মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৪০

0
1955

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪০]

হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে রুমের ভিতরে নিজেকে বন্ধ করে রেখেছে রাহি। আফিয়া আহমেদ এখনো হসপিটালেই রয়েছে। তিনি নওশাদের সাথেই থাকতে চান। রাহিও তার সাথে কোন কথা বলে নি। তাকে হসপিটালে রেখে চলে এসেছে বাড়িতে। সেই বাড়িতে আসার পর থেকেই নিজেকে রুমের ভিতরে আটকে রেখেছে। বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে কাঁদছে রাহি। তার ভাবতেও অবাক লাগছে আফিয়া আহমেদ তার মা।তাকে মা বলে স্বীকার করতে ঘৃণা হচ্ছে তার। আপসোস হচ্ছে আজ নিজের ভাগ্যের উপর। মেহের তার বোন কিন্তু মা-টা কেন তার হলো না। মেহেরের উপর হিংসে হচ্ছে রাহির। কারন মেহেরের এমন একটা মা আছে যাকে নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাচা যায়। আজ রাহির মনে হচ্ছে এই বাড়ি গাড়ি অর্থ প্রতিপত্তির পরিবর্তে যদি সৈয়দা মাহবুবা তার মা হতো তাহলে সে হত পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যাক্তি। যার কাছে এমন একজন সম্মানিত, প্রতিষ্ঠিত মা আছে। কিন্তু আফসোস সব থেকেও আজ রাহির কিছুই নেই। যা আছে সবই এক একটা মুখোশ। মুখোশের আড়ালে থাকা লোকটা চেনতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে যায় রাহি। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে শাওয়ারের নিচে বসে থাকে সে। সব সময়ের মত আজও হট শাওয়ার নিচ্ছে সে। কিন্তু প্রতি দিনের মত আজ তার শরীর সতেচ হচ্চে না। কারন আজ ক্লান্তিটা তার মনের। এই ক্লান্তি কোন দিন দূর হবে না। শাওয়ারের নিচে বসে কাঁদতে থাকে রাহি। চোখের পানিগুলো শাওয়ারের পানির সাথে মিশে যাচ্ছে তাই হয়তো তার কান্নাটা দেখা যাচ্ছে না। দরজার ওপাশ থেকে রাহির দাদি এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে। সেই হসপিটাল থেকে এসে রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। এখনো খোলার কোন নামই নেই। লাঞ্চটাও এখনো করা হয়নি কারোর। ভিতর থেকে রাহির কোন রিসপন্স না পেয়ে দাদি সার্ভেন্ট ডাকে। দাদির ডাকে তিনজন সার্ভেন্ট এসে হাজির হয় রাহির রুমের সামনে। দাদির মুখ থেকে সব কথা শুনে সার্ভেন্টরা খুব ভয় পেয়ে যায়। কিছুূদিন আগেও রাহি সুইসাইড করতে যাচ্ছিল আর আজও রুমের দরজা লক করে রেখেছে। আচ্ছা এটা নতুন কোন বিপদের সংকেত নয় তো! সার্ভেন্টরা দ্রুত রাহির রুমের দরজা ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা সকলে ব্যার্থ, কেউই দরজা ভাঙতে পারে না তাই তারা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে রাহিকে কোথাও দেখতে পায়না। ওয়াশরুম থেকে পানি পরার শব্দ ভেসে আসে সকালের কানে। রাহি ওয়াশরুমে। সবাই রুম থেকে বের হয়ে যায়। দাদি গিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় লক করে। কিছুক্ষণ পর রাহি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। তখন তার গায়ে শুধু মাত্র টাওয়াল ছাড়া অন্য কিছুই ছিলো না। চুলগুলো কোমড় পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়া আছে, সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পরছে রাহির কোমড়ে। রাহি গিয়ে বিছানায় বসে পরে। দাদি অন্য আর একটা টাওয়াল নিয়ে এসে রাহির চুলগুলো মুছে দিতে থাকে। রাহি নিঃপলক তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। দাদি রাহিকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে, রাহি তার দাদির করা প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না। সে মূর্তির মত হয়ে বসে থাকে।

– কি হয়েছে দাদুভাই! কেন এমন পাগলামি করছিস? আমাকে বল কি হয়েছে। আফিয়া কিছু বলেছে!

রাহি এবারও কোন জবাব দেয় না। সে দাদিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাও করে কাঁদতে থাকে। দাদি রাহির মাথার হাত বুলিয়ে দেয়। আর জানতে চায় কি হয়েছে রাহির। রাহি কেন এত কষ্ট পাচ্ছে।

এক পর্যায়ে দাদিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রাহি। ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেসটা পরিধান করে নেয়। রুমে এসে ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে একটা হিজাব পরে নেয়। দাদি আড় চোখে মেহেরকে দেখছে আর জিগ্যেস করছে কোথায় যাচ্ছে সে। কিন্তু রাহি এবারও কোন জবাব না দিয়ে পার্স নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

আজ বাড়ির গাড়ি নিয়ে আসে নি রাহি। বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে আসলে সাথে ড্রাইভারকেও আনতে হবে। রাহি ড্রাইভিং জানে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় লোকাল গাড়িতে করে তার গন্তব্যে ফিরবে। বাস স্টপে এসে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছে রাহি। এভাবে কোন দিন কোথাও যাওয়া হয়নি তাই একটু আনইজি ফিল করছে রাহি। এত মানুষের আনাগোনায় জার্ণি করার তার পক্ষে বেশ কষ্টকর। আর এই গরমের মাঝে বাস স্টান্ড দাঁড়িয়ে যে কতটা কষ্টের যে জার্ণি করে সেই জানে। বাস ছেড়ে রিক্সায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রাহি। রিক্সার দিকে দু কদম এগোতেই তার মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠে। ব্যাগে থেকে মোবাইলটা বের করে দেখতে পায় রাহনাফ কল করেছে। মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কল রিসিভ করবে কি করবে না সেটাই ভাবছে রাহি। কলটা কেটে যায়। অধোর কামড়ে শ্বাস ত্যাগ করে সে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার কল করে রাহনাফ। রাহি এবার কল রিসিভ করে নরম সূরে বলে উঠে,

– আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি রাহনাফ। তুমি কোন চিন্তা করো না। আফিয়া আহমেদ তার কৃতকর্মের সাজা পাবে। উচিৎ সাজা পাবে। উপরের দিকে তাকিয়ে অধোর কামড়ায় রাহি। ওপাশ থেকে রাহনাফ বলে উঠে,

– তুমি যা করছো ভেবে করছো তো রাহি। দেখ উনি কিন্তু তোমার মা। আর মায়ের সাথে,,,,

– তাহলে কেন তুমি আমাকে সবটা বললে। কেন আমায় এমন জঘন্য কাজের ব্যাপারে অবগত করলে রাহনাফ। এখন আমার নিজের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে। কথাগুলো বলার সময় রাহির গলার স্বর ধরে আসছিলো।

– আই এম সরি রাহি।

– তুমি কেন সরি বলছো রাহনাফ। তুমি তো কোন অন্যায় করো নি। তাহলে সরি বলার কথা আসে কোথা থেকে। যে অন্যায় করেছে সে তো মাথা উচু করে বাচছে। আচ্ছা এখন কোথায় আছো তুমি? বের হতে পারবে! না মানে যদি একটু দরকার ছিলো। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে রাহি।

– কোথায় আসতে হবে বল!

– লোকেশন দিয়ে দিচ্ছি চলে এস।

রাহি কল কেটে দেয়। মোবাইল টিপতে টিপতে রাস্তা ক্রশ করছে এমনি সময় কেউ একজন রাহির হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে নেয়। রাহি গিয়ে লোকটার বুকের উপর পরে। নিমিষেই সব কিছু স্তব্ধ হয়ে যায়। রাহি লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে কিছুটা দূরে সরিয়ে দেয়। ঘটনাক্রমে লোকটা দু-পা পিছিয়ে যায়। রাহি ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লোকটার দিলে, অতঃপর বলে,

– আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে জড়িয়ে ধরার। আমি আপনাকে, লোকটার গায়ে হাত তুলতে গেলে সে রাহির হাত ধরে বলে,

– হ্যালো মিছ ধানি লংকা, আপনাকে জড়িয়ে ধরার কোন ইন্টারেস্ট নেই আমার ওকে। আর একটু হলে গাড়ি চাপা পড়তেন। আপনাকে বাঁচিয়ে দিলাম। এবার ধন্যবাদ দিয়ে কেটে পরুন।

লোকটার কথাশুনে ভ্রু কুচকে ফেলে রাহি। তাকে পা থেকে মাথা অব্ধি অবলোকন করে নেয়। দেখতে সুন্দর সুশ্রী, বাইশ থেকে তেইশ বছরের কোন যুবক হবে আর কি! পরনে হলুদ টিশার্ট আর কালো রংয়ের প্যান্ট। মাথায় কুঁকড়ানো চুল। রাহি বাকা চোখে যুবকটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হলুদ টিশার্ট না হয়ে যদি হলুদ পাঞ্জাবি হত তাহলে একে হয়তো হিমুর থেকে আলাদা করা মুশকিল হয়ে যেত। যুবকটার ড্রেসের কম্বিনেশন দেখে মনে হচ্চে সে হিমুর ছোট ভাই। আচ্ছা হিমুর কি কোন ভাই ছিলো! আমার জানা নেই।তবে আমার মতে হিমুর যদি কোন ছোট ভাই থেকে থাকে তাহলে এই যুবকটাই হিমুর ছোট ভাই হবে। রাহির ভাবনার মাঝেই যুবকটা ওর সামনে তুরি বাজিয়ে বলে,

– কোথায় হাড়িয়ে গেলেন মেডাম। তাড়াতাড়ি ধন্যবাদ বলুন আর ফটাফট এখান থেকে বিদায় হোন।

– আমি কেন আপনাকে ধন্যবাদ দিতে যাব।

– এই যে, আমি আপনাকে বাঁচিয়ে দিলাম।

– এটা আপনার দায়িত্ব। কে যেন বলেছে, কোথাও একাকি কোন সুন্দরি মেয়ে দেখলে তাহলে তার দায়িত্ব নিতে শিখুন। আপনিও তাই করেছেন তাহলে ধন্যবাদ কেন দিবো। বলেই ভুবন ভুলানো হাসি হাসে মেহের আর চলে যাওয়ার জন্যে সামনের দিকে এক পা বাড়ায়। তখন পিছন থেকে যুবকটা বলে উঠে,

– তিনি আরো বলেছেন, মেয়েটার দায়িত্ব নিন, মেয়েটা যদি আপনাকে ধন্যবাদ না দিয়ে চলে যায় তহালে ধরে নিন মেয়েটা পটে গেছে। বলেই যুবকটা চোখ টিপ দেয়। রাহির চোখ বড় বড় হয়ে যায়। হা হয়ে তাকিয়ে থাকে সে যুবকটার দিকে।

চলবে,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here