যবনিকা। (পর্ব-৬) #আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা

0
143

#যবনিকা। (পর্ব-৬)
#আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা।

আজ ঈদ। চারদিকে খুশির আমেজ। সেমাই, পায়েশের ঘ্রাণে মৌ মৌ। আতর মেখে ঈদগাহে ছুটেছে বাড়ির পুরুষরা। মহিলারা হেসেল সামলে গোসল সেরে সাজতে বসেছে। আম্মা নতুন শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বেরিয়েছেন জা’দের সাথে দেখা করতে। আমি রান্নাঘরে পড়ে আছি তখনো। গায়ে রংজ্বলা পুরনো জামা। দু’হাতে কাজ করছি, ইদের সকালের এক চামচ মিষ্টিমুখ করবার ও সুযোগ হয়নি। গায়ে হালকা জ্বর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তখনো। তা মাড়িয়ে ভোর ছ’টায় উঠেছি। উঠেই রান্নায় ঢুকেছি।
বিয়ের আগে ও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতাম। তবে পার্থক্য হলো, তখন উঠতাম, এক রাশ খুশি আর উত্তেজনা নিয়ে। চোখ মেলেই হাত দেখতাম। মেহেদীর রঙ কেমন এলো? রাতে সইদের সাথে মিলে দু’হাত ভরে মেহেদি দিয়েছি। রঙ ভালো আসা চাই। শুনতে নিতান্তই বাচ্চামো হলেও বিয়ের আগে ইদের আমেজ ছিল ভরপুর। সকাল সকাল ওঠা। গোসল সেরে মায়ের হাতের সেমাই খাওয়া। তারপর নতুন জামা পরে উঠোনে বের হওয়া। বাড়ির সব মেয়ে জমা হতো। সবাই মিলে হাঁটতে বের হওয়া। কার জামা কেমন হয়েছে, কে কত সালামি পেয়েছে, এ নিয়ে এক আমেজ ছিল। বাবার সল্প আয়ের অল্প আয়োজনেও অভিনব আনন্দ ছিল।
আর এখন…! এখন ইদের ভোরে আনন্দ নয় দায়িত্বের ভার নিয়ে ঘুম ভাঙে।
বিয়ের আগে আমি মেহেদি সৌখিন ছিলাম। হাতের মেহেদি সরতো না। একবার উঠলে আবার লাগাতাম। চাচীরা বলতো, তোর খালি হাত আর অমাবস্যার চাঁদ একই? মেলা ভার।
সেই আমি ইদে মেহেদি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাইনি। বসে মেহেদি দিবার মন ও হয়নি।

রমজানে ভন্ডুল হওয়া দাবাত এসে ঠেকেছে ইদের দিন দুপুরে। খালু অবস্থা ভালো বলে দাওয়াত নিতে কার্পন্য করেন নি খালা। দুপুরের ভূরিভোজনের সাথে ইদের মিষ্টিভোজের বিশাল এ লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছেন আম্মা। ইদের নামাজ পড়েই ছেলেপুলেরা সবাই চলে আসবে। বাকিরা দুপুর নাগাদ আসবে। সেসব আয়োজনে ইদ কাটছে।

রান্না মাড়িয়ে ইদের আনন্দ ছুঁতে পারেনি। রান্নাঘর থেকে বেরুবার ফুরসত হয়নি। এ নিয়ে এ চোট হলো আতিফের সাথে। নামাজে যাবার আগে বেশ ক’বার ডেকে গেছিল। আমি তখন চুলোর দু’মুখে মাংসের মসলা কষাচ্ছি। নড়লেই লেগে যাবে। আম্মা শ্যাম্পু হাতে গোসলে ঢুকেছেন। এ মুখো হবেন না আজ।

ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে রেগেমেগে একাকার আতিফ। নামাজ থেকে ফিরে আমাকে দেখে ক্ষুব্ধ হলো। হনহন করে ঘরে চলে গেল। খানিক বাদেই ঘর থেকে ভারি আওয়াজ এলো। চাপা শ্বাস ফেললাম আমি।
জ্বর কাটিয়ে উঠবার পর আম্মা পক্ষ থেকে বাবার বাড়ি থেকে না আসা ইদের কাপড়ের খোটা এলো, সাথে সস্তা একটা যাকাতের কাপড়। সবার জন্য কাপড় কিনতে গিয়ে টাকার টান পড়ায় না কি আমার কাপড়টা বেশি দেখে কিনতে পারেন নি। কাপড়ের ব্যাগ দিয়ে এমনই বলেছিলেন আম্মা।
জীবন থেকে আশা চলে যাবার পর এসব আমাকে হতাশ করেনা আজকাল।
সেই সস্তা কাপড় আতিফ দেখেছিল কি না জানি না। তবে সেদিন রাতে ফিরে একটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সে।
আমি অবাকই হয়েছিলাম। লাল আভায় সুন্দর একটা জর্জেট শাড়ি। আন্দাজ করা যায়, দামটা বেশ চড়া। আমি বিস্ময়ভূত হয়ে চেয়ে বলেছিল,
“আমার জন্য? ”

আতিফ বিরক্ত চোখে চেয়ে বলল,
” ইদের দিন এই শাড়িটা পরবে।”

ওর ভাব দেখে বুঝলাম, বেশ শখ করে কিনেছে শাড়িটা। আশা করেছে, ঈদগাহ থেকে ফিরে আমাকে তার দেয়া শাড়িতে দেখবে। কিন্তু…..
আশাদের জলাঞ্জলি হতে দেখে রাগে কাপড়ে প্যাকেজ ছুঁড়ে ফেলেছে। কাপড়ের সাথে থাকা কাচের চুড়ি ঝনঝন শব্দে ভেঙে চুরমার হলো। সেই শব্দ তীরের মতো বিঁধল কানে।
বিয়ের পর প্রথম ইদ। গেল ইদে এ নিয়ে কত স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম আমি। বউ বউ শাড়ি পরে সেমাইর প্লেট নিয়ে হাজির হবো আতিফের সামনে। ওর চোখ ধাঁধিয়ে সালামি নিব। কত খুনসুটি হবে। অথচ তার কিছুই হলো না। সারা গায়ে মসলার মাখামাখি। গোসল সেরে নতুন কাপড় জড়াতেও আধঘন্টা সময় লাগবে। কাজের পাহাড়ময় রান্নাঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে শোবার ঘরে পা রাখবার সময়টা কুলাচ্ছেনা। আর তো সাজা?
মেহমান আসতে শুরু করেছে। তাদের নাস্তা দেয়া, আনা। রান্না দেখা। একা হাতে ৩০জনের রান্না চারটে খানি কথা নয়।
কিভাবে সব ছেড়ে আমি ঘরে গিয়ে সাজতে বসব? বউদের ওমন বিলাসী জীবন হয়? ওটা তো ছেলেরা পারে।
বউ হবার পর না থাকে শখ আহ্লাদ, না থাকে ইদ। তারা কেবল অন্যের ইদ রাঙাতে ব্যস্ত থাকে…

অমোঘ চোখে আমি চেয়ে রইলাম। নিজের নিয়তির জন্য দুঃখ হবে না কি আতিফের অনুভূতির জন্য? ভেবে পেলাম না। তবে মন একটা কথাই বলল,
আমার জীবন ছিল মেয়ে হওয়াতেই, বউ হওয়ার পর আর জীবন নেই। আমার নেই, অন্যের জন্য বরাদ্দ জীবন। সেখানে আমার বলতে কিছুই নেই।

____________

বেলা গড়াতেই দলে দলে মেহমান এসে ভরতি হলো ঘর। সালামির কাড়াকাড়ি, হৈ-হুল্লোড়, হাসি ঠাড্ডার মাতল। রান্নাঘর থেকে হাসির দমক কানে এলো। আম্মা আয়েশ করে গল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। খানিক পরপর এসে হুমকি-ধমকি করছেন, এটা হলো না কেন? এটা রঙ আসেনি। এতক্ষণে শুধু এ কয়টা করলে? মায় কিছু শিখায়নি। বড়ো ঘরের ছেলে দেখে লেলিয়ে দিয়েছে। শিখিয়ে পাঠাতে পারেনি। এটা করো, ওটা করো… বিচার বিশ্লেষণ করলেন। হাতের কাজ শেষ করতে করতে দুপুর হলো। মামী শ্বাশুড়ি এসে তাড়া দিল বিধায়, রান্নাঘর থেকে বেরুনোর ফুরসত পেলাম।
-নতুন বউর প্রথম ইদ, রান্নাঘরে পড়ে আছে। পুরান কাপড় পিন্দা। আপা ওরে ছাইড়া দেন। গোসল সাইরা ঈদের কাপড় পিন্দুক।

নিজের মান ধরে রাখতে আম্মা প্রশ্রয়ের সুরে জানালেন, তিনি সকাল থেকেই বলছেন আমাকে রান্নাঘর থেকে বেরুতে, নতুন কাপড় পরে আসতে। আমি শুনিনি। নিজের উপর এত বিরক্ত হলাম আমি। আম্মার এমন একটা আদেশ কিভাবে আমার কানের উপর দিয়ে গেল! আমি কেন শুনলাম না? লালবউ সেজে বসলাম না?

শরীরটা তখন কথা বলছে। মেরুদণ্ড ভেঙে আসছে যেন, জ্বরের ব্যাথার সাথে কাজের চাপটা ভালোই মানিয়েছে। একসাথে বসেছে। একটু শুতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু গায়ে যা মসলা মেখেছে এ নিয়ে ঘরে ও যাওয়া যাবেনা। গতকালের শুকনো কাপড় তার থেকে তুলে পুকুরপাড়ে চলে গেলাম।

গোসল সেরে আসতে আসতে জ্বরটা ফের এলো। তেঁতোমুখো মুখরোচক একটা তথ্য জানলাম। খাবার ঘরে সবার হৈ-হুল্লোড়। খেতে বসেছে। আম্মা বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। তখন মোটা কন্ঠের চড়া আওয়াজের প্রশংসায় ভাসছে আম্মা। এখানের মজাদার সবগুলো খাবার আম্মা করেছেন। কেবল মাছের তরকারিটা আমি করেছি। তাই একটু লবণ কম হয়েছে।
এমন সুন্দর কথায় এতক্ষণের ধকলই যেন কেটে গেল। নিজের শরীরকে শাসালাম, লবণ ছাড়া একটা তরকারি রান্না করে এত আদিখ্যেতার মানে আছে?

পুরপুরে মনে শোবার ঘরের দুয়ারে এলাম। দেখলাম ভেতর থেকে খিল দেয়া। মশাই এখনো অভিমানের আঁধারে ডুবে আছে। এত হৈহৈ ও তাকে বের করতে পারেনি। আম্মা জানালেন, ৩০টা রোজা রেখে ছেলে তার ক্লান্ত। তাই আজ সারাদিন ঘুমোবে, এই ঘোষণা জারি করেছে শোবার ঘরে যাবার আগে।

আমি কড়া নাড়লাম। সাড়াশব্দ এলো না কোন। ডানে বামে চেয়ে দুই বার ডাকলাম,
“আতিফ? আতিফ?”

এ বাড়িতে বরের নাম ধরে ডাকা নিষেধ। আম্মা নারাজ হন। স্বামীর নাম মুখে নেয়া বেয়াদবি না কি। স্বামী বউয়ের মা বাপ তুলে গালি দেয়াটা অবশ্য আদব। চুলের মুঠি ধরে দু’চার গা বসালেও আদবে আঁচ লাগে না। বাড়ির ছেলেদের আদবের বাঁধন এত নড়বড়ে না কি! যে সামান্য আঁচে ‘বে’ লাগবে। ওরা বউ মারলেও শিষ্টাচার। পুরুষমানুষ ওমন একটা আধটু হয়।

আতিফের সাড়া এলো না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এবার পা টনটনে ব্যাথা শুরু হলো। আমি স্বর নরম করে ডাকলাম,
“আতিফ? দোহাই লাগে দরজা খুলে ভেতরে যেতে দাও। তারপর যা করার করো। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা।”

খানিক বাদেই ক্ষুব্ধ গলা এলো,
“ঘরে আসতে হবেনা তোর, রান্নাঘরে পঁচে মর।”

চলবে…..

রি-চেইক ছাড়া পর্ব। ভুল ইনবক্সে বলে দিলে ধন্য হবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here