মেয়েবেলা পাঠ-১

“বিয়ের তিন বছর পরেও যেই মেয়ে মা হতে পারে নি তার সাথে সংসার করার দরকার নেই। সোহেল তুই এই মেয়েটাকে তালাক দে। আমি তোর আবার নতুন করে বিয়ে দেব।”

শাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে মালিহা বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো। মা হতে পারেনি জন্য তাকে কিনা এত বড় শাস্তি পেতে হবে। মালিহা উদাস নয়নে তার স্বামী সোহেলের দিকে তাকায়। সোহেল আজ তার হয়ে কিছু বলছে না। মালিহা অবাক হলো না একটুও৷ যেখানে তার শাশুড়ি একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর কষ্ট বুঝল না সেখানে সোহেলের আর কি দোষ।

মালিহা তাই আজ সোহেলকে কিছু না বলে নিজের শাশুড়ি সিতারা বেগমকে বলল, “আপনি নিজেও তো একজন মেয়ে মা। তাহলে আপনি কি করে আরেকটা মেয়ের দূর্বল যায়গায় আঘাত করছেন? এটা ঠিক আমি এখনো মা হতে পারিনি কিন্তু এখানে তো আমার কোন দোষ নেই।”

সিতারা বেগম হার মানার পাত্রী নন। তাই তিনি বললেন, “আমাকে কিছু শেখাতে এসো না। দোষ তোমারই। তুমি একটা বন্ধ্যা।”

মালিহা মলিন হেসে বলল, “সমস্যা তো আপনার ছেলেরও হতে পারে। কিন্তু আপনি সেটা দেখবেন না। কারণ সমাজে নারীদেরকেই সবকিছুর দোষ দেওয়া হয়। এখানে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। আপনি একজন পুরুষের গায়ে কাদা ছিটালে অন্য পুরুষেরা তাকে আগলে নেবে। কিন্তু একজন নারীকে তো আরেকজন নারীই ছোট করে। তাই যুগে যুগে মেয়েরা এভাবে অবহেলিত হয়ে আসছে। কারণ মেয়েরাই যে মেয়েদের সবথেকে বড় শত্রু।”

সিতারা বেগম যেন এসব কথা শুনেও শোনেন না। নিজের মতো বিড়বিড় করতে থাকেন। মালিহা এবার মোক্ষম আঘাতটাই হানল। নিজের ননদের প্রসঙ্গ টেনে বলল, “আপনার মেয়ের তো এক বছর হলো বিয়ে হওয়ার। সৃষ্টিকর্তা না করুক, সেও যদি আমার মতো সন্তান জন্ম দিতে না পারে তাহলে কি আপনি তার স্বামীকে গিয়ে বলবেন তাকে ডিভোর্স দিতে?”

সিতারা বেগম এবার গর্জে ওঠেন, “আমার মেয়ের সাথে নিজের তুলনা করিও না।”

“আচ্ছা বেশ না করলাম। কিন্তু আপনি মনে রাখবেন এই পৃথিবীতে আপনি কারো সাথে অন্যায় করলে সেটা সুদে আসলে ফেরতও পাবেন। আজ একজন মেয়ে হয়েও আপনি আমার কষ্টটা বুঝছেন না। একদিন যখন আপনার কাছে এমন কষ্ট ফিরে আসবে তখন বুঝবেন।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে নিজের কক্ষের দিকে এগোলো মালিহা। সিতারা বেগম নিজের ছেলে সোহেলকে চিৎকার করে বলল, “তোর বউ আমাকে এত অপমান করল আর তুই চুপ করে দেখলি। আমার হয়ে কোন কথা বললি না। বন্ধ্যা মেয়ে মানুষের মুখে এত কথা মানায় না। তুই আজ এর বিচার কর। হয় তোর বউ এই বাড়িতে থাকবে নয়তো আমি।”

মালিহা সবগুলো কথাই শুনল নিজের কক্ষ থেকে। কথাগুলো শুনে সে মনে মনে বলল, “একজন মেয়ের সংসার মূলত আরেকজন মেয়ের জন্যই নষ্ট নয়। আমরা অনেকেই একতরফাভাবে পুরুষকে দোষারোপ করি কিন্তু একটু ঘাটাঘাটি করলে দেখা যাবে একজন মেয়ের সর্বনাশের পেছনে আরেকজন মেয়েরই হাত আছে। স্বামী প*রকীয়া করে, তো কার সাথে করে? অন্য একজন মেয়ের সাথেই তো। এছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শাশুড়ি, ননদরাও সংসার ভাঙনের কারণ হয়। সমাজ কিভাবে বদলাবে? পুরুষদের আমরা কিভাবে দোষ দেব? একজন
মেয়ের শত্রু আরেকজন মেয়েই। তাই আগে আমাদের নিজেদের সামলাতে হবে।”

নিজের মায়ের কথায় প্ররোচিত হয়ে সোহেল আসে মালিহার কাছে। মালিহার কোন কথা না শুনেই তাকে এলোপাতাড়ি মা*র‍তে থাকে। মালিহা কোনপ্রকার প্রতিবাদ করে না। যেন আজ সেও দেখতে চায় যে ভাগ্য তার জন্য আর কত খারাপ হতে পারে। একপর্যায়ে সোহেল মালিহার সব জামাকাপড় বের করে ছু*ড়তে থাকে। মালিহাকে বাজে ভাষায় গালিগালাজ করে বলে, “আজই তুই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি। তোর সাথে আমি আর সংসার করবো না।”

সিতারা বেগম বাইরে থেকে সব কথা শোনেন। এসব কিছু যেন তাকে পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছিল। মালিহা নির্বিকার ছিল। তার আজ আর কিছুই বলার নেই।

নিজের সব জামাকাপড় একটি ব্যাগে ভড়ে নিলো মালিহা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হলো। আসার আগে নিজের স্বামী সোহেলকে বলল, “তুমি আমাকে তালাক দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমিও মুক্তি চাই তোমার থেকে।”

সোহেল হুশহুশ করছিল। সিতারা বেগম বলেন, “হ্যাঁ সোহেল। এই মেয়েকে তালাক দে। তারপর দেখব কি করে খায়।”

মালিহা মৃদু হেসে বলে, “আমার খাওয়ার চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। নিজের ব্যবস্থা আমি নিজে করে দেবো। শুধু এটুকুই আশা করব আপনার ছেলের নতুন বউ এসে যেন আপনার খাবার কেড়ে না নেয়।”

সিতারা বেগম কিছু বলতে যাবেন সেটা না শুনেই মালিহা বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িই নাকি মেয়েদের সব। অথচ আজ তাকে শ্বশুর বাড়ি নামক গৃহ থেকে বিদায় নিতে হলো। এখন নিজের বাপের বাড়ি যাবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে কি সসম্মানে থাকতে পারবে? সমাজ কি এত সহজে ভালো থাকতে দেয় মেয়েদের?

❤️
সিতারা বেগম যখন মালিহাকে তাড়িয়ে দিয়ে আনন্দে মগ্ন অন্য দিকে তার আপন মেয়ে সুবর্ণার জীবনে তখন চলছে ভয়ানক তান্ডব।

সুবর্ণা আজকে জানতে পারল তার স্বামী মোর্শেদ অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছে। শুধু তাই নয় তাদের সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আজ একটি হোটেলে তাদের হাতেনাতে ধরেছে সুবর্ণা। মোর্শেদ তাকে কিছু বোঝাতে যাবে তার আগেই রুহি নামের মেয়েটিকে থা*প্পড় মে*রে বলে, “লজ্জা করে না তোর একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সংসার নষ্ট করিস। আমার স্বামীকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাস। কেন রে দেশে কি অবিবাহিত ছেলের অভাব পড়েছে? নিজের স্বামীকে আমি কি দোষ দেব, দোষ তো তোদের মতো মেয়েদেরই। ছেলেরা স্বভাবতই মেয়েদের প্রতি দূর্বল থাকে। তুই যদি সুযোগ না দিতি তাহলে আমার স্বামী কোনদিনও এই অপকর্মে জড়িয়ে পড়ত না। আসলে সবাই ঠিকই বলে একটা মেয়েই আরেকটা মেয়ের সবথেকে বড় শত্রু।”

রুহি ন্যাকাকান্না করে মোর্শেদকে বলে, “তোমার সামনে তোমার স্ত্রী আমাকে মা*রল আর তুমি চুপ করে দেখছ। কোন প্রতিবাদ করছ না। এই না তুমি বলতে তুমি আমায় ভালোবাসো। এই তোমার ভালোবাসার নমুনা।”

মোর্শেদ রুহির কথায় প্রভাবিত হয়। সুবর্ণার চু*লের মুঠি ধরে বলে, “আমি রুহিকে ভালোবাসি। তোমাকে শুধুমাত্র নিজের পরিবারের জন্য এতদিন সহ্য করছিলাম। কিন্তু এখন আর না। তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে এবার আমি রুহিকে বিয়ে করব। দেখি তুমি কি করতে পারো।”

সুবর্ণাকে দূরে ছু*ড়ে দিল মোর্শেদ। সুবর্ণা অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইল। রুহি সুবর্ণার সামনে এসে বিশ্রীভাবে হেসে বলল, “আজ যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। তুমি আজ আমাদের ধরে ফেললে এখন আর লুকোচুরির প্রয়োজন নেই। আমি এবার সসম্মানে মোর্শেদের বউ হয়ে যাব। ইউ পোর গার্ল।”

সুবর্ণা নিজের চোখে আগত জল মুছে নিয়ে বলল, “একজনের সংসার ভেঙে কখনো সুখী হওনা যায়না। তুমি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সংসার নষ্ট করে সুখী হতে চাইছ। কিন্তু দেখে নিও তুমি পারবে না।”

সুবর্ণা উঠে দাঁড়ায়। মোর্শেদকে শাসিয়ে বলে, “তোমার নামে আমি কেইস করব। ডিভোর্স তো দেবোই কিন্তু তার আগে তোমাকে জেলের ঘানি টানাবো। আর রুহি তোমাকেও আমি ছাড়ব না। প্রস্তুত থাকো নিজেদের পরিণতির জন্য।”

সুবর্ণা হোটেল থেকে বেরিয়ে আসে। সাহসিকতার সাথে কথাগুলো বললেও সে জানে সে এখন কত অসহায়। এই সমাজে পুরুষের দোষ কয়জনই বা দেখে? সবাই মেয়েদেরই ব্লেইম করে। সমাজের চোখে তাই সুবর্ণাকেই হয়তো ছোট হতে হবে!

#চলবে

#মেয়েবেলা
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী

(গল্পটা একটু ভিন্ন ধরনের হতে চলেছে। অন্যান্য গতানুগতিক গল্পের থেকে আলাদা। এই গল্পে কোন রোম্যান্টিক কাহিনি থাকবে না। সমাজের কিছু বাস্তব গল্প থাকবে। যাদের ভালো লাগবে তারাই শুধু পড়বেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here