যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
পর্ব ১১
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই, সানোয়ার সাহেব এত রাত পর্যন্ত কখনো জেগে থাকেন না। তিনি চাকরিজীবনের শুরু থেকে সময় মেনে চলা মানুষ। সকাল আটটায় অফিস গিয়ে সন্ধ্যা ছয়টায় বাসায় ফিরতেন, তারপর চা নাস্তা খেয়ে পেপার নিয়ে বসতেন। একঘন্টা পেপার আর এক ঘন্টা খবর দেখার পর রাতের খাবার খেয়ে নিতেন দশটার ভেতর। এগারোটা না বাজতে ঘুম। বেশিরভাগ দিন তিনি একাই খেতেন, হামিদা বেগমের খাওয়ার সময় এলোমেলো, বাসার কাজ শেষে খেতে খেতে বিকেল পাঁচটা, রাতেরটা বারোটা। ছেলেমেয়েরা বড়ো হওয়ার পর তিনি নিজে কখনো শখ করে ডাকেননি, হামিদাও ভাতে তরকারি বাটিতে দিয়ে ছেলেমেয়েদের পাশে বসতেন, না হয় টেলিভিশন দেখতেন। অজান্তেই নিজের বাসাতে নিজের এক আলাদা জগতে যেন বাস করতেন সানোয়ার সাহেব।
ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বাসার বাজার, সামাজিক অনুষ্ঠান সবকিছু স্ত্রী হামিদাই দেখতেন। সানোয়ার সাহেবের ছোটোবেলায় বাবা মারা যান, আর বিয়ের একবছর পর মা। তিন ভাইয়ের ভেতর তিনিই ছোটো। ওনার মতো বাকি দুই ভাইও অবসর জীবন কাটাচ্ছেন, তারাও নিজেদের সংসার নাতি নাতনি নিয়ে আলাদা জীবনে ব্যস্ত আছেন। এখন ভাইয়ে ভাইয়ে কথা হয় কোন উপলক্ষে সামনে এলে। তিনি নিজেও অবশ্য কখনো সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখার চেষ্টা করেননি। স্ত্রী হামিদাকে তাই বলতে গেলে শ্বশুরবাড়ির ঝুট-ঝামেলায় কখনো পড়তেই হয়নি। সময়ে সময়ে শাশুড়ি, শ্বশুরবাড়ি নিয়ে হামিদার কাছে মেয়ে রুমির করা অভিযোগগুলো বাড়াবাড়ি মনে হওয়া অস্বাভাবিক না। কখনোই তাই রুমি হামিদার কাছে সহমর্মিতা পায়নি। হয়তো তিনি নিজে তা অনুভব না করায় রুমির সমস্যাগুলো বুঝতে পারতেন না। একসময় রুমি কথা শেয়ার করাই বাদ দিয়ে দিয়েছিল। তবে সেই অভিমান যে আজও মনে পুষে রেখেছে রুমি, আজ সন্ধ্যায় তা বুঝতে পেরেছেন সানোয়ার সাহেব আর হামিদা বেগম দু’জনই।
মনে মনে রুমির অভিযোগগুলো আওড়ান সানোয়ার সাহেব। শুধু হামিদাকে না মেয়েটা তো ওনাকেও অভিযুক্ত করেছেন। সত্যিই তো বলেছে রুমি, বাবা হিসেবে সংসারে শুধু আয়ের দিকটা তিনি দেখেছেন, আর সবকিছু থেকে দূরে থেকেছেন। বাবা হিসেবে সন্তানদের কাছাকাছি যাওয়ার কোন ভূমিকা তিনি নিতে চাননি, একটা উদাসীনতা সবসময় ছিল। কেমন নির্লিপ্ত ভাব বজায় রেখেছেন। তার উপর একটা সময় অফিসের রিসেপশনিস্ট রিতার সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক আছে ভেবে নিয়ে হামিদা ভীষণ চাপ দেওয়া শুরু করেছিলেন। লুকিয়ে অফিসে যাওয়া, পিওনকে টাকা দিয়ে পিছনে লাগানো সহ রিতাকে ফোনে হুমকি ধামকি দেওয়া, কোন কিছুই বাকি রাখেননি। তবে হামিদা এই জিনিস কোনদিন ছেলেমেয়ের সামনে তোলেনি এই জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। সংসারের শান্তির জন্য সেই চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে ঢুকেন তিনি, কিন্তু হামিদার সন্দেহ মুক্ত হতে পারেননি। এর তিক্ত প্রভাবে ওনার আর হামিদার সম্পর্ক শীতল হয়ে গিয়েছে বহু আগে। হামিদা অবশ্য কখনোই রুমির মতো ঘর ছেড়ে চলে যায়নি, বরং মনে সন্দেহ আর বিদ্বেষ পুষে রেখে সংসার করে গিয়েছেন। তবে ওনাদের সম্পর্কের মাঝে একটা বিশাল শূণ্যতা আছে। এই সংসারে তাই রুমির মামা খালার প্রভাব যতটুকু আছে, গৃহকর্তা হয়েও তার সিকিভাগও ওনার নিজের নেই। অবসরে যাওয়ার পর তো আরও সরে গিয়েছেন গৃহকর্ম থেকে। এখন দিনের বেশিরভাগ সময় তাবলীগের সহযাত্রীদের সাথে কাটান, পেপার পড়েন, খবর দেখেন। রুমির মেয়েটা ঘরময় দুষ্টুমি করে, হামিদা পেছন পেছন দৌড়ে হয়রান হয়, তিনি কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে আদর করেন, এইটুকুই। একটু কিছুক্ষণ বাচ্চাটাকে সময় দিলে হামিদার একার উপরে সংসার আর নাতনির চাপ আসত না, মেয়েটাকেও তাহলে সেই রাগটা দেখাতেন না হামিদা। রোজ রুমি বাসায় ফিরলে যে হামিদা চাপা জিদ দেখায় তা তিনি দেখেও না দেখার ভান করেন। রুমি কী সত্যি বলেছে! মেয়ে ডিভোর্স নেওয়ায় তিনিও কী বিরক্ত নন! হামিদার মতো তিনিও চেয়েছেন রুমি সংসার করুক, যেখানে হিমেল মাফ চেয়ে সংসার করতে আগ্রহী ছিল। স্বামী ভুল করলে, স্ত্রী মাফ করে সংসার করবে, এই তো হয়, এই তো সমাজের নিয়ম!
“আম্মা থাপ্পড় মারলে কেন? অন্যায় কী বলেছি? মামী আমার নামে উল্টোপাল্টা কথা বলে না বলো? যখনই তুমি একটু স্বাভাবিক হও, তখনই মামী একটা না একটা প্যাঁচ লাগায়। শুরুতে মনে হতো কত সহমর্মি মামী, পরে আস্তে আস্তে বুঝেছি, এটা শুধু একটা মজা মামীর কাছে। এই যে আমাদের ঘরে ঝগড়া হয়, অশান্তি হয়, আমরা পারিবারিক সালিস ডাকি, তাতে মামা মামী প্রধান হয়, এটাই তাদের মজা।”
রুমির বড়োমামাও শান্ত ভাগ্নীর এমন রূপ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, “রুমি আমার সামনে তুই তোর মামীকে নিয়ে এসব বলছিস, ছিঃ। আর দশটা মানুষ থেকে কত আলাদা জুলেখা, কয়জন মহিলা ননদের পরিবারের খেয়াল রাখে? তোমাদের খোঁজ খবর রাখে বলে আজ ও খারাপ হয়ে গেল?”
“খোঁজ খবর রাখা একটা মামা। আর পিছনে লাগা আরেকটা। আমরা কে কী করলাম কী করবো, সেই বিষয়ে সারাক্ষণ আপনাদের রায় নিয়ে চলতে হয়। কেন? আমার আব্বা আম্মা কী নিতু আর মাসুম ভাইয়ের জীবন নিয়ে কোন মন্তব্য করে?”
” না করে না। কারণ ওদের জন্য আমরা যথেষ্ট। ওদের সাথে তোমাদের তুলনা হয়?”
“কোন দিকে হয় না? কী হাতি ঘোড়া? নিতুর বিয়ের সবে একবছর মামা, এখনি এত নিশ্চিত হলেন কিভাবে যে সারাজীবন সংসার টিকবে? আর মাসুম ভাইও আদিলের মতোই বেকার, আপনার দোকান দেখা আলাদা কোন পেশা তো না।”
সেই সময় সানোয়ার সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, “রুমি বেয়াদব মেয়ে, আর একটা কথা বললে থাবড়ে দাঁত ফেলে দেব, শয়তান মেয়ে।”
“বাহ্ আব্বা তুমি কথাও বলতে পার! আমি তো মাঝেমাঝে ভুলেই যাই যে তুমিও আছ। কেন আব্বা, কেন মারবে? আমার অপরাধ কী? তুমিও আলাদা কেউ না। আজ আমি যদি হিমেলের হাতে খুনও হতাম তাও বোধহয় তুমি এত কষ্ট পেতে না, যতটা চলে আসায় পেয়েছ। আমি কী তোমাদের বোঝা? একজন বাইরের মানুষ এসে বলছে আমি আমার বোনের বিয়েতে থাকতে পারব না, অথচ তুমি আর আম্মা চুপচাপ শুনছ। আমাকে আর আমার মেয়েকে ছোটো করতেও বাঁধছে না। আমি কেন লুকাবো? আমি কী পাপ করেছি? শুধু তুমি আর আম্মা না, তোমরা সবাই আমাকে রাতদিন কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ। এগারোটা মাস ধরে আমি সহ্য করছি। কঠিন সময়ে তোমাদের পাশে না পেয়ে শুধু সমালোচনা পাচ্ছি। আমি উঠলে দোষ, বসলে দোষ, সাজলে দোষ, ফেসবুকে ছবি দিলে দোষ। আমার ভাই-বোনগুলো পর্যন্ত আমাকে তাচ্ছিল্য করে তোমাদের দেখে দেখে। টিভি চালিয়ে বসি, রশ্মি হঠাৎ এসে হাত থেকে রিমোট নিয়ে যায়, অথচ আমরা দু’জনই এই বাসার মেয়ে। আদিল উঠতে বসতে এটা ওটা করার হুকুম দেয়। আর আম্মা তো রাতদিন কী এক আজব জিদ দেখায়। এই যে মামী সারাক্ষণ আমার পেছনে পড়ে থাকেন, ছবি দিলেই, আম্মাকে ফোনে বলেন আমি এত ছবি দেই কেন, মানুষ খারাপ বলে। আমি কী ছবি দেই যে মানুষ খারাপ বলে? অথচ মামীর কথায় আম্মা আমাকে উল্টোপাল্টা বলেন। বাসায় আসলেই মামী আম্মাকে বলেন যে, আম্মা আমার বাচ্চা কষ্ট করে কেন দেখে, এখন এই বয়সে রেস্ট দরকার। আমি কী আম্মাকে দিয়ে বাড়তি কোন কাজ করাই? বাধ্য হয়ে অফিসের সময়টুকু রেখে যাই। অফিসে যাওয়ার পর, অফিস থেকে এসে আমি ননস্টপ কাজ করি, তারপরও তোমাদের কেন এত বিরক্তি। একটু টিভি ছাড়লে হইচই করো, বাসায় আসতে দশ মিনিট দেরি হলে হইচই করো। আমি তো তোমাদেরই মেয়ে, কেন তোমাদের কাছে এত অসহ্যকর হয়ে গিয়েছি?”
রুমির কিছু অভিযোগ হয়তো হাস্যকর ছিল, রাগের বশে অনেককিছুই বলেছে। কিন্তু কিছু কথা চরম সত্য ছিল, তা ঠিকই বুঝতে পারছেন সানোয়ার সাহেব। একাকী বসে বসে ভাবেন, নিজের অবহেলায় আর ভুলে সংসারটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। স্ত্রীর সাথে অভিমান পুষে রেখে দূরে থেকেছেন, একসময় সন্তান, সংসার সব অবহেলা করেছেন, দিনশেষে আজ নিজেকে বড়ো নিঃসঙ্গ আর ব্যর্থ মনে হচ্ছে। হামিদা বেগম বুঝবে না জানেন সানোয়ার সাহেব। নিজের ভাইবোনকে হামিদা বেগম অন্ধ বিশ্বাস করেন। সংসারের এই সম্পর্কের ছিঁড়ে যাওয়া সুতো কী আর জোড়া লাগানোর সময় নেই! মনে মনে তাই ভাবেন সানোয়ার সাহেব।
(চলবে)