মেয়েবেলা পাঠ-৪ শেষ পাঠ

#মেয়েবেলা
#৪র্থ_পর্ব(অন্তিম)
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী

সুবর্ণা যে গর্ভবতী এটা বাড়ির সবাই জানা যায়। ব্যাস এই থেকে শুরু হয়ে যায় তার উপর মানসিক চাপ দেওয়ার পালা। বিশেষ করে সিতারা বেগম নিজের মেয়েকে নানা ভাবে বোঝাতে থাকে তার স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। সোহেলও বলে, “যা হওয়ার হয়েছে। তুই আমার বোন, তোর দায়িত্ব নাহয় আমি নিতে পারতাম কিন্তু তোর বাচ্চা! এটা সম্ভব না। তুই তোর স্বামীর কাছেই ফিরে যা।”

নিজের মা ও ভাইয়ের ব্যবহার দেখে আর কথাবার্তা শুনে সুবর্ণা হতাশ হয়। নিজের ভাইয়ের কাছে আজ সে বোঝা হয়ে গেছে! তার জন্মদাত্রী মা তাকে বলছে এমন একজন লোকের কাছে ফিরে যেতে যে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে অন্য একটি মেয়ের জন্য।

সুবর্ণা সিতারা বেগমকে বলে, “আমি আর যেখানেই যাই, মোর্শেদের জীবনে অন্তত আর ফিরে যাব না। এটাই আমার ফাইনাল ডিশিসন যা তোমাদের জানিয়ে রাখলাম।”

“পুরুষ মানুষ একটু আধটু ওরকম করতেই পারে। এখন যদি তুই তোর স্বামীকে গিয়ে বলিস তুই মা হতে চলেছিস তাহলেই দেখবি তোকে মেনে নিবে। আবার ধুমধাম করে তোকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।”

“পরকীয়া কত বড় অপরাধ তুমি জানো আম্মু? আর আমি কিনা এমন একজনের কাছে ফিরে যাবো। সেটা হতে পারে না। আমি আমার সন্তানকে এমন একজন পিতার পরিচয়ে বড় করতে পারব না যে এত নিকৃষ্ট মনের।”

“তাহলে তোকে আর এই বাড়িতেও থাকতে হবে না। হয় নিজের স্বামীর বাড়িতে যা নাহয় এই বাড়ি থেকে বের হয়।”

সিতারা বেগমের কথায় সুবর্ণার আত্মসম্মানে আঘা*ত লাগে। সুবর্ণা বলে, “তুমি আবার প্রমাণ করে দিলে আম্মু যে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। ঠিক আছে আমি আজই বেরিয়ে যাব এই বাড়ি থেকে। জানো আমার আগে ভাবিকে নিয়ে আফসোস হতো কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যেই মহিলা নিজের মেয়ের সাথে এমন করতে পারে অন্যের মেয়ের সাথে সে আরো কত নিকৃষ্ট ব্যবহার করতে পারে। মালিহা ভাবির ভাগ্য ভালো যে এখান থেকে যেতে পেরেছে। ডিভোর্সও পেয়েছে তোমার ছেলের সাথে।”

সুবর্ণা আর অপেক্ষা করল না। নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো। যাওয়ার সময় সিতারা বেগম তাকে আটকানোর চেষ্টা করে। তিনি আরো বলেন, “এভাবে একা যাবি কই তুই? আমি মোর্শেদকে বলছি ও এসে তোকে নিয়ে যাবে। আমার কথা শোন, আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি।”

সুবর্ণা সেসব কথা শোনার কোন প্রয়োজনই মনে করে না। নিজের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তার গন্তব্য সে জানে। এখন সেই গন্তব্যের দিকেই যাওয়া তার পরিকল্পনা। সুবর্ণা নিজের ফোন বের করে কথা বলে সব কিছু ঠিক করে নেয়। মেয়ে বলেই অসহায় নয় সে।

❤️
মালিহাও নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে রেখেছে। নিজের ভাই আর ভাবির উপর আর বোঝা হয়ে থাকতে কোন ভাবেই রাজি নয় সে। মালিহাও নিজের জন্য একটি যায়গা ঠিক করে নিয়েছে। যেখানে সে এখন যাবে৷ তার সেই ঠিকানাই এখন তার গন্তব্য।

যাওয়ার সময় মালিহা তার ভাই ভাবির সাথে দেখা করে যায়। মালিহার ভাই তার যাওয়া নিয়ে আপত্তি করলেও মালিহা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। যার ফলে আর কিছু বলারই থাকে না। এখানেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়। বাপের বাড়ি ত্যাগ করে মালিহা। এখন তার গন্তব্য “মেয়েবেলা” নামক একটি নারী আশ্রম। যেখানে অসহায় মেয়েদের আশ্রয় দেওয়া হয় এবং তাদের সাবলম্বী তৈরি করে দেওয়া হয়।

মেয়েবেলায় এসে উপস্থিত হয় মালিহা। এখানে এসে সবার সাথে পরিচিত হয়ে নেয়। মালিহার আসার কিছু সময় পরেই সুবর্ণাও চলে আসে। দুজনেই একে অপর কে দেখে অনেক বেশি অবাক হয়ে যায়। তবে এখানে অবাক হওয়ার মতো কিছুই ছিলনা। কারণ দুজনেই যে এখন একই পথের পথিক।

মেয়েবেলায় মেয়েদের সাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা দেয়। এখান থেকেই শিক্ষা নিয়ে নতুন করে নিজের জীবন গড়ে নেবে সবাই এটাই সবার কাম্য।

৫ বছর পর,
সুবর্ণার কোলে তার ৪ বছরের ছোট্ট রাজকন্যা। এই কত গুলো দিন মেয়েবেলাতেই কাটিয়ে দিয়েছে সে। যেখানে তার জীবন সেজে উঠেছে নতুন ভাবে। মালিহা দুই বছর আগে আবার নতুন করে সংসার গঠন করেছে। তার কোল আলো করে একটি ছেলেও এসেছে। অথচ যেই বন্ধ্যা হওয়ার অভিযোগে সোহেল মালিহাকে ত্যাগ করে দিয়েছিল এখন দেখা গেলো সেটা ভুল। উলটো সোহেল দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছে কিন্তু সে আর বাবা হতে পারে নি৷ এর থেকে বোঝা গেছে সমস্যা ছিল সোহেলের মধ্যে।

এরমধ্যে একদিন সুবর্ণা মেয়েবেলায় নতুন একটি মেয়েকে দেখতে পায়৷ যে আর কেউ নয় রুহি। সুবর্ণার প্রাক্তন স্বামী মোর্শেদের দ্বিতীয় স্ত্রী রুহি। যার জন্য মোর্শেদ সুবর্ণাকে ত্যাগ করেছিল। অথচ আজ রুহিকেও একইভাবে ছেড়ে দিয়েছে সে।

রুহিও মেয়েবেলায় এসে সুবর্ণাকে দেখে অবাক হয়েছিল। সুবর্ণা অতীতের কথা মনে করে বলে, “দেখলে তো আমি বলেছিলাম না তোমায় অন্যের ক্ষতি করে কখনো ভালো থাকা যায় না। আজ মিলল তো আমার কথা। দেখ আজ তোমাকেও ছেড়ে দিল মোর্শেদ।”

রুহি অপরাধবোধ অনুভব করে বলে, “তুমি ঠিক বলেছিলে সুবর্ণা। আজ আমি তোমার সব কথা অন্তর থেকে উপলব্ধি করে উঠতে পারছি। তুমি ঠিক বলেছিল। একজন মেয়েই আরেকজন মেয়ের শত্রু হয়৷ আবার নতুন একটি মেয়ে আমার আর মোর্শেদের সংসার নষ্ট করে দিয়েছে।”

সুবর্ণা হাসে। তৃপ্তির হাসি। কারণ তার মতে সৃষ্টিকর্তা এখন একদম সঠিক বিচার করেছে রুহির সাথে। অন্যের সুখ কেড়ে নিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। অন্যের ক্ষতি করলেও নিজের উপরেও ক্ষতির প্রভাব চলে আসে।

সুবর্ণাকে অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু সুবর্ণা তাদেরকে সাফ বলে দেয়, “যে আমার মেয়ের দায়িত্ব নেবে তাকেই আমি মেনে নেবো।” এইকথা শুনেই সবাই পিছিয়ে যায়৷ তাই সুবর্ণাও আর এগোয় না। সম্পর্ক হীন থাকে। একা একা নিজের মেয়েকে নিয়েই নাহয় থাকবে বাকি জীবন।

আজ অনেক দিন পর নিজের মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছে সুবর্ণা। এই সিতারা বেগমকে দেখে চেনার উপায়। চেহারায় আগের সেই তেজ নেই, নাদুসনুদুস শরীরও আর নেই। সুবর্ণাকে দেখে তিনি আফসোস করে বলেন, “কত শখ করে সোহেলকে দ্বিতীয় বিয়ে দিলাম। কিন্তু ওর বউ আমাকে দেখে না। আমাকে বাড়ির সব কাজ করতে হয়। এভাবে আর পারছি না আমি। এর থেকে মালিহাই ভালো ছিল।”

সুবর্ণা হাসে। হাসতে হাসতে বলে, “এখন এসব কথা বলে কি লাভ আছে? তুমি নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে এনেছ। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আম্মু। তাই তোমাকে দেখতে এসেছি। আর কিছু বলার নেই।”

আসলে মেয়েরাই মেয়েদের সর্বনাশের কারণ যা যুগে যুগে পরিচয়। তাই সমাজে সম্মান পেতে চাইলে আগে মেয়েদের একে অপরের শত্রু নয় বন্ধু হয়ে উঠতে হবে।

#সমাপ্ত

(পুরো গল্পে আপনাদের কাকে বেশি ভালো লাগল? সুবর্ণা নাকি মালিহা?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here