যবনিকা। (পর্ব- ৮) #আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

0
143

#যবনিকা। (পর্ব- ৮)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

প্রাণপ্রিয় পুত্রবধূর বৈরী আচরণ সইতে পারলেন না আম্মা। তর্কে দক্ষ মানুষটা বাকহারা হয়ে চেয়ে রইলেন কেবল। রাহেলা চোখ রাঙিয়ে, আঙুল উঁচিয়ে আম্মাকে শাসাচ্ছে, খোঁটা দিচ্ছে। রমজানে ইফতারি গুলো পারলে পেট ছিঁড়ে বের করে, এমন ভাব।
” বড়ো বড়ো কথা বলেন কোন মুখে? মুরোদ আছে? ফকিন্নির মত আমার বাপের বাড়ির জিনিস হা-ভাতের মত গিলেন। পেট খুঁটলে সব আমার বাপের বাড়ির খানা পাওয়া যাইব। এই জলহস্তির মত শরীর বানাইছেন। আবার আমার সাথে লাগতে আসেন, বলি লাজ লজ্জা নেই আপনার? দুনিয়াতে খারাপ মানুষ দেখছি, কিন্তু আপনার মত বাটপার আর লোভী, দজ্জাল মানুষ দেখিনাই। ”

যে বউকে এতদিন মেয়ের মত ভালোবেসেছেন, মাথায় তুলে রেখেছেন সেই বউ আজ সাপ হয়ে ছোঁবল দিচ্ছে, তা আম্মার কাছে অকল্পনীয় ছিল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলেন।। রাহেলার চেঁচামেচিতে বাড়ির মানুষ জড়ো হলো। সবার সামনে আম্মা বেশ অপমানবোধ করলেন। মুখ থুবড়ে পড়লেন যেন। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,
” মাইনসে ঠিকই কয়, বউ হইল গরুর মতো। আইরে এই মাইর, যাইতে এই মাইর দেওন দিলে ঠিক থাকে।
তোরে মাইয়ার মতন আদর কইরা ভুল করছি। আগ ধইরা টাইট দিল, আইজকা মাতাত উটতি পারতি না। যা করছস আজকে। আমি কিচ্ছু কইতাম না।
আমার পোলা আসুক আগে, তারপর হেয় তোরে দেইখ্যা লোইব।”

” বহুত করছেন, আর কইরেন না। মুরুব্বি বইলা বহুত সম্মান করছি। নইলে আপনার মত দুই টাকার মহিলারে ভাঙতে আমার দুই মিনিট ও লাগব না। আমার দিকে হাত বাড়াইলে হাত কাইট্টা ফেলব।”

আম্মাকে শাসিয়ে রাহেলা ঘরের দোর দিল। সদর দরজায় আম্মা ছেলের অপেক্ষায় বসলেন। আজ ছেলে আসুক। এই কালনাগিনীর নামে কানভাঙানি দিয়া ছেলের হাতে মার খাওয়াবেন। কত বড় সাহস, আমারে টক্কর দেয়।
আমার ভাসুর এলো ঘন্টা খানেক বাদে। দুয়ারে পা রাখতেই আম্মা চেপে ধরলেন ছেলেকে। হাউমাউ করে কেঁদে ভাসালেন। ইনিয়েবিনিয়ে ছেলের কান ভাঙালেন। বিপরীতে আমার ভাসুর নিরুত্তাপ। মায়ের কান্না দেখে বউয়ের প্রতি রাগ জমল না তার চোখে, যেমনটা আতিফের চোখে জমতে দেখে অভ্যস্ত আমরা।
বরং মায়ের আশায় পানি ফেলে বিরক্তি নিয়ে বলল,
” মা, বাইরে থেকে এসেছি। কানের কাছে গ্যানগ্যান কইরো না তো! তুমি এখন ওর সাথে লাগতে গেছ কেন? অসুস্থ ও জানো না। শুধু অশান্তি করো!”

মায়ের পাশ কাটিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, চোখে পানি ঠোঁটে হাসি নিয়ে চট করে পর্দার আড়াল হলো রাহেলা। স্বামীর আগে নিজেই ঘরে ঢুকল। শ্বাশুড়ি ছেলের নাগাল পাবার আগেই সে ফোন দিয়ে অঝোর ধারায় চোখের পানি ছেড়ে স্বামীর কাছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বিচার দিয়েছে। বিনা দোষে তার মা রাহেলার সাথে প্রচন্ড দুর্ব্যবহার করেছেন। তেড়ে এসেছেন ওর দিকে।

আমি স্তব্ধ হয়ে ওদের তামাশা দেখলাম। আমি তবে এইজন্যই আতিফকে বশ করতে পারিনি! এই ছলনা জানি না বলে!
আম্মার দিকে গেলাম না। রান্নাঘরে চলে গেলাম। আম্মা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জা’য়ের কাছে গেলেন। রাগ ক্ষোভ ঝেড়ে বউকে অভিশাপ দিতে লাগলেন।
এই নাগিনীর উপর আল্লাহর গজব পড়ুক, ওরে ট্রাকে খক। দুইন্না তুন গায়েব করক।

_______________

রেঁধেবেটে, গোসল সেরে ঘরে গেলাম আমি। আজ খাবার ঘরে তালা। রাহেলা’রা কেউ বেরুবে না। মা খাবার ঘরে আসবেনা। ঘরের এই গরম মহলে যদি আমি একা ভাত খেতে যাই তবে আম্মা রাহেলার উপর উঠাতে না পারা সব ঝাঁজ আমার উপর ঝাড়বেন। অশান্তির ভাত খাওয়া থেকে উপোষ থাকে ঢের ভালো।

বন্ধুর বাড়ির দাওয়াত খেয়ে আতিফ এলো দুপুরের পর। ঘরের থমথমে পরিবেশ দেখে ভ্রু বাঁকিয়ে মায়ের ঘরে গেল। এর খানিক বাদেই মায়ের ঘর থেকে বিলাপ ভেসে এলো। আতিফ মা ভক্ত ছেলে। মায়ের কষ্ট দেখে বেজায় রাগ। দমে ফুঁসে উঠল, ভাইকে কিছু বলতে পারল না। মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে গেল। এসে আমাকে ডাকল,
“কবিতা কবিতা?”

আমি ডাক শুনে বেরিয়ে গেলাম। দেখলাম আম্মা আমাকে নিয়ে ও ছেলের কাছে অভিযোগ করলেন। এ যাত্রায় আম্মা হতাশ হলেন না। আতিফ আমার উপর চড়াও হলো। তাদের ভাব দেখে মনে হলো,
রাহেলাকে আমি উস্কে দিয়েছি। আম্মার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছি। সব দোষ আমার। আতিফ আমাকে ধমকাল, তা দেখে আম্মা খুশি হলেন।
হাসিহাসি মুখ নিয়ে ছেলের সাথে দুই প্লেট ভাত খেলেন।

______________

দিন বাড়ার সাথে সাথে ঘরের অশান্তি বাড়ল। এখন বউ শ্বাশুড়ির ঝগড়া নিত্যকার। পান থেকে চুন খসলেই রাহেলা আম্মার উপর চড়াও হয়, আম্মা ও ছেড়ে দেবার পাত্রী নন। মুখের উপর বাপ মা তুলে গালি দেন, প তি তার সাথে তুলনা করেন অনায়েসে। তারপর বাঁধে তুমুল ঝগড়া। এতদিন আমি ভাবতাম, আম্মা সবচেয়ে দক্ষ ঝগড়াটে। কিন্তু রাহেলাকে দেখার পর মনে হলো সে আম্মা থেকে ও এক কাঠি উপরে।
ঝাগড়া করার স্বভাব নেই আমার। আমি শান্তি প্রিয় মানুষ। তবুও কালেভদ্রে কারো সাথে তর্ক বাঁধলে আমি আসল কথাই ভুলে যাই। বিপরীত পক্ষ অনায়েসে জয় লাভ করে। রাতের বেলা একলা হয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে, তখন এটা বলা উচিত ছিল। আমি তো মুল কথাই বলিনি।

অথচ ঝগড়ার সময় রাহেলা পয়েন্ট টু পয়েন্ট বলে আটকে দেয়। বিয়ের দিন রাহেলাদের বাড়িতে খেতে বসে আম্মার একটার বদলে দুটো ডিম খাওয়ার কথা ও মনে পড়ে। আম্মা কোন দিন তাকে দেখে মুখ বাঁকিয়েছে, কোন এঙ্গেলে বাঁকিয়েছে সে সব ও বলে সম্পাদ্যের মতো। এমন এমন কথা বলে আম্মার মুখে কুলুপ এঁটে যায়। আম্মা যদি মা ধরে গালি দেয়, তবে রাহেলাও উলটো তার মা ধরে গালি দেয়। তুই তোকারিতে নেমে আসে।

এক কথায় দুই কথায় ঝগড়া চলতে থাকে। প্রথম প্রথম ভাইয়া চুপ থাকতো, পরে ভাইয়া ও বউয়ের পক্ষ নিয়ে মাকেই কথা শুনাতে শুরু করল। মা রণচণ্ডী রূপ নিল রাহেলা যেদিন ঝগড়া মাকে বলল,
” আমাদের সম্পত্তির ভাগ নিয়ে আলাদা হয়ে যাব। জিন্দেগী ও তোর এই কালমুখী দেখব না। চোখের সামনে দিয়ে তোর ছেলে নিয়ে যাব, কিচ্ছু করতে পারবি না। ”

আম্মা ও রাগের তোড়ে বলে দিলেন,
” নে দেখি কত সাহস তোর। মগ দিয়া তাবিজ কইরা তোরে যদি রাস্তায় না বের করছি তো আমার নাম ও বদলাইয়্যা ফেলব। বেশি বাড় বাড়তেছস না? দেখব খোদার গজব পড়ব তোর উপর। কুত্তার মত মরবি বে*….

আমজাদ মানে আমার ভাসুর আগে বাড়ি ছিলেন না। সম্ভবত রাহেলা ফোন দিয়ে আনিয়েছে। এসে বউয়ের কথা না শুনলেও মায়ের কথা শুনে গেল। অশ্রাব্য গালি আর অভিশাপ শুনেই তার চোখ লাল হলো। বউয়ের পাশে এসে গঁজগঁজ করতে করতে আম্মাকে বলল,
” মুখ সামলে কথা বলো আম্মা। নয়তো আমি ভুলে যাব তুমি আমার কে হও।”

আম্মা রেগে গেলেন
“তোর বউরে সামলা। দুইদিন্না বউয়ের লাইগা মারে ধমকাইতে আইবিনা। অজাতের বাচ্চা সংসারটা শ্যাষ কইরা ফালাইছে। কোন অলক্ষুণে তোর জন্য এই খান* মা* বে* রে বউ কইরা আনছি!…

রাহেলা জোর পেল। ন্যাকাকান্নায় নাক টেনে বলল,
” দেখলে দেখলে, তোমার মা তোমার সামনে এরাম করতেছে, তোমার পেছনে কী করে! খালি মা মা করো, এই মা তোমার বাচ্চারে মারার পরিকল্পনা আঁটছে। তোমার বাচ্চার কসম, যদি আইজকা কিছু ন কও, তয় আমারে আর পাইবানা।”

আম্মা রাহেলার দিকে তেড়ে এলেন।
” দুই দিন হয়নাই সংসারে পা রাখছে। এ বে* আমার পোলাডারে আমার থেইক্যা দূর করছে। আমারে অপমান করতেছস না? তোরে আল্লাহ ধারে ধারে অপমান করাইব। বাপ এই কালনাগিনী রাখিস না, ওরে এহনি তালাক দে। মা তোরে আবার বিয়া করামু।”

রাহেলার কান্নার বেগ বাড়ল। পেটে হাত দিয়ে কাঁদতে লাগল। তা দেখে আমজাদ ভাই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন মায়ের উপর,
” মা করছিনা আমার বউয়ের লগে লাগতে! আমার সামনে আমার বউরে এরাম কতা কইবার সাহস কে দিছে তোমারে? রাহেলা ঠিকই কয়, তুমি মা নামের কলঙ্ক…..

আম্মা কিছু বলতে গেল, আমজাদ ভাই আম্মাকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল। ঝগড়া মাঝে আতিফ ও এসে পড়ল। ভাই কতৃক মায়ের অপমান দেখে সে এগিয়ে গেল। প্রতিবাদ করতেই এবার ভাইয়ে ভাইয়ে এক চোট ঝগড়া হলো। হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেল তা।

এক পাতে খাবার খাওয়া দুই ভাই যেন জানে দুশমন। আমজাদ ভাই আতিফের নাকে ঘুষি দিল, নাক বেয়ে রক্ত ঝরল। আতিফ পাশে থাকা চেয়ার ভেঙে বাড়ি বসাল। ভাইয়ার মাথা ফেটে গেল। বাড়ির মানুষ জড়ো হলো।

আতিফের অবস্থা দেখে ওকে টেনে আনতে গিয়ে কিসের বাড়ি যেন আমার হাতে লাগল। হাত কেটে গেল।
পাড়াপ্রতিবেশি জড়ো হয়ে ছাড়াল। গ্রাম্য সমাজ বলে পুলিশ ডাকল না, মুরুব্বিরাই আলাদা করল। সেদিনই আমরা ভাই বউ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন চিরতরে।

_______________

সে ঘটনার পর ঘরের আবহ বদলে গেল। আম্মা বেশ বড়ো সড়ো ধাক্কা খেলেন। ভাঙা নাক নিয়ে আতিফ ও নিশ্চুপ ব্যাথা হজম করছে। রা এ করছেনা কোন। পুরো দু’দিন কেউ একটা দানা এ মুখে তুলে নি। আম্মা বোবার মত পড়ে রইলেন ঘরে। ভুলের পাহাড় জমলেও আমাকে বকলেন না। রান্না করে খাবার সাজালেও খেতে আসলেন না। আতিফকে তুলে খাওয়াতে পারলেও আম্মাকে পারা গেল না। ঘরটা কেমন নিস্তব্ধ কবরের মতো ঠেকল।

একটু একটু করে ঠিক হলো। আতিফ অফিস যাওয়া শুরু করল। অফিস থেকে একটা ট্যুরের আয়োজন করল সেবার। তিনদিনের ট্যুর। আতিফ গেল। আমি ও ভাবলাম, ঘুরে এলে মনটা ভালো হবে।

কিন্তু বিপত্তি বাঁধল, ট্যুর থেকে ফিরবার পর। আমি আবিষ্কার করলাম অন্য এক আতিফকে। কাঁপা বুকে বুঝলাম, সে যতটুকু আমার ছিল, তাও নেই।

চলবে…….

বিঃদ্রঃ আজও রিচেক হয়নি। সময় সল্পতায়। দুঃখিত। বানান ভুল ধর‍তে পারলে ইনবক্সে জানিয়ে দিবেন।

ধন্যবাদ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here