যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-২০

0
713

#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব২০

দেখতে দেখতে রুমির ছোটবোন রশ্মির বিয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ছোটখাটো আয়োজন হবে, রুমি তাই অফিসের কলিগ কাকে কাকে বলবে বুঝতে পারছে না। যদিও হাসানকে দাওয়াত দিতে খুব ইচ্ছে করছে, দাওয়াত দিতে না পেরে লজ্জাও লাগছে। কিন্তু শুধু হাসানকে দাওয়াত দিলে কলেজে জোর আলোচনা উঠবে, আবার সাথে আরও কয়েকজনকে দাওয়াত দিতে গেলে যাদের বলা হবে না তারা হয়তো সামনাসামনি কিছু বলবে না, কিন্তু রুমিরই ওদের সামনে বিব্রত লাগবে। সব ডিপার্টমেন্টের সবাইকে বলতে গেলে ত্রিশজনের বেশি মেহমান রুমিরই হয়ে যাবে। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়, অন্ততঃ ফাইনাল ইয়ারের সব কলিগদের তো বলা উচিত, যাদের সাথে বছর জুড়ে কাজ করা হয়। কেটে ছেঁটে তেরো জনের লিস্ট করে রুমি।

কপালের টিপটা জায়গামতো বসায়, নীল একরঙা শাড়ির সাথে কালো টিপ, চোখে কাজল, আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধই হয় রুমি। এই লাবণ্য গত একবছরে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, হাসানের সাথে সম্পর্কটা যত সামনে এগুচ্ছে চেহারায় যেন এক সুখ খেলা করছে, নতুন করে জীবন শুরু করতে ইচ্ছে করছে। যদিও সে বা হাসান, কেউই এখনো ভালোবাসি কথাটা উচ্চারণ করেনি, কিন্তু চোখে চোখে রোজ শত কথা বলা হয়ে যায় সবার নজর এড়িয়ে। রুমি জানে তিতলির মনে হিমেলের স্মৃতি আস্তে আস্তে মলিন হয়ে যাচ্ছে, একবছর আগে যখন হিমেলের সাথে ডিভোর্স হয়, তিতলির বয়স তখনো দুই বছরও হয়নি। ডিভোর্সের পর নিয়মিত তিতলির জন্য পাঁচ হাজার টাকা পাঠালেও হিমেল দেখা করতে এসেছে হাতে গোণা কয়েকদিন। শুরুতে তিতলি বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেও, আজকাল চর হিমেলের কথা জানতে চায় না, যপন তিতলির জীবনে কোন বাবার অস্তিত্ব নেই। রুমির তাই বিশ্বাস আছে হাসানের সাথে তিতলির বন্ডিং হতে সমস্যা হবে না। রুমির এই হাসিখুশি পরিবর্তন মা সাহেদা বেগমেরও নজর এড়ায় না, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারেন না। রুমি নিজ থেকে না জানালে এসব নিয়ে কথা কিভাবে বলবেন, তাছাড়া মাথায় এখন ছোট মেয়ের বিয়ের চাপ। তবে মনে মনে দোয়া করেন, ভালো একজন মানুষের সাথে যেন আসলেও এগিয়ে যেতে পারে রুমি, মেয়ে আর নাতনির জীবনটা গুছানো দেখতে চান তিনি।

******

“রুমি কী সুন্দর লাগছে আপনাকে। আমি আসলে কাটখোট্টা মানুষ না হলে আরও সুন্দর করে বলতে পারতাম।”

“রাকিন ভাই, আপনি যথেষ্ট সুন্দর করে বলেছেন। এরচেয়ে বেশি বললে মনে হতো ফ্লার্ট করছেন।”

মিষ্টি করে হাসে রুমি, রাকিনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, এই মেয়ের মাঝে কী জাদু আছে। কী যে ভালো লাগে। ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, পরিশ্রমী, গুণী রুমির প্রতি এই গোপন আকর্ষণ রাকিন গোপনেই রাখে। সতর্ক থাকে যেন রুমির সামনে নিজেকে প্রকাশ না করে ফেলে। রাকিনকে দেখতে চুপচাপ, গুরুগম্ভীর আর নিজের জগতে ব্যস্ত একজন মানুষ মনে হলেও তার পর্যবেক্ষণ শক্তি যথেষ্ট প্রখর। রাকিন বুঝতে পারে রুমির পরিবর্তন তাকে ঘিরে নয়, বরং হাসানকে ঘিরে। হাসান হাসিখুশি, সদালাপী, বুদ্ধিমান, মেয়েরা যেমনটা পছন্দ করে। নিজেকে আড়াল করে রাখা, আড্ডায় নিষ্প্রভ থাকা রাকিনের মতো মানুষগুলোর মন যতই ভালো হোক না কেন, তাদের নিয়ে স্বপ্ন খুব কম মেয়েই দেখে। প্রেমের সময় মেয়েদের পছন্দ বল্গাহরিণের মতো লাগামহীন পুরুষ, আর বিয়ের পর চায় শান্ত পুকুরের মতো মন নিয়ে সেই হরিণটা সংসার করবে। কিন্তু হরিণ কী চাইলেই পুকুর হয়! মন বান্ধা সহজ নয় বলেই তো গান হয়েছে, “আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে….”

“রাকিন ভাই, কোথায় হারিয়ে গেলেন?”

“না, মানে এমনি একটা কথা ভাবছিলাম।” আসলেও কোন খেয়ালে হারিয়ে গিয়েছে রাকিন।

“তাহলে আসছেন তো?”

“কোথায় আসব?”

“এই না দাওয়াত দিলাম! আমার ছোট বোনের বিয়ে।”

“ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ। স্যরি স্যরি আমার আসলে মনটা এলোমেলো। স্যরি।”

“আরে সমস্যা নেই। আচ্ছা আসি ভাইয়া।”

ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই হাসানকে দেখতে পায় রুমি। সাধারণত সালোয়ার কামিজই পরে আসে, আজ শখ করে শাড়ি পরেছে। হাসানের চোখে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখার সূক্ষ্ম ইচ্ছে কাজ করে।

“রুমি, টিপ পরা হারাম। মুসলমান মেয়েদের টিপ লাগানো ঠিক না।”

হাসানের কথায় একটু ধাক্কাই খায় রুমি। আইলাইনার দিয়ে টিপ দিয়েছিল। সবসময় দেয় না, মাঝেমাঝে একটু শখ হয়। হঠাৎ এমন কথায় বিব্রত হয়ে যায়, কী করবে বুঝতে না পেরে ওয়েট টিস্যু দিয়ে ঘষে টিপটা মুছে ফেলে রুমি।

“টিপ তোমার পছন্দ বলেছিলে একদিন। পহেলা বৈশাখে আমি টিপ দিয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে সুন্দর লাগছে।”

“বলেছিলাম তো, আর সুন্দর তো আজও লাগছে। তবে যা ঠিক না তা বাদ দেওয়াই ভালো। অনেকের নজরেও আসে। দেখ না রাকিন ভাই কিভাবে দেখছিল।” রুমি আর কথা বাড়ায় না, কাজে মন দেয়।

******
“রুমি, কাকে কাকে বোনের বিয়েতে দাওয়াত দিলে?”

“রৌশন আপা, ফাইনাল ইয়ারের সব কলিগদের বলেছি। আসবেন আপা, খুশি হবো।”

“প্রেমের বিয়ে?”

“নাহ্ আপা, পারিবারিক বিয়ে। ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে।”

“তোমার কথা জানে ছেলের পরিবার?”

“কী কথা?”

“না মানে এই যে তুমি বাবার বাড়িতে আছ মেয়ে নিয়ে। নাকি বিয়ের পর জানাবে ঠিক করেছ তোমরা?”

রুমি শক্ত হয়ে যায়। রৌশন আপা সুযোগ পেলেই আঘাত করে কথা বলতে পছন্দ করেন। এত নিচু স্বরে হেসে হেসে বুকে শেল বিঁধানো কথা একজন মানুষ কিভাবে বলতে পারে!

“বাবার বাড়িতে থাকা কী কোন অপরাধ আপা? এটা লুকানোরই কী হলো যে আগে পড়ে বলবে? আপনি জান না বাবার বাড়ি? থাকেন না?”

“রাকিন, আমি যাই বেড়াতে, মেহমান হয়ে। রুমির কথা আলাদা।”

“আলাদা কেন আপা? বিয়ের পর বাবার বাড়ি বেড়াতে যান, হয়তো ওনারা আপনাকে মেহমান ভাবে বলে। রুমির মা বাবা মেয়েকে সন্তানই ভাবেন হয়তো, মেহমান না।”

“রাকিন, তুমি দুই মহিলার কথার মাঝখানে নাক ঢুকাচ্ছ কেন? এমনি তো বোমা মারলেও মুখ দিয়ে কথা বের করো না। এখন এত খই ফুটছে? ভালোই রুমি কলেজের পুরুষদের সবাইকে তাহলে নিজের বন্ধু বানিয়েছে, ডিপার্টমেন্টের হেড থেকে জুনিয়র, সবাই রুমি আপা বলতে অজ্ঞান। শুধু মহিলারাই রুমির শত্রু।”

রাকিন উঠে চলে যায়। কনফারেন্সের রুমের বাকিরাও রৌশন আপার উপর বিরক্ত হয়। কোথা থেকে কথা কোথায় গেল। রুমিও নিজেদের ডিপার্টমেন্টের রুমে চলে আসে। পিছুপিছু হাসানও আসে।

“রুমি, মন খারাপ করো না, রৌশন আপাতো জানোই এমন। রাকিন ভাইয়েরও ওনাকে খোঁচানো কী দরকার ছিল। অযথা পাগল খেপানো।”

“আর তোমার কী করা দরকার ছিল? তুমি কেন কখনো কারও সামনে আমার পক্ষ নাও না? আমি ঠিক তোমাকে, আমাদের সম্পর্ককে বুঝতে পারছি ন। এই মনে হয় তুমি অধিকার দেখাচ্ছ, এই মনে হয় তুমি আমি নদীর দুই পাড় যেন, পাশাপাশি আছি, কিন্তু সাথে নয়।”

“কিসব কাব্য করে বলছো। আমি আনন্দপ্রিয় মানুষ। তোমাকে পছন্দ করি, এটা তো অজানা না তোমার। কিন্তু কলেজে সবার সামনে তোমার প্রতি দুর্বলতা দেখালে আমাদের দু’জনের জন্য কাজ করা মুশকিল হবে, আমরা গসিপের বস্তু হবো। এই বন্ধুত্বই তো ভালো।”

“তুমি বন্ধন চাও না?”

“আপাততঃ না। প্লিজ রৌশন আপার জন্য নিজেরা ঝগড়া না করি প্লিজ। আর তোমার ব্যাগে কাজল আছে?”

“কাজল! কেন?”

“আবার টিপ এঁকে নাও। শাড়িতে টিপ ছাড়া তোমাকে কেমন মলিন লাগছে।” মিষ্টি করে হাসে হাসান। কিন্তু প্রতিবারের মতো এইবার এই হাসির তরঙ্গ যেন রুমির মনে দোলা দিয়ে যায় না। আরেকবার কী মানুষ যাচাইয়ে ভুল হচ্ছে!

(যারা আমার লেখা পছন্দ করেন, তারা অর্ডার করতে পারেন আমার লেখা উপন্যাস “হৃদয়ে তার পায়ের ছাপ” আশা করি ভালো লাগবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here