#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব১৯
রুমির কী হয়েছে! টিনএজারদের মতো অবস্থা, মন সদা অস্থির। হাসানের সাথে যতক্ষণ থাকে কী ভীষণ ভালো লাগে, কারণে অকারণে কথা বলতে ইচ্ছে করে, খাতা দেখতে দেখতে একসাথে চা খেতে ভালো লাগে, হাসানের সেন্স অফ হিউমার ওকে মুগ্ধ করে। হাসতে পারা আর হাসাতে পারা বিশাল গুণ, এই দুটোই হাসানের আছে। হাসানের উপস্থিত বুদ্ধি, তার হাসি সবকিছু ধীরে ধীরে রুমিকে মোমের মতো গলিয়ে ফেলছে। প্রেমে পড়ার প্রবল অনুভূতি হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। অথচ সবকিছু বুকের ভেতর বুদবুদ তুলে শেষ, নিজেকে যে হাসানের সামনে প্রকাশ না করার কঠিন সংগ্রামে ব্রত রুমি।
আসলে গত একবছরে নানা চড়াই উৎরাই পাড়ি দিতে গিয়ে বেশ কঠিন মানবীর রূপ ধারণ করেছে রুমি। একা মেয়েমানুষের চলার পথ কঠিন করতে যে সদা একদল মানুষ প্রস্তুত থাকে। যারা ভাবে স্বামীহীনা নারীকে খুব সহজেই বাগে পাওয়া যাবে। তাদের হাত থেকে বাঁচতেই এতটা কাঠিন্যের মোড়কে নিজেকে মুড়িয়েছে যে এখন চাইলেই সহজ হতে পারে না হাসানের সামনে। তাছাড়া রুমি কানকথা ছড়ানোর ভয়ে থাকে, মিতুর মতো অবিবাহিত হলে হয়তো এতটা অস্বস্তি হতো না, কিন্তু রুমির জন্য গালগল্প ছড়ানোটা সহজ। কিছু টের পেলে রৌশন আপাও বড় গলায় বলতে পারবেন, “আমি আগেই বলেছিলাম, এমনই হবে। রুমি তো একটা পুরুষের পেলেই ঝুলে পড়তে রাজি ছিল, সেখানে হাসান তো সোনায় সোহাগা।”
আর তাছাড়া বাঙালি সমাজ এখনো এতটা উদার হয়েছে কই! এখানে এখনো বয়স্ক ডিভোর্সি পাত্রের পরিবার ছেলের দ্বিতীয় বিয়ের সময় কুমারী মেয়ে খোঁজে। আর হাসানের মতো অবিবাহিত ছেলের পরিবার নিশ্চয়ই এক সন্তানসহ রুমিকে সাদরে গ্রহণ করবে না, যদি না হাসানের মনে রুমির জন্য একই রকম তীব্র আবেগ থাকে। আর সেই আবেগ আছে কিনা রুমি জানে না। হাসান সুন্দর করে কথা বলে, মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করে, কোনদিন কলেজে দেরি হয়ে গেলে সবার দৃষ্টি বাঁচিয়ে বাইকে লিফট দেয়। কিন্তু এর কোনটাই এখনো ঠিক প্রেম বলে ধরা দেয় না।
“রুমি আপা, প্রফের বেশ কিছু কাজ আছে। আজ একটু সময় লাগতে পারে, আপনার কষ্ট হয়ে যাচ্ছে জানি।”
হাসানের ডাকে রুমির ধ্যান ভাঙে, নিজেকে সামলে জবাব দেয়, “প্রফের সময় একটু চাপতো যাবেই। সমস্যা হলো আগের ডিপার্টমেন্টেও সময় দিতে হচ্ছে, রাকিন ভাই তো নতুন জয়েন করেছেন, বেশকিছু টপিকস নিয়ে আলোচনা করতে চাইছেন। স্যারও বলেছেন বছরের এমন সময় জয়েন করেছে, ওনাকে একটু সাহায্য করতে।”
“রাকিন ভাইকে কেমন চুপচাপ মনে হয়, রাশভারী।”
“সবাই কী আপনার মতো হয়, হাসিখুশি।”
“প্রশংসা করলেন, না মজা করলেন আপা? আমরা ভাই এত মেধাবী মানুষ না, এত ডিগ্রি টিগ্রি নাই তো, তাই জ্ঞানী ভাব তাই আসে না। তবে রাকিন ভাই লেকচারার পোস্টে কেন ঢুকলেন এটাই অবাক হলাম।”
“স্যারের সরাসরি ছাত্র তো, তাই স্যারের কথা ফেলতে পারেনি। তবে বেশিদিন লেকচারার থাকবে না, এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে প্রমোশনের ব্যবস্থা হবে।”
“বাহ্, আসতে না আসতে প্রমোশন হবে। ভালোই।”
“জ্বি। তবে রাকিন ভাইকে রাশভারি মনে হলেও লোক ভালো। মাপা কথাবার্তা বলেন এই আরকি।”
“হুম বেশ ভালো, রুমি আপার তাহলে আমাদের ভালো লোক মনে হয় না।”
“আরে ধুর, আমার জন্য সবাই এক।”
“তবে রাকিন ভাইয়ের উপর অনেকের নজর পড়েছে।।মিতু তো ভালোই আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে। চিলড্রেন ডিপার্টমেন্টের আলো আপা নাকি ওনার ছোটবোনের জন্য ভেবেছেন। তবে এই লোক এখনো সিঙ্গেল কেন অবাক তাই হলাম। দেখতে শুনতে তো বেশ স্মার্ট, টাকা পয়সাও আছে। আমাদের মতো হাভাতে না যে মহিলারা ভাই বলেই কাজ চালাবে।”
রুমি শব্দ করেই হেসে দেয়, “হাসান ভাই, আপনি কারও সাথে জড়াতে চান না তাই বলেন। শুধু শুধু ঐ বেচারাকে হিংসা করছেন। মিতু কতদিন ডিপার্টমেন্টে ঘুরে গেল আপনাকে নিয়ে চা খাবে বলে, পাত্তাই দিলেন না। আপনার মনের পথের রাস্তা না পেয়েই তো এখন পথ বদলালো।”
“আপনাকে তো পাত্তা দেই, চা ও খাই রোজ একসাথে, তারপরও আপনি মনের পথ ধরছেন কই? আমাকে রাকিনের মতো যোগ্য মনে হয় না?”
একমুহূর্তের জন্য রুমির হাসি মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। এটা কী ছিল, হাসান কী মজা করেছে, না কিছু বোঝাতে চাইছে! যদিও হাসান কথাটা বলেই পরমুহূর্তে রুম ছেড়ে চলে যায়। রুমি ঠায় বসে থাকে, খাতা গুলো এলোমেলো পড়ে আছে, ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করে যেন রুমিকে জিজ্ঞেস করছে, “রুমি তুমি ঠিক আছ?”
*****
মরিয়ম টানা দশদিন ছুটি নিয়েছিল, কাল ছুটি শেষে। সেইদিনের সেই ঘটনার পর মরিয়ম বাসায় আর কোন রকম উচ্চবাচ্য করেনি। কলেজে রুমনের অসুস্থতার কথা জানিয়ে দশদিনের আর্নিং লিভ নিয়েছে। এই দশদিন সে তার পুরোটা সময় রুমনকে দিয়েছে। মরিয়মের শাশুড়ি দিলারা বেগম মাঝেমাঝে এটা সেটা বলার চেষ্টা করলেও আবার নিজ থেকেই চুপ হয়ে গিয়েছেন। ঘুমের ঔষধের ঘটনা যে পরিবারের কেউ ভালোভাবে নেয়নি, এতটুকু তিনি বুঝতে পারছেন। শিহাব মাকে খুব ভালোবাসে, তাই মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু ছেলের যে অভিমান হয়েছে তা তিনি জানেন। মরিয়মকে আগের মতো চোখে চোখে রেখে ভালোমন্দ বুঝ দিতে পারেন না বলে বেশ অস্থিরতায় ভোগেন। আজ না পেরে মেয়েকে ফোন দিয়েছেন,
“হ্যালো আম্মা, কেমন আছ?”
“এই আল্লাহ রাখছে একরকম। তোমরা সবাই মিলে তো শাস্তি দিতেছ, কেমন আর থাকবো।””
“আমরা কী শাস্তি দিলাম আম্মা?”
“আর বাদ রাখলে কী। আমি কী জানি যে ঘুমের ঔষধ অর্ধেক করে খাওয়ানোও ঠিক না। আর সেই তোমাদের আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার যে রাতের ঘুম নাই হয়ে গিয়েছিল, তখন তোমরাই ডাক্তারের কথামতো আমাকে ঔষধ খেতে বলো নাই? তখন বলছো, আম্মা ঔষধ খেলে আপনার ঘুম হবে, শরীর ভালো লাগবে। আজ এতদিন ধরে রাতে ঘুমের ঔষধ খাই, তখন কেউ বলো নাই এটা খারাপ।”
“আম্মা তোমার বয়স আর রুমনের বয়স এক হলো? আব্বার মৃত্যুর পর না ঘুমিয়ে তুমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলে, তাই ডাক্তার ঔষধ দিয়েছিল। এরপর দেখ এখন নিয়মিত ঔষধ না খেলে তোমার ঘুম হয় না। এই অবস্থা তো এইবয়সেই রুমনের হয়ে যাবে।”
“আমার ভুল হইছে স্বীকার যাই। কিন্তু আমি বুঝি নাই এত কিছু। এখন তো তোর ভাবি সারাদিন ছেলে আগলে পড়ে আছে, যেন আমি শত্রু। অথচ কেউ বলতে পারবে যে নাতিরে কোনদিন অনাদর করছি? ছেলের বৌকে মন্দ বলছি? মরিয়মের বেশি বয়সে বাচ্চা হচ্ছে, আমি যত্নআত্তির কম রাখছি? ও যেন দুপুরে একটু ঘুমাতে পারে সেইজন্য রুমনরে ঘুম পাড়াতে চাইছি। আর কিছু তো না।”
“তোমার উদ্দেশ্য ভালো হলেও, পথ ভুল ছিল আম্মা, যতই ব্যাখ্যা দাও। তুমি ঠিক জানতা যা করছো ঠিক না, না হলে ভাবি না হোক, তুমি ভাইয়াকে ঠিক জিজ্ঞেস করতে যে রুমনকে রোজ ঔষধ দেওয়া যাবে কিনা। এখন যদি জানাজানি না হতো তুমি নিয়মিত ঔষধ দিতে আম্মা। তারউপর তুমি রুমনকে তার মায়ের কাছে যাওয়া থেকে আটকাতে। এটা করে বাচ্চাটার মনে কত চাপ দিয়েছ তুমি। ওর অবসথা তুমি জানো না….”
মেয়েকে কথা শেষ করতে বা দিয়েই ফেন কেটে দেন দিলারা বেগম। সুযোগ পেয়ে সবাই ওনাকে জ্ঞান দিচ্ছে, ভুল ধরছে তাই মনে হচ্ছে এখন। মরিয়মকে রুমনের কাজের চাপ থেকে দূরে রাখতেই তো এসব করেছেন, ছেলের বৌকে তো অত্যাচার করেননি। আর রুমন তো জন্ম থেকেই এমন, মন মতো না হলেও অস্থির হয়ে যায়। সেই জন্য সবাই এভাবে ওনার ভুল ধরবে। এই পরিবারে আগে কখনো এমন হয়নি। বিচক্ষণ বলেই সবাই ওনাকে সম্মান করে, আর আজ সবাই ভালো খারাপের পাট পড়াচ্ছে।
একা একাই রুমে গজগজ করেন দিলারা বেগম।