#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩৫]
মেহের আজ অনেক খুশি। তার মা নিজে তাদের বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে খুশি না হয়ে পারা যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সে ভুলে গেছে রাহনাফকে পুরো ঘটনাটা বলতে। তখন রাহনাফকে সে বলতে চাইছিলো কিন্তু পরক্ষনে মনে পরে, রাহনাফ তো বিকালে তাদের বাড়িতে আসবেই তখন না হয় বলা যাবে। তার কাছেও সারপ্রাইজ হবে ব্যাপারটা। দারুন হবে সব মিলিয়ে। খুশি মনে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। কাঁধে থাকা ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছে সে। মাথার দু-পাশে দুটি বেনুনী করে দু কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। রাহনাফের কথা ভাবছে। তাদের বিয়ে হবে ছোট্ট একটা সংসার হবে। আর তাদের কোল আলে করে একটা পরী আসবে। ভাবতেই লজ্জা লাগছে তার। হেলেদুলে যাচ্ছে আর লজ্জা মাখা হাসি দিচ্ছে। তখনি তাকে পাশ কাটিয়ে একটা বড় গাড়ি চলে যায়। কাল রাতে ঝড় বৃষ্টি হওয়ার কারনে রাস্তায় কিছুটা পানি জমে আছে। গাড়িটা যখন মেহেরকে ক্রশ করে তখন রাস্তায় জমে থাকা কিছুটা পানি মেহেরের গায়ে এসে লাগে। ভাবনায় ছেদ ঘটে মেহেরের। রাগে মেহের গাড়ির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মুখ দিয়ে অশ্রাব্য ভাষার গালি বের করতে গিয়েও করে না সে। দমে যায়। দাত কটমট করে নাক ফুলিয়ে বড় বড় করে শ্বাস নেয় কয়েকবার। ততক্ষণ গাড়িটা তার দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। রাগে হাত মুঠি করে নেয় মেহের। এত আনন্দ সহিত বাড়ি থেকে বের হয়েছিল সে অথচ তার আনন্দটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। আবার বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে। ভাগ্যিস বাড়ি থেকে বেশীদূর আসে নি এখনো সে। বাসায় ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করে কলেজে চলে যায় মেহের।
কলেজে পৌঁছাতেই সবাই মেহেরকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। কিছুদিন আগে মেহের এই কলেজের হয়েই ডিবেট প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়েছে। তারপর আজ কলেজে আসা হয়নি মেহেরের। সেদিনের পর আজই এল সে কলেজে। তবে এই কয়দিনের মাঝে কলেজে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। মেহেরের প্রিয় স্যার যার কিনা বদলি হয়েছে অন্য একটা কলেজে আর তার পরিবর্তে এই কলেজে জয়েন করেছে অন্য আরেকজন স্যার যেটা মেহেরের অজানা। রাজনৈতিক তত্ব পরিচিতি ক্লাসে মেহেন যখন তার প্রিয় স্যারের পরিবর্তে একটা ইয়াং স্মার্ট সুদর্শন যুবককে দেখতে পায় তখন কিছু সময়ের জন্যে সে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। চক্ষুদ্বয় বড় বড় রসোগোল্লার মতো করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পাশ থেকে মেহেরের এক সহপাঠী মেহের কাঁধে চাপট মেরে বলে,
– এভাবে হা করে কি দেখছিস মেহু। মনে ধরেছে নাকি স্যারকে।
– স্যার। অবাক কন্ঠ মেহেরের। এটা আমাদের স্যার??
– হ্যাঁ, এনি আমাদের নতুন স্যার। কদিন আগেই জয়েন হয়েছে।
– একে দেখে কোন এঙ্গেল থেকে স্যারের মত লাগে। বিড়বিড় করে বলে মেহের।
– তাহলে কিসের মত লাগে, বয়ফেন্ড। সবাই তো স্যারের উপর ক্রাশ খাচ্ছে তুইও কি তাই??
মেহের তার সহপাঠীর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। যার ফলে সে চুপ হয়ে যায়। তারপর যখন সে কলেজের নতুন স্যারের দিকে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তখন স্যারের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয়। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেলে মেহের। নতুর স্যার তার দৃষ্টি নামিয়ে আবার পড়ায় মন দেয়।
সেদিন বিকালে রাহনাফ মেহেরদের বাসায় আসে না। কোচিং এ কাজের চাপ থাকায় বের হতে পারে না। অবশ্য এই নিয়ে সৈয়দা মাহবুবার কোন অভিযোগ নেই। সে জানে একা বাচতে গেলে একটা মানুষকে কত কিছু সামলে সামনে এগোতে হয়। রাহনাফের মত ছেলে হাজারে একটা পাওয়া যায়। ওর দিকটাও তো সবাইকে বুঝতে হবে। পরের দিন যখন রাহনাফ মেহেরদের বাসায় আসে তখনি সৈয়দা মাহবুবা তাকে মেহের আর তার বিয়ের কথা বলে। বিয়ের কথা শুনে প্রথমে রাহনাফের মুখ উজ্জল হলেও পরে সেটা আর দেখা যায় না। কিছু একটা ভেবে উঠে দাঁড়ায় সে। সৈয়দা মাহবুবা মেহের আর মৌ সকলে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে, যদিও সবাই জানে রাহনাফের উত্তর হবে হ্যাঁ। তবুও আরো একবার তার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছে। রাহনাফ সৈয়দা মাহবুবার সামনে গিয়ে হাটু গেরে বসে পরে। অতঃপর বলে,
– ছোট বেলায় বাবাকে হাড়িয়েছি তারপর মা। মা থেকেও মা নেই আমার। বাড়ি গাড়ি পরিবার সব থেকেও এতিম খানায় মানুষ আমি তবুও আমার কোন অভিযোগ নেই। জিবনের সাথে যুদ্ধ করে বড় হয়েছি আমি। আপনিও তো জিবন সংগ্রাম করে মেহের কে জন্ম দিয়েছেন ওকে লালন পালন করেছেন। আপনি নিশ্চয় বুঝবেন। আন্টি আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। আপনি রাখবেন,,,,
সবাই রাহনাফের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। মেহেরের চোখে যেন আজ পলক পরছে না। তার মনের মাঝে অজানা এক ভয় কাজ করছে। রাহনাফ কি পিছিয়ে যাবে। সে কি মেহেরকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। সৈয়দা মাহবুবা রাহনাফ হাত নিজের হাতের মুষ্ঠিতে আবদ্ধ করে নিয়ে বলে,
– কি বলতে চাও তুমি!! নিঃসংকোচে বলতে পারো ৃ
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাহনাফ। অতঃপর বলে,
– আমি এখন বিয়েটা করতে পারবো না আন্টি। মাথা নিচু করে ফেলে রাহনাফ। সবাই তার দিকে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মেহেরের চোখের কোটরে অশ্রুর ভীড় জমে গেছে। ঠোট কাঁপছে। রাহনাফ মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেহের ছলছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাহনাফ মেহেরের এমন দৃষ্টি নিতে পারে না বেশীক্ষণ। সে তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাকে একটু সময় দিন আন্টি। আমার এখনো অনেক কাজ বাকী আছে। জীবন থেকে যা যা হাড়িয়েছি তার হিসাব বাকি আছে। মায়ের অধীকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি তাই বলে নিজের অধীকার ছেড়ে দিব না। হ্যাঁ আমার এই জার্ণিটা একটু কঠিন। সব কিছু ঠিকঠাক হলে এলে না হয় আমাদের বিয়েটা দিয়ে দিন। ততদিন নাহয় মেহেরকে আপনার কাছে রেখে দিন আমার আমানত হিসাবে। এতদিন তো মেহেরকে নিজের মেয়ে হিসাবে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছেন। এখন না হয় আমার আমানত হিসাবে ওকে দেখে রাখবেন। যতদিন না আমরা বিয়ে করছি ততদিন।
– কিন্তু কতদিন চলবে এভাবে। তুমি মেহের এভাবে ঘুরে বেড়াও লোকে তো মন্দ কথা বলবে। শান্ত গলায় প্রশ্ন করেন সৈয়দা মাহবুবা।
রাহনাফ উঠে দাঁড়ায়। পকেটে দু-হাত গুজে দিয়ে মেহেরের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠে,,
– আর মাত্র কয়েকদিন আন্টি। আসল কার্পেটকে খুঁজে বের করতে পারলেই হবে। তারপরেই আমার অপেক্ষার অবসান ঘটবে।
মেহের আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দৌড়ে সেখন থেকে চলে যায়। রাহনাফ পিছন থেকে লক্ষ করলো মেহের যাওয়ার সময় হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে যাচ্ছে। সেও মেহেরের পিছু যেতে চাইলো কিন্তু ওর পা থেমে যায় পিছুটানে। পিছনের দিকে ঘুরে সৈয়দা মাহবুবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– রাখবেন আমার এই অনুরোধটা!!
সৈয়দা মাহবুবা মাথা নাড়িয়ে তাকে সম্মতি জানায়। অতঃপর বলেন,
– যা করবে সাবধানে করবে। মনে রাখবে তোমার সাথে আমার মেহুর ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে।
মৃদু হাসে রাহনাফ।অতঃপর সে মেহেরের পিছু চলে যায়।
জানালার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে মেহের। কাল যখন তার মা তাকে তাদের বিয়ের কথা বলছিলো তখন থেকেই মনে হাজারো স্বপ্নের জাল বুনেছে সে। অথচ আজ সেই স্বপ্নটা রাহনাফ ভেঙে দিলো। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় রাহনাফ। মেহেরকে কাঁদতে দেখে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে এই খারাপ লাগার মাঝেও এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করে। মেহের তাকে হাড়িয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছে। কতটা ভালোবাসলে ঠিক এমন ভয় পায় মানুষ সেটা রাহনাফের জানা নেই। ধীর পায়ে মেহেরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মেহের রাহনাফের উপস্থিতি টের পেলেও আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে থাকে। অধোর চেপে হাসে রাহনাফ তারপর মেহেরের কাঁধে হাত রেখে। মেহের রাহনাফের হাতটা সড়িয়ে দিতে চাইলে রাহনাফ আরো শক্তকরে ধরে। মেহের রাহনাফের থেকে ছাড় পাওয়ার জন্যে ছুটাছুটি করতে থাকে কিন্তু রাহনাফের শক্তির কাছে হেরে যায় সে। তাই সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। রাহনাফ মেহেরকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
– প্লিজ লেখিকা সাহেবা রাগ করো না আমার উপর। আমার কাজটা শেষ হোক তারপরেই আমরা বিয়ে করে নিব। একটু সময় দাও আমাকে।
– আমি আপনাকে ভালোবাসি রাহনাফ। আপনার সাথে এক ছাদের নিচে থাকতে চাই। বাড়ি গাড়ি এসব আমি চেয়েছি কখনো!!
রাহনাফ মেহেরকে ছেড়ে ওর চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর ওর গালে হাত রেখে বলে,
– বাড়ি গাড়ি অর্থ প্রতিপত্তি এসব আমারও চাইনা লেখিকা সাহেবা। আমি তোমাকে নিয়ে ছোট্ট একটা বাবুই পাখির বাসা বানাবো। সেখানে থাকবে অফুরান্ত ভালোবাসা। কিন্তু কি বলতো, আমি আমার বাবার স্বপ্নটা পূরণ করতে চাই। একটা ছেলে হিসাবে বাবার স্বপ্ন পূরণ করাটা আমার দায়িত্বে পড়ে।
– সেটা তো আমাকে সাথে নিয়েও করতে পারেন।
– আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে পারবো না লেখিকা সাহেবা। আমার কারনে যদি তোমার বিন্দু মাত্র ক্ষতি হয় তাহলে আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবো না। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো লেখিকা সাহেবা তারপর আমরা সারাজীবন এক সাথে থাকবো।
মেহের রাহনাফের হাতের উপর হাত রাখে। রাহনাফ মেহেরকে তার বুকে জড়িয়ে নেয়।
চলবে,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা। #মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩৫]
মেহের আজ অনেক খুশি। তার মা নিজে তাদের বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে খুশি না হয়ে পারা যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সে ভুলে গেছে রাহনাফকে পুরো ঘটনাটা বলতে। তখন রাহনাফকে সে বলতে চাইছিলো কিন্তু পরক্ষনে মনে পরে, রাহনাফ তো বিকালে তাদের বাড়িতে আসবেই তখন না হয় বলা যাবে। তার কাছেও সারপ্রাইজ হবে ব্যাপারটা। দারুন হবে সব মিলিয়ে। খুশি মনে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। কাঁধে থাকা ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছে সে। মাথার দু-পাশে দুটি বেনুনী করে দু কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। রাহনাফের কথা ভাবছে। তাদের বিয়ে হবে ছোট্ট একটা সংসার হবে। আর তাদের কোল আলে করে একটা পরী আসবে। ভাবতেই লজ্জা লাগছে তার। হেলেদুলে যাচ্ছে আর লজ্জা মাখা হাসি দিচ্ছে। তখনি তাকে পাশ কাটিয়ে একটা বড় গাড়ি চলে যায়। কাল রাতে ঝড় বৃষ্টি হওয়ার কারনে রাস্তায় কিছুটা পানি জমে আছে। গাড়িটা যখন মেহেরকে ক্রশ করে তখন রাস্তায় জমে থাকা কিছুটা পানি মেহেরের গায়ে এসে লাগে। ভাবনায় ছেদ ঘটে মেহেরের। রাগে মেহের গাড়ির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মুখ দিয়ে অশ্রাব্য ভাষার গালি বের করতে গিয়েও করে না সে। দমে যায়। দাত কটমট করে নাক ফুলিয়ে বড় বড় করে শ্বাস নেয় কয়েকবার। ততক্ষণ গাড়িটা তার দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। রাগে হাত মুঠি করে নেয় মেহের। এত আনন্দ সহিত বাড়ি থেকে বের হয়েছিল সে অথচ তার আনন্দটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। আবার বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে। ভাগ্যিস বাড়ি থেকে বেশীদূর আসে নি এখনো সে। বাসায় ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করে কলেজে চলে যায় মেহের।
কলেজে পৌঁছাতেই সবাই মেহেরকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। কিছুদিন আগে মেহের এই কলেজের হয়েই ডিবেট প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়েছে। তারপর আজ কলেজে আসা হয়নি মেহেরের। সেদিনের পর আজই এল সে কলেজে। তবে এই কয়দিনের মাঝে কলেজে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। মেহেরের প্রিয় স্যার যার কিনা বদলি হয়েছে অন্য একটা কলেজে আর তার পরিবর্তে এই কলেজে জয়েন করেছে অন্য আরেকজন স্যার যেটা মেহেরের অজানা। রাজনৈতিক তত্ব পরিচিতি ক্লাসে মেহেন যখন তার প্রিয় স্যারের পরিবর্তে একটা ইয়াং স্মার্ট সুদর্শন যুবককে দেখতে পায় তখন কিছু সময়ের জন্যে সে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। চক্ষুদ্বয় বড় বড় রসোগোল্লার মতো করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পাশ থেকে মেহেরের এক সহপাঠী মেহের কাঁধে চাপট মেরে বলে,
– এভাবে হা করে কি দেখছিস মেহু। মনে ধরেছে নাকি স্যারকে।
– স্যার। অবাক কন্ঠ মেহেরের। এটা আমাদের স্যার??
– হ্যাঁ, এনি আমাদের নতুন স্যার। কদিন আগেই জয়েন হয়েছে।
– একে দেখে কোন এঙ্গেল থেকে স্যারের মত লাগে। বিড়বিড় করে বলে মেহের।
– তাহলে কিসের মত লাগে, বয়ফেন্ড। সবাই তো স্যারের উপর ক্রাশ খাচ্ছে তুইও কি তাই??
মেহের তার সহপাঠীর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। যার ফলে সে চুপ হয়ে যায়। তারপর যখন সে কলেজের নতুন স্যারের দিকে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তখন স্যারের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয়। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেলে মেহের। নতুর স্যার তার দৃষ্টি নামিয়ে আবার পড়ায় মন দেয়।
সেদিন বিকালে রাহনাফ মেহেরদের বাসায় আসে না। কোচিং এ কাজের চাপ থাকায় বের হতে পারে না। অবশ্য এই নিয়ে সৈয়দা মাহবুবার কোন অভিযোগ নেই। সে জানে একা বাচতে গেলে একটা মানুষকে কত কিছু সামলে সামনে এগোতে হয়। রাহনাফের মত ছেলে হাজারে একটা পাওয়া যায়। ওর দিকটাও তো সবাইকে বুঝতে হবে। পরের দিন যখন রাহনাফ মেহেরদের বাসায় আসে তখনি সৈয়দা মাহবুবা তাকে মেহের আর তার বিয়ের কথা বলে। বিয়ের কথা শুনে প্রথমে রাহনাফের মুখ উজ্জল হলেও পরে সেটা আর দেখা যায় না। কিছু একটা ভেবে উঠে দাঁড়ায় সে। সৈয়দা মাহবুবা মেহের আর মৌ সকলে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে, যদিও সবাই জানে রাহনাফের উত্তর হবে হ্যাঁ। তবুও আরো একবার তার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছে। রাহনাফ সৈয়দা মাহবুবার সামনে গিয়ে হাটু গেরে বসে পরে। অতঃপর বলে,
– ছোট বেলায় বাবাকে হাড়িয়েছি তারপর মা। মা থেকেও মা নেই আমার। বাড়ি গাড়ি পরিবার সব থেকেও এতিম খানায় মানুষ আমি তবুও আমার কোন অভিযোগ নেই। জিবনের সাথে যুদ্ধ করে বড় হয়েছি আমি। আপনিও তো জিবন সংগ্রাম করে মেহের কে জন্ম দিয়েছেন ওকে লালন পালন করেছেন। আপনি নিশ্চয় বুঝবেন। আন্টি আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। আপনি রাখবেন,,,,
সবাই রাহনাফের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। মেহেরের চোখে যেন আজ পলক পরছে না। তার মনের মাঝে অজানা এক ভয় কাজ করছে। রাহনাফ কি পিছিয়ে যাবে। সে কি মেহেরকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। সৈয়দা মাহবুবা রাহনাফ হাত নিজের হাতের মুষ্ঠিতে আবদ্ধ করে নিয়ে বলে,
– কি বলতে চাও তুমি!! নিঃসংকোচে বলতে পারো ৃ
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাহনাফ। অতঃপর বলে,
– আমি এখন বিয়েটা করতে পারবো না আন্টি। মাথা নিচু করে ফেলে রাহনাফ। সবাই তার দিকে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মেহেরের চোখের কোটরে অশ্রুর ভীড় জমে গেছে। ঠোট কাঁপছে। রাহনাফ মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেহের ছলছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাহনাফ মেহেরের এমন দৃষ্টি নিতে পারে না বেশীক্ষণ। সে তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাকে একটু সময় দিন আন্টি। আমার এখনো অনেক কাজ বাকী আছে। জীবন থেকে যা যা হাড়িয়েছি তার হিসাব বাকি আছে। মায়ের অধীকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি তাই বলে নিজের অধীকার ছেড়ে দিব না। হ্যাঁ আমার এই জার্ণিটা একটু কঠিন। সব কিছু ঠিকঠাক হলে এলে না হয় আমাদের বিয়েটা দিয়ে দিন। ততদিন নাহয় মেহেরকে আপনার কাছে রেখে দিন আমার আমানত হিসাবে। এতদিন তো মেহেরকে নিজের মেয়ে হিসাবে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছেন। এখন না হয় আমার আমানত হিসাবে ওকে দেখে রাখবেন। যতদিন না আমরা বিয়ে করছি ততদিন।
– কিন্তু কতদিন চলবে এভাবে। তুমি মেহের এভাবে ঘুরে বেড়াও লোকে তো মন্দ কথা বলবে। শান্ত গলায় প্রশ্ন করেন সৈয়দা মাহবুবা।
রাহনাফ উঠে দাঁড়ায়। পকেটে দু-হাত গুজে দিয়ে মেহেরের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠে,,
– আর মাত্র কয়েকদিন আন্টি। আসল কার্পেটকে খুঁজে বের করতে পারলেই হবে। তারপরেই আমার অপেক্ষার অবসান ঘটবে।
মেহের আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দৌড়ে সেখন থেকে চলে যায়। রাহনাফ পিছন থেকে লক্ষ করলো মেহের যাওয়ার সময় হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে যাচ্ছে। সেও মেহেরের পিছু যেতে চাইলো কিন্তু ওর পা থেমে যায় পিছুটানে। পিছনের দিকে ঘুরে সৈয়দা মাহবুবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– রাখবেন আমার এই অনুরোধটা!!
সৈয়দা মাহবুবা মাথা নাড়িয়ে তাকে সম্মতি জানায়। অতঃপর বলেন,
– যা করবে সাবধানে করবে। মনে রাখবে তোমার সাথে আমার মেহুর ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে।
মৃদু হাসে রাহনাফ।অতঃপর সে মেহেরের পিছু চলে যায়।
জানালার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে মেহের। কাল যখন তার মা তাকে তাদের বিয়ের কথা বলছিলো তখন থেকেই মনে হাজারো স্বপ্নের জাল বুনেছে সে। অথচ আজ সেই স্বপ্নটা রাহনাফ ভেঙে দিলো। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় রাহনাফ। মেহেরকে কাঁদতে দেখে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে এই খারাপ লাগার মাঝেও এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করে। মেহের তাকে হাড়িয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছে। কতটা ভালোবাসলে ঠিক এমন ভয় পায় মানুষ সেটা রাহনাফের জানা নেই। ধীর পায়ে মেহেরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মেহের রাহনাফের উপস্থিতি টের পেলেও আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে থাকে। অধোর চেপে হাসে রাহনাফ তারপর মেহেরের কাঁধে হাত রেখে। মেহের রাহনাফের হাতটা সড়িয়ে দিতে চাইলে রাহনাফ আরো শক্তকরে ধরে। মেহের রাহনাফের থেকে ছাড় পাওয়ার জন্যে ছুটাছুটি করতে থাকে কিন্তু রাহনাফের শক্তির কাছে হেরে যায় সে। তাই সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। রাহনাফ মেহেরকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
– প্লিজ লেখিকা সাহেবা রাগ করো না আমার উপর। আমার কাজটা শেষ হোক তারপরেই আমরা বিয়ে করে নিব। একটু সময় দাও আমাকে।
– আমি আপনাকে ভালোবাসি রাহনাফ। আপনার সাথে এক ছাদের নিচে থাকতে চাই। বাড়ি গাড়ি এসব আমি চেয়েছি কখনো!!
রাহনাফ মেহেরকে ছেড়ে ওর চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর ওর গালে হাত রেখে বলে,
– বাড়ি গাড়ি অর্থ প্রতিপত্তি এসব আমারও চাইনা লেখিকা সাহেবা। আমি তোমাকে নিয়ে ছোট্ট একটা বাবুই পাখির বাসা বানাবো। সেখানে থাকবে অফুরান্ত ভালোবাসা। কিন্তু কি বলতো, আমি আমার বাবার স্বপ্নটা পূরণ করতে চাই। একটা ছেলে হিসাবে বাবার স্বপ্ন পূরণ করাটা আমার দায়িত্বে পড়ে।
– সেটা তো আমাকে সাথে নিয়েও করতে পারেন।
– আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে পারবো না লেখিকা সাহেবা। আমার কারনে যদি তোমার বিন্দু মাত্র ক্ষতি হয় তাহলে আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবো না। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো লেখিকা সাহেবা তারপর আমরা সারাজীবন এক সাথে থাকবো।
মেহের রাহনাফের হাতের উপর হাত রাখে। রাহনাফ মেহেরকে তার বুকে জড়িয়ে নেয়।
চলবে,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।