যবনিকা-৩ #আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা।

0
121

#যবনিকা-৩
#আফিয়া_খোন্দকার_আপ্পিতা।

“তুই ভালা আছিস, মা?”
মাথায় হাত দিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, মা। সাধারণ একটা প্রশ্ন, অথচ আমার মনে হলো এরচেয়ে কঠিন প্রশ্ন আর দু’টি নেই। কতদিন কেউ এমন করে জিজ্ঞেস করেনা আমি ভালো আছি কিনা। গলা পাকিয়ে কান্না এলো আমার। ইচ্ছে হলো চিৎকার দিয়ে বলি, আমি ভালো নেই মা, ও বাড়িতে আমি দু’দণ্ড ভালো থাকি না। যার জন্য তোমাদের ছেড়ে গেলাম, সেই আমার ভালো থাকার কারণ হয়না। এই যে আজ চারদিন হতে চলল, আমি বাপের বাড়ি এসেছি, আতিক একটা কলের উপর উঠেনি। সেদিন সেই সিএনজি ঠিক করে দিয়ে তুলে দিল, তারপর তার দেখা কথা কিছুই পায়নি। আমাকে নিয়ে ওর কোন আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা কিছুই হয়না। বিয়ের আগের সব অনুভূতি ফ্যাকাশে। প্রেমিক কখনো স্বামী এক হয়না। স্বামী হবার পর সব বদলে যায়।

কিন্তু বলতে পারলাম না, বাবার ঋণের চিন্তায় মায়ের চোখের নিচে কালি জমেছে। আমার মন্দ থাকার গল্প শুনলে মা একদণ্ড ও শান্তিতে থাকতে পারবেন না, একটা সজীব শ্বাস ফেলতে পারবেন না। কালি জমা চোখবেয়ে গড়াবেন চিন্তার অশ্রুজল। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আমি ঢোক গিলে ফেললাম।
ঠোঁটে বড্ড সুখ তুলে হেসে বললাম,
“ভালো আছি, মা। ”

মা সুন্দর উত্তর দিলেন,
“তোদের ভালাতেই মোর ভালা থাকা।”

মা মলিন শ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন,
” কী খাইবি? কী বানাইতাম তোর লেইগ্যা?”

এই প্রশ্নদ্বয় ও স্বাভাবিক, অথচ এক গৃহিণীর কাছে বড্ড অস্বাভাবিক। পরিবারের সবাই দিনে বারেবারে শুনলেও তার শোনার সৌভাগ্য হয়না দিন, সপ্তাহ, মাস, বছরে, কেউ বা আবার সারাজীবনে। তাদের পুরো জীবন উৎসর্গ অন্যের অন্ন জোগাড়ে।
আমাদের ঘরে রান্নার মতো তেমন কোন কিছু নেই, মায়েদের নিজেদেরই খেয়ে দিন কুলাতে কষ্ট হচ্ছে। তাও মা আমার মনখস্ত জিজ্ঞেস করছেন, আমি জানি আমি কোন খাবারের নাম বললে মা যে কোন উপায় তা হাজির করবেন। মা তো এমনই হয়। মা মা-ই হয়, মা কখনো শ্বাশুড়ি হয়না।

এই প্রশ্ন শুনবার সৌভাগ্যে আমোদিত হয়ে আমি ভাবতে বসলাম, আমার খাওয়া সম্পর্কে। এবং অবাক করা বিষয় হলো, আমার মনে পড়ল না কোন খাবারটা বড্ড আগ্রহ নিয়েই খাই। অনুধাবন করলাম, আমার কোন পছন্দ নাই। কোন বাছবিচার নেই। অথচ বিয়ের আগে আমার কত বাছবিচার ছিল! এখন সব কোথায় হারিয়ে গেছে। সবার খাওয়ার পর যা বেছে যায়, তাই খেয়ে নিই। কোন অভিযোগ নেই।
আমি মাকে বললাম,
” আমি সব খাই, মা। যা ইচ্ছে বানাও। ”

আমি আসবার পর বাবা বাজার করেছেন। ইফতারের জন্য ছোলা বুট, সাহরির জন্য আমার পছন্দের রুইমাছ কিনে এনেছেন। আমি বারবার জিজ্ঞেস করলাম, টাকার উৎস, মা বললেন না। আমি ঘর ছাড়বার পর ছোটোবোনকে বলতে শুনলাম, কারো কাছ থেকে ধার নিয়েছে।

মা ডাঁটাশাক দিয়ে বড়া বানিয়েছে ইফতারের জন্য, পেঁয়াজ, বেগুনি ও করেছেন। ছোটোবোন লেবু চিপে শরবত করেছে। অনেকদিন বাদে আমি তৃপ্তি ভরে খেলাম। পেঁয়াজিটা মুখে তুলে মাকে বললাম,
” পেঁয়াজিটা ভালো হয়েছে। কিভাবে বানাও, আমার বোলো তো।”

খানিক বাদে মা তার পাতের পেঁয়াজি আমার পাতে তুলে দিলেন। জিজ্ঞেস করতেই মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
” খাইতে ভালা লাগেনা।”

বাবা দিলেন না পেঁয়াজি। তবে খেলেন ও না। পাতের একদিকে রেখে দিলেন। তারাবির পর মা বললেন,
“তোর বাবা তোর জন্য পেঁয়াজি রেখেছে।”

দীর্ঘ অবহেলার পর এই ভালোবাসা পেয়ে আমি পেঁয়াজি মুখে তুলেই কেঁদে ফেললাম।

___________

পরদিন সকাল সকাল কিস্তির লোক এসে হাজির হলো বাড়িতে এ মাসের পুরো কিস্তি শোধ করতে পারেনি, এক কিস্তি বাকি আছে। তার টাকা চাইতে এসে চেঁচামেচি করে গেল মহিলা দু’জন। বাবাকে দেখলাম নতমুখে গা ঢাকা দিতে। বাবা মাথা নিঁচু দেখে আমার বুক ভার হয়ে এলো আমার। বাবাকে সবসময় দেখেছি, মাথা উঁচু করে চলছে। এসব ধার কর্য বাবার পছন্দ ছিল না।
দরিদ্রের খাতায় আমাদের নাম ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল। বাবা ছোটোখাটো একটা ব্যবসা করতেন। যা আয় হতো তা দিয়ে সুন্দরমতো সংসার চলে যেত। অভাব, ঋণ ছিল না। সংসার চালিয়ে বাবা আমাদের শখ আহ্লাদ ও পূরণ করতেন। কিন্তু আমার বিয়ের পালা আসতেই পাত্রপক্ষের দাবি পূরণ বাবার সামর্থ্যের বাইরে ছিল।
উপহার নামক যৌতুকে লাখ কয়েক টাকা গচ্ছা গেল। ফ্রিজ, ফার্নিচার, জিনিসপত্র….
তারপর নিয়ম করে একে দাওয়াত করা ওকে দাওয়াত করা। আতিকদের বংশের কেউ বিদেশ থেকে এলে, বাবা বিয়ে হলে তার উপলক্ষ্যে পুরো গুষ্টিকে দাওয়াত করতে হতো। না করলে শ্বাশুড়ি কথা শুনাতেন, এটাই না কি সম্মান। দেবরের বিয়ে হলো, সোনার চেইন দিল, দাওয়াত করে বউকে কাপড়চোপড় দিতে হলো।
একেকটা দাওয়াতে হাজার ত্রিশেক টাকা খরচা।
আজ এটা, কাল ওটা করতে করতে ঋণের বোঝা কমার বদলে বেড়ে চলল।

ঋণের পাহাড় ছুঁতেই সংসারের আদল বদলে গেল। অভাব হানা দিল। বাবা যা আয় করেন, তা পুরোটা চলে যায় ঋণের বোঝা মেটাতে। সন্তানের শখ আহ্লাদ পূরণ তো দূরে থাক, সন্তানের অন্ন জোগাড়ে ও হিমসিম খান।
সব আমার জন্য। নিজেকে এত নগন্য মনে হচ্ছিল আমার। কেন মেয়ে হয়ে জন্মালাম? কেন সমাজের এত নীতি মানতে হবে। সেইক্ষণে কঠিন পণ করলাম, বাবার ঋণের পাহাড় আর বাড়তে দিব না। আর একটা জিনিস ও নিবনা ও বাড়ি। সে আম্মা যাই বলুক, যাই করুক।

________________________

” পিরিত কইরা নাগরের লিগা বাপ মারে ছাইড়া গেল, স্বামী সোহাগে মুহে চান ভাসোনের কতা, মেঘ ভাসে ক্যা? হুগাইয়্যা, কালা হইয়্যা আন্দার হইয়া গেছে দেখছেন ভাবি? লক্ষন ভালা না। জামাইর লগে কাইজ্জা কইরা আইছে, দেহেন গিয়া।”

উঠোনে কাপড় মেলতে গিয়ে কানে এলো ফিসফিস শব্দ। আমাদের বাড়িটা বেশ বড়ো, অনেক ঘিরিওয়ালা পরিবার নিয়ে বাড়িটা। মাঝে বড় উঠোন। উঠোনের পাশে একটা ভেঁড়াঘরের ভেতরে বাড়ি দুই নারী আমাকে নিয়ে মহা গবেষণা চালাচ্ছেন।

“খেয়াল করছেন? মাইয়্যা একাই আইছে। জামাই আহেনাই। দিতে আইল না, এমনে ও আইল না। যে জোলা লইয়্যা আইছে, মনে হয় এক্কেবারে পাঠাইয়্যা দিছে। রোজা রমজানের দিনে কেউ বাড়ি বউ পাঠায় কোনহানে? মাইয়্যার চরিত্রে দোষ আছে, মিলাইয়্যা নিয়েন। ”

প্রতিটা বাড়িতে দুই একজন কুটিল নারী থাকে, যারা একের সাথে অন্যের প্যাঁচ লাগায়। ভদ্র ভাষায় যাদের পাশের বাসার আন্টি বলা হয়। আমাদের বাড়িতে এই তালিকায় আছেন এই দুই নারী। প্রতিবেশী কাকী। মানুষের বিরুদ্ধে এমনভাবে মিথ্যা রটাবে, যে সে নিজেই দ্বিধায় পড়ে যাবে। কোন মেয়ে যদি কোন ছেলের দিকে একবার তাকাতে দেখেন, তবে সেই ছেলেকে মেয়েটা প্রেমিক ভেবে, বিয়ে-শাদির কথাও প্রচার করে দেন। কথা ঘুরাতে ঘুরাতে এত গাঢ়ভাবে চরিত্র দাগ বসায়।

মফস্বলে মেয়ে বাপের বাড়ি এসে একদিনের বেশি দু’দিন থাকতে প্রতিবেশীর ধরেই নেন, ঝগড়া করে এসেছে। পারলে এখনই তালাক করিয়ে দেন। বাবা মা থেকেও তার চিন্তা বেশি যেন। বাবার ঘরে খাচ্ছে, অথচ চিন্তা প্রতিবেশীদের। কাকীরা দীর্ঘক্ষণ আমার সমালোচনা করার পর একে অপরকে বললেন,
“বাদ দেন ভাবি, রোজা রমজানের দিন।”

” হ, আমাগো কী কাম কওনের। এরলেইগ্যাই কিচ্ছু কইতাছি। ”

এতক্ষণে মনে পড়ল, এখন রোজার দিন! ভেবে হাসি পেল আমার। কাপড় মেলা শেষ করে আমি ঘরে চলে এলাম। পরদিন সকাল সকাল সেই কাকী এলেন আমাদের ঘরে। আমি তখন ঘুম থেকে উঠেছি সবে। বিছানা গোছাচ্ছিলাম। কাকীর আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন,
“কবিতা নি? ভালা আছোনি? মেলাদিন পরে দেখতাছি তোমারে। তোমার মারে কত জিগাই তোমার কতা?”

কাকী স্বরে মধু ভাসছে। এত আন্তরিকতা বোধহয় আমার মা ও আমাকে দেখান না। কাল আড়ালে তাদের কথা না শুনলে আমি বোধহয় এটাকে আন্তরিকতাই ভেবে নিতাম। কিন্তু এখন আমি কাকী দিকে তাকিয়ে ভাবছি, মানুষ এত নিঁখুত অভিনয় কিভাবে করে!
“ভালো আছি, কাকী। আপনি ভালো আছেন?”

কাকী খুব আদর নিয়ে বুকে জড়ালেন। তারপর বললেন,
” তোমাগো দোয়ায় ভালা আছি। বসো, কতা কই। কতদিন কাছে পাইনা তোমারে। তা আমাগো জামাইডা ভালা আছেনি? আইল না যে? ”

কায়দা করে উত্তর নিতে চাইলেন। আমি ধীরে বললাম,
“ওর অফিস আছে তো। মা ঘরে আছে জেঠি। যান।”

কাকী মায়ের কাছে যেতেই হাঁফ ছাড়লাম। এত মেকিতা গায়ে লাগছিল।

কাকী মায়ের সাথে কী বলেছেন, জানি না। তবে কাকী যাবার পর থেকে মায়ের মুখে অমানিশা নামল। চুলোর কাছে বসে দুই একবার আঁচলে চোখ মুছতে ও দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, বলল না কিছু।
বাবা দোকান থেকে খোশমেজাজে বাড়ি ফিরেছেন বিকেলবেলা। ইফতারের সময় তার মুখ ও মলিন হলো। কাল একসাথে ইফতারটা যতটা আনন্দের ছিল আজ ততটাই যেন বিষাদ।

রাতেরবেলা মাকে ঝেঁকে ধরলাম, আসল ঘটনা সামনে এলো। আমার শ্বশুরবাড়ির পাশের বাড়ি কাকীর বাড়ি। আমার শ্বাশুড়ি পাশের বাড়ি গিয়ে আমার বেশ বদনাম করেছেন। আমি সংসারের একটা কাজ ও করিনা, আতিককে কান ভাঙিয়ে মায়ের বিরুদ্ধে নেয়ার চেষ্টা করি। বেয়াদবি করি, ঝগড়া করি, আম্মার মুখে মুখে তর্ক করি। জিনিসপত্র ভাংচুর করি, রান্নাবান্না কাজ কর্ম কিছুই পারিনা। কাজ করিনা, কিন্তু সবার আগে খেয়ে নিই। সংসারে অশান্তি করি। আমার জন্য সংসারে অশান্তি। সামাজিকতা জানি না, আনমান সনমান করিনা। এবার আমি ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে এসেছি। এমন বেয়াদব বউ রাখবেন না আম্মা।
কাকী মা সেসব কথা রসিয়ে কাকীকে বলেছেন। কাকী কাল এসে মাকে বলেছে। শুধু মা না, মোটামুটি এখন পুরো এলাকা জানে কবির মিয়া বড়ো মেয়ে সংসারে বনিবনা করতে না পেরে বাপের বাড়ি এসেছে। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে।

এবং কি এখন আমার নামে আরও কত গুজব রটছে, আমার কত দোষ সামনে আসছে। কেউ কেউ চরিত্রের উপর ও আঙুল তুলছে। আমার যে এত দোষ আমি নিজেই জানতাম না। অবাকই হলাম শ্বশুরবাড়িতে নিজের রাজত্বের গল্প শুনে, এমন গল্প শুনতেও সুন্দর। হাসি ও পেল ভীষণ। আমার হাসি দেখে মা ডুকরে উঠলেন।
” তুই হাচাই কাইজ্জা কইরা আইছস? ”

আমি মায়ের চোখে ভয় দেখলাম। সমাজের ভয়। আমার কাধে ডিভোর্সী ট্যাগ লাগার পরিণতির ভয়। বিয়ের বছর গড়ানোর আগেই যদি তালাক নিয়ে বাপের বাড়ি এসে পড়ি, তবে সমাজ তো আমাকেই দোষ দিবে। নিশ্চয়ই মেয়ের দোষ আছে, নইলে তালাক হইল কেন? ছেলেদের কোন দোষ হয়? ছুরি তরমুজের উপর পড়ুক, কিংনা তরমুজ ছুরির উপর, কাটবে তো তরমুজই।
সমাজ তো বাঁচতে দিব না আমায়। ছোটোবোনকে নিয়ে ভয়। মেয়েটা বড়ো হয়ে গেছে, চোখে লাগে। বিয়ে শাদী দিতে হবে। আমার ডিভোর্স হলে ওকে তো কেউ বিয়ে করবে না। ওর জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। কত ভয় মায়ের…!

আমি হাসতে হাসতে নিজের ঘরে চলে এলাম। আমার এত হাসি পাচ্ছে কেন বুঝতে পারছিনা। আবার চোখ বেয়ে ও পানি পড়ছে। কী হচ্ছে যে আমার সাথে!
দোলাচল নিয়ে আতিকের নাম্বারটা ডায়াল করলাম। আতিক বোধহয় ভারি আয়েশ করে মুভি দেখছিল। ভুট্টা ভাজা খেতে খেতে জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। আমার ফোনে বিরক্তই হলো,
“হ্যালো! ফোন দিয়েছো কেন?”

আমার আবার হাসি পেল। শব্দ করেই হেসে ফেললাম। আমার হাসির শব্দে আতিক ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল বোধহয়। এটা কেবলই আমার আন্দাজ। আমি হাসতে হাসতে বললাম,
” শুনলাম, তোমরা নাকি ইফতারি আর তালাক দুই পাল্লায় নিয়ে ওজন মাপছো…? ”

চলবে……

বিঃদ্রঃ – রি-চেক করা হয়নি।

নোট- এটা সমসাময়িক জীবনের গল্প। আমি গল্পের মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বাস্ততা খুব নিষ্ঠুর। এখানে অভীকরা নয় আতিকরা থাকে। আপনি যদি অভীককে পড়ে থাকেন, তবে আতিককেও জেনে নিন।

ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here