#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব২১
মরিয়ম ছুটি নিয়ে নিয়েছে, এখনো ডেলিভারির প্রায় সাড়ে তিনমাস বাকি, কিন্তু মরিয়ম ম্যাটার্নিটি লিভে চলে গিয়েছে। কলেজের সবাই জানে মরিয়মের দ্বিতীয় বাচ্চাটা প্রায় বারো বছর পর হচ্ছে, বয়সও বেশি, এসময় প্রেগন্যান্সি রিস্ক থাকে বেশ, তাই ছুটি পেতে সমস্যা হয়নি। যদিও ডিপার্টমেন্ট বেশ ঝামেলায় পড়েছে হঠাৎ একজন শিক্ষক ছুটিতে যাওয়ায়, কিন্তু মরিয়মের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ছুটি মঞ্জুর হয়েছে।
এখন তো ম্যানেজ হয়েছে কিন্তু ছয়মাস পর কী করবে মরিয়ম জানে না। অসুস্থতার জন্য যতটা না,তারচেয়ে বেশি সাংসারিক কারণে ওকে ছুটি নিতে হয়েছে। রুমনকে ঘিরে শাশুড়ি মায়ের সাথে সম্পর্কটা বেশ শীতল হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক কথাবার্তা, ঘর সংসার সবই হচ্ছে, কিন্তু কোথাও যেন সেই আন্তরিকতাটা নাই হয়ে গিয়েছে। মরিয়ম বরাবরই চাপা স্বভাবের, বোন নেই, ভাই বয়সে বেশ ছোট তারউপর প্রেমের বিয়ে তাই পারিবারিক টানাপোড়েনের কথা নিজের মা বাবার সাথে শেয়ার করে না। মনে হয় শেয়ার করলে যদি শুনতে হয় নিজেই পছন্দ করেছ, এখন ভুগো!
যেন পারিবারিক বিয়েতে কোন সমস্যা হয় না, সমস্যা শুধু নিজে পছন্দ করে করলে হয়! জীবনের তাগিদে বন্ধু বান্ধবেরা সবাই আলাদা হয়ে গিয়েছে, ফেসবুকে যোগাযোগ থাকলেও সবার সাথে একধরনের মানসিক দূরত্ব হয়ে গিয়েছে। একমাত্র রুমির সাথে একটা নির্মল সম্পর্ক ছিল, অসম বয়সের বন্ধুত্ব আর ভরসার জায়গা। কিন্তু কয়েকমাস আগের সেই রাতের পর থেকে রুমি কেমন জানি অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। মরিয়মের খুব ইচ্ছে করে আগের মতো রুমির সাথে মন খুলে কথা বলতে, কিন্তু রুমি দূরে দূরে থাকায় তা সম্ভব হয় না।
এই দমবন্ধ অবস্থায় জীবনের একমাত্র খোলা আকাশ আর শীতল বাতাস হয়ে আছে শিহাব। শিহাব যদি মরিয়মের হাত ধরে না থাকতো, তাহলে এতটা শক্তি নিয়ে পথ চলার সাহস মরিয়ম পেতো না। ইদানীং সকালে উঠলে বেশ খানিকটা সময় ধরে মরিয়মের শরীর খারাপ লাগে। মর্নিং সিকনেসটা অনেক কষ্ট দেয়। সে সময়টা শিহাব বাসায় থাকে, রুমনকে সকালের নাস্তাটা দেয়, স্কুলের জন্য রেডি করে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় স্কুল খুলেছে, শিহাব রুমনকে স্কুলে নিয়ে যায়। থেরাপিতেও রুমন এখন নিয়মিত যাচ্ছে। রুমন আবার অনেকটা সুস্থির। ডাক্তার স্পষ্টভাবেই বলেছেন আচরণগত সামাজিক মেলামেশার সমস্যা আর হঠাৎ রেগে যাওয়া ছাড়া রুমনের অটিজমের অন্য সমস্যা নেই। পড়াশোনায় সে বেশ ভালো, ছবি আঁকায় অসাধারণ, আর দশটা বাচ্চার চেয়ে সে কোন অংশে কম নয়। রুমনের যেটুকু সমস্যা আছে তা সাথে নিয়েই সে বহুদূর এগিয়ে যেতে পারবে। শুধু প্রয়োজন মনোযোগ আর নার্সিং এর, আশেপাশের মানুষদেরও রুমনের অনুভূতিকে সম্মান দিতে হবে। এই যে রুমন হঠাৎ কারো স্পর্শ করাটা পছন্দ করে না, মিথ্যা বলতে পারে না, মিথ্যে কথা নিতেও পারে না, নিজেকে আড়াল করে হাসিখুশির অভিনয় করতে জানে না, এই জিনিসগুলো আশেপাশের দ্বৈত চরিত্রধারী মানুষদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে রুমন জীবনে চলতে পথের জন্য দরকার যে অভিনয় করা, তা শিখতে পারেনি, পারবেও না। ও নির্মল সত্যের মূর্তি, আর তাকে সেভাবেই মেনে নিতে হবে।
মরিয়ম রুমনকে সাথে নিয়ে একটা ওয়েব সিরিজ দেখে, “দ্য গুড ডক্টর” সিরিজটা রুমন আর মরিয়মের ভীষণ প্রিয়, সেখানে অটিজমে আক্রান্ত একজন ডাক্তারের চরিত্র আছে, ডাক্তার শন। শনের দক্ষতা আর অদম্য মেধা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র অটিজমে থাকায় পদে পদে শনকে যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। ডাক্তার হওয়ার পথটা শনের জন্য সহজ ছিল না, ছোটবেলায় শনের ভাই ছাড়া পরিবারের কেউ ওকে বুঝতে পারত না। শনের মানুষের সাথে মিশতে না পারা, কেউ স্পর্শ করলে প্রতিক্রিয়া দেখানো, স্কুলে খেলাধুলায় অংশ না নেওয়া এই সবকিছুই ওর বাবার কাছে বিরক্তিকর লাগতো, জোর করে এসব করানোর চেষ্টা করতো, যার ফলে বাবার সাথে ওর বিশাল দূরত্ব হয়েছিল, এর মাঝে সবচেয়ে কাছের মানুষ ছোটভাইয়ের মৃত্যু শনকে মানসিক ভাবে ভেঙে দেয়। সে সময় ভঙ্গুর শনের জীবনে এঞ্জেল হয়ে আসেন একজন প্রফেসর, যিনি শনের গডফাদার হয়ে যান, যার সাহায্যে শন মেডিকেল প্রফেশনে আসে।
মরিয়ম ভাবে দিন কী বদল হয়েছে! হয়নি। অটিজম নিয়ে এখনো অনেক পরিবারের অনেক অজ্ঞতা আছে। এখনো মানুষ এই বাচ্চাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে তারজন্য পথটা কঠিন করতে ব্যস্ত হয়। অথচ একটু সাপোর্ট পেলে এরা তাদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে সক্ষম। মরিয়ম আর শিহাব সেই চেষ্টাই করছে, রুমনের চলার পথটা তারা মসৃণ করবেন, তারজন্য সবার সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত, আজ যারা রুমনকে মরিয়মের দুর্বলতা ভাবছে কাল তারাই তা শক্তিরূপে দেখবে। মরিয়ম জানে না রুমন একজন গডফাদারের দেখা পাবে কিনা, কিন্তু তার বাবা মাকে সবসময় পাশেই পাবে।
“আম্মু”
“হ্যাঁ বাবা?”
“এটা তুমি”
রুমন হাতের ছবিটা মেলে ধরে, আপন ভাবনায় মরিয়ম এতটা আচ্ছন্ন হয়েছিল যে রুমন কী আঁকছে খেয়াল করা হয়নি। রুমনের মেলা ধরা ড্রয়িং বুকে শোভা পাচ্ছে একজন মা, যারা চারপাশটা কাঁটাগাছে ভরপুর, মাথায় ফুলের মুকুট নিয়ে মা স্ফীত গর্ভ দুই হাত দিয়ে আগলে রেখেছেন, গর্ভের ভেতর নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে একটা ছোট মানব শিশু।
রুমনের কল্পনা শক্তি দেখে মরিয়ম হতবাক হয়ে যায়, মনের অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ে দুচোখ বেয়ে। রুমনকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, রুমন আড়ষ্ট হয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু মায়ের ভালোবাসা যে অনুভব করছে, সেটা বোঝে মরিয়ম। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে, এই অসময়ে কে আসল ভেবে, চোখ মুখ মুছে দরজা খুলতে যায় মরিয়ম।
“আসসালামু আলাইকুম আপু।”
“রুমি!”
একগাদা ফলমূল হাতে দরজায় রুমিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।