যদি বলি ভালোবাসি🍁 পার্ট ২৭

0
1370

#যদি_বলি_ভালোবাসি ♥
#PART_27
#FABIYAH_MOMO🍁

–স্যার…স্যার জলদি আসুন! পেশেন্ট আবার পাগলের মতো ব্যান্ডেজ খুলার চেষ্টা করছে! সেলাইয়ের জায়গায় রক্ত ঝড়ছে স্যার!ব্যাপারটা সাংঘাতিক!

–হোয়াট! আবার? ডক্টর মুগ্ধ স্টেব্যাল না? এক্ষুনি ইনজেকশন রেডি করুন নার্স! লক্ষন ভালো না! সেলাই খুলে গেলে রগে দারুন ক্ষতি হবে!

নার্স এক ছুট দিল ইনজেকশন রেডি করতে। ডাক্তার লিয়াকত গেলেন মুগ্ধ নামক নিউরো ডিপার্টমেন্টের ডক্টরকে শান্ত করতে। রোগীটা নাগালের খুব বাইরে চলে গিয়েছে, কখন কি উটকো কাজ করে ফেলে কেউ জানেনা। এই নিয়ে দুইবার বাম হাতে সেলাই করা জায়গার ব্যান্ডেজ টেনে খুলার চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই ব্যান্ডেজের টানাটানিতে সেলাইয়ের জায়গা খোচা লেগে, কাচা হয়ে তাজা রক্ত গড়িয়েছে। কারোর কিচ্ছু করার নেই, রাত থেকে পেশেন্ট নিজেকে মার্ডার করার অন্তিম চেষ্টা করছে, কিন্তু নার্স ডাক্তারের টানাপোড়নে সেই চেষ্টা কোনোভাবেই ফলাফল রূপ ধারন করেনি। এবার কি তাহলে রক্ষে হবে? নাকি অন্তিম থেকে চূড়ান্তে এসে মৃত্যুর পন্থা বেছে নেবে?

— তুই যাবি না তুই যাবিনা না না যাবি না….তুই স্বার্থপর! তুই কখনো আমাকে ভালোবাসিস নি! তুই স্বার্থপর! তুই কেমন পারলি? আমি.. আমি..আমি..নিজেকে শেষ করে ফেলব!! সব শেষ কর‍ে ফেলবো! তুই যাবি তাইনা!! তুই চলে যাবি!!…আমি….

মুগ্ধ বেড থেকে নেমে পাগলের মতো কথা বলা শুরু করে দিয়েছে, হাতের কাছে সব জিনিস ছুড়ে আছড়ে ফেলছে, রুমের মধ্যে লন্ডভন্ড তান্ডব! ট্রেতে যতপদের কাচের শিশি ছিলি সব মেঝেতে চুরমার হয়ে আছে, ব্যান্ডেজ খুলে হাতের একপাশে সেলাই জায়গাটার সাথে জবুথবু হয়ে ঝুলে আছে। বামহাত রক্তাক্ত, তাজা তরল লাল রক্তে ব্যান্ডেজ ভিজে উঠছে, ফ্লোরে ছিটকাচ্ছে, বেডশিটে পড়ছে, হঠাৎ মুগ্ধ ট্রলি উঠিয়ে আছাড় দিতে নেবে ডাক্তার লিয়াকত দরজা খুলে হতবাক হয়ে যায়। মুগ্ধ পাগলের ন্যায় ভয়ংকর আচরন করছে। রাগে ফুসছে ও…হাতে ট্রলি যেকোনো মূহুর্তে ফ্লোরে আছড়ে ফেলবে! ডাক্তার লিয়াকত পরিস্থিতি টালার জন্য ভেতরে ঢুকে অভয় দিয়ে বললেন,

–ডক্টর..ডক্টর…দেখুন প্লিজ আপনি শান্ত হন। দেখুন ট্রলিটা রেখে দিন, আপনার সর্বনাশ হয়ে যাবে ডক্টর মুগ্ধ। প্লিজ প্লিজ আপনি আমাদের সাথে কো-অপারেট করুন। মাথা গরম করলে আপনি ট্রাবেলে পড়বেন, প্লিজ আন্ডারস্টেন্ড!

মুগ্ধ কথাটা কানে নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, তাই আরেক তান্ডবলীলা হিসেবে ট্রলিটা ছুড়ে ফেলল ফ্লোরে! ভস্মস্তুপ ভাঙ্গার মতো বিকট শব্দ হলো! তাতেও ক্ষান্ত নেই সে, আরো চাই! আরো চাই ভাঙ্গার! ও চলে যাবে? আমাকে…আমাকে ও চোখে দেখে না? আমি অমানুষ? এই আমি মানুষ না?? তুই তুই যাবি না! তুই রাদিফকে ছেড়ে যাবি না! তোর জন্য বাবা আমাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে! তোর জন্য আমি পরিবার ছেড়ে বিদেশের মাটিতে থেকেছি! তোর তোর তোর জন্য! তুই স্বার্থপর! তুই স্বার্থপর!

মুগ্ধ দেয়ালে ঘুষাতে শুরু করলে ডক্টর লিয়াকত পেছন থেকে কোমর টেনে দেয়াল থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একা ডক্টর সামলাতে প্রচণ্ডভাবে হিমশিম খায়।যদি স্টেচ খুলে যায়! হাতের ব্যাপক ক্ষতি হবে যা ধরাছোয়ার বাইরে! ভাগ্যবশত, ওয়ার্ড বয় এবং নার্স এসে ডক্টর লিয়াকতের সাথে এসে সাহায্য করে। তাতে বেগতিক উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি আর বিস্তার লাভ ঘটেনা। ওয়ার্ড বয় হাত-পা ধরে বেডে শুয়িয়ে দেয়, নার্স অপরদিকে ইনজেকশন পুষ করানোর জন্য হাত টেনে ধরে। ব্যস! মুগ্ধ ধীরেধীরে শান্ত হতে থাকে। সবাই হাপাচ্ছে। ডাক্তার লিয়াকত পকেট থেকে রুমাল বের করে ধস্তাধস্তির কারনে কপালে জমা ঘাম পরিস্কার করে নেয়, নার্স ও ওয়ার্ড বয়ের একই হাল। মুগ্ধ শান্তশিষ্ট হয়ে যায়।ডাক্তার বাকিদের রুম ছেড়ে যেতে বলে। সে মুগ্ধের হাতে নতুন ব্যান্ডেজ করে দেয়াতে হাত ধরলে হঠাৎ কৌতুহল মনে জিজ্ঞেস করে-

–আপনি একজন ডক্টর মিষ্টার। এভাবে কো অপারেট না করলে আপনার সাথে আমাদের অসুবিধা হতো না?

মুগ্ধ চলন্ত ফ্যানের বৃত্তাকার পথে তাকিয়ে আছে। চোখে অশ্রু। পাশে বসা ডক্টর লিয়াকত কি কি বলছেন সব শ্রবন ইন্দ্রিয় দ্বারা শুনছে। একটা ঢোক গিলল, বাম চোখের বাম কোনা থেকে বড় ফোটা গড়িয়ে পড়ল।

–কখনো ভুল ছাড়া শাস্তি পেয়েছেন? বিনা ভুলে শাস্তি?
ডাক্তার লিয়াকত তুলো দিয়ে রক্ত মোছা থামিয়ে দিলেন, হকচকিয়ে তাকালেন। কিছুটা অবাক মুগ্ধের কথায়।
–সরি? বুঝলাম না মিস্টার।
–আমার ওয়াইফ! আমার ওয়াইফ আমাকে বিনা ভুলে শাস্তি দিয়ে চলে গেছে ডাক্তার। যে ভুল আমি করিই নি, সেই ভুলের শাস্তি দিয়ে গেছে। ডক্টর? ক্যান ইউ এ্যারেন্জ সাম পয়জন প্লিজ? ডোন্ট ওরি, ইউ ওন্ট হেভ টু ফেস এনি প্রবলেম রির্গাডিং দিজ,

ডাক্তার লিয়াকত এখন আশ্চর্য হয়ে সপ্তম আসমানে ধাবিত হয়েছেন। একজন ওয়েল প্রফেট নিউরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ভালো পজিশনে স্টে করা ডক্টর সুইসাইড এট্যাম করার করা বলছে। ডাক্তার লিয়াকত কথাটা নিতেই মনের মধ্যে কারনটা জানার জন্য উৎসুক করছে। একসময় সে না পারতে বলেই দেয়,
–আপনি সুইসাইড কেন করতে চাচ্ছেন ডক্টর? এজ ফার এজ আই নো, আপনি রোমেল আবরারের ছোট ছেলে প্লাস কানাডা থেকে ভালো জুরিখে দেশে এসে ডাক্তারি করছেন। এমন ভীতিকর স্টেপ নিতে চাচ্ছেন?
মুগ্ধ মৃদ্যু হাসল। হাসির কারন, রোমেল আবরার তার বাবাকে নিয়ে।
–রোমেল আবরার বেচে নেই ডক্টর, নিউজ তো মেবি পেয়েছেন।
–জ্বি, পেয়েছি। কিন্তু মিস্টার আপনি আমার কথার জবাব দিলেননা,
–শুনবেন? আই হোপ আপনিও শুনে শক্ড হবেন,
–শক্ড?
–ইয়েস! আমার ওয়াইফ স্নিগ্ধা মম, মাই লাভ, মাই লাইফপার্টনার, মাই এভ্রিথিং! ভালোবাসি তাকে। নিজের চাইতেও বেশি। ইউ নো, ও আমাকে কিডন্যাপ করে বিয়ে করেছিলো। সে এক হিউজ ঘটনা। মায়ের ওয়াদার কাছে ওকে বড়ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, ও মানতে নারাজ। ওর পরিবার আমার সাথে বিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে ছিলো, আমার ফ্যামিলিও তাতে এড হয়ে গেল। জাস্ট অনলি ফর এ্যা “প্রমিস ফ্যাক্ট”! দুই ফ্যামিলির এগিনেস্টে ও বিয়ের দিন বিকেলে আমায় কিডন্যাপ করে। বিয়ে করে। আমি আর বাধা দেইনি, কজ দ্যা গার্ল ইজ আউট অফ মাইন্ড। কখন কি করে ফেলে বোঝার বহুহাত বাইরে। বিয়ে করলাম, নিজের বাসায় তুললাম। বাট হ্যাপিতে রাখতে পারলাম না। সবাই ওকে কথা শোনাতে লাগল। আমার আম্মু, বড় ফুপি, ফুপাতো বোন রূপা সবাই ওকে কথা শুনাতে লাগল। রাতের বেলা ও ঘুমালে আমি ঘুমাতে পারতাম না ডক্টর। ওর দিকে তাকিয়ে আমি আগামীকালের চিন্তা করতাম, সামনে কি হবে? কিভাবে সব মোকাবেলা করবো? মেয়েটা আমার জন্য সব নিলামে চড়িয়েছে, আমি হসপিটালের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সারাদিন কেবিনে বসে ভাবতাম, বাসায় ও ঠিক আছে ? কেউ কিছু শোনালো? ডক্টর আমার ওয়াইফ না একটা ডেভিল! রাস্তায় কেউ টিজ করলে জুতা মেরে গাল ফুলিয়ে দিতে পারতো! অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করতো, চুপচাপ টলারেট করার মতো মেয়েই না। কিভাবে হেরে গেলো? আমি খুব রাগী ডক্টর কিন্তু ওর কাছে গেলে বাচ্চার মতো শান্ত হয়ে যাই। কতবার যে কলার টেনে আমাকে ঝুকিয়ে ফেলেছে আনকাউন্টেবল। তবুও ছোট্ট ছোট্ট আবদারগুলোকে আমি ভালোবাসি। ছোট্ট পাকনি আমার। আমাকে ছেড়ে চলে যাবে আমি মানতে পারছিনা!আমি ওকে ভালোবাসি। ভালো রাখতে যেয়ে সব ছেড়ে দিয়েছি। আলাদা ফ্ল্যাট কিনে ওর নামে দিয়েছি। আমার জমানো সব টাকা ওর ফিউচারে রেডি করছি। ও আমায় বুঝলোই না ডক্টর! রাতে আমার কাছে ডিভোর্স ফাইল নিয়ে আবেদন করে বসেছে, আমি কোথায় যাবো? আমার পরিবার একপায়ে দাঁড়িয়ে ফুপাতো বোনের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে। বড়ভাই ওকে বিয়ের পর থেকে দেখতেই পারেনা, আম্মু আমাকে মেনে নিলেও ওয়াইফকে দেখতে পারেনা। ওকে সবাই ভার্বায়ালি টর্চার করে। পরিবারের কাছে আমার হাত শিকলে বাধা! আই ওয়ান্ট টু সুইসাইড ডক্টর! মরে যেতে চাই!

ডক্টর লিয়াকত থমকে গেছেন, ইয়াং জেনারেশনের নিউকামার ডক্টরের মুখে সুইসাইড শব্দটা কতটা বেমানান। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। মুগ্ধ কাদছে। ব্যান্ডেজ করে বা হাতটা সোজা করে রাখলেন। ডক্টর লিয়াকত আফজাল বয়সে খুব বড়, বলতে গেলে মুগ্ধের বাবার বয়সী। তার চোখের সামনে একটা ছেলে কাদছে, উনার খুব বিবেক নাড়াচ্ছে। উনি পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুগ্ধের কোমল মুখটা মুছে দিলেন। সহজ হয়ে বললেন-

–সুইসাইড কারা করে জানেন, যারা জীবন যুদ্ধ অংশগ্রহণ করতে জানেনা। খুবই বোকা হয় তারা। আপনি কি বোকা? অবশ্যই বোকা নন। ওয়াইফ ছেড়ে গিয়েছে, বিচ্ছেদ চেয়েছে। কিন্তু ডিভোর্স কি হয়েছে? স্ট্যান্ড আপ ম্যান! কাদলে আপনার জিনিস ফিরে আসবে না। তাকে নিজের কাছে আনার জন্য লড়তে হবে। এফ্রড ছাড়া লাইফ টিকে না! কাদলে মনে কষ্ট ছাড়া কিচ্ছু পাবেননা। উঠুন!

মুগ্ধ ডাক্তারের সৌজন্যসূচক ব্যবহারে চোখের পানি বন্ধ করলো। মনের ভেতর নানা প্রশ্নের ছড়াছড়ি হলেও এখন তার মধ্যে একটা সুরই বেজে চলছে, আমি তোকে ফিরে চাই! তোকে আমি ছাড়ব না! নাও ইটস মাই আল্টিমেটাম!

.
.

মনিরা উত্তর টু দক্ষিণ দিকে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে, পায়চারি বললে বড্ড ভুল হবে সে নিজের সাথে হাটার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছে। একমিনিটে দুশো রাউন্ড হাটা! মাথায় খোপা মোড়ানোর পাশাপাশি খুলির ভেতরে টেনশনের ঝুলি উপচে পড়েছে, কেননা নিজের অতীব কাছের বান্ধুবী “মম” নামক ক্রিয়েচারটি বিছানায় বসে। সকাল এখন সাতটা! হোস্টেলের রুমমেট শিফা ছাড়া ওয়ার্ডেন মহিলা জানেনা এ মেয়েলি হোস্টলে তালিকাভুক্ত ছাড়া আরো একজন মানবী উপস্থিত। মনিরা ঢোলা প্লাজো ও পাতলা টিশার্টে গলায় ওড়না ঝুলিয়ে পায়চারী করছে। সে হাত ভাজ করলো এবং ভ্রু উচিয়ে কাঠিন্য করে বলল,

— ****!*****!শেলফিস!**! মুগ্ধ ভাইয়ের কি অবস্থা হইতে পারে ইমেজিন করছোস **! কেমনে ঢ্যাং ঢ্যাং করে এইখানে চলে আসলি! তোকে উনি একা ছাড়ছিলো! বাল ছাল মহিলা!

মম বিছানায় বসে কোলে বালিশ নিয়ে মাথা নুয়িয়ে কাদছে, শব্দ না হলেও “টুপটুপ” কান্নার সাথে হালকা হালকা ফুপানো হাওয়া আসছে। মনিরা মমর কান্ডে অগ্রীম সীমায় রেগে আছে! এমন হতো, শ্বশুরবাড়ির পরিবার স্বীকৃতি জানায়নি বলে স্বামীও ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ঘটনা বিপরীত! স্বামী সাপোর্ট দিচ্ছে। বউ উল্টো অসুস্থ বেডে শোয়া হাতের অপারেশন করা স্বামীর সঙ্গ ছেড়ে বান্ধুবীর বাসায় বিবেক নাড়িয়ে কাদছে। কেমন উচ্ছৃঙ্খল ! মনিরা মমর মাথা উঠিয়ে উচু করে ধরে, চোখে চোখ রেখে রাগী কর্কশ গলায় বলে,

–তুই ভাইয়ের কাছে ফিরা যা মম! ন্যাকামি করিস না। থাবড়া খাবি ! তোর বালের শ্বশুরবাড়ির চটকানি খাইয়া তুই ওই মানুষটার হাত ছাইড়া দিবি? তোরে বহুত ভালোবাসে বইলা ওই মানুষটার মূল্য নাইরে!!…ওই ছেরি! চোখ বন্ধ করবি না! তাকায়া কথা ক! তোরে আমরা শা***মার্কা ডিভোর্স দেওয়ার লিগা বিয়েতে হেল্প মারাইছি! চোখ খুইল্লা কথা কবি!

মম কান্নামাখা ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে ছিলো।চোখ খুলে হেচকি তোলা সুরে বলে,
–দোদোস্ত…আমি যাবো না, ফুফুপি অঅনেক খখারাপ দদোস্ত…উউনারে…আআমারর…সসাথে….দেখখতে পাপারে না…

মনিরা এক থাপ্পড় কষে তর্জনী আঙুল উঠিয়ে বলল,
–শালার ঘরে শালা! তুই এই কথা কস! বিয়ার সময় চক্ষু দুইটা আকাশে ফেলায়া আইছিলি?? কথা বলার জায়গা পাসনা তুই!!তোর জন্য ওই পোলা কেন কষ্ট পাইবো! আমারে এইটা ক ! কম তো কাহিনি করোস নাই! এখন বেচারারে হাসপাতালে ফালাসা তুমি বান্ধুবী মারাইতে আইসো!

অশ্রাব্য, কটুক্তি যুক্ত বেসামাল কথা শোনাচ্ছে মনিরা। তার মনে দাউদাউ আগুনের প্রজ্জলনের মতো রাগ জ্বলছে। কিভাবে পারলো নিজের হাতেগড়া সম্পর্কের ইতি টানতে? একমাস আগে এই প্রতিশ্রুতিতে মনিরা, ইতি বাকি সবাই বিয়েতে সাহায্য করেছিলো? এইদিন দেখার জন্য? ইতির সাথে যোগাযোগ চ্ছিন্ন, গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে। সাফিন কুয়েতের ব্যবসা সামলাতে বিজি। মিরার কোনো খোঁজই নেই মমর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর। আবির পথের পথিকের মতো বাসায় শুয়ে, অফিসে বসে দিন পার করে। অবশিষ্ট ছিলো মনিরা। মনিরা নিজেকে শান্ত করে, বড় শ্বাস ছাড়ে।

–তাকা! বেশি দেরি হয়নাই। আমি আছি। তুই আমার সাথে চল। তোর ওই ফুপিটুপিরে আমি ঝাড়ু দিয়া বাইড়ায়া বাইড়ায়া কেমনে খেদাই দেখিস! মুখ ধো! রেডি হ। শাড়ি খুইলা, আমার কুর্টি পড়। ওই বেডিরে সাইজের পর ফাল্ডি না কইরা গরুর গোবরে ঢালতাছি! তুই খাড়া!

মম নিজেকে স্বাভাবিক করে নাক টেনে নিল। শাড়ির আচঁলে অশ্রু নয়ন মুছে গালের ভেজাভাব মুছলো। নিজেকে সিরিয়াস করে মনিরাকে বলল,
–তুই আমাকে সাপোর্ট করবি নাকি করবি না! আমি অতিরিক্ত কথা শুনতে চাইনা। লেকচার অফ!
–তুই কি মেন্টাল মম? মানে মাথা কি পুরাই গেছে? কারে ছাড়ার কথা চিন্তা করতাছোস? রাদিফ মুগ্ধরে?? তোর জামাই! তোর ভালোবাসা! তোর প্রেম! তোর মহব্বত! তুই হেরে ছাড়বি? আমি বইন পারতাছিনা…..মাথায় রক্ত উঠলে খারাপ কিছু হইয়া যাইবো!
–দেখ মনিরা! আমি সকল ইন্দ্রিয় খোলা রেখেই ডিসিশন নিছি, যেটা ফাইনাল! আমি বাড়তি কথা বলতে চাইনা।
–তুই বুঝতাছোস না কেন! বিয়াশাদি খেলা? মনমর্জি মতো বিয়া করলি! মনমর্জি মতো ডিভোর্স নিলি? খাজুরা রিলেশনের মতো ব্রেকআপ মারাও! এইটা ব্রেকআপ মারানের সম্পর্ক?
–প্লিজ মনিরা আমি যদি তোর কাছে ইর্ম্পট্যান্ট হয়ে থাকি তো জ্ঞান দেওয়া বন্ধ কর! আমি মুগ্ধের কাছে যাবো না। সরল কথায় বলছি, যাবো না।
–পোলায় যদি মরলো? দায়ভার তুই নিবি! জিন্দা লাশ হইয়া থাকতোনা বলতে পারবি?
–উনি ম্যাচিউর, যুক্তিবাদী ছেলে। আমার বিশ্বাস, উনি এসব করবেন না।
–আমি কিছু কইতাম না! সময় আসুক! তুই যে কত্ত বড় আকাম করলি!! বুঝবি !
.
.

বিকেল চারটা। দুপুরের কড়া রোদের সূর্যটা এখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছে। মনিরা রেগে আছে, কথা বলছেনা। শাড়ি পাল্টিয়ে কুর্তি পড়ে আছি, রুমে এখন থেকে তিনজন বাস করবো। মনিরা, আমি, শিফা। শিফা টিউশনি করতে গিয়েছে, মনিরা রাতের খাবারের জন্য বাজার করতে, আমি রুমে একা বসে আছি। হাত খালি, টাকা নেই। ফোন করে ভাইয়াকে বলেছি টাকা বিকাশ করতে, কিন্তু মনিরার ফোনে। মুগ্ধ ভালো আছেন, হসপিটাল থেকে ডিসর্চাজ নিয়েছেন। আবির ভাইয়ার কাছ থেকে জানলাম। ছয়তলা থেকে গ্রিল ধরে বাইরের দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগে। আমি একা। নিজের পড়াশোনার অজুহাত দেখিয়ে উনাকে ছেড়ে এসেছি, অমানুষিক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে মাফ করবেন ডাক্তার সাহেব। আপনার কাছে স্বার্থান্বেষী লাগলেও আমার কাছে এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। জানেন? আমার না উচিত ছিলো গলায় দড়ি দিয়ে আগেই মরে যাওয়া। পারলাম না কেন জানি, তার উপর আপনাকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছি, নিজের সাথে গোলমাল বাজাচ্ছি।

মনিরার সাইড ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে নিচে নামলাম, মন খারাপ। আবির ভাইয়াকে ঠিকানা বলেছি, উনি দেখা করতে এখানে আসছেন। সামনে একটা গার্ডেন এরিয়া আছে, ওখানে বসবো। আমি গার্ডেনে গোলটেবিল ও চেয়ার সাজানো জায়গা পাতানো সাইডটায় গেলাম। চেয়ার টেনে বসলাম, সারি সারি চেয়ার-টেবিল সাজানো হয়েছে গার্ডেনের ভেতরে মানুষের অবসর সময় কাটানোর জন্যে। ভাইয়া আসলেন। “সিনু” বলে ডাক দিয়ে আমার অপজিট চেয়ার টেনে বসলেন, এক চিলতে হাসি দিয়ে বললেন-

–বদমাইশ ভুটকি!! কি খবর!! কি খাবি? আইসক্রিম? দোকান থেকে কিছু যে আনবো মনে ছিলো না!!
–ভাই প্রথমত তুমি ভুটকি ভুটকি করা বন্ধ করো! বুঝছো! আমি কোনদিক দিয়ে ভুটকি লাগি? আমার মতো চিকনিরে তুমি ভুটকি দেখো?
–ছোটবেলায় ড্রাম আছিলি ড্রাম! খাই খাই কইরা সারা বাড়ি খাইতি! আর আব্বু তোরে কাধে উঠায়া…..

আব্বুর কথাটা শুনে মনটা ছ্যাত করে উঠলো।হাসিটা উবে গেল ঠোট থেকে। আবির ভাইয়াও হাসিমুখে কথা বলা পাল্টিয়ে কুচকুচে কালোমুখ করে নিলেন। আমি প্রসঙ্গে ঘুরিয়ে হাসি দিয়ে বললাম,

–ভাই কফি হলে মন্দ হয়না !! কি বলো?
–হাদা একটা! গার্ডেনে কফি কই পাবি? এইটা রেস্টুরেন্ট না।
–কথা অতি সত্য! আচ্ছা বাদ দেও। তোমার খবরাখবর বলো। মিরা আপু? সে কেমন আছে?
ভাইয়ার মুখটা আরো কালোঘন হয়ে গেল। মিরা আপুর ব্যাপার নিয়ে আমি এখনো তদন্তের পৃষ্ঠা দেখিনি, মস্ত কিছু ভুলই করে ফেলেছি।

–ভাইয়ু? চুপ থাকলে চলবে? মিরা আপুর বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কেউ জানাবে তাই মানুষের অভাব। তুমি বলবে?

–মিরার কাবিন হয়ে গেছে সিনু..

বুকভরা ব্যাথার তৎক্ষণাত প্রকাশ পেল ভাইয়ার। উনি মিরা আপুকে পছন্দ করতেন, বিয়েও করে নিতেন। কিন্তু কেন সেটা বাস্তবায়ন হলো না, এখন জানতে হবে!
–কি বলছো ভাই! মিরা আপুর বিয়ে হয়ে গেল তুমি আমাকে জানাওনি! কেমন কাজ করলে ভাই? মিরা আপু আর তুমি দুজন দুজনকে ভালোবাসো তাও?
–ভালোবাসলেই বিয়ে করা হয়না সিনু, আমার চেয়ে ভালো তো তুই ফিল করছিস। মুগ্ধকে বিয়ে করে ছেড়ে দিবি, পাপের চেয়ে কম না?
–আমার কথা বাদ ভাই! আমারটার সাথে তোমার টা জোড়া না!
–কেন কে বলছে? জোড়া না কে বলল? তুই ভাবতে পারোস! মুগ্ধ যে সুইসাইড করার চেষ্টা করছে? আমি বা মিরা ওই কাজ কিন্তু করিনাই আর আমরা আলাদা হয়ে ভালোই করছি। ঠিক আছি।

হাতের মুঠো গুটিয়ে আসলো! ‘সুইসাইড’! উনি সুইসাইডের চেষ্টা করেছে? আশ্চর্য! আমি অন্যের ঝাড়ু-লাত্থি-চড়-গালি খেয়েও সুইসাইড করতে পারিনি!!উনি আমার বিরহে সোজাসুজি সুইসাইড! বুকের ভেতর ঢিপঢিপ তালে যন্ত্র চললেও নিজেকে অর্নবর হতে দিচ্ছিনা। আমার জন্য স্বার্থপরের খেতবই ঠিক আছে। পার্ফেক্ট!

–মুগ্ধকে বলবেন বিয়ে করে নিতে। আমাকে ডিভোর্স লেটারটা দিয়ে মুক্তি দিতে। আমি উনার সাথে আর এগুতে চাইনা।

আবির ভাইয়া হুট করে কথাটা আমলে নিয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।

–ভাইয়ের বন্ধুর সাথে প্রেমগাথা করতে ভাই কোনোদিন সাহায্য করেনা সিনু! তোরে আমি প্রথমদিন থেকে সাহায্য করছি! বিয়ের দিনও পারতাম রাফিন ভাইয়ের সাথে তোর বিয়েটা দিতে কিন্তু দেইনাই! তোর খেয়ালখুশি মতো আমি চলছি! কিন্তু হইছে ভাই ব্যস! আর ভাই-ভাই করার শখ রাখিনাই! শেষ রিকুয়েস্ট করবো! রাখলে তোর মঙ্গল নাইলে তোর জীবন অভিশপ্ত। তুই ভদ্রতার সাথে মুগ্ধের কাছে ফিরা যা। ও তোরে সবদিক দিয়ে ভালো রাখবো!

–মনিরাকেও বলেছি তোমাকেও বলছি, আমি যাবো না। উনি আমাকে ছাড়াই ভালো থাকতে পারবেন। আমি রাতে ফোন করে কসম দিয়ে দিচ্ছি, যেন পরেরবার সুইসাইডের চিন্তা মাথায় না আনে।

.
.

রাতে ফ্লোরে বসে খাতা নিয়ে রুটিন করছি, এই একমাসে কিভাবে ইন্জিনিয়ারিং যোগ্যতা হাসিল করা যায় তা নিয়ে। ইন্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে চান্স পেতে হলে পুরো হরদমে পড়া দিতে হবে। সমস্যা একটাই! আমার বই-খাতা-কলম-ক্যালকুলেটর সব বাসায়। বাসায় বলতে এমন বাসায় যে বাসায় আমাকে এবং মুগ্ধকে চড় মেরে থু দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। অসম্ভব! ওই বাসা থেকে নিজের জিনিসপত্র চাওয়া কোনো আক্কেলেই ঠিকনা। আমি বসে আছি। মনিরা এখনো কথা বলছেনা, রাত বাজে দশটা বাইশ। ও ওর পড়া গুনগুনিয়ে পড়ছে, আমি দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কলম কামড়াচ্ছি।শিফা ঘুমিয়ে। হঠাৎ আমাদের মেইন দরজায় কেউ কড়া নাড়লো, মনিরা আমার দিকে সরু চোখে তাকালো। মনে হচ্ছে দরজার বাইরে আসা মানুষ আমার পার্সোনাল মাল! আমার জিনিস! মানে আমার জামাইও হতে পারে। চিন্তা করছি মনিরার মুখ কি আবার নর্দমার মতো ছুটে নাকি! আমি কলম কামড়ানো বন্ধ করে মনিরার দিকে পাল্টা চোখে তাকালে ও গড়গড় করে বলে উঠে-

–তোর সোয়ামী আইসে নি জিগিন্নি!

-চলবে🍁

-Fabiyah_Momo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here