্গে ভালো ও উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। বাবা-মা অন্যায় কাজে জড়িত থাকলেও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে নরম ও কোমল আচরণ অব্যাহত রাখতে হবে। দুটি বিষয়ই খুব সতর্কতার সঙ্গে ম্যানেজ করতে হবে। এবার তুই কি করবি সেটা একান্তই তোর ইচ্ছে তাদের বুঝিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করবি নাকি তুই ও তাদের মতো অন্যায় করবি।

ভালো শ্রোতার মতো গভীর মনোযোগ দিয়ে আলিহানের কথা শুনছিলো রাহি। সব শুনে সে নাক টেনে বলে,

– আমি চেষ্টা করবো। কিন্তু তাতেও যদি তারা নিজেকে না শুধরে নেয় তাহলে আমি তাদের শাস্তি দিবো। কঠিন শাস্তুি।

– এই তো লক্ষি বোন আমার। বলেই রাহিকে জড়িয়ে ধরে আলিহান। আর তখনি রুমে প্রবেশ করে আফিয়া আহমেদ। ওদের দুজনকে এক সাথে হাসতে দেখে আফিয়ার মুখ বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। সে এখানে এসেছিল আলিহানকে ডাকতে। সৈয়দ নওশাদ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। এখানে এসে দুজনের মাধ্যে এত ভাব দেখবে সেটা ভাবতে পারেনি আফিয়া আহমেদ। আফিয়া আহমেদকে দেখে আলিহান রাহিকে ছেয়ে একটু নড়েচড়ে বসে। আফিয়া আহমেদ আড় চোখে একবার রাহির দিকে তাকিয়ে থেকে আলিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– তুমি আবার কোন মন্ত্র দিলে আমার মেয়েটাকে। দেখ আলিহান আমার মেয়েকে আমার বিরুদ্ধে উসকানোর চেষ্টা করবে না। না হলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। বলে দিলাম।

আফিয়া আহমেদের কথা শুনে স্মিত হাসে আলিহান। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে নাক চুলকিয়ে বলে উঠে,

– একদম সিরিয়ালের মায়েদের মতো কথা বলছেন আপনি। বলছি যে সিরিয়াল একটু কমকম দেখবেন। আচ্ছা একটা বলুন, ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখে দেখেই শিখেছেন! কি করে সতিনের সন্তানকে মারতে হয় তাইতো।

আলিহানের কথাশুনে শুকনো ডুকগিলে আফিয়া আহমেদ।

– মানে কি- কি বলতে চাইছো কি তুমি?

– নাথিং। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে আলিহান। রাহির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,

– আমি আসছি বোন। নিজের খেয়াল রাখিস।

রাহির মৃদি হেসে আলিহানকে বিদায় জানায়। অতঃপর প্রস্থান করে আলিহান।

৪১,
বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে মেহের। ওর পাশেই বসে মৌ গুনগুনিয়ে গান গাইছে। ওর থেকে কিছুটা দূরে টেবিলের কাছে বসে আছে রাহনাফ। রাহনাফ বসে বসে কিছু আঁকছে আর একটু পরপর আড় চোখে মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে। মেহের ব্যপারটা লক্ষ করলেও কিছু বলছে। এতে ওর অনেক ভালো লাগছে। মৌ মোবাইল নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিক কি হচ্চে না হচ্চে সেটা খেয়াল নেই তার। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ হাতে ইয়া বড় একটা ছবি নিয়ে মেহেরের সামনে দাঁড়ায়। ছবিটা দেখেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহের। এত বড় একটা ছবি একেছে রাহনাফ তাও সেটা মেহেরের। খুশিতে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে মেহের। রাহনাফ এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে এটা জানতো না মেহের। নিচের ঠোঁটে ঝুলান্ত মৃদু হাসি দেওয়া আছে ছবিটায়। গভীর ভাবে না দেখলে কেউ এই হাসিটা দেখতে পারবে না। ছবির নিচে থাকা ক্যাপশন টা দেখে আরো অবাক হয় মেহের। হাতের লেখাগুলো দেখলে মনে হবে যেন কম্পিউটারে টাইপিং করছে। ইতালিয়ান অক্ষরে লেখা আছে,

– আমার দিনের উজ্জ্বলতা রোদের উপর নির্ভর করে না বরং তোমার হাসির উপর নির্ভর করে, লেখিকা সাহেবা।

চলবে,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here