যবনিকা। (পর্ব-১) #আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা

0
214

” রোজা চলে এলো, তোমার বাপের বাড়ি থেকে ইফতার এলো না যে বৌমা?”

ইফতার টেবিলে বসতেই বলে উঠলেন আমার শ্বাশুড়ি। ইফতার বানিয়ে সব গুছিয়ে আসতে আযান শেষ হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ, একটা খেজুর মুখে নিয়ে শরবতের গ্লাসে হাত দিয়েছিলাম সবে। শ্বাশুড়ির কথায় তৃষ্ণা মিটে গেল।

একান্নবর্তী পরিবারের বিশাল টেবিল তখন মানুষে ভরা। টেবিলে সাজানো দশ পদের ইফতার। আয়েশ করে খাওয়ার ফাঁকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখছেন এদিকে। কেমন তুচ্ছ করা চাহনি। এমন ভরা মজলিসে খেতে বসবার পরেই আমার শ্বাশুড়ি দাবি দাওয়া নিয়ে বসেন। আকারে ইঙ্গিতে বুঝান, বাপের বাড়ি থেকে আনার মুরোদ নেই, আবার খেতে আসো। লজ্জা করেনা। সবার আড়ালে অবশ্য এত রাখডাক করেন না। সরাসরিই বাক্যবাণে জড়ান।

আমি কোন উত্তর দিলাম না। পানি দিয়ে ইফতার করা দরিদ্র বাবাকে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির জন্য ইফতার আনার কথা বলার সাহস যে নেই। আমার নিরবতা দেখে আম্মার অসন্তোষ রাগে রূপ নিল। গমগমে গলায় বললেন,

” শুনো বৌমা, বিয়ের পর এটা তোমার প্রথম রোজা।
তোমার বাপকে বলবা ১০রমজানের মাঝে ইফতার নিয়ে আসতে। আর চোখ ধরা জিনিস আনতে, সমাজে আমাদের সম্মান আছে। বিয়ার সময় ত একবেলা দাওয়াত কইরা খাওয়াতে পারল না, অন্তত ইফতার খাওয়াক।”

মুখে থাকা খেজুরটা এত তিতো মনে হলো! গলা দিয়ে নামল না। বাবার চেহারাটা চোখে ভাসল।
নিজের সব সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে মাস আট মাস আগে আমার বিয়ে দিয়েছেন। ঘরোয়া আয়োজনের বাহানায় বরযাত্রী খাওয়ানোর খরচা বাঁচাতে পারলেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত মেয়ের বাবার উপহার, সম্মানি থেকে বাঁচতে পারেন নি। সমাজ বলে, মেয়ের ঘর সাজিয়ে দেয়া বাবার দায়িত্ব। সব তো মেয়ের জন্যই। না দিলে সংসারে অশান্তি হয়। মেয়ের সুখের কথা ভেবে ধার কর্য করে লাখ দেড়েকের ফার্নিচার; সোফা, খাট, আলমারি, ড্রেসিংটেবিল, রান্নার সমগ্রী ছাকনি থেকে ঝাড়ু অবধি সব দিয়েছেন।

এখনো সেই ঋণের বোঝা টানছেন বাবা। মাসে যা টাকা আয় করেন সব চলে যায় দেনাদারের হাতে। এখন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। নিজেদের জন্য ও রোজার বাজার করতে পারেন নি। সেখানে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির জন্য…..

আমি আশা নিয়ে চাইলাম আম্মার পাশে বসা আতিকের দিকে। বিয়ের আটমাস হলেও আতিকের সাথে আমার পরিচয় দু’বছরের। মনের লেনা দেনা সম্পর্ক গড়িয়েছে বিয়েতে। আর কেউ না জানলেও আতিক আমার পারিবারিক অবস্থার কথা ভালোই জানে। আমার মন বলছিল আতিক মাকে বলবে, বাবা তো এক বস্তা ইফতার বাজার করেছেন। এগুলোতে হয়ে যাবে আমাদের। যদি না হয়, তবে আমি বাজার করে আনব। আমি তো ভালোই আয় করি। ইফতারের জন্য পরের বাড়ির দিকে চেয়ে থাকতে হবে না।”

পাশে থাকার মতো কথা আওড়াবে, না পারলে অন্তত প্রসঙ্গ ঘুরাবে। কিন্ত আতিক কিছুই বলল না। মায়ের পাশে বসে আরাম করে পেঁয়াজু চিবাতে লাগল। আমার দিকে একটাবার তাকাল না অবধি, এই যে টেবিল ভরতি ইফতার সাজানো, অথচ আমি খালি প্লেট নিয়ে বসে আছি, সেদিকে খেয়াল করল না। ভাবটা এমন যেন আমাকে চিনেই না। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওকে।

“রাহেলা, তুমি বেগুনি নাও নাই যে?”
আমার খালি প্লেট ডিঙিয়ে খাবারের স্তুপ থাকা প্লেটে বেগুনি দিলেন আম্মা। রাহেলা আমার ছোটো জা। এই তো মাস চারেক আগে বিয়ে হয়েছে । বাবার অর্থবিত্ত ভালো। মাস ঘরতেই বস্তা ভরে বাজার পাঠান, শীতে কার্টুন ভর্তি পিঠা। রোজা আসার দিন পাঁচেক আগেই এক গাড়ি ইফতার পাঠিয়েছেন। শ্বাশুড়ি এসবে বেজায় খুশি। লোক ডেকে ডেকে ইফতার বিলি করেছেন । আমার বড়ো ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছেন। শ্বশুরটার আত্মা বড়, দু’হাতে সম্মান করে। বাড়ির চাচী জেঠিরা পানি চিবোতে চিবোতে বাহ্বা দিচ্ছেন, ছেলে ভালো বিয়ে করিয়েছেন দেখি। তা বড়োটার কী অবস্থা? কিছু টিছু এলো না?

আম্মা তখন মুখ বাঁকান। আম্মার কাছে রাহেলার জায়গাটা আলাদা। পরিবারের সবার কাছে ওর একটা দাপট আছে। আম্মা আমার মতো তাকে কথায় কথায় দুরছাই করেন না। আদর আপ্যায়ন করেন। আমার মতো পাতিল তলার ভাত খেতে হয়না ওকে। মুরগীর চামড়া দিয়ে ভাত শেষ করতে হয়না। বাড়ির ছেলেদের মতো ভরা মাংসের একটা পিস তার ভাগে পড়ে।
দু’দিন পরপর আমার দেবরের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায় তখন আম্মা বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসেন। আমার দেবরকেও বকেন খুব।

আমার বেলায় অবশ্য সব ভিন্ন। আমার বাবার টাকা নেই, বস্তা ভরে বাজার আসেনা। আমি রেগে বাপের বাড়ি গেলে বুঝিয়ে আনেন না। উলটো ছেলেকে বুঝান,
” কী দেইখ্যা যে তুই ওরে পছন্দ করলি? আমার কাছে কত ভালা মাইয়্যা আছিল, বিয়া করলে কপাল খুইল্যা যাইতো। তা না কইরা কোন বস্তির ফক্কিন্নি তুলে এনেছিস? না আছে চলন বলন, না আছে আনমান সম্মান। তাও ঠাঁট দেখায়, নির্লজ্জ মেয়ে। আর আনিস না। গেছে থাকুক। তোরে আমি আবার বিয়া করামু।”

আম্মা গদগদ হয়ে বড়ো বউকে আদর আপ্যায়ন করছেন, আমি চুপচাপ দেখলাম। আসোলে শ্বশুরবাড়িতে বউদের অবস্থান যাচাই-বাছাই হয় রঙ রূপ আর বাবার অর্থবিত্তের উপর।

একটা খেজুরে ইফতারের যবনিকা ঘটিয়ে চলে এলাম রুমে। সার সময় আম্মার কড়া গলা কানে এলো,
” ঠাঁট দেখাইয়্যা যাইতাছ যে এগুলান কে গুছাইব? বড়োলোক ঘরের সমন্ধ দেইখ্যাই লোভে পইড়া মাইয়্যা তুইলা দিল। কাম গাজ আদব লেহাজ শেখাইনাই বাপ মায়? ”

ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, তিনবেলা নিয়ম করে আমার বাবা মা-কে তিরস্কার করা হয়। সারাবেলা চুলোর তাপে পুড়ে রান্না করার পর লবন এদিক ওদিক হলে আমার গুষ্ঠি উদ্ধার করা হয়। প্রতিবাদ করতে গেলে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার, ছেলের বিয়ের হুমকি দেয়া হয়। আর ছেলে? নিশ্চুপ শুনে।

ঘরে আসতেই শরীর ভেঙে এলো। ক্লান্তিতে, কান্নায় শরীর অসাড়। কিন্তু বিশ্রামের সুযোগ নেই। নামাজ পড়েই ইফতার গুছাতে হবে, এঁটো বাসন ধুতে হবে। তারপর চা বসাতে হবে। সবাই ইফতারের পর আরাম করে চা খায়। তারপর আবার রাতের রান্না বসাতে হবে। কতকাজ!

মাগরিবের তিন রাকাত নামাজের সালাম ফিরিয়েছি সবে, ওমনি আতিক এসে হাজির হলো। হনহন করে এসে জায়নামাজের সামনে দাঁড়াল।
” রোজা রমজানের দিন মাকে না রাগালে হয়না তোমার? সারাদিন রোজা রেখে, অফিস করে শান্তিমতো ইফতার করব, তোমার ক্যাচালের জন্য সেই উপায় ও নেই।”

বলক আসা চায়ের মতো বিরক্তি ফুটছে আতিকের চেহারায়। বিরক্তিটা আমার জন্য নয়, মায়ের চিন্তায়। আমার জন্য যদি মায়ের শরীর খারাপ হয়? মাতৃভক্তি ছেলে মায়ের প্রসঙ্গে বাদবাকি সব বাদ। আমাকে প্রথম দিনই বলে দিয়েছে, মা মেরে ফেললেও টু করা যাবে না। আমার মা সবার আগে।
প্রেম করবার সময় ওর মাঝে মায়ের প্রতি সম্মান ভালোবাসা দেখে ভাবতাম, যে মাকে এত আগলে রাখে সে নিশ্চয়ই বউকেও রাখেনি। আমার বাবাকে দেখতাম দাদীকে ভীষণ সম্মান করতেন। মা আর দাদীর ঝগড়ায় কখনো দাদীর উপর বিরক্ত হতেন না। বরং সুন্দর করে বুঝাছেন। দাদী মায়ের উপর রাগ করে না খেলে হাতে তুলে খাইয়ে দিতেন। দাদী তখন বিচার দিতেন, তোর বউ এটা ওটা বলেছে, বিচার কর তুই।
বাবা দাদীর কথায় মাকে কখনোই বকতেন না। বরং মা রাগ করে না খেলে সেদিন বাইরে থেকে মায়ের পছন্দের ভাজাপোড়া আনতেন। কখনো তাতেও মায়ের রাগ ভাঙতো না, না খেয়ে ঘুমাতেন। তবে সকালবেলা মাকে দেখতাম আগের মতো প্রফুল্ল।

ভাবতাম আতিক ও এমন হবে। কিন্তু বিয়ের পর বুঝলাম আতিক আমার বাবার মতো নয়। সে মাকে ভালোবাসে, অন্ধের মতো। সেই চোখে আর কাউকে দেখেনা। আমাকে ও না।

আমি প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলাম,
” তুমিও চাইছো আমি বাবার বাড়ি থেকে ইফতার আনি?”

আতিক কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলল,
” এগুলো তোমাদের বউ শ্বাশুড়ির ব্যাপার। আমাকে এসবে টানবে না একদম।”

আমি কিছু বলতে নিয়েছিলাম আতিক বলল,
” রোজায় ভীষণ টায়ার্ড, রেস্ট নিব। বিরক্ত করবেনা। ”

ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল আতিক। আমি ওকে দেখলাম অবাক হয়ে এই ছেলে আমাকে বিয়ে করবার জন্য আমার বাবার পায়ে পড়েছিল, সেই ভালোবাসা আজ কোথায়?

সবার ক্লান্তি আছে, আমার ক্লান্তি নেই। বউদের ক্লান্তি থাকতে নেই, সংসারের দায়িত্বের ভারে ওমন বিশ্রাম ভাগ্যে জুটে না। আমি রান্নাঘরে ডুকলাম।

ভেবেছিলাম ব্যাপারটা বেশিদূর আগাবে না, কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে অনেক দূর এগিয়ে গেল। সমাজের বউ সম্মানির জন্য আমার স্থান হলো বাপের বাড়িতে…

________

#যবনিকা। (পর্ব-১)
#আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা।

চলবে……?

জীবনের উত্থান পতনের মাঝে বিশাল একটা লেখালিখির বিরতি নিয়েছি। লন্বা সময় বাদে নতুন করে আবার ফিরছি লেখা নিয়ে। জানি না পেইজের সচলতা, পাঠকের একাগ্রতা। গল্পটা পড়লে অবশ্যই রেসপন্স করবেন। উপযুক্ত সাড়া পেলে গল্পটা নিয়মিত দিব, ইনশা আল্লাহ……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here