যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-১২

0
670

# যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
# পর্ব ১২

“মরিয়ম আপা, আমি তিতলিকে নিয়ে কাল সকালেই সিফট করতে চাইছি। কর্মজীবী হোস্টেলে কী বাচ্চাসহ রুম দেয়? বা তোমার বাসায় আমরা মা মেয়ে সাবলেট থাকতে পারব? ভাড়া দেব আপু।”

“রুমি কী হলো হঠাৎ? এসব কি কথা?”

“আপা দেখা হলে তখন খুলে বলব, আপাততঃ এতটুকু বলি আগামীকালই মেয়েকে নিয়ে নিরাপদ কোন জায়গায় উঠতে চাই। আপা আমার কোন বান্ধবীর সাথে এখন তেমন সখ্যতা নেই যে সরাসরি তাদের কারও বাসায় ওঠা যাবে। তাছাড়া সবাই এখন বিবাহিত, তাদের শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা হয়তো সহজ ভাবে নেবে না। আপা অন্তত কয়েকদিন কী আপনার বাসায় থাকতে পারব ? তিতলি রুমনকে কোন বিরক্ত করবে না। এরমাঝে বাসা খুঁজে পেলে চলে যাব।”

মরিয়ম সহসা কী জবাব দেবে বোঝে না। শ্বশুরবাড়ি না হোক, শাশুড়ি তো তারও আছে। তিনি কী এটা সহজ ভাবে নেবেন!

“রুমি আমি একটু পর ফোন দিচ্ছি। তুমি কান্না থামাও প্লিজ। ধৈর্য ধরো, আমি জানাচ্ছি।”

রুমি তখন রাগ করে বলে তো দিয়েছে যে মেয়ে নিয়ে আর এক মুহূর্ত থাকবে না। কিন্তু সহসা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে অনুভব করে এই বিশাল শহরে তার হুট করে চলে যাওয়ার কোন নিরাপদ জায়গা নেই। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে অভিমান করে বাবার বাড়ি আসে, কিন্তু বাড়ির বাড়ি থেকে অভিমান করে যাওয়ার জায়গা এত সহজ নয়। মামা চাচা খালা ফুপু সবাই তো বাবার বাড়িরই অংশ, অভিমান করে সেই তাদের কাছেই আশ্রয় চাইতে যাওয়া রুমির পক্ষে এখন সম্ভব না। মামা মামীর সাথে কথাকাটাকাটিতে শুরু হওয়া মনোমালিন্য এতদূর চলে গিয়েছে যে এখন এখান থেকে বের হয়ে খালার বাসায় গেলে সেটা হাস্যকর হবে! আর চাচাদের কারও সাথে অতটা ঘনিষ্ঠতা এখন নেই, তাছাড়া পারিবারিক মহলে সবমিলিয়ে কেমন বিব্রতকর পরিস্থিতি হবে।

স্বামীর সাথে যখন সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, তখন প্রাক্তন স্বামীর আত্মীয় স্বজনদের সাথেও আর কোন সম্পর্ক রাখাটা কেমন জানি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রুমির স্বামী হিমেলের ছোটোখালার বয়স কম, রুমিকে খুব আদর করতেন, বান্ধবীর মতো সম্পর্ক ছিল। হিমেলের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তিনি দুইরাত রুমির সাথে ঘুমিয়েছিলেন। রাতে উঠে যখন রুমি কান্না করতো, খালা শক্ত করে রুমিকে জড়িয়ে ধরতেন। সেই সময়,সেই আলিঙ্গন ভঙ্গুর রুমির যে কতোবড় একটা শক্তি হয়ে পাশে ছিল। ছেলের ঘটনায় বিব্রত হলেও রুমির শাশুড়ি একমাত্র ছেলের বিরুদ্ধে গিয়ে রুমির পাশে দাঁড়াননি। বরং বারবার রুমিকে সব চেপে যেতে চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু হিমেলের সাথে ডিভোর্সের পর আর চাইলেও আগের মতো ছোটোখালার শরণাপন্ন হতে পারে না রুমি, এখন যে তিনি প্রাক্তন স্বামীর খালা। তার সাথে সম্পর্ক রাখাটা সমাজের চোখে অশোভনীয়! তাই কোথায় যাবে ভাবতে ভাবতে মরিয়ম আপার কথাই মাথায় আসে রুমির।

****
রুমিকে ফোন দেবে তো বলেছে মরিয়ম আপা কিন্তু ভেবে পায় না শাশুড়ি বা স্বামী শিহাবকে কী বলবে। অবশ্য শাশুড়ি মা খুব খুশি এখন। আজ সন্ধ্যায় মরিয়ম শাশুড়িকে জানিয়েছে যে তিনি আবার মা হতে চলেছেন। দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হওয়ার সংবাদে শাশুড়ি ভীষণ আনন্দিত।

সাঁইত্রিশ বছর বয়সে দ্বিতীয় বার গর্ভধারণ করেছে মরিয়ম, দীর্ঘ বিরতিতে বেশি বয়সে সন্তান নিলে বেশ ঝুঁকি থাকে সন্তান জন্মদানে। আর তাই বাসার সবাই মরিয়মকে একদম বেড রেস্টে থাকতে চাপ দিচ্ছে। দরকার হলে শুরুর তিন মাস অফিস থেকে ছুটি নিতে বলছেন পরিবারের সবাই। শাশুড়ি মা জোর করে রাতের রান্নাও করেছেন। মরিয়মকে খাইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি শুতে পাঠিয়েছেন। মরিয়ম যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারে তাই শিহাব রুমনকে নিয়ে পাশের ঘরে ঘুমিয়েছে। শিহাবও যে নতুন সদস্যের আগমনের সংবাদে ভীষণ খুশি তা বুঝতে পারে মরিয়ম। যদিও একটু অভিমান ছিল, কেন সবার আগে শিহাবকে বলেনি মরিয়ম। রুমনকে নিয়ে মরিয়ম তার মনের ভয়টুকু প্রকাশ করলে অবশ্য অভিমান ভুলে সাহস দিয়েছেন শিহাব। সবার এত যত্ন দেখে কিছুক্ষণের জন্য মরিয়মের মনের দুঃশ্চিন্তার কালো মেঘ সরে গিয়ে খুশি এসেছে। বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমও চলে এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ রুমির ফোন এসে চিন্তায় ফেলে দিল। এখন বাজে প্রায় রাত একটা, এসময় শিহাব বা শাশুড়িকে জাগানো কী ঠিক হবে! আবার রুমিও ওর ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকবে।
কী বলবে মরিময়!

“কার সাথে কথা বললা মরিয়ম?”

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেন শিহাব সাহেবের আম্মা।

“আম্মা, এতরাতে জেগে আছেন?”

“তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য অপেক্ষা করতেছিলাম। গভীর রাতে আল্লাহরে ডাকলে আল্লাহ বান্দার উপর খুশি হোন। এতবড় খুশির খবর দিলেন আল্লাহ, শুকরিয়া জানাব না?”

নাতি নাতনির আগমনের খবরে কতটা খুশি হয়েছেন বোঝে মরিয়ম। মাথা নেড়ে শাশুড়ির কথা সায় দেয়।

“বললে না তো কে ফোন দিল? কোন সমস্যা?”

ধীরে ধীরে যতটুকু জানে তা খুলে বলে মরিয়ম। শিহাব সাহেবের আম্মা মরিয়মের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেন। তারপর ধীর কণ্ঠে বলেন,

“না করে দাও বৌ। আমার ছেলে ভালো, তুমি ভালো, ঐ মেয়েও নিশ্চয়ই খুব ভালো। কিন্তু শয়তান খুব খারাপ। সারাক্ষণ কুমন্ত্রণা দেয়। কমবয়সী একটা মেয়ে ঘরে আশ্রয় দেওয়ার চিন্তা যদি তোমার ভালোমানুষি হয়, তবে শয়তান তাকে সতীন বানাতে সময় নিবে না। দিনে দিনে দুনিয়া কম দেখি নাই। এমনিও শিহাবরে সময় দিতে পার না রুমনের জন্য, তারউপর এখন বাচ্চা হবে তোমার। এরপরও একটা কমবয়সী মেয়েকে আশ্রয় দেওয়ার কথা মাথায় আসে কিভাবে? আমারে খারাপ ভাবলে খারাপ, কিন্তু পরিবারের ভালোমন্দ দেখা আমার কাজ।”

শাশুড়ির কথা বুঝতে পারে মরিয়ম। রুমিকে সাহায্য করতে চায়, কিন্তু মাত্রই শাশুড়ি মা কী বোঝাতে চেয়েছেন তাও মাথা থেকে সরাতে পারে না। ইতস্তত করে ফোন হাতে তুলে নেয় মরিয়ম।

***
টুং করে মেসেজের শব্দ আসে রুমির ফোনে।

“স্যরি রুমি।”

দুই শব্দে অপারগতা জানায় মরিয়ম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here