যদি বলি ভালোবাসি🍁 পার্ট ২৬

0
1680

#যদি_বলি_ভালোবাসি ♥
#PART_26
#FABIYAH_MOMO🍁

হঠাৎ কারো আছড়ে পড়া কান্নার শব্দ পেলাম।কেউ বাইরে থেকে গলা ফাটিয়ে হাউমাউ করে কাদছে। শোকের কান্না যাকে বলা হয়, কে কাদছে? বুকের মধ্যিখানে ভয়ের জোয়ার ভাসিয়ে দিয়ে হৃদের ক্রিয়া স্রোতের বেগে চলছে….খুব ভয়, প্রচুর ভয়, অনুমানশক্তির পূর্বাভাস পাওয়ার মতো ধকলে উঠা ভয়, আপন কাউকে হারানোর মতো কাঠিন্য ভয়…কারোর কিছু হলো? মৃত্যু?

বাইরে বেরিয়ে ফ্লোরের দেয়াল ধরে বসে আছি, মা ফ্লোরে লুটিয়ে নিশ্চুপ, রাফিয়া করছে বিলাপ, ফুপি আচল ভিজিয়ে কাদছেন, রূপা আইলাইনের সরু কোনাটা সাবধানতার সাথে টিস্যু দিয়ে নোনাজল মুছছে, মেহমান সব চোখ লাল করে আছে, পানি তাদেরও গাল গড়িয়ে পড়ছে। এই শোকযাত্রায় দুইজন ব্যক্তি অনুপস্থিত। এক. আমার শ্রদ্ধেয় স্বামী রাদিফ আবরার মুগ্ধ, দুই. আমার শ্বাশুড়ীর স্বামী, রোমেল আবরার সৈকত। ফ্লোরে লাশের খাটিয়া পাতা, সবাই হাটু নুয়িয়ে ঝুকিয়ে হেলে বসে শোকাবস্থায় হারা। অজস্র ফোটায় ফোটায় নোনাজল গড়িয়ে গাল ভিজিয়ে পড়ছে হাতে।গলায় দলা পাকানো কান্নার ঝুড়ি। রাফিন ফ্লোরে লুটানো মায়ের মাথা কোলে নিয়ে স্থির, বিয়েবাড়ি স্থগিত। ডাক্তার সাহেবের বামহাতে স্টিচ লেগেছে, উনি বেচেঁ আছেন, ডিসচার্জ করতে একদিন নিবে। শ্বশুড় বাবা ওপারে চলে গেলেন, এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে মালবাহী ট্রাকের সাথে গাড়ি এক্সিডেন্ট। মুগ্ধের সেন্স ফিরেছে, ট্রমাতে আছেন, বাবাকে আনতে যেয়ে উনি গাড়ি আউট অফ কন্ট্রোলে চালিয়েছেন। গাছের সাথে ধাক্কা লেগে কাচ ভেঙ্গে হাতে লেগেছে, ঘটনাস্থলে বেহুঁশ।। উনার সেলাই লেগেছে, এই তথ্যটাও কানে পৌছাতো না, যদিনা ফুপি কড়া করে দুটো গালাগাল করে মুখ ফসকে বলে দিতেন। ফুপি ইতিমধ্যে ঠাসঠাস দুইটা পাচঁ আঙ্গুলের ছাপ বসিয়ে চড় দিয়েছেন। নতুন কিছু না। অভ্যস্ত। আমি বাবার অকালে চলে যাওয়ায় খুব বেশি মর্মাহত, ইনিই প্রথম মনুষ্য ছিলেন, যে অতি আদরে “টুকটুকি” নামটা সবার সান্নিধ্যে দিয়েছিলেন।তারপর থেকে মা, বাবা মিলিয়ে মিলিয়ে আদর করে টুকটুকি বলে ডাকতেন। আমাকে এ বাড়িতে কেউ যদি মাফটা করে দিতো তা একমাত্র “শ্বশুড় বাবা” হতেন। আমি উনার বিদেশ থেকে ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। আমি জানতাম মন থেকে নরম গলায় মাফসূচকে চাইলে বাবা সত্যি ক্ষমা করে দিতেন। তা আর নসিবে হলো না….

আমাকে মাফ করে দিয়েন বাবা, শেষবারের মতো আপনার কাছে ক্ষমার যোগ্যতাটা পেলাম না, আপনি চলে গেলেন….সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন, আমাকে অনুতপ্ত রেখে চলে গেলেন….

উনার পদযুগলে হাত লাগিয়ে শেষবারের মতো সালাম করে নিলাম, অতঃপর মুগ্ধকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। ফুপি আমার লাগেজ গুছিয়ে বাড়ির বাইরে নর্দমায় ফেলে দিয়েছেন, নিত্যদিনের সাইড ব্যাগে হাতখরচা হিসেবে পাচশ টাকার তিনটে নোট ছিলো, এখন একটাও নেই, ব্যাগের চামড়ার হ্যান্ডেল একটা ছিড়ে দিয়েছেন ফুপি। ছিড়া ব্যাগ নিয়ে আমিও ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম, রাতের অন্ধকারে পাড়ি দিলাম। সঙ্গে শুধু পন্ঞ্চাশ টাকার ময়লা নোট, হসপিটালে পৌছানোর ভাড়া মাত্র, এক্সট্রা একটাকার পয়সাও নেই। সব ঝেড়েনেড়ে ফুপি পুষিয়ে রেখেছেন। রিকশার ভাড়া চুকিয়ে হসপিটালে গিয়ে মুগ্ধের খোজে সিচুয়েশন দেখতে গেলাম, নরমাল কেবিন ১২০৫ -এ শুয়ে আছেন ডাক্তার সাহেব। শাড়ির আচল কম্বলের মতো পেচিয়ে নিয়েছি, রিসেপশনের পুরুষ লোকটা ভালো না, শরীরের ভাজে চোখ মিলাতে দ্বিধান্বিত হচ্ছেনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

–বিবাহিত?
শার্টের পকেটে মনোগ্রাম লাগানো, নাম দেয়া- “সিরাজ”, নামটা দেখে জিজ্ঞেস করলে সে হলদে দাতের বিশ্রী হাসি দেয়।
–হু, আপনে জিজ্ঞেস করলেন যে?
–মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এতোটাই নিচু হয়েছে, সে নিজেও বিবাহিত অথচ আরেক বিবাহিত মেয়ের দিকে খাচ্চরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ নামিয়ে রাখবেন ! হসপিটাল বলে ছাড় দিবো না !

লোকটা আমার কথায় কাচুমাচু করতে লাগল,মাথা চুলকিয়ে পরে কিছু বললো না। আমি উনার কেবিনের সামনে দরজার হাতল ধরে দাড়িয়ে আছি, মনের অবস্থা কতো কষ্টদায়ক হবে ভেবে পাচ্ছিনা। শত হোক উনার বাবা! বাবা হারিয়েছেন উনি। আমি উনার জায়গায় হলে সেন্স হারাতাম হাজারবার। বুকে ভরসা নিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লাম। হাতল চেপে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। উনি চোখবন্ধ করে শুয়ে ছিলেন, ভেতরে ঢোকার “ক্যাচ” শব্দেই আমার দিকে তাকালেন। আস্তে গলায় বলে উঠলেন,
–ভেতরে আয়….
আমি ঢুকলাম, দরজা আপনাআপনি বন্ধ হলো। উনি বামহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে কাছে ডাকছেন আমায়, চোখের পাতা নামিয়ে বোঝাচ্ছেন- “প্লিজ তুই কাছে আয়”। হালকা পায়ে হেটে উনার বেডে বসি আমি। উনি বামহাতটা আমার গালে রেখে দিলেন। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে আমার গালে বুলাচ্ছেন , চোখমুখে প্রশ্নের বিদ্ধতা উনার, কি প্রশ্নে খুচখুচ করছে উনার, আমি তা জানিনা। কপাল কুচে বললেন,

–থাপ্পর দিয়েছে পাকনি, কে মারলো?গাল লাল হয়ে আছে।
সহজভাবে বললাম,
–কেউ মারেনি, মশা বসেছিলো। আমি মেরেছি।
–বেডে শুয়ে, হাতে সেলাই, ধাক্কা খেয়ে পড়ে আছি তুই আমায় মিথ্যা অজুহাত দেখাচ্ছিস? ত্যাড়া ত্যাড়া কথার জবাব দেওয়াটা সাইডে রাখবি? আমি মিথ্যা পছন্দ করিনা মম । প্লিজ, কে মেরেছে?ফুপি?

গাল থেকে উনার হাত সরিয়ে নিচু স্বরে বললাম,
–আমার কিছুই হয়না, সরকারি মাল আমি, দুমকা হাওয়ায় দুমড়ে এসে ঠাঠানো চড় খেয়ে হেলে যাই। বসে বসে গুনি, কয়টা খেলাম। ভালোই।
–কষ্ট হচ্ছে?
–চড়ের কষ্ট না, বাবা চলে যাওয়ার কষ্ট। আপনি বেডে শুয়ে আছেন নির্মম কষ্ট। আমি আর পারছিনা মুগ্ধ। আমি ডিভোর্স চাই। এতে আপনি খুশি, আমিও খুশি। সমাজও চুপ, ফুপিও চুপ। রূপাকে বিয়ে করে সংসার করে নিয়েন, আমি ইন্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যাই। ফিরেও আসবো না। নিজের পায়ে দাড়াতে পারলো, একদিন বিকেলে চা খেয়ে যাব, নয়তো কলুষিত মুখ আমি আদৌ দেখাবো না। অনেক হয়েছে।

মুগ্ধ হতভম্ভ হয়ে আছেন। আমি জানি আমার কথার পরিস্থিতি আগাগোড়া বাতলে দিবেনা, কিন্তু সব ছেড়ে দূরে গেলেই বোধকরি পিছুটান আর থাকবে না। ডানহাতে ফুল ব্যান্ডেজ, চোখে অমলিন কথা, কিছু কথা আমি বুঝতে পারলেও জানতে চাইনা তার ব্যাথা। কষ্ট আমারো হচ্ছে, তিন বর্নের শব্দ নিয়ে “ডির্ভোস” কথাটা মনের ভেতর চুরচুরে করলেও জমের মতো শক্ত হয়ে আছি। উনি চোখ টলমল করে তাকিয়ে আছেন, আমি নষ্ট তারঝোলানো এসির দিকে তাকিয়ে আছি।

–ডির্ভোস চাস? না চাইলে হয়না? স্বার্থপরের মতো কিভাবে বলতে পারলি, ডিভোর্স চাই? বিয়েটা যদি নিজের মনমতো করতে পারিস, বিচ্ছেদ তো আর মনমতো হতে যাবে না, এখানে আমারো গুরুত্বপূর্ণ মত আছে।

–আপনি কি স্বামীশাষিত সমাজের মতো অধিকার ফলাচ্ছেন? স্বামীর আজ্ঞাধীনে স্ত্রী ঝুকে থাকে তা চাচ্ছেন? আমি আপনাকে জোর করে বিয়ে করেছি, এখন আমি আপনাকে জোর দেখিয়ে মুক্তি দিতে চাচ্ছি!

–ভাইকে বিয়ে করতি, আমি তো দূরে চলে গিয়েছিলাম। সবার চোখে অপমানিত হয়ে কেন আমাকে বিয়ে করতে গেলি?

–জবাবটা নতুন করে বলার প্রয়োজন দেখছি না। আমি কাল সকালে ঢাকায় চলে যাব, মনিরা ব্যবস্থা করে দিবে। আপনি এখানে আপনার পরিবার ও আপনার পেশা নিয়ে পড়ে থাকুন, আমি চললাম! হাতে একমাস সময় আছে আমি ভর্তি কোচিংয়ে এডমিট হয়ে ইন্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে এক্সাম দিতে চাই। চান্স পেতে পেতে আপনি ডিভোর্স পেপার রেডি করুন। ডিভোর্স দিবো! আল্লাহ হাফেজ মুগ্ধ, আমি মনিরার হোস্টেলে গেলাম। ঠিকানা ছেড়ে যাব কিনা পরে ভেবে দেখবো, আসি!

তার বেরিয়ে খোলসযুক্ত সাদা এসির দৃষ্টিপাতে চোখ রেখে গটগট করে সব বলে গেলাম। উনার দিকে ফিরেও তাকাইনি, আমার মহিম শক্তি নেই। উনি কান্না করছেন কি করবেন, কেমন থাকবেন বা আছেন – আমার জানতে চাওয়ার ইচ্ছাশক্তি নেই। আমি এখন বাচঁতে চাই। কারোর পা চেটে বসবসে চড়ের পর চড়ের খেয়ে, মুখ বুজে সহ্য করতে চাইনা! আমি মেয়ে! হেয়প্রতিপন্ন না! নিজের সন্ধান নিজেই খুজে বের করতে পারব। পূর্বের করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত এখন ভোগ করবো! উনি ভালো থাকুক। নিজেকে নিয়ে স্বার্থান্বেষী হতে হলে আমার কোনো সমস্যা নেই। ভুল আমি করেছি, ভুল আমি শোধরাবো, ডানে-বামে কি ঘটবে ভবিষ্যতে জানাবো।

উঠতে যাব মুগ্ধ আমার শাড়ির আচঁল টান দিলেন। টান অনুভবে আমি উঠলাম না বসলাম। কিন্তু আমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে দরজায় তাকিয়ে আছি। উনার চোখের কান্নাবিন্দু দেখলে আমার কাজে চরমসীমায় বিঘ্ন ঘটবে, আমি তা চাইনা। গলা জড়ানো সুরে বললেন,

–ছেড়ে যাস না প্লিজ, আমি বিচ্ছেদ চাইনা প্লিজ, আমি চাই না। আমাদের বিয়ে হয়েছে, হাসি-তামাশা না!! আমি নিজ দায়িত্বে তোকে পড়াবো। তোর স্বপ্নপূরনে আমি সাহায্য করবো।আমি আছি তো!! আমার টাকার কমতি? টাকার অভাব? দেখনা পাকনি দেখ প্লিজ… আমরা সবার থেকে দূর….বাসা থেকে দূর, আলাদা শহরে থাকছি, এতোকিছু কার জন্যে করছি? ডিভোর্সের জন্যে?আমার অসুস্থতার সুযোগ নিস না রে….আমি তোকে ছাড়া দূর্বল…

আপ্লুত হয়ে বেদনায় কাদছিলাম। “আনন্দ অশ্রু” বলে কথা আছে একটা, হাসতে হাসতে মানুষ কাদেঁ, আমি এখানে কাদতে কাদতে হাসছি, ব্যাপারটা উল্টো না? কেদেঁ দিয়ে হাসে কেউ? আমি হাসছি।। একটা ছেলের অনুনয়-বিনয়, কান্না-অভিযোগ, সব আমি আর্বজনা ঢালার জব্দ স্তুপে ফেলে দিয়ে যাচ্ছি।নিজের স্বপ্ন গড়ার অভিসারে আমি আবার পুরনো রূপে ফিরে যাচ্ছি, পুরোনো সেই শক্ত, অনড়, সাক্ষাৎ প্রতিবাদে ফিরবো আরো একবার, সেই আমার – “আমি” তে দেখিয়ে দিব নতুন করে বাচার।

“আলবিদা !”

-চলবে🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here