যাত্রাশেষে (পর্ব-১৬)

#যাত্রাশেষে (পর্ব-১৬)
#হালিমা রহমান।

তুষার বয়কট করেছে মহুয়াকে।একদম ভয়াবহ বয়কট।কথা বলছে না,আশেপাশে থাকছে না,তাকাচ্ছে না।মহুয়ার কাছ থেকে মৃত্তিকাকেও জোর করে টেনে নিয়ে গেছে।তাদের বিয়ে হয়েছে, প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেছে।এই কয়েক দিনে মৃত্তিকার কাজগুলো মহুয়াই করতো।তুষারও খুব বেশি নজর দিত না এদিকে।মা-মেয়ে যেভাবে থাকলে কাছাকাছি থাকতে পারবে সেভাবেই থাকুক।মহুয়ার অনেক কাছাকাছি থাকার কারণে, এখন অনেকটাই মা নেওটা হয়ে গেছে মৃত্তিকা।মা তার সারাদিনের খেলার সাথী।মৃত্তিকা সারাদিন মহুয়ার সাথেই লেপ্টে থাকে।মহুয়া যখন রান্না করে তখন মৃত্তিকা রান্নাঘরের ফ্লোরে বসে থাকে।মহুয়া কাটাকাটি করতে গেলে মৃত্তিকাও তার পাশে বসে পিঁয়াজ-রসুন এলোমেলো করে ফেলে।অনেক সময় মৃত্তিকাকে এককাঁখে নিয়ে রান্না সারতে হয়।মহুয়া এখন পাঁচ মিনিটে গোসল সাড়ে।মেয়ের দুঃশ্চিন্তায় একদম মরে যায় সে।এমনকি নামাজের সময়ও মৃত্তিকা জায়নামাজের পাশে থাকে।তাই মহুয়া তাকে প্যাম্পার্স পরিয়ে রাখে।কখনো কখনো আবার মহুয়ার সেজদার জায়গায় চলে আসে হামাগুড়ি দিয়ে।গোলগোল চোখ করে মাকে নামাজ পড়তে দেখে।মহুয়া সেজদা দিতে গেলে পিঠ ধরে দাঁড়িয়ে যায় মৃত্তিকা।এসব খুব ভালো লাগে মহুয়ার।ইচ্ছে করে মেয়েটাকে একেবারে জাপটে ধরে রাখতে।একদম পাখির ছানার মতো।একটা বাচ্চার অনেক শখ মহুয়ার।যতবার মহুয়া মৃত্তিকাকে আদর করে,ততোবার মৃত্তিকাও নিজেকে যেন সঁপে দেয় মায়ের কাছে।একেবারে মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে থাকে।মা-মেয়ের এই সম্পর্ক দুচোখ ভরে দেখে তুষার।আজকাল নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হয়।তারও একটা রাজ্য আছে।সেখানে একটা আদুরে রাজকন্যা আছে। একটা গম্ভীর রানী আছে।মৃত্তিকা-মহুয়া যখন কাছাকাছি থাকে তখন মহুয়ার মুখ খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ঠোঁটের কোন থেকে হাসি সরেই না।তুষার কখনো কখনো খুব আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে।বাচ্চাদের প্রতি মহুয়ার দুর্বলতার কথা সে জানতো।কিন্তু,মহুয়ার আচরণ দেখে তার মাথায় একটাই চিন্তা খেলে যায়।একটা ছোট্ট শিশু শুধু মহুয়ার শখ ছিল নাকি আকুলতা ছিল?মানুষ অনেক লোভনীয় কিছু পেলে যেমন দিশাহারা হয়ে যায়, মহুয়াও ঠিক তেমন।মৃত্তিকাকে পেয়ে সে কি করবে না করবে ঠিক করতে পারছে না যেন।মহুয়া কি খুব লোভী?কিসের এতো লোভ তার?মাতৃত্বের?

বিপত্তি ঘটলো আজ সকালে।শুক্রবার হলেও ফজরের নামাজ পড়তে পারেনি ওরা।কাল তুষারের খালা-খালু বাংলাদেশ ছেড়েছে।তাদেরকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছে ওরা।ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।তাই না খেয়ে ক্লান্ত হয়েই শুয়ে পড়েছিল দুজনে।সেই ঘুম ভেঙেছে সকাল নয়টায়।মৃত্তিকাকে ঘুম থেকে থেকে তুলে, তাকে তৈরি করে,খাবার খাইয়ে ;মহুয়ার আর ইচ্ছে করলো না নাস্তা বানাতে।তাই তুষারকেই ঘুম থেকে টেনে তুলে দোকান থেকে নাস্তা আনতে পাঠালো।তুষারের কিছু টিশার্ট, ট্রাউজার ধোয়া লাগবে।সকাল সকাল সেগুলো ভিজিয়ে রাখলো।ঘর ঝাড়ু দিল।দুপুরের জন্য ফ্রিজ থেকে মাছ নামিয়ে, ভাত বসিয়ে দিল চুলায়।এখানে একটু বেলা হলেই আর গ্যাস থাকে না।কালকে একটানা অনেক্ষণ বসে ছিল।তাই সকাল থেকে পা ব্যাথা করছে।নাস্তা খেয়েই একটা ব্যাথার ঔষধ খেতে হবে।নাহয় আর বাঁচবেই না মহুয়া।
দোকানে অনেক ভীড় থাকায় তুষারের বেশ দেরি হলো ঘরে ফিরতে।দুজনে একসাথে নাস্তা করার পর, মহুয়া কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।তুষার বসে পড়লো মোবাইল নিয়ে।ইদানীং, ওর কাজ কমে গেছে।পাতাল মার্কেটের দোকানটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।একসাথে দুটো দোকান চালানো খুবই কষ্টকর।ঘরে একদম সময় দিতে পারে না।তুষার আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় না।স্ত্রী-সন্তানকে সর্বোচ্চ সময় দিতে চায় সে।টাকার পিছনে দৌড়ে কি লাভ,যদি পারিবারিক বন্ধনটাই না থাকে?গুলিস্তানের দোকানটাতেও চারজন কর্মচারী। তাই তুষারের কাজ অনেকটাই কমে গেছে।সারা দোকানে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে।ঘরে বসেই কাজ তদারক করা যায়।পাতাল মার্কেটের দোকান থেকেও মাস শেষে ভালোই ভাড়া আসে।দিনগুলো বেশ কেটে যায় এখন।তুষারের প্রায়ই গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছা করে।আহ! আশেপাশে এতো সুখ কেন?

মহুয়া রান্না চাপিয়ে তুষারের পাশে এসে বসলো।দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না।ঔষধ খাওয়ার পরেও কমলো না কেন?
তুষার ফোন রেখে বউয়ের দিকে নজর দেয়।দুজনের মাঝে মৃত্তিকা।মহুয়াকে দেখেই মৃত্তিকা তার কাছে চলে যায়।মায়ের কানের দুল নিয়ে খেলতে শুরু করে। তার খুব প্রিয় খেলা এটা।মহুয়াকে শরীর ছেড়ে দিতে দেখে রীতিমতো অবাক হলো তুষার।মেয়েটা অলস নয়।একটু কাজ করেই হাঁপিয়ে যায় না।আজ কি হলো? অসুস্থ নাকি?

—” কি হয়েছে,মহুয়া?অসুস্থ?
—” উঁহু।”
—” তাহলে?”
—” পা ব্যাথা করছে খুব। অনেকদিন পরে অনেক হেঁটেছি না কালকে।ব্যাথা করছে।”
—” ঔষধ খেয়েছ?”
—” হুম।”
—” কমে যাবে, চিন্তা করো না।আজ আর রান্না ঘরের দিকে যেয়ো না।কি বসিয়েছো?আমি দেখতে পারব না?”
—” চিংড়ি মাছ দিয়ে মিষ্টি কুমড়ো,করলা ভাজি।আর মিত্তির জন্য ঝাল ছাড়া মাংস।আপনি এগুলো রাঁধতে পারবেন না।খামোখা ওদিকে যেয়ে তরকারি নষ্ট করার দরকার নেই।”

মহুয়া বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।তুষারও ওর পাশে আধশোয়া হয়ে বসে।গালে হাত দিয়ে বলেঃ” তুমি চাকরি করবে কিভাবে,বলো তো?ঘরের কাজ সামলে একটু ঘুরতে গেলেই এই অবস্থা।আর যখন রান্নাবান্না শেষ করে মাস্টারি করতে যাবে,আবার দুপুরে এসে মিত্তিকে ধরতে হবে,দম ফালানোর সুযোগ পাবে না,তখন কি করবে?আল্লাহ মালুম।”

মহুয়াও তুষারের মতো বালিশে ভর দিয়ে একটু উঠে বসে।অবাক গলায় প্রশ্ন করেঃ” আমি চাকরী করব তা আপনাকে কে বলল?আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি না?”

—” হ্যাঁ, সেটাতো আজিমপুরে বলে।এখানে স্কুলে জয়েন করবে না?”

—” কেন!”— বেশ অবাক হয়ে যায় তুষার।হঠাৎ চাকরি করবে না কেন?
হুট করেই মহুয়ার কি যেন হলো।সে আউটসোর্সিংয়ের কথা খুলে বলল না তুষারকে।ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে বললঃ” মেয়ের জন্য বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন।আমাকে খাওয়াচ্ছেন,পরাচ্ছেন।আমিই যদি চাকরি করি তবে মেয়ে রাখবে কে?আমার খানিকটা হলেও জ্ঞান-বুদ্ধি আছে।”

তুষারের কানে যেন কেউ সিসা গলিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে।বিরক্তিতে সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করতে লাগলো।এ নিয়ে বিয়ের আগেই ঝামেলা-টামেলা চুকে গেছে।আজ আবার কেন?মহুয়ার কথাগুলো যতটা বিরক্তিকর তার চাইতে কথা বলার ধরন আরো বেশি অসহ্য।মহুয়ার মনে এসব চলে?মৃত্তিকাকে কেন এতো আদর করে তবে?সব কি শুধু তুষারের সেই কথার জন্য! হতভম্ব হয়ে যায় তুষার।মহুয়ার প্রতি এক আকাশ অভিমান নিয়ে ঝট করে নিচে নেমে দাঁড়ায়।তীব্র আক্রোশ ফুটিয়ে তুলে গলায়।

—” আমি আমার মেয়ের জন্য মা এনেছি,আয়া নয়।শুধুমাত্র মেয়ের খেয়াল রাখার জন্য বিয়ে করতে হতো না।টাকা দিয়ে আয়াই রাখতে পারতাম।তাছাড়া, তুমি যেই কথা নিয়ে খোটা দিলে তা আমি কেন বলেছি, তার কৈফিয়ত আগেই দিয়েছি।তাহলে আজ আবার কেন, মহুয়া?সেদিন পার্কে আমি সব বলিনি তোমাকে?তোমার মনে এরকম কোনো চিন্তা-ভাবনা থাকলে সেদিনই বলতে।আমি তোমাকে বিয়ের আগে দেখিনি?আমি জানি না যে তুমি চাকরিজীবী মেয়ে?চাকরি করায় আপত্তি থাকলে আমি তো তখনই বলতাম তোমাকে। মেয়ে-বউকে সময় দেওয়ার জন্য একটা দোকান ভাড়া দিয়ে দিলাম।দোকানে কর্মচারী বাড়িয়ে ফেললাম।এতে কতো খরচ বেড়েছে জানো তুমি?তবুও সবকিছু মেনে নিলাম।বউ চাকরিতে জয়েন করলে যেন মেয়েকে সময় দিতে পারি, এজন্য আগেভাগেই সব গুছিয়ে রাখছি।এতো কিছুর পরেও কিভাবে বললে এমন কথা?আজ এটা বলেছ।মৃত্তিকার প্রতি আকর্ষণ কমে গেলে তখন কি বলবে?তখন তো বলবে, মিত্তির জন্য তোমার ক্যারিয়ার হলো না।এসব তো আমি মেনে নিব না।আজ থেকে মেয়েকে প্রয়োজনের বাইরে ধরারও দরকার নেই।আমার মেয়েকে আমি নিজেই রাখতে পারব।”

আশ্চর্যের বিষয় হলো, মহুয়া একবারো শোয়া থেকে উঠলো না।সে শুধু চুপচাপ তুষারের মুখের দিকে চেয়ে রইলো।তুষারের মুখে গভীর বিষাদের ছাপ।চোখদুটো যেন অভিমানে ভরে গেছে।খুব রাগ করেছে তুষার?কিন্তু খুব বেশি সময় এমন নির্বিকারভাবে থাকতে পারলো না মহুয়া।যখন তুষার মহুয়ার গায়ের উপর থেকে মৃত্তিকাকে টেনে নিয়ে গেল,তখন লাফ দিয়ে উঠে বসলো।এই লোক এতো পাষণ্ড কেন!মহুয়া পিছন থেকে টেনে ধরলো তুষারের হাত।

—” এতো রাগ করছেন কেন?আমার কথা শুনুন। আমি একটা কারণে এমন….”

তুষার শুনলো না মহুয়ার কথা।মহুয়ার হাত সরিয়ে, মেয়েকে নিয়ে ধপধপ করে ঘর ছাড়লো।হতাশ হয়ে বসে পড়লো মহুয়া।কি দরকার ছিল আগুন লাগানোর?মাঝে মাঝে তার কি যে হয়!!!

***

মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়েছে তুষার।কড়া রোদ আকাশে।তুষারের চোখ-মুখ জ্বলে যাচ্ছে।এমনিতেই রোদ সহ্য করতে পারে না সে।মৃত্তিকা আশপাশ দেখছে।এই মেয়েটার কৌতুহলের শেষ নেই!মহুয়ার সাথে ঝামেলা না হলে কোনোভাবেই এরকম গরমে বাইরে বের হতো না তুষার।মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে বাজারে চলে এলো তার খেয়ালই নেই।আশেপাশে মানুষ গিজগিজ করছে।সারি সারি মাছ বিক্রেতা বসেছে মাছের পাতিল নিয়ে।বড় বড় কৈ মাছ দেখে চোখ আটকে গেল তুষারের।কৈ মাছ সে খুব একটা পছন্দ করে না।কিন্তু মহুয়ার খুব পছন্দ।এর মাঝে একদিন কিনেছিল এই মাছ।মহুয়া কড়কড়া করে ভেজে রেখেছিল সব মাছ।তুষারের পাতে মাছ দিলেও নিজের পাতে নেয়নি।ভাত খাওয়ার পরে হেঁটে হেঁটে মাছ খেয়েছে।বিড়ালের মতো কাঁটাসহ চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে।মহুয়ার এতো পছন্দ দেখে তুষার রাতে আর খায়নি।তার ভাগের মাছটাও মহুয়ার জন্য রেখে দিয়েছিল।রাতে শোয়ার আগে আবারো একইভাবে খেয়েছে।সেদিনই বুঝেছিল মহুয়ার খুব পছন্দ এই মাছ।কয়েক কেজি কিনে নিবে?বেশ তাজা মাছগুলো।

—” ভাই,সরেন।রাস্তার মাঝে খাড়ায়া আছেন কেন?”

এক লোকের বিরক্তিমাখা গলার স্বরে বিব্রত হলো তুষার।ভুল স্বীকার করে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ালো রাস্তা থেকে।আবারো মহুয়ার উপর রাগ উঠলো।মেয়েটা নিশ্চিত একটা জাদুকরী।নাহয় সারাক্ষণ মনে পড়বে কেন ওর কথা?সামান্য কৈ মাছ দেখেই রাস্তার মাঝে মহুয়ার কথা মনে পড়ে গেল?আজব!ঘর,মন, মাথা সবকিছু একদম দখল করে রেখেছে।
“ফাজিল মেয়ে।সবকিছুতে দখলদারি।বেয়াদব।”—মনে মনে আরো কয়েকটা ভদ্র, নরম, আদুরে গালি দিল মহুয়াকে।কপাল কুঁচকে মেয়েকে নিয়ে বাজারের বাইরে পা বাড়ালো।কিন্তু মনটা খচখচ করতে লাগলো খুব।কৈ মাছ কিনে নিলে খুব ভালো হতো না?মহুয়া তো খুব পছন্দ করে।

***

বেলা বারোটা বাজলেও যখন তুষার মেয়েকে নিয়ে ফিরলো না, তখন খুব খারাপ লাগলো মহুয়ার।খুব বেশি করে ফেলেছে, সেটা নিজেই বুঝতে পেরেছে।একবার ফোন দিয়েই দেখা যাক তুষারকে।কোথায় ঘুরছে কে জানে!মহুয়া রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।বাইরে প্রখর রোদ।মেয়েকে নিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরার দরকার আছে?ঘর-বাড়ি নেই?মহুয়া কি পুরো ঘর দখল করে রেখেছে?চুলার আঁচ কমিয়ে মহুয়া ফোন হাতে নিল।কিন্তু পাঁচবারের সময়ও যখন তুষার ফোন ধরলো না, তখন বিরক্তিতে ভিতরটা তেতো হয়ে গেল মহুয়ার।রাগ দেখিয়ে যাবি,যা।কিন্তু মেয়েকে নিয়ে যেতে হবে জেন তোর?মৃত্তিকার এই সময়ে ক্ষুধা পায়।এটা তার নুডলস খাওয়ার সময়।খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।অথচ, এই লোক বলদের মতো মেয়েকে নিয়ে বিশ্বভ্রমনে বেড়িয়েছে।আজব!
টানা আটবারের বেলায় ফোন ধরলো তুষার।মহুয়ার বিরক্তি তখন রাগের রূপি নিয়েছে।পুরুষ মানুষের আবার এতো ঢং কীসের।তাই ফোন ধরতেই ঝাঝালো গলায় বললঃ” কোথায় আপনি?”
—” তোমার কি দরকার?”
—” যা জিজ্ঞেস করেছি তা বলুন।মেয়েকে নিয়ে রোদে রোদে কেন ঘুরছেন?বাড়ি আসুন।মেয়ের খাওয়ার সময় না এখন?যদি কান্না করেছে, খবর আছে আপনার।”—মহুয়ার গলায় আলাদা অধিকারবোধ।
—” আসব না এখন।”
—” ঠিক আছে, তাহলে আমিও বেড়িয়ে যাচ্ছি।ঘরের চাবি পাশের ঘরে।খাইষ্টা লোক।”

খট করে ফোন রেখে দেয় মহুয়া।মনে মনে তুষারকে আরো জঘন্য কিছু গালি দেয়।সবকিছু বেশি বুঝে।অসহ্য একটা মানুষ।

তুষার বাড়ি ফিরলো পৌনে একটায়।হাতে কেজি কয়েক মাছ,কোলে ঘর্মাক্ত মৃত্তিকা।মহুয়া তখন সবে গোসলে ঢুকছিল।তুষারকে দেখে মেয়েকে খপ করে নিয়ে নেয়।শাড়ির আঁচল দিয়ে মেয়ের মুখ মুছে দেয়।আড়চোখে একবার তাকায় তুষারের দিকে।থমথমে মুখ পুরো লাল হয়ে আছে।টিশার্টের সামনে-পিছনে অর্ধেকটাই ভিজে গেছে।মহুয়া তাকালেও তুষার তাকালো না।মাছের পলিথিন ঠাস করে মেঝেতে ফেলে গটগট করে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।মাছ দেখে মহুয়া হেসে ফেললো।বউয়ের সাথে রাগ করে বউয়ের পছন্দের মাছই নিয়ে এসেছে।আবার কষ্ট যাতে না হয় তাই কেটে এনেছে।ব্যাটা আবুল! এ কেমন রাগ!
দুপুর হওয়ায় মৃত্তিকাকে গোসল করিয়ে খাইয়ে,ঘুম পাড়িয়ে দিল।পা ব্যাথা কমেনি মহুয়ার।আজকাল কি সব ঔষধ যে বাজারে আসে।কোনো কাজেরই না।ব্যাথার তীব্রতায় মৃত্তিকার পাশে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো মহুয়া।পায়ের ব্যাথা সারবে না জানলে আজ আর কাপড়গুলো সাবানে ভিজাতো না।তুষারের এইসব ভারী জামা-কাপড় ধুতে আজ বেশ কষ্ট হবে।এদিকে তুষার এখনো বের হচ্ছে না।কি করছে এতোক্ষণ বাথরুমে?মহুয়া উঠে কয়েকবার দরজায় আঘাত করলো।গলা উঁচিয়ে ডাকলো বেশ কয়েকবার।

—” মিত্তির বাবা,আজ আর বের হবেন না?খাবার-দাবার দিয়ে যাব এখানে?ভাত ঘুমের জন্য বালিশও
দেই।খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন এখানেই।দেব?”

মহুয়ার কথায় বিরক্তিতে দম আটকে আসলো তুষারের। কি হয়েছে আজ তার?ভূতে-টুতে ধরলো নাকি।একরাশ বিরক্তি আর হাতের বালতি ভর্তি কাপড় নিয়ে বের হলো তুষার।কাপড়গুলো ধুতেই এতো সময় লাগলো।মহুয়ার পা ব্যাথার কথা মনে আছে তার।বাইরে বেড়িয়ে মহুয়াকে দেখেই নাকের পাটা ফুলিয়ে ফেললো তুষার।তুষারের হাতে কাপড় দেখে বেশ স্বস্তি পেল মহুয়া।যাক জ্ঞান-বুদ্ধি আছে তাহলে।তুষারের দিকে তাকিয়ে মহুয়া মুচকি হাসলো।

—” রেগে থাকলে এতো কাজ করেন আপনি!বাহ!দারুন ব্যক্তিত্ব।আজ থেকে আপনি সারাক্ষণ রেগে থাকবেন,প্লিজ।আমি শুধু মেয়েটাকে নিয়ে থাকব।”

মহুয়ার দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে ঘর ছাড়লো তুষার।যদি চোখে সত্যিকার আগুন থাকতো তবে নিশ্চিত আজ মহুয়া পটল তুলতো।

জুমার নামাজ শেষ করে তুষার যখন ঘরে ঢুকলো, তখন মহুয়া নামাজ পড়ছে।তাই সেদিকে আর গেল না তুষার।মেয়েটাকে আজ ভিন্ন লাগছে।তুষারের কাছে মহুয়া ছিল গম্ভীর,বুদ্ধিমতি।কিন্তু,আজ ওর আচরণ যেন ভিন্ন।সদ্য কৈশোরে পা দিলে কিশোরীরা যেমন প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে,মহুয়াও ঠিক তেমন।হঠাৎ করে প্রাণের সন্ধান কোথায় পেলো সে?
তুষার মৃত্তিকার পাশ ঘেষে শুয়ে পড়লো।বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ লেগে আসে তার।আবার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম ভেঙেও যায়।মহুয়া এসে পাশে বসেছে।শুধু বসেনি, তুষারের কাঁধে রীতিমতো ধাক্কা দেওয়া শুরু করেছে।তুষার চরম বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে।

—” কি সমস্যা, মহুয়া?”
—” ক্ষুধা পেয়েছে।ভাত খাব।”
—” আমি কি ভাত-তরকারি নিয়ে বসে আছি?খেয়ে নেও।”
—“আপনিও খাবেন। চলুন।এখন কীসের ঘুম?ভাত খেয়ে ঘুমাবেন।”

খুন বিরক্ত হয় তুষার। উঠে একদম মুখোমুখি বসে মহুয়ার।

—” আমি তোমার উপর রেগে আছি,বুঝতে পারছো?”
—” রাগ আমার উপর।ভাত কি করলো?ভাত খাবেন না কেন?”
—” খাব না আমি।তুমি খেয়ে নেও।”
—-” ঠিকাছে, চলুন নিজেদের মাঝে সব ঠিক করে নেই।আমার ওই কথা নিয়েই রাগ তো?ওটা আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছিলাম।কাল খালামনি যাওয়ার আগে আমাকে আপনার সম্পর্কে অনেক কথা বলে গেছেন।আপনি সহজে রাগেন না। কিন্তু রেগে গেলে তখন আর হুশ থাকে না, এরকম আর কি।আমিও ভাবলাম,একবার রাগের পরিধি যাচাই করেই নেই।দেখি, আমি সহ্য করতে পারি নাকি।কিন্তু,আজ যা দেখলাম তাতে আমি খুবই আশাহত।
আপনি রেগে থাকলেই আমার লাভ।এই যে আজকে কতো কাজ করে দিলেন।সারাদিন শুয়ে বসেই কেটেছে আমার।তাছাড়া, চাকরি করার ইচ্ছা আমার নেই।আমার নেশা আউটসোর্সিংয়ে। এজন্য গ্রাফিক্স ডিজাইনের উপর একটা কোর্সও করেছিলাম প্রায় দু-বছর আগে।এখন কয়েকদিন আবারো চর্চা করলেই হয়ে যাবে।ধরা বাধা চাকরি আমার ভালো লাগে না।আমি নিজের স্বাধীন মতো কাজ করব।তাই চাকরি করার ইচ্ছা অনেক আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছি।এবার বুঝলেন?সকালের বিষয়টা ইচ্ছাকৃত ছিল।তবুও যদি দুঃখ পেয়ে থাকেন, তবে সরি।”

তুষার কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো।কয়েক সেকেন্ড মাত্র।তারপর হুট করে হাঁটুতে ভর দিয়ে মহুয়ার দিকে এগিয়ে গেল।মহুয়ার টিপের মতো তিলটাতে দুই নখ দিয়ে কুট করে চিমটি দিল।

—” সমস্যা কি মিত্তির বাবা?”
—” আরেকদিন এরকম করলে আছাড় দিয়ে নাড়ী-ভুরি বের করে ফেলব,ফাজিল মহিলা।”
—” নাড়ী রশির মতো হয় না?আপনাকেই আমি ছেড়ে দেব ভেবেছেন?আমার নাড়ী-ভুরি আপনার গলায় পেঁচিয়ে আপনাকেও মেরে দেব।আমি মহুয়া,হুহ।খেতে আসুন।”

তুষার মহুয়ার গমনপথে চেয়ে রইলো।নিজের চাইতে বড় স্বামীকে কে এমন হুমকি দেয়!!!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here